তোমার মা খবর পেয়েছিলেন তুমি ফোবিয়ানে করে আসছ। তুমি কবে পৌঁছাবে সেটি জানার জন্যে তিনি মহাজাগতিক কেন্দ্রের সাথে প্রায় প্রতিদিন যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং সেটিই হয়েছে কাল।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে সেখানে বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম হলো এবং হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ফোবিয়ান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আধিনায়ক ইবান, তোমার মা যখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আমরা তখন তাকে জানিয়েছিলাম যে নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে ফোবিয়ান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে– আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
আমি খুব দুঃখিত অধিনায়ক ইবান, এই খবরটিতে তোমার মায়ের বুক ভেঙে গেল। তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসতেন, তিনি কিছুতেই সেই ভয়ংকর আশাভঙ্গের দুঃখ থেকে উঠে আসতে পারলেন না। একদিন রাতে যখন জোড়া উপগ্রহ থেকে উথালপাথাল জোৎস্নার আলো, কালো সমুদ্রে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ছুটে এসেছে, তোমার মা তখন হেঁটে হেঁটে সেই সমুদ্রের ফুসে ওঠা পানির মাঝে হেঁটে গেলেন। সমুদ্রের পানি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি খুব দুঃখিত অধিনায়ক ইবান পরদিন তার দেহ যখন বালুবেলায় ফিরে এসেছে সেটি ছিল প্রাণহীন।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বিষণ্ণ চোখে তাকাল, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মা মৃত্যুর আগে একটা ছোট ভিডিও ক্লিপ রেখে গিয়েছেন। আমরা তোমার কাছে সেটা পাঠালাম।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনিটর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার হঠাৎ করে মনে হলো বুকের ভিতরটি ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, ফোবিয়ানের বিশাল কক্ষ জটিল যন্ত্রপাতি উজ্জ্বল আলো, গোল জানালা দিয়ে বাইরের কালো মহাকাশ এবং উজ্জল নেবুলা এবং মনিটরের উপর সাজিয়ে রাখা আমার মায়ের জন্যে সৌভাগ্য-বৃক্ষ সবকিছু কেমন জানি অর্থহীন মনে হতে থাকে। আমার চোখের সামনে সবকিছু কেমন জানি অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে, নিশ্চয়ই চোখ ভিজে আসছে। আমি হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে মনিটরে তাকালাম সেখানে আমার মায়ের ভিত্তি ও ক্লিপটি দেখা যাচ্ছে আমি হাত বাড়িয়ে সেটি স্পর্শ করতেই হঠাৎ করে ঘরের মাঝখানে আমার মা জীবন্ত হয়ে উঠলেন, তার কালো চুল বাতাসে উড়ছে, আকাশের মতো দুটি নীল চোখে গভীর বেদনা। আমার মা ঘুরে অনিশ্চিতের মতো তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আমি আর পারছি না, খুব আশা করেছিলাম যে ছেলেটাকে দেখব, বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাব। হলো না। এক নিঃসঙ্গ একটি মহাকাশযানে আমার সোনার টুকরো ছেলেটি নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেল। প্রাচীনকালে মানুষ বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর একজন মানুষ আকাশের নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকে। আমারও সেটা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে আমার সোনামনি ইবান আকাশের একটি নক্ষত্র হয়ে বেঁচে আছে।
আমার মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার সোনামনি ইবানের কাছে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। আমিও সেই নক্ষত্রের পাশাপাশি অন্য একটি নক্ষত্র হয়ে থাকব। উথালপাথাল জোছনায় একটু পরে যখন কালো সমুদ্রের পানি ফুসে উঠবে আমি তখন তার মাঝে হেঁটে হেঁটে যাব। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
আমার মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন, সমুদ্রের বাতাসে তার চুল উড়তে লাগল, তার উজ্জ্বল চোখ দুটো গভীর বেদনায় নীল হয়ে রইল। আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ পানিতে ভরে উঠল, আমার মা অস্পষ্ট হয়ে এলেন। ঠিক তখন শুনতে পেলাম কেউ একজন আমাকে ডাকল, ইবান।
আমি ঘুরে তাকালাম। ফোবিয়ানের দরজা ধরে মিত্তিকা দাঁড়িয়ে আছে। সে শান্ত পায়ে হেঁটে এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল, বুড়োমতো একজন মানুষ আমাকে জাগিয়ে তুলে বলেছে তুমি ইবানের কাছে যাও। আজ তার জন্যে খুব দুঃখের দিন। কী হয়েছে ইবান? আজ কেন তোমার জন্যে দুঃখের দিন?
আমার মা মারা গেছেন মিত্তিকা।
মারা গেছেন? তোমার মা?
হ্যাঁ।
কেমন করে মারা গেলেন?
আমার মা ভেবেছিলেন ফোবিয়ান নিউট্রন স্টার ধ্বংস হয়ে গেছে, আমিও ধ্বংস হয়ে গেছি। সেটা ভেবে আমার মা এত কষ্ট পেলেন যে–
যে?
আর বেঁচে থাকতে চাইলেন না। আমার মা সমুদ্রের পানিতে হেঁটে হেঁটে চিরদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মিত্তিকা একধরনের বেদনার্ত মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমি খুব দুঃখিত ইবান। আমি খুব দুঃখিত।
আমি মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তার নীল দুটি চোখে এক আশ্চর্য গভীর বেদনা— ঠিক আমার মায়ের মতন। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুকের ভিতরে এক বিচিত্র আলোড়ন অনুভব করলাম, এক বিচিত্র নিঃসঙ্গতা হঠাৎ করে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার রিতুন ক্লিসের কথা মনে পড়ল, তিনি বলেছিলেন আমি যেন নিজেকে প্রতারণা না করি। আমি করলাম না, মিত্তিকার হাত ধরে ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা
কী হয়েছে, ইবান?
আমি— আমি বড় একা।
মিত্তিকা গভীর মমতায় আমার হাত ধরল। আমি কাতর গলায় বললাম, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, মিত্তিকা।
মিত্তিকা গভীর ভালোবাসায় আমার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, যাব না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না ইবান।