আমি শব্দ করে হেসে বললাম, আমার মা আমার এই সর্বনাশটি করে গেছেন! বিশ্বজগতের সব মানুষ যখন বুদ্ধি প্রতিভা সৌন্দর্য, শক্তি সৃজনশীলতা নিয়ে জন্ম হচ্ছে তখন আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে!
সত্যি?
হ্যাঁ, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে শুধুমাত্র এই একটি জিনিসই আমাকে দেয়া হয়েছে। আমার জন্ম হয়েছে। একজন দুর্বল মানুষ হয়ে, আমি বড় হয়েছি দুর্বল মানুষ হিসেবে!
মিত্তিকা সুন্দর করে হেসে বলল, ভালোবাসা দুর্বলতা নয় ইবান। তোমার মা চমৎকার একজন মানুষ নিজের সন্তানকে এর চাইতে ভালো কী দেয়া যায়?
আমি মাথা নাড়লাম, যখন বড় হওয়ার জন্যে আমি কষ্ট করেছি তখন এই গুণটি আমার খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় নি।
তোমার মা এখন কোথায় আছেন?
তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে রিশি নক্ষত্রের কলোনির কাছাকাছি কোথাও আছেন। আমি আসলে সেজন্যেই যাচ্ছি, মায়ের সাথে দেখা করব! এই সৌভাগ্য- বৃক্ষটা আমি মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।
ইশ! কী মজা।
হ্যাঁ, আমি খুব অপেক্ষা করে আছি। ফোবিয়ানের যোগাযোগ মডিউলটা হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেল— এটা ঠিক করে আমি চারপাশে ট্রেসার পাঠানো শুরু করব। খুঁজে বের করতে হবে আমার মা কোথায় আছেন।
মিত্তিকা সুন্দর করে হেসে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, তুমি খুব সৌভাগ্যবান ইবান, তোমার একজন প্রিয় মানুষ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার কেউ নেই।
আমার হঠাৎ করে বলার ইচ্ছে করল, মিত্তিকা আমি আছি, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব। কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একজন প্রিয়জন পাবে মিত্তিকা। নিশ্চয়ই পাবে।
মিত্তিকা কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে হাসল। তার সেই হাসি দেখে হঠাৎ কেন জানি আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল।
মিত্তিকা তার নিও পলিমারের পোশাক পরে কালো ক্যাপসুলে শুয়ে আছে। আমি খুব ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নিচে নামিয়ে আনলাম, মিত্তিকা শেষ মুহূর্তে ফিসফিস করে বলল, ভালো থেকো ইবান।
আমিও নরম গলায় বললাম, তুমিও ভালো থেকো মিত্তিকা।
মিত্তিকা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, বিদায়।
বিদায় মিত্তিকা।
আমি ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নামিয়ে সুইচটা স্পর্শ করতেই স্বয়ংক্রিয় জীবন রক্ষাকারী প্লাজমা জ্যাকেটের হালকা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। ক্যাপসুলের স্বচ্ছ ঢাকনা দিয়ে আমি মিত্তিকাকে দেখতে পেলাম খুব ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ। হয়ে আসছে। ক্যাপসুলের মাঝে শীতল একটি প্রবাহ বইতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে গভীর ঘুমে অচেতন। হয়ে পড়বে। আমি একদৃষ্টে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, মনে হলো এই সাদামাটা সরল মেয়েটি আমার জীবনের বড় একটা অংশকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেল।
শীতল কক্ষ থেকে বের হয়ে আমি ফোবিকে ডাকলাম। ফোবি সাথে সাথে উত্তর দিল, বলল, বলুন মহামান্য ইবান।
ফোবিয়ান তো প্রায় ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বলা যায় একটি বিপজ্জনক অবস্থা।
আপনি ঠিকই বলেছেন।
সবচেয়ে জরুরি কাজ কোনটি? কোন কাজটা দিয়ে শুরু করব?
সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে যোগাযোগ মডিউলটি ঠিক করা। ত্বরণের প্রথম ধাক্কাটা লাগার সাথে সাথে প্রচণ্ড ঝাকুনিতে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। গত ছত্রিশ ঘণ্টা এখান থেকে কোনো সংকেত যায় নি। মহাজাগতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের লোকজন ভাবতে পারে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি!
বেশ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তাহলে এটা দিয়েই শুরু করা যাক।
আপনি এটা দিয়ে শুরু করতে পারবেন না মহামান্য ইবান। মূল নিয়ন্ত্রণটি না সারিয়ে আপনি কিছুতেই যোগাযোগ মডিউল সারাতে পারবেন না। আবার মূল নিয়ন্ত্রণ সারিয়ে তোলার আগে দেওয়ালের সূক্ষ্ম ফাটলগুলো বন্ধ করতে হবে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার রবোট ছেড়ে দাও, কাজে লেগে যাই।
আমি প্রায় একডজন ইঞ্জিনিয়ার রবোট নিয়ে কাজে লেগে গেলাম। মহাকাশযানের বাইরে থেকে মাইক্রো স্ক্যানার দিয়ে সূক্ষ্ম ফাটলগুলো খুঁজে বের করে ইঞ্জিনিয়ার রবোটদের নিয়ে সেগুলো ওয়েল্ড করে সারিয়ে তুলতে লাগলাম। প্রায় একটানা কাজ করে যখন দেখতে পেলাম শরীর আর চলছে না তখন আমি মহাকাশযানের ভিতরে ফিরে এলাম, এসে দেখি মহামান্য রিতুন ক্লিস আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনি?
হ্যাঁ! তোমার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।
বিদায়?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটি তুমি চমৎকারভাবে গুছিয়ে নিয়েছ। আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনার প্রয়োজন কখনোই ফুরাবে না মহামান্য রিতুন। আপনি সাহায্য না করলে আমি কখনোই এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতাম না।
রিতুন ক্লিস হেসে বললেন, সেটি সত্যি নয়। যেটি করার সেটি তুমি নিজেই করেছ।
কিন্তু কী করতে হবে আমি জানতাম না। তুমি জানতে ইবান।
তুমি এখনো জানো। নিজের উপরে বিশ্বাস রেখো।
রাখব।
রিতুন ক্লিস কাছাকাছি এসে বললেন, আমি সত্যিকারের মানুষ হলে তোমাকে স্পর্শ করতাম। সত্যিকারের মানুষ নই বলে স্পর্শ করতে পারছি না।
আমি বললাম, আমার কাছে আপনি তবুও সত্যিকারের মানুষ।
শুনে খুশি হলাম। রিতুন ক্লিস আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাবার আগে একটা শেষ কথা বলে যাই?
বলুন।
আমি সত্যিকারের মানুষ নই। যারা সত্যিকারের মানুষ তাদের নিয়ে কখনো নিজের সাথে প্রতারণা কোরো না।