আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, একটি জটিল যন্ত্র থেকে একটা ছোট নল বের হয়ে এসেছে, তার মাথায় একটা সুচের মতন কী যেন। আঙুলটিতে সেটা দিয়ে ছোট একটা খোঁচা দিতেই লাল এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে আসে, সাথে সাথে ঘড়ঘড় করে যন্ত্রটার মাঝে শব্দ হতে থাকে, রক্তের ফোঁটাটি যন্ত্রের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়। সামনে স্ক্রিনে অসংখ্য সংখ্যা বের হয়ে আসে। ইলি ভুরু কুচকে সংখ্যাগুলো দেখে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখছ ইলি?
তোমার সম্পর্কে সবকিছু লিখে দিচ্ছে!
কিরীণ জিজ্ঞেস করল, কী লিখেছে?
এশীয় বংশোদ্ভূত পুরুষ। বয়স তেরো–
তেরো। আমি খুব অবাক হবার ভান করে বললাম, হতেই পারে না! আমি কমপক্ষে পনেরো।
ইলি চোখ মটকে বলতে শুরু করল, রক্তের গ্রুপ জিটা চৌদ্দ দশমিক চার, জিনেটিক কোড আলফা রো তিন তিন চার পাঁচ নয়—
এ গুলোর মানে কি?
ইলি মাথা চুলকে বলল, আমিও ঠিক জানি না। তবে তুমি কোন এলাকা থেকে এসেছ সেটাও বলে দেবার কথা।
খানিকক্ষণ স্ক্রিনটা দেখে ইলি মাথা নাড়ল, তোমার পূর্বপুরুষেরা এসেছে ভারত মহাসাগরের ছোট একটা দ্বীপ থেকে। দ্বীপের অক্ষাংশ সাত দ্রাঘিমাংশ।
কিরীণা বলল, এবার আমারটা বের কর।
এক ফোঁটা রক্ত দিতে হবে কিন্তু।
ব্যথা করবে না তো?
না, ব্যথা করবে না।
কিরীণার রক্ত পরীক্ষা করেও বিশেষ নূতন কিছু জানা গেল না। সে মেয়ে, তার বয়স চৌদ্দ এ দু’টি তথ্য জানার জন্যে এরকম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। তার পূর্বপুরুষেরা এসেছে উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে।
আমার আর কিরীণার রক্ত পরীক্ষা করে বোঝা গেল এই প্রাচীন এবং নড়বড়ে যন্ত্রটি মোটামুটিভাবে কাজ করে। এবারে তরুণটির রক্ত পরীক্ষা করার কথা। আমি তরুণটিকে ইঙ্গিত করলাম তার হাতটা টেবিলের উপর রাখার জন্যে। সে আপত্তি না করেই হাতটি এগিয়ে দিল। তরুণটির মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি, ছোট শিশুদের অর্থহীন আব্দার শোনার সময় বড়রা যেরকম মুখভঙ্গি করে, অনেকটা সেরকম।
তার আঙুল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে যন্ত্রটি অনেকক্ষণ নানারকম বিদঘুটে শব্দ করে একসময় স্ক্রিনে অসংখ্য লেখা শুরু হতে থাকে। ইলি ভুরু কুঁচকে সংখ্যাগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল ইলি?
কিছু-একটা গোলমাল হয়েছে। ঠিক করে কাজ করে নি যন্ত্রটা।
কেন?
লিখেছে এশীয় বংশোদ্ভূত পুরুষ। আদি বাসস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, রক্তের গ্রুপ কাপা তেরো দশমিক নয়। জিনেটিক কোড়টাও দিয়েছে কিছু একটা। কিন্তু বয়সটা গোলমাল করে ফেলেছে।
কি গোলমাল?
ইলি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, বয়স লিখেছে দুই হাজার তিন শ’ নয়।
কিরীণা হি হি করে হেসে বলল, এর বয়স দুই হাজার?
