আমি ঢোক গিলে বললাম, আ-আমি তোমাকে বলতে পারব?
হয়তো পারবে না। কিন্তু দুজন থাকলে একটু কথা বলা যায়। একটু পরামর্শ করা যায়। একটা ছোট বাচ্চা, তার ভালোমন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে না?
আছে। আমি মাথা নাড়লাম, তার ভালোমন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে। তবে–
অনিক ভুরু কুঁচকে বলল, তবে কী?
একটা ছোট বাচ্চা যার কাছে চলে আসে, তার কোনো ভালো নেই। তার শুধু মন্দ।
তুমি কী বলতে চাইছ?
ছোট বোন শিউলিকে দেখেছিলাম। তার প্রথম বাচ্চা হবার পর খাওয়া নেই ঘুম নেই। কেমন যেন পাগলী টাইপের হয়ে গেল। এখনো ঠিক হয় নি।
অনিক ছোট বাচ্চাটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, সেটা পরে দেখা যাবে। এখন কী করা যায় বলো।
আমি মাথা চুলকালাম, বললাম, এর মা-বাবাকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে ফেরত দিতে হবে।
এর মা-বাবা যদি বাচ্চাটাকে নিজের কাছে রাখতই তা হলে আমার বারান্দায় কেন ফেলে গেল?
আমি আবার মাথা চুলকালাম। কোনো একটা সমস্যায় পড়লেই আমার মাথা চুলকাতে হয়। আমার কপাল ভালো। আমার জীবনে খাওয়া এবং ঘুম ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপার নেই। সমস্যাও কম, তা না হলে মাথা চুলকানোর কারণে এতদিনে সেখানকার সব চুল উঠে যেত। অনিক বলল, এই ময়লা কাপড় দিয়ে বাচ্চাটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে, তার মানে এর মা-বাবা নিশ্চয়ই গরিব।
তাই বলো। আমি আরো ভাবছিলাম তুমি এত ছোট বাচ্চাটাকে কেন এত ময়লা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছ!
আমি রাখি নাই।
তা হলে খুলে রাখছ না কেন?
বাচ্চাটা মার জন্ম হয়েছে। একটা বাচ্চা থাকে মায়ের পেটে, সেখানে শরীরের গরমটুকু থাকে। যখন জন্ম হয় তখন বাইরের পৃথিবী তার কাছে কনকনে ঠাণ্ডা। তাই তাকে গরম করে রাখতে হয়।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, তুমি কেমন করে জান?
বাচ্চাটা পাবার পর আমি কি বসে আছি মনে করেছ? ইন্টারনেটে ছোট বাচ্চা সম্বন্ধে যা পাওয়া যায় সব ডাউনলোড করে পড়া শুরু করে দিয়েছি না?
আমি দেখলাম তার টেবিলের আশপাশে কাগজের স্তুপ। অনিক বলল, আমি এর মাঝে ছোট বাচ্চার একটা এক্সপার্ট হয়ে গেছি। তুমি জান একটা ছোট বাচ্চার যখন জন্ম হয়, তখন প্রথম চদ্বিশ ঘণ্টা সে শ্রেনেক কিছু করতে পারে, যেটা পরে করতে পারে না। হাত দিয়ে ধরে ফেলতে পারে, মুখ ভাংচাতে পারে—
মুখ ভাংচাতে পারে?
অনিক হাসল, বলল, অনুকরণ করতে পারে। আমি জিব বের করলে সেও জিব বের করবে। কিন্তু বাচ্চাটা বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ রাখছে।
অনিকের কথা শুনে কিনা কে জানে বাচ্চাটা ঠিক তখন দুই চোখ খুলে ড্যাবড্যাব করে তাকাল। অনিক বাচ্চাটার কাছে মুখ নিয়ে নিজের জিব বের করতেই এইটুকুন ছোট্ট বাচ্চা তার লাল টুকটুকে জিব বের করে অনিককে ভেংচি কেটে দিল। অনিক জিবটা ভেতরে ঢোকাতেই বাচ্চাও তার জিব ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। অনিক আবার জিবটা বের করতেই এইটুকুন গ্যাদা বাচ্চা আবার তার জিবটা বের করে ফেলল! কী আশ্চর্য ব্যাপার।
অনিক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখেছ ব্যাপারটা? ঠিক যেটা বলেছিলাম। জন্ম হবার পরপর ছোট বাচ্চাদের অসম্ভব কিছু রিফ্লেক্স থাকে। মাঝে মাঝে এ সময় এরা খপ করে ধরে ফেলতে পারে।
অনিক তখন তার একটা আঙুল বাচ্চাটার সামনে নাড়াতে থাকে এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সত্যি সত্যি বাচ্চাটা খপ করে আঙুলটা ধরে ফেলল। অনিক আনন্দে দাঁত বের করে হেসে বলল, দেখেছু ব্যাপারটা? দেখেছ?
আমি বললাম, দেখেছি। কিন্তু—
অনিক আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, কিন্তু কী?
তোমার বাসার বারান্দায় একটা গ্যাদা বাচ্চা পাওয়া গেছে, সেটা নিয়ে তুমি কিছু একটা করবে না?
সেই জন্যেই তো তোমাকে ডেকে এনেছি। কী করতে হবে তুমি কর। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে একটু গবেষণা করি। বইপত্রে যেসব কথা লিখেছে সেগুলি সত্যি কিনা পরীক্ষা করে দেখি।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, অনিক তুমি গবেষণা করার অনেক সময় পাবে। আগে ব্যাপারটা কাউকে জানাও।
অনিক বাচ্চাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে নিজের মাথাটা একবার বামে আরেকবার ডানে নিয়ে বলল, উঁহুঁ গবেষণা করার অনেক সময় পাব না। বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা তাদের এরকম রিফ্লেক্স থাকে। একটু পরে আর থাকবে না।
আমি বললাম, তা হলে তুমি কী করতে চাও?
বাচ্চাটা চোখ দিয়ে ট্র্যাক করতে পারে কিনা দেখছি।
আমি বুঝতে পারলাম অনিক এখন কিছুই করবে না, সে তার গবেষণা করে যাবে। যা করার আমাকেই করতে হবে এবং প্রায় সাথে সাথে আমার মনে পড়ল, আমি নিজে নিজে কোনো কাজই করতে পারি না। খাওয়া এবং ঘুমের বাইরে জীবনে কোনো কাজ নিজে করেছি বলে মনে পড়ে না।
ঠিক এরকম সময় আমার সুব্রতের কথা মনে পড়ল। সুব্রতের জন্ম হয়েছে এই ধরনের কাজের জন্যে! আমি অনিকের টেলিফোন দিয়ে সুব্রতকে ফোন করলাম। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর সুব্রত এসে ফোন ধরল, ঘুম ঘুম গলায় বলল, হ্যালো।
আমি বললাম, সুব্রত, আমি জাফর ইকবাল।
জাফর ইকবাল? সুব্রত অবাক হয়ে বলল, তুই এত ভোরে কী করছিস?
একটা জরুরি কাজে—
জরুরি কাজ? তোর আবার জরুরি কাজ কী হতে পারে? ঘুমাতে যা।
আমি বললাম, না, না সুব্রত, ঠাট্টা নয়। আসলেই জুরুরি কাজ।
কী হয়েছে?
আমি তখন সুব্রতকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। শুনে সুব্রত চেঁচিয়ে উঠে বলল, বলিস কী তুই?
আমি বললাম, ঠিক বলছি। এই এতটুকুন একটা বাচ্চা। গোলাপি রঙের। এই এতটুকুন হাত-পা। এতটুকুন আঙুল।