কেন? তুমি বাজার কর না? মাছ কেন না?
ইয়ে–কিনি। কিন্তু—
কিন্তু কী?
যেমন মনে কর গত সপ্তাহে মাছ কিনতে গিয়েছি, পাবদা মাছ, আমার কাছে চেয়েছে এক শ বিশ টাকা, আমি কিনেছি এক শ ত্রিশ টাকায়।
দশ টাকা বেশি দিয়েছ!
হ্যাঁ।
কেন?
মাছওয়ালা তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে এমন একটা দুঃখের কাহিনী বলল যে আমার চোখে পানি এসে যাবার অবস্থা। দশ টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছি।
অনিক মাথা নেড়ে বলল, ও, আচ্ছা।
আমি লিখে দিতে পারি অনিক না হয়ে অন্য যে কেউ হলে আমার এই বোকামির কথা শুনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসা শুরু করত। অনিক শুধু যে হাসল না তা না, আমার যুক্তিটা এক কথায় মেনেও নিল। একেই বলে প্রাণের বন্ধু।
আমি বললাম, কাজেই আমি টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলতে পারব না, আমি বললে তোমার মনে হয় সাত থেকে ক্ষতিই হবে বেশি।
হলে হোক। আমি তো আর বিক্রি করার জন্যে গবেষণা করি না। আমি গবেষণা করি মনের আনন্দ আনো।
তা ঠিক। আমিও মাথা নাড়লাম, মনের আনন্দের সাথে সাথে যদি একটু টাকাপয়সা আসে খারাপ কী?
সেটা অবশ্য তুমি ভুল বলো নাই।
অনিক তার টেস্টটিউব নিয়ে আবার ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মশা নিয়ে গবেষণার কী অবস্থা? মহিলা মশারা খেতে পছন্দ করে এরকম কিছু কি এখনো খুঁজে বের কবে?
উঁহু। কাটা সোজা না।
লেবুর শরবত দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছ?
লেবুর শরবত? অনিক অবাক হয়ে বলল, লেবুর শরবত কেন?
আমি মাথা চুলকে বললাম, তা জানি না। আমার কাছে মনে হল মহিলা মশারা হয়তো লেবুর শরবত খেতে পছন্দ করবে।
অনিক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা শুনে বোঝা যায় তোমার ভেতরে কোনো বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা নাই। বৈজ্ঞানিক চিন্তা থাকলে যুক্তিতর্ক দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। এমনি এমনি তখন কেউ কোনো একটা কথা বলে না।
আমি বললাম, ধুরঃ যুক্তিফুক্তি আমার ভালো লাগে না। যখন যেটা মনে হয় আমি সেটাই করে ফেলি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সেদিন মতিঝিলে যাব, যে বাসটা এসেছে সেটা ভাঙাচোরা দেখে পছন্দ হল না। চকচকে একটা বাস দেখে উঠে পড়লাম, বাসটা আমাকে মিরপুর বারো নম্বরে নামিয়ে দিল।
কিন্তু, কিন্তু–অনিক ঠিক বুঝতে পারল না কী বলবে। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার না মতিঝিলে যাবার কথা?
আমি বললাম, কপালে না থাকলে যাব কেমন করে?
হাজার হলেও অনিক বিজ্ঞানী মানুষ, তার কাজ-কারবারই হচ্ছে যুক্তিতর্ক নিয়ে, কাজেই আমার সাথে একটা তর্ক শুরু করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। মনে হয় মশার গবেষণা কেনার মানুষটা চলে এসেছে।
অনিক দরজা খুলে দিতেই মানুষটা এসে চুকল। মোষ্টাসোটা নাদুসনুদুস মানুষ, চেহারায় একটা তেলতেলে ভাব। ঠোটের উপর সরু গোঁফ। সরু গাফ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। গোঁফ রাখতে চাইলে সেটা রাখা উচিত বঙ্গবন্ধুর মতো, তার মাঝে একটা ব্যক্তিত্ব আছে। মানুষটা সুট-টাই পরে আছে, চোখে চশমা, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। গায়ের রং ফরসা, ফরসার মাঝে কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ ভাব। হঠাৎ হঠাৎ এক ধরনের তেলাপোকা দেখা যায় যেগুলো সাদা রঙের, দেখতে অনেকটা সেরকম, দেখে কেমন যেন ঘেন্না ঘেন্না লাগে।
মানুষটা অনিকের দিকে তাকিয়ে তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বলল, কী খবর বিজ্ঞানী সাহেব? কেমন আছেন?
অনিক বলল, ভালো। আসেন, ভেতরে আসেন।
মানুষটা ভেতরে এসে ভুরু কুঁচকে চারদিকে তাকাল। অনিক বেচারী ঘরষ্টা পরিষ্কার করার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। যারা নোংরা এবং অগোছালো মানুষ তারা ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার চেষ্টা করলে সেটা দেখতে আরো বদখত দেখায়। মানুষটা ঘরটার ওপর চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকাল এবং আমাকে দেখে মুখটা কেমন যেন কুঁচকে ফেলল। তাকে দেখে মনে হল সে যেন আমাকে দেখছে না, একটা ধাড়ি চিকাকে দেখছে। অনিক তখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে বলল, এ আমার বিশেষ বন্ধু। নাম জাফর ইকবাল।
ও। মানুষটা কিছুক্ষণ আমাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, আমার নাম আক্কাস আকন্দ।
আমি মনে মনে বললাম, বাটা বুড়া ভাম কোথাকার। তোমার নাম হওয়া উচিত খোক্কস আকন্দ। আর মুখে বললাম, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম আকন্দ সাহেব।
খোক্কস আকন্দ তখন কেমন জানি দুলে দুলে গিয়ে সোফায় বসে আবার তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে দেখতে লাগল।
অনিক জিজ্ঞেস করল, আমার বাসা পেতে কোনো ঝামেলা হয়েছে আকন্দ সাহেব?
নাহ। বাস পেতে কোনো ঝামেলা হয় নাই। তবে আকন্দ সাহেব নাক দিয়ে ঘেঁত করে একটা শব্দ করে বলল, বাসায় আসতে একটু ঝামেলা হয়েছে।
অনিক একটু থতমত খেয়ে বলল, কী রকম ঝামেলা?
বাসার গলি খুব চিকন। আমার গাড়ি ঢোকানো গেল না। সেই মোড়ে পার্ক করে ব্রেখে হেঁটে হেঁটে আসতে হয়েছে।
ব্যাটার ফুটানি দেখে মরে যাই। একবার ইচ্ছা হল বলি, তোমারে আসতে বলেছে কে? কিন্তু কিছু বললাম না।
অনিক বলল, চা কফি কিছু খাবেন?
খোক্কস আকন্দ বলল, না। আমি চা কফি সাধারণত খাই না। যেটা সাধারণত খাই সেটা আপনি খাওয়াতে পারবেন না! বলে খোক্কস আকন্দ কেমন যেন দুলে দুলে হাসতে লাগল। ভাব দেখে মনে হল সে বুঝি খুব একটা রসিকতা করে ফেলেছে।
অনিক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, এখন আমিও জানি তার বাসায় চা কিংবা কফি কোনোটাই নাই। খোস আকন্দ একসময় হাসি থামিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, এখন কাজের কথায় আসা যাক বিজ্ঞানী সাহেব, কী বলেন?