ভিড় ঠেলে ইলিও এগিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বলল, রুকাস, তুমি কেমন করে সবকিছু ধ্বংস করে দিলে, কী ছিল তোমার হাতে?
আমি বললাম, আমি বলব?
বল।
আমি রুকাসের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, তুমি ভবিষ্যতের মানুষ। তুমি দুই হাজার থেকেও বেশি ভবিষাৎ থেকে এসেছ। তাই না?
রুকাস আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
তাই তোমার আছে ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র। যেটা দিয়ে তুমি ধ্বংস করে দিয়েছ সবকিছু।
কিরীণা বিস্ফারিত চোখে রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, সেজন্যে ইলির যন্ত্রে তোমার বয়স এসেছে নেগেটিভ দুই হাজার তিন শ’ নয়। কারণ তুমি সময়ের উল্টোদিকে এসেছ। রুকাস আবার মাথা নাড়ল।
তুমি কেন এসেছ রুকাস, আমাদের কাছে? রুকাস বিষণ্ণ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার উপর ভয়ানক বিপদ, তাই আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। লুকিয়ে আছি অজ্ঞাত সময়ে।
তুমি লুকিয়ে আছ?
হ্যাঁ। আমি লুকিয়ে ছিলাম। এখন আর লুকিয়ে নেই। এখন জানাজানি হয়ে গেল। এখন তারা জেনে যাবে।
কারা?
যারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের নাম বায়োবট। সব জায়গায় তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজছে আমাকে।
০৫. বায়োবট
আমার মা রুকাসের কনুইয়ে একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। এক জন মানুষ যে নিজের শরীরের ভেতরে করে এরকম ভয়ঙ্কর একটি অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে সেটি কে জানত। ব্যান্ডেজটি লাগাতে লাগাতে বললেন, তোমার শরীরের ভেতরে কি আর কিছু রয়েছে?
না। আর কিছুর প্রয়োজনও নেই।
কেন?
কাস টেবিলের উপর রাখা ছোট ধাতব অস্ত্রটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, এই অস্ত্রটি শুধু আমিই ব্যবহার করতে পারব, পৃথিবীর আর কেউ এটা ব্যবহার করতে পারবে না। এটা শুধু অস্ত্র নয়, এটা আমার যোগাযোগের যন্ত্র। এটা দিয়ে আমি আমার মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারব।
তোমার কোন মানুষ? আমি যে সময় থেকে এসেছি, সেই সময়ের মানুষ। তুমি যোগাযোগ করেছ?
এখনো করি নি। অস্ত্রটা যখন ব্যবহার করেছি তখন অবশ্যি নিজে থেকে যোগাযোগ হয়ে গেছে। আমার যারা বন্ধু তাদের সাথে, যারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের সাথেও
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?
রুকাস হাতের ব্যান্ডেজটা একবার হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল, সেটা অনেক বড় একটা গল্প।
বলবে আমাদের সেই গল্প?
