এই মানুষটার লেখা কিছু বইপত্র আছে, কিছু ভিডিও ক্লিপ আছে কিছু মেটা ফাইল১৬ আছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, দেখেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। মানুষটা অসম্ভব বুদ্ধিমান, অসম্ভব প্রতিভাবন। মনে হয় ঈশ্বর বুঝি নিজের হাতে তার মাথায় একটা একটা করে নিউরনকে সাজিয়েছে, সিনান্সে সংযোগ দিয়েছে! তার ভাবনাচিন্তার সাথে পরিচিত হয়ে আমার নিজের ভেতরকার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি!
সেদিন রিতুন ক্লিস সম্পর্কে একটা নতুন তথ্য পেয়েছি। মানুষটা দুই শ বত্সর আগে মারা গেলেও তার মস্তিষ্কের পুরো ম্যাপিং নাকি রক্ষা করা আছে। পৃথিবীর বড় বড় মানুষ, বড় বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিল্পীদের মস্তিষ্ক নাকি এভাবে ম্যাপিং করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। তার মানে রিতুন ক্লিস মারা গেলেও তার মস্তিষ্ক বেঁচে আছে। বিশাল কোনো নিউরন নেটওয়ার্কে সেটা বসালে তার সাথে কথা বলা যাবে! কী আশ্চর্য ব্যাপার।
কিন্তু দুঃখের কথা কী জানিস? মানুষের মস্তিষ্কের ম্যাপিং নিয়ে কাজ করার মতো নিউরাল নেটওয়ার্ক খুব বেশি নেই। যে কয়টি আছে সেগুলো আমার নাগালের বাইরে। আমার মতো সাধারণ মানুষ কখনো সেটা ব্যবহার করতে পারবে না। আমি খবর পেয়েছি তুই চতুর্থ মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হয়েছিস। যদি কোনোভাবে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারিস তাহলে তুই তোর মহাকাশযানে সেরকম একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক পাবি। তুই তাহলে রিতুন ক্লিসের সাথে কথা বলতে পারবি। কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হবে চিন্তা করতে পারিস?
আমার মা উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর আবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন, দেখ, কতক্ষণ থেকে আমি বক বক করছি! আমার এরকম উদ্ভট জিনিস নিয়ে কৌতূহল বলে ধরে নিচ্ছি তোরও বুঝি এরকম কৌতুহল। আমার সব কথা ভুলে যা বাবা ইবান। ধরে নে এইসব হচ্ছে পাগলের প্রলাপ! তুই যদি পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারিস তাহলে মহাজগতের একেবারে শেষমাথায় মানুষের যে কলোনি আছে সেখানে অভিযান করতে যাবি। আমি রাত্রিবেলা আকাশের একটা নক্ষত্র দেখিয়ে সবাইকে বলব, আমার ছেলে ওখানে গেছে! আমার নিজের ছেলে— যেই ছেলেকে আমি পেটে ধরেছি!
আমার মা কথা শেষ করে আমার দিকে হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু আমি দেখতে পেলাম তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে, আর আমার মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে তার সেই চোখের পানি গোপন করতে।
যেরকম হঠাৎ করে আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি আমার ঘরের মাঝখানে এসে হাজির হয়েছিল ঠিক সেরকমভাবে আবার হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বুকের ভিতর কেমন জানি একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। উঠে দাঁড়িয়ে আমি কিছুক্ষণ খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। তারপর ফিরে এসে ভিডি টিউবটা স্পর্শ করে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতেই, ছোট স্ক্রিনটাতে লি-হানের ছবি ভেসে উঠল। সে আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খবর ইবান? তুমি কি শেষপর্যন্ত মন স্থির করেছ?
করেছি লি-হান। আমি যাব।
চমৎকার। তাহলে দেরি করে কাজ নেই, তুমি কাল ভোরবেলা থেকে কাজ শুরু করে দাও, বুঝতেই পারছ আমাদের হাতে সময় নেই। আমাদের চার নম্বর এস্ট্রোডোম থেকে একটা স্কাউটশিপ১৭ তোমাকে ফোবিয়ানে নিয়ে যাবে।
ফোবিয়ান?
হ্যাঁ আমাদের পঞ্চম মাত্রার নতুন মহাকাশযানটির নাম ফোবিয়ান। স্থিতিশীল একটা কক্ষপথে সেটাকে আটকে রাখা হয়েছে।
কক্ষপথে?
হ্যাঁ, পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানকে সাধারণত গ্রহে নামানো হয় না।
ও। আমি একমুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, লি-হান।
বল।
তোমাকে একটা প্রশ্ন করি— তুমি সত্যি উত্তর দেবে?
প্রশ্নটা না শুনে আমি তোমাকে কথা দিতে পারছি না। বেঁচে থাকার জন্যে অনেক সময় অনেক সত্যকে আড়াল করে রাখতে হয়।
আজ ভোরবেলা তোমার সাথে আমি রিশি নক্ষত্রের কাছাকাছি মানুষের কলোনিতে অভিযান নিয়ে যে কয়টি কথা বলেছিলাম তার প্রত্যেকটা সত্যি ছিল, তাই না?
লি-হান একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল। তাতে কিছু আসে যায়?
না যায় না।
তাহলে আমরা সেটা নিয়ে কথা নাইবা বললাম!
মহাকাশযান ফোবিয়ানকে দেখে আমি চমকৃত হয়ে গেলাম। বিশাল এই মহাকাশযানটি একটি ছোটখাট উপগ্রহের মতো। টাইটেনিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের সংকর ধাতুর দেয়ালের উপর তাপ অপরিবাহী নতুন একধরনের আস্তরণ দিয়ে ঢাকা। মূল ইঞ্জিনটি পদার্থ-প্রতিপদার্থ৮ জ্বালানি দিয়ে চালানো হয়। বিশেষ পরিস্থিতির জন্যে প্লাজমা-৯ ইঞ্জিনও রয়েছে। আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ পরিভ্রমণের জন্যে একটি অপূর্ব যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করে রাখা আছে। পুরো ফোবিয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে নিউরাল নেটওয়ার্কটি বসানো হয়েছে সেটি দেখে নিজের ভিতরে হীনমন্যতা এসে যায় মানুষের মস্তিষ্ক সত্যিকার অর্থেই এই নেটওয়ার্কের তুলনায় একেবারেই অকিঞ্চিতকর। চতুর্থ মাত্রার মহাকাশযানের সাথে ফোবিয়ানের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে, এটি নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে বোঝাই, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরক থেকে শুরু করে এক্স-রে লেজার কিছুই বাকি নেই। সৌভাগ্যক্রমে আমার নিজেকে এই অস্ত্র চালানো শিখতে হবে না— ফোবিয়ানে অস্ত্র চালাতে অভিজ্ঞ রবোটেরা রয়েছে।