আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মহামান্য রিতুন।
বুঝতে না পারলে কথাটি তোমার জন্যে নয় ইবান। কিন্তু কখনো যদি বুঝতে পারো কথাটি মনে রেখো। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আমাকে বিদায় দাও ইবান।
বিদায়। বিদায় মহামান্য রিতুন।
বিদায়– আমার একটু ভয়-ভয় করছে ইবান। ভয় এবং দুঃখ। তার সাথে একটু আনন্দ– তোমার মতো। একজন চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় হলো সেই আনন্দ।
আমারও খুব সৌভাগ্য মহামান্য রিতুন যে আপনার সাথে আমার পরিচয় হলো। আমার মা এখানে থাকলে খুব খুশি হতেন।
রিতুন ক্লিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর নিচু এবং বিষণ গলায় বললেন, যদি তার সাথে দেখা হয় তাকে আমার ভালোবাসা জানিও। তাকে বলবে তিনি ঠিক কাজ করেছিলেন, সন্তানের বুকের মাঝে সবার আগে ভালোবাসা দিয়েছিলেন।
বলব।
রিতুন ক্লিস একটি হাত উপরে তুলে হঠাৎ করে মিলিয়ে গেলেন, আমার মনে হলো আমি মৃদু একটা আর্তচিৎকার শুনলাম তবে সেটি আমার মনের ভুলও হতে পারে। ঘরের ফাঁকা জায়গাটিতে তাকিয়ে আমি বুকের ভিতরে একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। আমার মা সত্যি কথাই বলেছিলেন, রিতুন ক্লিস সত্যিই চমৎকার একজন মানুষ। ফোবিয়ানে আমার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সময় রিতুন ক্লিস না থাকলে কী সর্বনাশই-না হতো। পুরো গল্পটা যখন আমার মাকে শোনাবো আমার হাসিখুশি ছেলেমানুষি মা নিশ্চয়ই কী আগ্রহ নিয়েই-না শুনবেন। ব্যাপারটি চিন্তা করেই একধরনের আনন্দে আমার চোখ ভিজে ওঠে।
যোগাযোগ মডিউলটি ঠিক হওয়ার সাথে সাথে আমি মহাজাগতিক মূল কেন্দ্রে যোগাযোগ করার জন্যে তথ্য পাঠাতে শুরু করলাম। এপর্যন্ত যা ঘটেছে তার পুরো বর্ণনা দিয়ে আমি আমার মায়ের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। তার আন্তঃগ্যালাক্টিক পরিচয়-সংখ্যা দিয়ে তিনি কোথায় আছেন সেটি খুঁজে বের করার জন্যে একটি অনুরোধ পাঠালাম। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি অনুরোধ হলেও পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে এটি একটি নির্দেশ হিসেবেই বিবেচনা করার কথা। মহাজাগতিক মূল কেন্দ্র থেকে খবর ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে, আমি তার মাঝে ফোবিয়ানের অন্যান্য সমস্যাগুলো সারতে শুরু করে দিলাম।
বিদ্যুৎ সঞ্চালনের অংশটুকু সেরে তুলতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। কাজটি সহজ হলেও বেশ সময়সাপেক্ষ, অভিজ্ঞ রবোটগুলি পুরো সময়টুকু একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছোটাছুটি করছিল। মহাকাশযানের ভেতরে সারাক্ষণই এক। ধরনের ছোটাছুটি এবং বিদ্যুতের ঝলকানি এবং তার সাথে হালকা ওজোনের গন্ধ। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজটুকু শেষ হওয়ার পর আমি তাপ পরিবহনের অংশটুকুতে হাত দিলাম, তাপ সুপরিবাহী বিশেষ সংকর ধাতুর উজ্জ্বল টিউবগুলো অনেক জায়গাতেই দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে, ভেতরে তাপ পরিবাহী ত্বরণগুলো নানা জায়গাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো পরিষ্কার করে টিউবগুলো পাল্টে দেয়ার কাজ শুরু করতে হলো। ফোবিয়ানের মূল পাম্পের বিভিন্ন অংশ থেকে টিউবগুলোর ভেতর দিয়ে তরলগুলো মহাকাশযানের নানা অংশে পাঠিয়ে পুরো পদ্ধতিটি বারবার পরীক্ষা করে দেখতে হলো।
ফোবিয়ানকে পুরোপুরি দাঁড় করানো বিশাল কাজ করতে করতে আমার সময়ের জ্ঞান ছিল না, ফোবিয়ানের অনুরোধে মাঝে মাঝে খেয়েছি মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়েছি। গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে আমি মহাকাশযানটিকে তার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চাই।
এরকম সময়ে ফোবি আমাকে জানাল মূল মহাজাগতিক কেন্দ্রের সাথে আমাদের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চমৎকার! তাদের প্রতিক্রিয়া কীরকম?
ফোবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি নিজেই দেখুন মহামান্য ইবান।
আমি হাতের যন্ত্রপাতি নামিয়ে রেখে মনিটরের দিকে তাকালাম, মহাজাগতিক কেন্দ্রের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হাত-পা নেড়ে ফোবিয়ানে যা ঘটেছে সেটা নিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে হড়বড় করে কথা বলছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো বড় একজন অপরাধীকে সার্বিকভাবে পরীক্ষা না করে ফোবিয়ানে তুলে দেয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। উপগ্রহটিতে সেই বিচিত্র প্রাণীদের নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে এবং তাদের নিয়ে গবেষণা করার বিস্তারিত পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে শুরু করেছে। ফোবিয়ানকে নিউট্রন স্টারের প্রবল মহাকর্ষ বল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্যে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে— আমি একধরনের কৌতুকমিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে তার কথা শুনতে লাগলাম। উচ্চপদস্থ কর্মচারীর দীর্ঘ বক্তব্য একসময় শেষ হলো এবং আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে বলল, অধিনায়ক ইবান, তুমি একজন মহিলার খোঁজ নেয়ার জন্যে যে ট্রেসার পাঠিয়েছিলে সেটি ফিরে এসেছে। আমি সেসংক্রান্ত তথ্য তোমাকে পাঠালাম।
আমি চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলাম, আমার মা সম্পর্কে তথ্য এসেছে যার অর্থ তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আমার বুক আনন্দে ছলাৎ করে ওঠে। মনিটরে কিছু অর্থহীন সংখ্যা এবং বিচিত্র প্রতিচ্ছবি খেলা করতে লাগল এবং হঠাৎ করে মনিটরে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে দেখতে পেলাম। মানুষটির বিষণ্ণ একধরনের চেহারা। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অধিনায়ক ইবান, আমি ঠিক কীভাবে খবরটি দেব বুঝতে পারছি না।
আমি চমকে উঠলাম, মানুষটি কী বলতে চাইছে?