মানুষের কণ্ঠস্বরে এধরনের যান্ত্রিক কথা শুনলে সবসময়েই আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি— আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়েই মনে করি যন্ত্র এবং মানুষের কথার মাঝে একটা স্পষ্ট পার্থক্য থাকা দরকার। মানুষের কথা শোনার সময় তাকে সবসময়েই আমরা দেখতে পাই, মুখের ভাবভঙ্গি থেকে কথার অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যন্ত্রের বেলায় সেটা সম্ভব নয়— সত্যি কথা বলতে কী কথাটা কোথা থেকে আসছে অনেক সময় সেটাও বুঝতে পারি না।
আমি চেয়ারে নিজেকে নিরাপত্তা বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিতে নিতে বললাম, আমি যদি বলি তোমার আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম না!
নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর তরল গলায় বলল, মহামান্য ইবান, আপনি ইচ্ছে করলে অবশ্যি সেটা বলতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না।
তুমি কে?
আমি ফোবি। ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মানুষের সংযোগকারী মডিউল ফোবি।
আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করতে করতে বললাম, আচ্ছা ফোবি, আমি যদি এখন তোমাকে জঘন্য ভাষায় গালাগাল করি তাহলে কী হবে?
কিছুই হবে না মহামান্য ইবান। আমি মানুষ নই, আমার ভেতরে কোনো মান-অপমান বোধ নেই— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি, যেভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করা যায় সেভাবে সাহায্য করব।
আমি কন্ট্রোল প্যানেলে ফোবিয়ানের ইঞ্জিনগুলোর খুঁটিনাটি পরীক্ষা করতে করতে বললাম, ফোবি, আমি যতদূর জানি তোমার নিউরাল নেটওয়ার্ক মানুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেক গুণ ভালো বলা হয়, মানুষ থেকে বারো গুণ বেশি তোমার বুদ্ধিমত্তা— যার অর্থ তুমি আসলে আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। কাজেই প্রকৃত অর্থে আমার তোমাকে বলা উচিৎ মহামান্য ফোবি—
ফোবি এবারে প্রায় হাসার মতো করে শব্দ করল, বলল, আপনি ভুল করছেন মহামান্য ইবান, আমি নিউরাল নেটওয়ার্ক নই— আমি শুধুমাত্র নিউরাল নেটওয়ার্কের মানুষের সাথে যোগাযোগকারী মডিউল। নিউরাল নেটওয়ার্ক যদি একটা মানুষ হয় তাহলে আমি তার কণ্ঠস্বর। আমার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা নেই। আর সম্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার কোনো অর্থ নেই মহামান্য ইবান। দীর্ঘদিন গবেষণা করে দেখা গেছে একজন মানুষ এবং একজন যন্ত্রকে পাশাপাশি কাজ করতে দেয়া হলে মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে খানিকটা প্রাধান্য দিতে হয়, পুরো ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়, এর বেশি কিছু নয়।
ও! আমি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, এই মহাকাশযানে আমি দীর্ঘ সময়ের জন্যে আছি তোমার সাথে যন্ত্র এবং মানুষ নিয়ে কথা বলা যাবে। এখন ফোবিয়ানকে শুরু করা যাক।
বেশ।
আমি কন্ট্রোল প্যানেল পরীক্ষা করে মূল ইঞ্জিন দুটো চালু করলাম, সাথে সাথে ফোবিয়ানের দুইপাশে বসানো শক্তিশালী ইঞ্জিন দুটি গর্জন করে উঠল। আমি ফোবিয়ানের জানালা দিয়ে বিদ্যুঝলকের মতো আয়োনিত গ্যাস বের হতে দেখলাম। আমি অসংখ্যবার মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিন চালু করে মহাকাশযানকে নিয়ে মহাকাশে ছুটে গিয়েছি। কিন্তু প্রথম মুহূর্তটি প্রত্যেকবারই আমাকে একইভাবে অভিভূত করেছে।
আমি ফোবিয়ানে তীব্র কম্পন অনুভব করি, মহাকাশযানটি শেষবারের মতো গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করেছে, শক্তিশালী ইঞ্জিন দুটি প্রদক্ষিণ শেষ করার আগেই এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে ছিন্ন করে উড়ে যাবে।
আমি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশ দূর হয়ে এখন এখানে ত্বরণ থেকে প্রচণ্ড আকর্ষণ শুরু হচ্ছে। আরামদায়ক চেয়ারটিতে অদৃশ্য কোনো শক্তি আমাকে ধীরে ধীরে চোপ ধরতে শুরু করেছে। সাধারণ যে-কোনো মানুষ থেকে আমি অনেক বেশি মহাকর্ষ শক্তি সহ্য করতে পারি। কন্ট্রোল প্যানেলে দেখতে পাচ্ছি আমার ওজন বাড়তে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে বুকের ওপর অদৃশ্য একটি দানব চেপে বসেছে। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, চোখের সামনে একটা লাল পর্দা কাঁদতে শুরু করে।
আমার কানের কাছে ফোবি ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ইবান, আপনাকে অচেতন করে দিই?
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, না।
কেন? কেন আপনি এই কষ্ট সহ্য করছেন?
জানি না।
আর কিছুক্ষণের মাঝে আপনার মাথার মাঝে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি এমনিতেই অচেতন হয়ে পড়বেন।
তবু আমি দেখতে চাই। আমি বুঝতে পারি অদৃশ্য শক্তির টানে আমার মুখের চামড়া পিছনে সরে আসছে, চোখ খোলা রাখতে পারছি না, মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ একটা বিশাল পাথর চাপিয়ে রেখেছে, আমি একবারও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
ফোবি আবার ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ইবান। আপনার নিরাপত্তার খাতিরেই এখন আপনাকে অচেতন করে রাখা প্রয়োজন। এটি নিছক পাগলামি—
আমি জানি।
কিন্তু—
ফোবি— তোমরা কি কখনো পাগলামি করো? যন্ত্র কি পাগলামি করতে পারে?
ফোবি উত্তরে কী বলল আমি শুনতে পেলাম না কারণ এর আগেই আমি অচেতন হয়ে পড়লাম।
৩. যখন জ্ঞান ফিরে এল
আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন মহাকাশযান ফোবিয়ান তার নির্দিষ্ট যাত্রাপথে উড়ে যেতে শুরু করে দিয়েছে। মহাকাশযানে একটি আরামদায়ক মহাকর্ষ বল। আমি নিরাপত্তা বেল্ট খুলে চেয়ার থেকে নেমে এসে ডাকলাম, ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
সবকিছু চলছে ঠিকভাবে? চলছে মহামান্য ইবান।
আপনি সুস্থবোধ করছেন তো?
মাথার ভেতরে একটা ভোঁতা ব্যথা, আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে দূরে অপসৃয়মান গ্রহটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এখনো বিশ্বাস হতে চায় না আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অংশ এই অশুভ গ্রহটির ভিতরে একটা বায়োডোমে কাটিয়ে দিয়েছি। আমি মনিটর থেকে চোখ সরাতেই ছোট স্বচ্ছ গোলকটির দিকে চোখ পড়ল, ভেতরে বিচিত্র একটি গাছ, গাছে নীল পাতা তিরতির করে নড়ছে। আমি গাছটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কি সৌভাগ্য-বৃক্ষ?