শুনতে চাও? ভালো লাগবে না শুনে।
তবু শুনব।
রুকাস যে গল্পটি বলল, সেটি খুব বিচিত্র। কেন জানি না আমার ধারণা ছিল যত দিন যাবে, মানব সভ্যতার তত উন্নতি হবে। কিন্তু মানব সভ্যতার যে সময়ের সাথে সাথে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে, সেটি আমার ধারণার বাইরে ছিল।
ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল একটা দুর্ঘটনার মাঝে দিয়ে। একটি শিশু একটা খারাপ দুর্ঘটনায় দুই হাত-পা-ই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসাসংক্রান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং তখন বেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে, কাজেই শিশুটিকে কৃত্রিম হাত এবং পা লাগিয়ে দেয়া হল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তার হাত এবং পা সাধারণ মানুষের হাত এবং পায়ের থেকে অনেক বেশি কার্যকর, অনেক বেশি শক্তিশালী।
ব্যাপারটির শুরু এভাবেক্ষুদ্র বিন্দুর মতো আকারের শক্তিশালী কম্পিউটার আবিস্কৃত হয়েছে, কৃত্রিম হাত এবং পায়ের মাঝে অসংখ্য কম্পিউটার জটিল কাজকর্ম করতে পারে। সাধারণ মানুষ তার হাত দিয়ে যে কাজ করতে পারে না, কৃত্রিম হাতের মানুষ তার থেকে অনেক নিখুত কাজ করতে পারে। ” তখন জটিল কাজকর্ম করার জন্যে কিছু মানুষ ইচ্ছে করে নিজের হাত কেটে সেখানে যান্ত্রিক হাত লাগিয়ে নেয়া শুরু করল। প্রথম প্রথম সেটা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছিল সত্যি, কিন্তু কিছুদিনেই সাধারণ মানুষজন ব্যাপারটিকে বেশ সহজভাবেই গ্রহণ করা শুরু করে দিল।
কৃত্রিম হাত-পা তৈরির কলকারখানাগুলো তখন সাধারণ মানুষজনকে তাদের সত্যিকার হাত-পা পাল্টে অনেক ক্ষমতাশালী যান্ত্রিক হাত-পা ব্যবহার করার জন্যে উৎসাহিত করতে শুরু করে দিল। কিছুদিনের মাঝেই দেখা গেল বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের কথা শুনে কৃত্রিম হাত-পা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তারা সাধারণ মানুষ থেকে বেশি কার্যক্ষম, এধরনের একটা কথা নানা জায়গায় শোনা যেতে লাগল। কৃত্রিম হাত-পা তৈরির কলকারখানা তখন বিশাল আকার নিয়েছে, তারা একসময় ব্যাপারটিকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করতে শুরু করে। ছোট শিশুর জন্ম নেয়ার সাথে সাথে তার স্বাভাবিক হাত-পা কেটে সেখানে যান্ত্রিক হাত-পা লাগিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা খুব ধীরে ধীরে মানুষজনের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। জৈবিক বা বায়োলজিক্যাল মানুষ এবং তাদের রবোটের মতো হাত-পা, দুই মিলে তাদের বায়োলজিক্যাল রবোট বা সংক্ষেপে বায়োবট বলা শুরু করা হল।
এর পরের কয়েক শতাব্দী মূলতঃ বায়োবটগোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষদের মাঝে একটা প্রতিযোগিতায় কেটে গেল। পৃথিবীর মূল অর্থনীতি রবোটিক শিল্পভিত্তিক। এই শিল্প গুলো নানাভাবে পৃথিবীর মাঝে করতে শুরু করায় বায়োবটদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল।
নানা ধরনের গবেষণা শুরু হল তখন। মায়েরা সন্তানদের পেটে ধরামাত্রই তাদের নানারকম ঔষধপত্র খাওয়ানো শুরু করিয়ে দেয়া হত, যে কারণে শিশুরা জন্ম নিল বিকলাঙ্গ অবস্থায়। তাদের বায়োবট তৈরি না করে কোনো উপায় ছিল না। খুব ধীরে ধীরে বায়োবটের মাঝে মস্তিষ্ক এবং প্রজননের অঙ্গ ছাড়া প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কৃত্রিম কোনো যন্ত্র দিয়ে পাল্টে দেয়া হল। মানুষের চিন্তা এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার সাথে যন্ত্রের নিখুত কাজ করার ক্ষমতা যোগ করে এক ধরনের বিচিত্র প্রাণীর সৃষ্টি হল তখন। তাদের সংবেদনশীল ফটো সেলের চোখ আলট্রা ভায়োলেট থেকে শুরু করে ইনফ্রায়েড পর্যন্ত দেখতে পায়। চোখ ইচ্ছেমতো অণুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ ক্ষমতায় পারদর্শী হতে পারে। তাদের ইলেকট্রনিক শ্রবণযন্ত্র কয়েক হার্টজ থেকে মেগা হার্টজ পর্যন্ত শুনতে পারে। তাদের ঘ্রাণশক্তি শ্বাপদের ঘ্রাণশক্তিকে হার মানিয়ে দিতে থাকে।