লি-হান বাধা দিয়ে বলল, আসলে কোনো ক্রু থাকবে না। তুমি একা এই মহাকাশযানটি নিয়ে যাবে।
আমি চমকে উঠে বললাম, একা?
হ্যাঁ।
একটি আন্তঃনক্ষত্র অভিযানে একজন মানুষ একা একটি পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। নতুন পঞ্চম মাত্রার যে মহাকাশযানগুলো বের হয়েছে সেগুলো বিস্ময়কর। প্রকৃত অর্থেই সেখানে কোনো মানুষের প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র মহাজাগতিক আইন রক্ষা করার জন্যে এখনো অধিনায়ক হিসেবে মানুষ রাখতে হয়। তাদেরকে কর্তৃত্ব দেয়া হয়।
আমি কোনো কথা না বলে লি-হানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল, পঞ্চম মাত্রার এই মহাকাশযানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নতুন যে সিস্টেম দাঁড় করানো হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে ভালো। সত্যি কথা বলতে কী আমরা যদি নিউরণ সংখ্যা, এবং সিনান্স সংযোগ এসব দিয়ে হিসেব করি তাহলে এই সিস্টেমকে প্রায় একডজন মানুষের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন হিসেবে বিবেচনা করতে পার। যার অর্থ হচ্ছে—
আমি জানি।
লি-হান হা হা করে হেসে বলল, অবশ্যি তুমি জানো। মানুষের মস্তিষ্কের ওপর তোমার কৌতূহলের কথা সবাই জানে।
হ্যাঁ। আমি শীতল গলায় বললাম, সবাই এটাও জানে যে এটা এসেছে আমার হীনমন্যতা থেকে। যেহেতু বুদ্ধিমত্তায় আমার জিনেটিক প্রাধান্য নেই তাই আমি সবসময় বোঝার চেষ্টা করি বুদ্ধিমত্তা এসেছে কোথা থেকে। প্রচলিত বিশ্বাস এটা আমার দুর্বলতা। আমার সীমাবদ্ধতা।
লি-হান মাথা নাড়ল, বলল, না, তোমার এ ধারণা সত্যি নয়। তোমাকে আমি তোমার সম্পর্কে কমিটির রিপোর্ট দেখাতে পারব না, যদি পারতাম তাহলে দেখতে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে কমিটির পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।
কোনটি সত্যি কথা, কোনটি মিথ্যা কথা এবং কোনটি কাজ উদ্ধারের জন্যে চাটুকারিতা সেটা বোঝা আমার জন্যে কঠিন নয়। কখন কথা বলতে হয় কখন চুপ করে থাকতে হয় এবং কখন রেগে যেতে হয় এতদিনে আমি সেটাও শিখে ফেলেছি, কাজেই আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম।
লি-হান তার গলায় একটু বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস ফুটিয়ে বলল, বারোজন মানুষের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন-এর অর্থ। বুঝতে পারছ? বারোজন মানুষ নয়— বারোগুণ মানুষ— বুদ্ধিমত্তার বারোগুণ—
আমি হাত তুলে লি-হানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি জানি।
তাহলে?
তাহলে কী?
তাহলে তোমার মাঝে উৎসাহ নেই কেন?
তুমি শুনতে চাও কেন আমার মাঝে উৎসাহ নেই?
লি-হান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ শুনতে চাই।
তাহলে শোনো। আমি একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, পঞ্চম মাত্রার এই মহাকাশযানটি মাত্র তৈরি করা হয়েছে, এটা পরীক্ষা করা দরকার। এই পরীক্ষার জন্যে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হবে আমাকে— এটাই হচ্ছে। সত্যি কথা। এই সত্যি কথা যে জানে তার পক্ষে এই অভিযানে উৎসাহ পাওয়া সম্ভব নয়।
তোমার এই সন্দেহ অমূলক।
হতে পারে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার পক্ষে এই অভিযানে যাওয়া সম্ভব নয়।
ভেবে দেখ ইবান। তুমি সবসময়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা, মানুষের নৈতিকতা, মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন এবং ভালোবাসা নিয়ে ভেবেছ। পৃথিবীর বড় বড় মানুষকে নিয়ে তোমার কৌতুহল। তারা কেমন করে ভাবে, কেমন করে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে সেটা জানতে চেয়েছ। এই প্রথম তোমার সুযোগ এসেছে পৃথিবীর সেরা মনীষীদের মুখোমুখি হবার। পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়ার জন্যে তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কই১২ শুধুমাত্র তোমাকে সেই সুযোগ দেবে। তুমি ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সেরা মনীষীদের মস্তিষ্ক ম্যাপিং১৩ সাথে নিয়ে যেতে পারবে। তোমার দীর্ঘ এবং নিঃসঙ্গ যাত্রাপথে তারা তোমার চমৎকার সঙ্গী হতে পারে। তোমার সারা জীবনের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার—
আমি হাত নেড়ে বললাম, তোমার বক্তৃতার জন্যে ধন্যবাদ লি-হান। কিন্তু আমি তোমার এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না।
লি-হান কোনো কথা না বলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি মাথা নেড়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। আমার পিছনে স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন লি-হান আমাকে ডাকল, ইবান।
আমি ঘুরে তাকিয়ে বললাম, কী হলো?
আমার ধারণা তুমি কিন্তু শেষপর্যন্ত আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে এই অভিযানে যাবে।
আমি তীক্ষ্ণ চোখে লি-হানের দিকে তাকালাম, সে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল। আমি কঠিন গলায় বললাম, কেন? তুমি কেন ভাবছ আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হব?
কারণ, তোমার একটা চিঠি এসেছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, চিঠি?
হ্যাঁ।
কার চিঠি?
তোমার মায়ের।
আমার মায়ের?
হ্যাঁ। আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা কী লিখেছে চিঠিতে?
আমি জানি না। আন্তঃমহাজাগতিক যোগাযোগ কেন্দ্র থেকে সবেমাত্র পাঠিয়েছে। লি-হান তার ড্রয়ার থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল।
আমি ক্রিস্টালটি হাতে নিয়ে লি-হানের দিকে তাকালাম। সে আবার একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, চিঠিটা এসেছে রিশি নক্ষত্রের কাছাকাছি মানুষের কলোনি থেকে। মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জ পার হয়ে যেই কলোনিতে যেতে হয়।
লি-হান উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে আবার আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ইবান, তুমি খুব সৌভাগ্যবান যে একজন মায়ের গর্ভে তোমার জন্ম হয়েছে। তুমি জানো আমার জন্ম হয় নি, আমাকে জিনম ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে! ফ্যাক্টরিতে যেভাবে মহাকাশযানের ইঞ্জিন তৈরি করা হয়, সেভাবে!