তাদের বুকের ভেতর ছোট দুর্বল ফুসফুসকে জুড়ে দেয়া হয় স্বয়ংক্রিয় ফুসফুসের সাথে। পৃথিবীর দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধ করে সেই ফুসফুস রক্তের সাথে বিশুদ্ধ অক্সিজেন মিশিয়ে দেয়। কৃত্রিম যান্ত্রিক হৃৎপিণ্ড সেই রক্ত মস্তিষ্ক এবং প্রজনন যন্ত্রে পাঠাতে থাকে। সেকেন্দ্রে দশবার করে হৃৎপিণ্ড বুকের মাঝে ধুকপুক করতে থাকে। হৃৎপিন্ডের যান্ত্রিক দেয়ালে অসংখ্য সংবেদনশীল ইলেকট্রনিক সেন্সর প্রতি মুহূর্তে শরীরের পরিবর্তন মনিটর করতে থাকে। রক্ত পরিশোধন করা হয় যন্ত্র দিয়ে, শরীরের বাইরে। অব্যবহৃত কিডনি, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় সরিয়ে ফেলা হয় জনামুহূর্তে, শরীরের আকার হয় ক্ষুদ্র, বিশাল বায়োবটের দেহের মাঝে জুড়ে দেয়া হয় সেই ক্ষুদ্র অপুষ্ট বিকৃত দেহ।
বায়োবটের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই। পরিপাকযন্ত্রের জায়গা শরীরের নানা অংশে টিউব দিয়ে আসতে থাকে পুষ্টিকর তরল। পরিপাকযন্ত্র নেই বলে মলমূত্র নেই। মানুষকে এরা প্রথমবার মুক্ত করেছে দৈনন্দিন জৈবিক প্রক্রিয়া থেকে, যদিও সেই ভয়াবহ প্রাণীটিকে সম্ভবত মানুষ আখ্যা দেয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ আর নেই।
জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে মস্তিষ্ককে বিকশিত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বেশি, নিউরনের সংখ্যা বেশি বলে তাদের স্মরণশক্তি অচিন্তনীয়। দৈহিক প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করা হয়েছে মস্তিষ্ককে, দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই মস্তিষ্ককে। দীর্ঘায়ু হয়েছে এই বায়োবট সম্প্রদায়।
বংশবৃদ্ধির জন্যে অবিকৃত রাখা হয়েছে প্রজননকে। যদিও সন্তানকে আর মায়ের গর্তে বড় হতে হয় না। চূণকে বের করে আনা হয় জরায়ু থেকে, কৃত্রিম যন্ত্রে বড় হয় দৃণ। প্রসববেদনার ভিতর দিয়ে যেতে হয় না কোনো বায়োবট রমণীকে, যন্ত্র খুলে বের করে আনা হয় সেই ভ্রূণ।
বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে এই বায়োবট শ্রেণীকে নিয়ে। পৃথিবীর অর্থনীতি এই বায়োবট শিল্পকে ঘিরে। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণে এই বায়োবট শ্রেণী।
মানুষের ছোট একটি দল বায়োবট হতে রাজি হল না। যন্ত্রের খাচায় অতিকায় মস্তিষ্ক এবং প্রজননযন্ত্রকে জুড়ে দিয়ে যান্ত্রিক সাবলীলতায় বাধা পড়ে যাওয়াকে তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ মনে করল। সেই অল্পসংখ্যক মানুষকে বায়োবট শ্রেণী উপেক্ষা করে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো একটি কারণে হঠাৎ করে বায়োবট শ্রেণী সিদ্ধান্ত নিল পৃথিবীতে সত্যিকার মানুষ কেউ থাকতে পারবে না। সবাইকে বায়োবট হয়ে যেতে হবে। মানুষের সাথে তখন বয়োবটের সংঘর্ষের সূত্রপাত। সেই ঘটনা ঘটেছে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর পর।
বায়োবটরা তখন প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী, সমস্ত পৃথিবী মোটামুটিভাবে তাদের হাতের মুঠোয়। মানুষের জন্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এল হঠাৎ। খুব ধীরে ধীরে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বায়োবটদের বিরুদ্ধে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। কিন্তু সামনে রয়েছে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কে জয়ী হবে এখনো কেউ জানে না।
রুকাসকে এই সময় আমি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন বলছ কেউ জানে না? তুমি তো সময়ের উল্টোদিকে অতীতে চলে এসেছ, তেমনি ভবিষ্যতে চলে গিয়ে দেখে এস।
রুকাস একটু হেসে বলল, সময় পরিভ্রমণের একটা সুত্র আছে। অনিশ্চয়তার সূত্রের মতো। তুমি শুধুমাত্র সেই সময়েই যেতে পারবে, যেই সময়ের ঘটনাবলীর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।
মানে?
মনে কর তুমি সময়ে পরিভ্রমণ করে দশ বছর অতীতে গেলে। সেখ দেখতে পেলে তোমাকে, ছোট শিশু। তাকে যদি তুমি হত্যা কর তাহলে তুমি কেমন করে আসবে? কাজেই সময় পরিভ্রমণের সূত্র বলে তুমি দশ বছর অতীতে যেতে পারবে না। তুমি দুই হাজার বছর অতীতে যেতে পারবে। কারণ সেখানে তুমি তোমার পূর্বপুরুষকে সম্ভবত খুঁজে পাবে না। তার সম্ভাবনা খুব কম। প্রকৃতির সূত্র সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে। যে জিনিসটির সম্ভাবনা কম সেটি সূত্রকে লঙঘন করে না।
কিন্তু সত্যি যদি পেয়ে যাই?
পেয়ে গেলেও তুমি তাকে মারতে পারবে না।
মা আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, জ্ঞানের কচকচিটা একটু বন্ধ কর দেখি, আমি আগে ইতিহাসটা শুনি।
যেটা এখনো হয় নি, ভবিষ্যতে হবে, সেটা ইতিহাস হয় কেমন করে?
চুপ কর তুই।
একটু হেসে রুকাস আবার শুরু করল।
রুকাসের বয়স যখন ছয়, তখন বিশাল এক বায়োবট বাহিনী হামলা চালিয়েছিল তাদের এলাকায় অনেকটা ট্রনেদের হামলার মতো। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছিল সত্যি, কিন্তু হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল এক জন মানুষকে খুঁজে বের করা। সেই মানুষটা হচ্ছে রুকাস। কেন এই ছয় বছরের শিশুটির জন্যে বায়োবটেরা এত ব্যস্ত হয়েছিল, সেটি তখনো কেউ জানত না। বায়োবটদের সেই ভয়ংকর হামলা থেকে রুকাস খুব অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল। তার বাবা-মা ভাই-বোন কেউ রক্ষা পায় নি।
এই ঘটনার পরও অসংখ্যবার রুকাসকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে, কখনো সফল হয় নি। অসংখ্য মানুষের মাঝে কেন রুকাসকে নিয়ে যেতে তারা এত মরণপণ করে চেষ্টা করেছে সেটা কেউ জানত না, কিন্তু যেহেতু রুকাসকে নিতে চাইছে, মানুষেরা বুঝে গেল এর মাঝে কোনো একটা রহস্য আছে। রুকাসকে অক্ষত অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ যুদ্ধে কে জয়ী হবে।
আমি রুকাসকে আবার বাধা দিলাম, কিন্তু সেটা কেমন করে হয়? তুমি তো বললে কাছাকাছি ভবিষ্যতের কিছু কেউ জানতে পারবে না।