ট্রন ভাষায় কী একটা বলল রুকাসকে। রুকাস মাথা নেড়ে বলল, ছেড়ে দাও সবাইকে। কাউকে নিতে পারবে না। কাউকে নিতে পারবে না।
ট্রন মেয়েটির মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে ওঠে, খানিকটা অবজ্ঞা, খানিকটা অবিশ্বাস, খানিকটা অন্ধ ক্রোধ। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে গুলি করল রুকাসকে। ছোট শিশুরা নোংরা হাতে বড়দের ছোঁয়ার সময় বড়রা আলগোছে সরে গিয়ে যেভাবে নিজেকে রক্ষা করে, অনেকটা সেভাবে রুকাস সরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করল, বলল, ছেড়ে দাও সবাইকে।
ট্রন মেয়েটি অবাক হয়ে একবার রুকাসকে, আরেকবার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির দিকে তাকাতে লাগল। কোনো মানুষ এই অস্ত্রটি থেকে এত সহজে নিজেকে রক্ষা করতে পারে সেটি এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মেয়েটি আবার অস্ত্রটি তুলে ধরে—রুকাস তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আমাদের দিকে ঘুরে তাকায়, অনেকটা ব্যথাতুর গলায় বলে, ওরা আমার কথা শুনছে না।
আমি চিৎকার করে বললাম, সাবধান।
ট্রন মেয়েটি গুলি করল এবং আবার রুকাস সরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করল। মেয়েটিকে বলল, তুমি আমাকে মারতে পারবে না। আর চেষ্টা কোরো না। ঠিক আছে?
মেয়েটা অবাক হয়ে ককাসের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাই বিস্ময়ের সাথে সাথে হঠাৎ আতঙ্কের একটা চিহ্ন পড়ছে তার মুখে।
রুকাস কিছুক্ষণ চারদিকে তাকাল। তারপর অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়ার মতো করে মাথা নাড়ল। চারদিক থেকে ট্রনেরা ছুটে আসছে রুকাসের দিকে, সবাই বুঝতে পেরেছে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে এখানে।
এরপর রুকাস যেটি করল আমরা কেউ তার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। সে নিজের হাতটা মুখের কাছে তুলে কনুইয়ের কাছে কামড়ে ধরে খানিকটা অংশ ছিঁড়ে নিল, একঝলক রক্ত বের হয়ে তার মুখ, দাঁত, বুকের কাপড় রক্তাক্ত হয়ে গেল মুহূর্তে। রুকাস ভূক্ষেপ করল না, রক্তাক্ত অংশটি স্পর্শ করে চামড়ার নিচে থেকে চকচকে ছোট একটা জিনিস বের করে আনল। রুকাস তার শরীরে এই জিনিসটি লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন।
জিনিসটি কী আমরা জানি না। এটা দিয়ে কী করা হয় তা আমরা জানি না। রুকাস সেই ছোট ধাতব জিনিসটা হাতে নিয়ে মহাকাশযানের মতো দেখতে বিশাল প্লেনটির দিকে লক্ষ করে কোথায় যেন টিপে দেয়, সাথে সাথে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো মহাকাশযানটি চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে গেল। জ্বলন্ত আগুনের বিশাল একটা গোলক সবাইকে আগুনের হলকার স্পর্শ দিয়ে উপরে উঠে গেল।
আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ট্রনেরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রুকাস হাতের ছোট ধাতব জিনিসটা দ্বিতীয় মহাকাশযানের দিকে লক্ষ করে মুহূর্তে সেটিকে ধ্বংস করে দিল। তারপর তৃতীয়টি।
রুকাস এবারে ট্রনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল, সবাইকে এখানে ছেড়ে দিয়ে তোমরা যাও। এক্ষুনি যাও।
ট্রনেরা তার কথা বুঝতে পারল না সত্যি, কিন্তু সে কি বলতে চাইছে বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধে হল না। হঠাৎ করে প্রাণভয়ে সবাই ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে তারা পিছনে তাকায়, তারপর আবার ছুটতে থাকে। হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, উঠে গিয়ে আবার ছুটতে থাকে। এক জনের মাথার উপর দিয়ে আরেকজন ছুটতে থাকে। এক জনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আরেকজন ছুটতে থাকে। হাতের অস্ত্র ফেলে তারা ছুটতে থাকে। দেহরক্ষী রবোট, অনুসন্ধানকারী রবোটকে পিছনে ফেলে তারা ছুটতে থাকে।
ছাড়া পেয়ে কিশোর-কিশোরীরা বুঝতে পারছে না কী করবে। বিহ্বলের মতো ইতস্তত এদিকে সেদিকে তাকাতে থাকে তারা, কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসতে থাকে আমাদের দিকে।
কিরীণাকে দেখতে পাই আমি, কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে সে। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে বালুতে, কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটে আসছে। আমি ছুটে গিয়ে কিরীণাকে জড়িয়ে ধরলাম, বললাম, কিরীণা, বিল্পীণা, সোনা আমার–
কিরীণা কাঁদতে কাঁদতে বলল, বলেছিলাম না আমি বলেছিলাম না?
কি বলেছিলে?
রুকাস হচ্ছে ঈশ্বরের দূত। দেখলে, কী ভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে ট্রনেদের? আমাদের রক্ষা করতে এসেছে। বলেছিলাম না আমি।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। কিরীণাকে শক্ত করে ধরে রাখলাম, দেখলাম, ট্রনদের মহাকাশযানগুলো একটা একটা করে আকাশে উঠে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শুধু মানুষগুলো পালিয়ে গেছে, পিছনে ফেলে গেছে অসংখ্য রবোট। সেগুলো এসে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। তাদের কপোট্রনের ভেতর এখন নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্ব! বুদ্ধির বাইরে কিছু একটা সমস্যার মুখোমুখী হলে রবোটদের মতো অসহায় আর কিছু নয়।
কিরীণাকে ছেড়ে আমি এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। রুকাস স্থির হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, ডান হাতে সেই আশ্চর্য ধাতব জিনিসটি, যেটি এখনো আলগোছে ধরে রেখেছে। হাতের কনুইয়ের কাছে ক্ষতটি থেকে এখনো রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অসংখ্য মানুষ ভিড় করে এসেছে রুকাসের কাছে। মাথা নিচু করে এসে। বসছে তার কাছে।
আমি কিরীণার হাত ধরে মানুষের ভিড় ঠেলে রুকাসের কাছে যেতে চেষ্টা করি। আমাদের পথ ছেড়ে দিল অনেকে, সবাই জানে রুকাস আমার বাসার অতিখি।
কাছে গিয়ে আমি রুকাসের হাত স্পর্শ করে বললাম, রুকাস। রুকাস ঘুরে আমার দিকে তাকাল। বলল, কী কুনিল?
আমি কিছু বলার আগেই কিরীণা বলল, তুমি না থাকলে আজ আমার কী হত? কী হত রুকাস? বলতে বলতে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
রুকাস একটু অবাক হয়ে কিরীণার দিকে তাকিয়ে অনিশ্চিতভাবে তার মাথায় হাত রেখে বলল, কাঁদে না কিরীণা। কেউ কাঁদলে কী করতে হয় আমি জানি না।