আমি রুকাস।
সেটা তো জানি, কিন্তু তুমি আসলে কে?
আমি আসলে রুকাস।
তোমার কি ভাই আছে?
তুমি আমার ভাই।
তোমার কি সত্যিকার ভাই আছে? সত্যিকার বোন? মা-বাবা? আছে?
রুকাস চুপ করে থেকে অল্প একটু হাসে।
আমি আবার জিজ্ঞেস করি, তুমি আমাদের কাছে কেন এসেছ?
রুকাস কোনো উত্তর দেয় না। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আবার চলে যাবে?
রুকাসের মুখ তখন হঠাৎ করে বিষ হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি একদিন সে যেরকম হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করে চলে যাবে।
আমার কেমন জানি একটু মন-খারাপ হয়ে যায়।
কয়দিন থেকে চারদিকে একটা চাপা ভয়। খবর এসেছে মধ্য অঞ্চলে ট্রনেরা হানা দিয়েছে। এবারে শিশু নয়, অসংখ্য কিশোর-কিশোরীকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তারা যদি আবার আমাদের এখানে আসে? সাধারণত এক জায়গায় তারা এত অল্প সময়ের মাঝে দ্বিতীয় বার আসে না, কিন্তু এসব ব্যাপারে কেউ কি তার সত্যিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
ভেবেছিলাম আমাদের চাপা অশান্তি রুকাসকে স্পর্শ করবে, কিন্তু তাকে স্পর্শ করল না। আমরা যখন বিষণ্ণ গলায় ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতাম, ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম, রুকাস সেগুলি কৌতূহল নিয়ে শুনত, কিন্তু কখনোই কোনো প্রশ্ন করত না। মাঝে মাঝে রুকাসকে দেখে মনে হত সে বুঝি জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। যে ভয়ংকর বিপদ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে এবং ঘটনাক্রমে সে। নিজেও যে এই বিপদের অংশ হয়ে গেছে, ব্যাপারটি যেন সে কখনো অনুভব করতে পারে নি।
তাই দু সপ্তাহ পর যখন ভোররাতে আবার সেই ভয়াবহ শ ধ্বনির মতো সাইরেন বেজে উঠল, রুস্কাসকে এতটুকু বিচলিত হতে দেখা গেল না। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ওটা কিসের শব্দ?
ট্রনেরা আসছে।
ও।
রুকাস বিছানা থেকে ওঠার কোনো রকম লক্ষণ দেখাল না। বিছানায় আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আমি তাকে ডাকলাম, রুকাস।
কি?
এখন আমাদের সবাইকে সমুদ্রতীরে যেতে হবে।
ও রুকাস কোনো আপত্তি না করে বিছানা থেকে ওঠে, আমাকে বলল, চল যাই।
আমার মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুকাসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার মুখে ভয় বা আতঙ্কের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই, ব্যাপারটি আমার মা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন। আমাকে ফিসফিস করে বললেন, দেখেছিস কুনিল? দেখেছিস? একটুও ভয় নেই
মুখে।
দেখেছি মা। কেন ভয় নেই?
কেন?
ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। ছোট বাচ্চারা দেখ নি আগুনকে ধরতে যায়? সেরকম।
না না। মা মাথা নাড়লেন, রুকাস কিছু-একটা জানে, যেটা আমরা জানি না।
আমি রুকাসের দিকে তাকালাম, তার শান্তপ্রায় নির্লিপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল ককাস সত্যিই কিছু একটা ‘জানে, যেটা আমরা জানি না। সেই অজ্ঞাত জ্ঞানটুকু যখন আমরা জানব, তখন আমাদেরও কোনো ভয়ভীতি থাকবে না। রুকাসের মতো শান্তমুখে সমুদ্রতীরে বালুবেলায় ঠুনদের জন্যে অপেক্ষা করতে পারব।
ট্রনদের আক্রমণটুকু হল বড় নৃশংস। বড় বড় ছয়টি মহাকাশযানের মতো দেখতে একধরনের প্লেন নামল বালুবেলায়। ভেতর থেকে ছোট ছোট একধরনের রবোট নেমে এল প্রথমে ছুটে গিয়ে সবাইকে ঘিরে ফেলল প্রথমে। ট্রনেরা নামল তারপর। গতবারের মতো হাসিখুশি নয়, চেহারায় ক্লান্তি এবং একধরনের বিতৃষ্ণা। দেহরক্ষী রবোটদের নিয়ে আমাদের কাছে হেঁটে আসতে থাকে ট্রন পুরুষ এবং মহিলারা। বারো থেকে পনেরো বছরের কিশোর-কিশোরীদের দেখিয়ে দিতে থাকে আঙুল দিয়ে। সাথে সাথে দেহরক্ষী রবোটগুলো হ্যাচকা টানে তুলে নেয় নিজেদের ঘাড়ে। করুণ কান্নায় পুরো বালবেলা আর্তনাদ করে ওঠে সাথে সাথে।
অত্যন্ত নৃশংসভাবে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটাল ট্রন পুরুষ এবং মহিলারা, কান্নার শব্দ তাদের ভালো লাগে না—যারাই এতটুকু শব্দ করেছে; সাথে সাথে তাদের হত্যা করেছে আশ্চর্য নির্লিপ্ততায়।
আমি আর কিরীণা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিরীণা ফিসফিস করে বলল, কুনিল।
কি? আমি যদি আজ মরে যাই–অশ্রুত কথা মুখে আনতে নেই।
যদি মরে যাই, কিরীণা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তাহলে কোনোদিন তোমাকে বলার সুযোগ পাব না।
কী বলার সুযোগ পাবে না? আমি তোমাকে
কিরীণার কথা মুখে থেমে যায়, এক জন ট্রন মেয়ে লম্বা পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি তার চোখে চোখ না ফেলতে, কিন্তু মেয়েটি খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। প্রথমে কুলাককে, তারপর নিশ, তারপর কিরীণার দিকে আঙুল দেখিয়ে ঘুরে চলে গেল। দেহরক্ষী রবোট সাথে সাথে তিনজনকে ধরে উপরে তুলে নেয়। কিরীণা রক্তহীন মুখে আমার দিকে তাকাল। একটা হাত একবার বাড়িয়ে দিল আমার দিকে যেন আমাকে একবার স্পর্শ করতে চায় শেষবারের মতো। চিৎকার করে পৃথিবী বিদীর্ণ করে দিতে চাইলাম আমি, পারলাম না, আমার মা জাপটে আমার মুখ চেপে ধরেছেন পিছন থেকে ফিসফিস করে বলছেন, হে ঈশ্বর, করুণা কর। করুণা কর। করুণা কর।
রুকাস শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ সে যেন একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল, আস্তে আস্তে বলল, কিন্তু এটা তো করতে পারে না।
কেউ কোনো কথা বলল না, রুকাস সবার দিকে তাকাল, তারপর দুই পা সামনে এগিয়ে উচ্চস্বরে বলল, এটা তো করতে পার না তোমরা। ছেড়ে দাও সবাইকে ছেড়ে দাও—
ট্রন মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে তাকাল, রুকাসকে দেখে হকচকিয়ে গেল। হঠাৎ গুলি করার জন্যে হাতের অস্ত্রটি তুলেও থেমে গেল মেয়েটি। এত রূপবান একটি মানুষকে হত্যা করা সহজ নয়—বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্যে।