আমি লি-হানের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমি একটু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাকে হঠাৎ একজন দুঃখী মানুষের মতো দেখাতে থাকে।
২. ভিডি টিউবের সুইচটা স্পর্শ করতেই
ভিডি টিউবের সুইচটা স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝামাঝি আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক একটা প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছবিটা এত জীবন্ত যে আমার মনে হলো আমি বুঝি তাকে স্পর্শ করতে পারব।
আমার মায়ের প্রতিচ্ছবিটি ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ইবান, আমি জানি না আমাকে তুই দেখছিস কি না! সেই কোন নক্ষত্রের কোন গ্রহপুঞ্জে তুই আছিস আমি জানিও না। তবু আমার ভাবতে ইচ্ছে করে তুই আমার সামনে আছিস, চুপ করে বসে আমার কথা শুনছিস।
মা কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, মনে হলো সত্যিই যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। মায়ের চেহারা সতেরো-আঠারো বৎসরের একটা বালিকার মতো কথার ভঙ্গিও সেরকম, চেহারায় বিন্দুমাত্র বয়সের ছাপ পড়ে নি।
মা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। হাত দিয়ে লালচে চুলগুলোকে পিছনে সরিয়ে বললেন, বুঝলি ইবান, কয়দিন থেকে নিজের ভেতরে কেমন জানি অস্থিরতা অনুভব করছি। শুধু মনে হচ্ছে এই জগতে কেন এসেছি, কী উদ্দেশ্য তার রহস্যটা বুঝতে পারছি না। আমি কি শুধু কয়েকদিন বেঁচে থাকার জন্যে এসেছি নাকি তার অন্য উদ্দেশ্য আছে? যদি অন্য উদ্দেশ্য থেকে থাকে তাহলে সেটা কী? প্রাণীজগতের যেরকম বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য থাকে মানুষের জন্যে তো আর সেটা সত্যি নয়! মানুষকে তো আর জন্ম নিতে হয় না। জিনম ফ্যাক্টরিতে অর্ডারমাফিক শিশুর জন্ম দেয়া যায়। তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটা কী?
মা কয়েকমুহূর্তের জন্যে থামলেন তারপর ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন, কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললেন, আমার মনে সারাক্ষণ এরকম প্রশ্ন দেখে আমার চারপাশে যারা আছে তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল, তারা ভাবল আমার চিকিৎসা দরকার! একদিন আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল চিকিৎসক রবোটের কাছে, সেটি আমাকে টিপেটুপে দেখে বলল আমার মাথায় মস্তিষ্কের ভিতরে একটা দ্বৈত কপোট্রন বসাতে হবে, যেটি আমার ভাবনা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সোজা কথায় আমাকে মানুষ থেকে পাল্টে একটা রবোটে তৈরি করে ফেলবে।
মা কথা থামিয়ে আবার ছেলেমানুষের মতো হাসতে শুরু করলেন, হাসি ব্যাপারটি নিশ্চয়ই সংক্রামক, আমিও মায়ের সাথে সাথে হাসতে শুরু করলাম। মা হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বললেন, আমি চিকিৎসক রবোটের কথা শুনি নি। আমার মাথায় দ্বৈত কপোট্রন বসানো হয় নি। মাথার ভিতরে এখনো আমার একশ ভাগ খাঁটি মস্তিষ্ক রয়েছে তাই এখনো আমি বসে বসে এইসব ভাবি! মা হঠাৎ সুর পাল্টে বললেন, বাবা ইবান, আমার কথা শুনে তুই আবার অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিস না তো?
আমি মাথা নাড়লাম, ফিসফিস করে বললাম, না মা অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি না।
অধৈর্য হলে হবি। আমার কিছু করার নেই। কেন জানি তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার মনে হয় তুই যদি আমার কাছে থাকতি তাহলে আমার প্রশ্নগুলোর গুর ত্বটা বুঝতে পারতি। এখানে আর কাউকে বোঝাতে পারি না।
প্রথম প্রথম মনে হতো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ত জ্ঞানের অনুসন্ধান করা। কিন্তু গত একশ বৎসরের ইতিহাসে দেখেছিস বড় আবিষ্কারগুলো কে করেছে? রবোট। কম্পিউটার। কপোট্রন। যেগুলো মানুষ করেছে তার পিছনেও রয়েছে যন্ত্রপাতি, নিউরাল নেটওয়ার্ক। তাহলে মানুষের জন্যে থাকল কী? মানুষ বেঁচে থাকবে কেন? তাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী?
মা কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন তারপর আবার হেসে ফেললেন মা যখন হাসেন তখন তাকে কী সুন্দরই না দেখায়! হাসি থামিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি না কেন আমি তোকে এসব বলছি। আসলে তোকে বলছি কি
সেটাও আমি জানি না— তাহলে কেন বলছি এসব? মাঝে মাঝে আসলে তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে— মনে হয় তুই হয়ত আমাকে বুঝতে পারবি। সে জন্যে বলছি— আমি কল্পনা করে নিচ্ছি তুই আমার সামনে বসে। আছিস, এই এখানে আমার কাছাকাছি।
কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন একটু একটু বুঝতে পারছি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী। ঠিক পুরোটুকু ধরতে পারছি না কিন্তু একটু যেন আন্দাজ করতে পারছি। আগে যেরকম মনে হতো আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই, কোনো অর্থ নেই— এখন সেরকম মনে হয় না। একসময় ভাবতাম তোর ভিতরে জিনেটিক কোনো প্রাধান্য না দিয়ে খুব ভুল করেছি, তোকে অতিমানব জাতীয় কিছু একটা তৈরি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু এখন আর তা মনে হয় না। এখন মনে হয় আমি ঠিকই করেছি, তোকে সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করেছি কিন্তু ভিতরে দিয়েছি। একটা চমৎকার হৃদয়। যেখানে রয়েছে ভালোবাসা। সবাইকে বড় হতে হবে কে বলেছে? মনে হয় যত ছোটই হোক জীবনের একটা অর্থ থাকে, একটা উদ্দেশ্য থাকে। কেউ এই জগতে অপ্রয়োজনীয় না। ছোট বড় সবাই মিলে সৃষ্টিজগৎ।
মা একটু থামলেন, থেমে হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, বেশি বড় জ্ঞানের কথা বলে ফেললাম? অন্য সবাইকে তো বলছি না তোকে বলছি। তুই আমার ছেলে, তোকে আমি পেটে ধরেছি। যখন পেটের মাঝে ছিলি তখন প্ল্যাসেন্টা দিয়ে তোর শরীরে পুষ্টি দিয়েছি, বড় করেছি। তোকে যদি এসব কথা বলতে না পারি তাহলে কাকে বলব?
বুঝলি ইবান, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন আসে আমার মাথায়, কাউকে জিজ্ঞেস করে তার উত্তর পাওয়া যায় না। নিজে নিজে তার উত্তর খুঁজে পেতে হয়। আমি তাই করছি। তবে একজন আমাকে খুব সাহায্য করেছে। মানুষটার নাম রিতুন। রিতুন ক্লিস। আলগল নক্ষত্রের কাছে মানুষের যে কলোনিটা আছে সেখানে থাকত সে। প্রায় দুইশ বছর আগে মানুষটা মারা গেছে, বেঁচে থাকলে আমি নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে যেতাম, যেভাবেই হোক।