আমাকে পুরো ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিতে খুব বেশি সময় দেয়া হলো না। মস্তিষ্ক উত্তেজক ড্রাগ নিহিলিন২১ নিয়ে নিয়ে আমি না ঘুমিয়ে একটানা চৌদ্দ দিন কাজ করে গেলাম। আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লাইসেন্স দেয়ার সময়টিতে আমি মোটামুটিভাবে একটা ঘােরের মাঝে ছিলাম এবং অনুষ্ঠানটি থেকে আমি কীভাবে নিজের ঘরে ফিরে এসেছি সেটি আমার মনে নেই, নিহিলিনের মতো উত্তেজক ড্রাগও আমাকে জাগিয়ে রাখতে পারছিল না। আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
ঠিক কখন আমি ঘুম থেকে উঠেছি সেটি আমি নিজেও জানি না— আমার ধারণা ছিল একবেলা পার করে দিয়েছি, কিন্তু ক্যালেন্ডার দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, এর মাঝে ছত্রিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যখন আমার ঘুম ভেঙেছে তখন আমার ঘরটি অন্ধকার এবং শীতল, আমি ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত। ঘরের ভিডি টিউবটি ক্রমাগত একটা জরুরি সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। আমি কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে টলতে টলতে ভিডি টিউবের কাছে গিয়ে সেটা স্পর্শ করতেই আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালক লি-হানের ছবিটি ছোট স্ক্রিনে ফুটে উঠল। সে একধরনের আতঙ্কিত গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার ইবান?
আমি জড়িত গলায় বললাম, ঘুমাচ্ছিলাম। নিহিলিন নিয়ে কয়দিন জেগে ছিলাম তো, শরীর আর চলছিল না।
আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে এত দীর্ঘ সময় ঘুমুবে বুঝতে পারি নি।
আমিও বুঝতে পারি নি। যা-ই হোক কেন ডেকেছ বল।
আমাদের হাতে সময় নেই। তোমাকে এক্ষুনি যাত্রা শুরু করতে হবে।
এক্ষুনি মানে কখন?
আগামী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে। একটা চৌম্বকীয় ঝড় আসছে, সেটা আসার আগে শুত্র না করলে অনেক দেরি হয়ে। যাবে।
ও। আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিন্তু আমার নিজেরও তো একটু প্রস্তুতি নিতে হবে।
না। তোমার নিজের প্রস্তুতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সবকিছুর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ—
লি-হান অধৈর্য হয়ে বলল, তোমার কোনো কিছু আর ব্যক্তিগত নেই। যখন থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তোমাকে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক করা হবে সেদিন থেকে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে-চোখে রাখা হয়েছে। তোমার ব্যক্তিগত সবকিছু আমরা জানি— ঠিক সেভাবে ফোবিয়ানে সবকিছু রাখা হয়েছে। তোমার পছন্দসই বইপত্র মেটা ফাইল থেকে শুরু করে প্রিয় খাবার, প্রিয় পোশাক, প্রিয় সঙ্গীত সবকিছু পাবে। তোমার কোনো ব্যক্তিগত কাজ বাকি নেই ইবান।
কিন্তু—
কোনো কিন্তু নেই। তা ছাড়া ফোবিয়ানের চরম গতিবেগ তোলার আগে পর্যন্ত তুমি নেটওয়ার্কে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে।
আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি সাথে আরো একটি জিনিস নিতে চেয়েছিলাম।
কী?
রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং।
লি-হান এবারে থেমে গিয়ে একটা শিস দেবার মতো শব্দ করল।
আমি ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পাওয়া যাবে না?
একটু কঠিন হবে কিন্তু আমি চেষ্টা করব।
চেষ্টা করলে হবে না। আমাকে পেতেই হবে। তুমি জানো আমি প্রায় একযুগ এই মহাকাশযানে একা-একা বসে থাকব। আমার কথা বলার জন্যে একজন মানুষ দরকার।
লি-হান হাসার শব্দ করে বলল, আমাদের সময়ে তুমি প্রায় একযুগ থাকবে, কিন্তু তোমার নিজের ফ্রেমে তো এতো দীর্ঘ সময় নয়। খুব বেশি হলে তিন বছরের মতো।
তিন বছর আর একযুগে কোনো পার্থক্য নেই। একই ব্যাপার। একটা-কিছু গোলমাল হলেই তিন বছর সত্যিসত্যি একযুগ নয় একেবারে এক শতাব্দী হয়ে যেতে পারে।
বুঝেছি।
আমি গলার স্বরে যথেষ্ট গুরত্ব দিয়ে বললাম, আমাকে রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং না দেয়া হলে আমি কিন্তু এই অভিযানে যাব না।
লি-হান একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আহ্! তুমি দেখি মহাকাশ-দস্যুদের মতো ব্ল্যাক মেইলিং শুরু করলে।
এটা ব্ল্যাক মেইলিং নয়— এটা সত্যি।
ঠিক আছে আমি যোগাড় করে দেব।
আমার আরো একটা জিনিস দরকার।
কী?
আমার মায়ের জন্যে একটা উপহার।
কী উপহার নিতে চাও?
ঠিক বুঝতে পারছি না।
বায়োডোমের বাইরে ঝড়ো বাতাসের গর্জনের সাথে মিল রেখে একটা সঙ্গীত- ধ্বনি তৈরি হয়েছে। শুনলেই বুকের মাঝে কেমন জানি করতে থাকে। সেই সঙ্গীত-ধ্বনি নিতে পার।
ঠিক আছে।
কিংবা এই গ্রহের প্রাচীন সভ্যতার কোনো চিহ্ন। কোনো রেলিক। গ্রানাইটের ছোট কোনো মূর্তি?
বেশ। তুমি যদি মনে করো সেরকম কিছু খুঁজে পাবে—
সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে করে একটা সৌভাগ্য-বৃক্ষ নিয়ে যাও।
সৌভাগ্য-বৃক্ষ?
হ্যাঁ। এই গ্রহের একটি বিশেষ ধরনের গাছ রয়েছে, ছোট গাছ তার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট নীল পাতা। এখানকার মানুষ বলে যখন জীবনে বড় ধরনের সৌভাগ্য আসে তখন সেখানে ফুল ফোটে। উজ্জ্বল কমলা রংয়ের ফুল। ভারি চমৎকার দেখতে!
বেশ। তাহলে এই গাছটাই নেয়া যাক। কিন্তু আন্তঃনক্ষত্র পরিবহনে গাছপালা বা জীবন্ত প্রাণী আনা-নেয়ার উপর নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে না?
লি-হান হা হা করে হেসে বলল, তুমি তোমার মহাকাশযানে করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে নিয়ে যাচ্ছ। যাকে ম্যাঙ্গেল জ্বাসের মতো একটি বস্তুকে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় তাকে যে-কোনো জীবন্ত প্রাণী নেয়ার অনুমতি দেয়া হবে। সেটা নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না!
ঠিক আছে আমি চিন্তা করব না।
তাহলে তুমি চার নম্বর এস্ট্রোডোমে চলে আসো। প্রস্তুতি শুরু করা যাক। তোমাকে তিন ঘণ্টা সময় দেয়া হলো।