দুই হাজার তিন শ নয়।
তোমার যন্ত্র এই সহজ জিনিসটাও জানে না যে এক জন মানুষের বয়স দুই হাজার তিন শ’ নয় হতে পারে না?
জানা উচিত ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বয়সটা নেগেটিভ দুই হাজার তিন শ’ নয়। সামনে একটা মাইনাস চিহ্ন রয়েছে।
এবারে আমি আর কিরীণা দু’জনেই জোরে হেসে উঠলাম। শুধু যে বয়স দুই হাজারের বেশি সেটাই নয়, বয়সটা আরো উল্টোদিকে!
ইলি স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এর আগে কখনো যন্ত্রটা ভুল করে নি। এখন কেন করল?
আমি তরুণটির দিকে তাকালাম, মুখে মূদ একটা হাসি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠি, হঠাৎ করে আমার মাথায় খুব বিচিত্র একটা সম্ভাবনার কথা উঁকি দেয়। আমি ইলির দিকে তাকিয়ে বললাম, ইলি—
কি?
এটা কি হতে পারে যে এই তরুণটি—
এই তরুণটি কি?
আমি মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। ঘুরে তরুণটির দিকে তাকালাম, সে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মুখে সেই মৃদু হাসিটি নেই, তার বদলে কেমন যেন গভীর বিষাদের ছাপ। সে কি বুঝতে পেরেছে আমি কী ভাবছি?
কিরীণ জিজ্ঞেস করল, এই তরুণটি কি?
না, কিছু না। আমি কথা ঘোরানোর জন্যে বললাম, তার সাথে কি কোনোভাবে কথা বলা যায় না?
কিরীণা বলল, আমি দেখি চেষ্টা করে। সে তরুণটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
তরুণটি হাসিমুখে কিরীণার দিকে তাকিয়ে রইল দেখে কিরীণা এবারে গলা উচিয়ে বলল, তোমার নাম কি যেন জোরে কথা বললেই ভাষার ব্যবধান ভেঙে পড়ে। কিরীণার কাজকর্ম মাঝে মাঝে এত ছেলেমানুষি যে সেটি বলার নয়।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তরুণটি হঠাৎ তার সেই অপূর্ব কণ্ঠস্বরে বলল, রুকাস!
কিরীণা চিৎকার করে বলল, এই তো কথা বলছে।
আমি কিছু বলার আগেই তরুণটি আবার ফিসফিস করে অনুচ্চ স্বরে বলল, নাম রুকাস আমার।
আমি একটু অবাক হয়ে রুকাসের দিকে তাকিয়ে দেখি! সত্যি তাহলে সে কথা বলার চেষ্টা করছে। উচ্চারণ ভঙ্গিটি কি বিচিত্র, প্রত্যেকটা শব্দ আলাদা আলাদা করে বলছে, কথা বলার সময় ঠোঁট দু’টি মনে হয় নড়ছেই না! কথাগুলো মনে হয় আসছে গলার ভেতর থেকে।
ইলির বাসা থেকে সে রাতে যখন আমরা ফিরে যাচ্ছিলাম তখন সেই বিচিত্র তরুণটি বেশ কিছু কথা শিখে গিয়েছে। তরুণটির স্মৃতি অত্যন্ত তীক্ষ্ম। একটি কথা একবার শুনলেই সেটি প্রায় নিখুঁতভাবে মনে রাখতে পারে।
দু মাস পরের কথা। রুকাস এতদিনে বেশ কথা বলা শিখে গেছে। আমি আমার ক্রিস্টাল রিডারের একটি অংশে বৈদ্যুতিক চাপ পরীক্ষা করতে করতে তার সাথে কথা বলছিলাম, কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আমি সবসময়েই তার ব্যক্তিগত ইতিহাস জানতে চাই, যেটা সে সযত্নে এড়িয়ে যায়। আমি সম্ভবত সহস্রতম বার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে রুকাস?