তিন ঘণ্টা? মাত্র তিন ঘণ্টার মাঝে আমি সারা জীবনের জন্যে একটা গ্রহ ছেড়ে চলে যাব?
লি-হান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেউ যদি আমাকে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিত, আমি তিন মিনিটে চলে যেতাম!
আমি কোনো কথা না বলে বাইরে তাকালাম। কুৎসিত বেগুনি আলোতে গ্রহটাকে কী ভয়ঙ্করই-না দেখাচ্ছে। লিহান মনে হয় সত্যি কথাই বলছে।
ফোবিয়ানের কারগো ভল্টে স্টেনলেস স্টিলের কালো একটি সিলিন্ডারকে দেওয়ালের সাথে আটকে দিয়ে সামরিকবাহিনীর উচ্চপদস্থ মানুষটি বলল, এটি হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ফোবিয়ানের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে একে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।
মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে আমি সিলিন্ডারটির কাছে গিয়ে সেটি স্পর্শ করে বললাম, এই মানুষটি সম্পর্কে আমি এত বিচিত্র ধরনের গল্প শুনেছি যে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে মানুষটি মাঝপথে জেগে উঠবে না।
সামরিক অফিসারটি হেসে বলল, সে-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, তাকে তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায়২২ জমিয়ে রাখা আছে। জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তোমার-আমার বেলায় সেটি সত্যি হতে পায়ে, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের বেলায় আমি এত নিশ্চিত নই!
এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র তোমার-আমার জন্যে যেটুকু সত্যি ম্যাঙ্গেল কৃাসের জন্যেও ততটুকু সত্যি। তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায় মানুষের শরীরে কোনো জৈবিক অনুভূতি থাকে না। সে আক্ষরিক অর্থে একটি জড়বস্তু।
বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলতে পারবে না?
না, এই সিলিন্ডারটিকে বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত পাঠাতে পারবে না। এটি বলতে পারো তথ্য বা সঙ্কেতের দিক থেকে একেবারে নিচ্ছিদ্র।
সামরিক অফিসারটি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাথে আনুষ্ঠানিক বোঝাপড়া শেষ করে আমাকে ছোট একটি ক্রিস্টাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ইবান, তুমি এখন তোমার যাত্রা শুরু করতে পার।
আমি ভল্টের দেওয়ালে আটকে রাখা সারি সারি সিলিন্ডারগুলোর দিকে তাকালাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ছাড়াও এখানে অন্য মানুষ রয়েছে। কেউ-কেউ প্রতিরক্ষা বাহিনীর, কেউ-কেউ একেবারে সাধারণ যাত্রী। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে তাদের পরিচয় দেওয়া রয়েছে, আমার আলাদা করে জানার কোন প্রয়োজন নেই। মানুষ ছাড়াও এই মহাকাশযানে অন্য জিনিসপত্র রয়েছে, যার কিছু কিছু আমার জানার কথা নয়। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমাকে সেগুলি মানুষের এক কলোনি থেকে অন্য কলোনিতে পৌছে দেবার কথা। ম্যাঙ্গেল কৃাসের কথা আলাদা, সে যে কোন মহাকাশযানে থাকলে সেটি মহাকাশযানের অধিনায়কের জানা প্রয়োজন। জড় বস্তু হিসেবে থাকলেও সেটি জানা প্রয়োজন।
সামরিক অফিসার এবং তার সাথে আসা টেকনিশিয়ানরা নিজেদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিতে শুরু করে। ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে যাওয়া যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেয়া খুব সহজ নয় কিন্তু এই টেকনিশিয়ানরা দক্ষ, তাদের হাতের কাজ দেখতে ভালো লাগে। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। একজন একজন করে সবাই এসে আমার সামনে মাথা নিচু অভিবাদন করে তাদের স্কাউটশিপে উঠে গেল। সামরিক অফিসার আমার হাত ধরে সেখানে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইবান।
আমি হেসে বললাম, আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না!
সামরিক অফিসার আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে তার স্কাউটশিপে ঢুকে গেল, আমি ফোবিয়ানের গোল বায়ু-নিরোধক দরজাটা বন্ধ করে দিতেই স্কাউটশিপের ইঞ্জিনের চাপা শব্দ শুনতে পেলাম, আমি এখন এখানে একা।
আমি নিজের ভিতরে একধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম, এই বিশাল মহাকাশযানটিতে আমি একা একা-এক বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করব— এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে। এই দীর্ঘ সময়ে আমার সাথে কথা বলার জন্যেও কোনো সত্যিকার মানুষ থাকবে না। মহাকাশের নিকষ কালো অন্ধকারে, হিম শীতল পরিবেশে এই বিশাল মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন তুলে উড়ে যাবে। নতুন এই মহাকাশযানে হয়ত অজানা কোনো বিপদ অপেক্ষা করে আছে, মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি দুটি বিশাল ব্ল্যাক হোল, তার পাশে দিয়ে বিপজ্জনক একটি কক্ষপথ দিয়ে আমাকে যেতে হবে। সেখানে মহাকাশ-দস্যুরা ওৎ পেতে আছে, কে জানে, হয়ত বিচিত্র কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হতে হবে! জানি না সেই দীর্ঘ যাত্রা কখনো শেষ হবে কি না, রিশি নক্ষত্রের সেই মানবকলোনিতে পৌঁছাতে পারব কি না। যদিওবা পৌঁছাই সেই একযুগ পর আমার মায়ের সাথে দেখা হবে কি না সে কথাটিই-বা কে বলতে পারে!
আমি জোর করে আমার ভেতর থেকে সব চিন্তা দূর করে সরিয়ে দিয়ে ভেসে ভেসে মহাকাশযানের ওপরের দিকে যেতে থাকি। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে আমাকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। ফোবিয়ানের শক্তিশালী ইঞ্জিন যখন প্রচণ্ড গর্জন। করে এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে উপেক্ষা করে মহাকাশে পাড়ি দেবে তখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।
কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসার সাথে সাথে আমি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণকারী মূল। নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, পঞ্চম মাত্রার আন্তঃ
নক্ষত্র মহাকাশযান ফোবিয়ানের পক্ষ থেকে আপনাকে এই মহাকাশযানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মহামান্য ইবান।