ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু তাহলে সেই মানুষটি তো ম্যাঙ্গেল ক্বাস থাকবে না, সেটি হবে অন্য একজন মানুষ। আমি কি অন্য মানুষ হতে চাই?
আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তার এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার দুই অনুচর ক্লদ এবং মুশকে তাদের ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে, দেহগুলোকে শীতল করে দীর্ঘসময়ের জন্যে সংরক্ষণ করতে আমার এবং মিত্তিকার দীর্ঘ সময় লেগে গেল। সত্যি কথা বলতে কি মিত্তিকা না থাকলে আমার একার পক্ষে এ কাজগুলো করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। ক্লদ এবং মুশ খুব সহজেই তাদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিল কিন্তু ম্যাঙ্গেল কাসের জন্যে সেটি ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। ক্যাপসুলের কালো ঢাকনাটি যখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিল তখনো সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় তাকে হত্যা করার জন্যে অনুরোধ করে যাচ্ছিল। কোনো একটি বিচিত্র কারণে ম্যাঙ্গেল ক্বাস বুঝতে পারছিল না যে আসলে তার মৃত্যু ঘটে গেছে। একজন মানুষ যখন এভাবে মৃত্যু কামনা করে তখন তার বেঁচে থাকা না-থাকায় আর কিছু আসে যায় না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আর তার দুজন অনুচরকে নিরাপদে সংরক্ষণ করার পর আমি প্রথমবার ফোবিয়ানের দিকে নজর দিলাম, নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণ থেকে বের হয়ে আসার জন্যে যে প্রচণ্ড শক্তিক্ষয় হয়েছে তার চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিয়ন্ত্রণের মূল অংশটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জরুরি অংশটি কোনোভাবে কাজ করছে। তাপ। সঞ্চালনের অনেকগুলো টিউব দুমড়ে মুচড়ে ফেটে গেছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একটি বড় অংশ অচল হয়ে আছে। ফোবিয়ানের দেওয়ালের কোথাও কোথাও সূক্ষ্ম ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, ভেতর থেকে বাতাস বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় ফোবিয়ানের অনেকগুলো অংশের জরুরি চাপ নিরোধক দরজা পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে আছে। যোগাযোগ মডিউলের কিছু অংশও অকেজো হয়ে আছে, গন্তব্য স্থানে নিয়মিত যে সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছিল সেটি বন্ধ হয়ে গেছে, সেটি আবার চালু করে না দিলে মহাজাগতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ধারণা করতে পারে ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের আকর্ষণে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এখন প্রচুর কাজ। কিছু কিছু এই মুহূর্তে শুরু করতে হবে।
কিন্তু সব কাজ শুরু করার আগে আমার মিত্তিকাকে তার শীতল ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। এই মহাকাশযানটিতে শুধুমাত্র তার অধিনায়কের থাকার কথা— এটি সেভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে আমার মিত্তিকাকে শীতল ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না— ইচ্ছে করছিল তাকে আমার পাশাপাশি রেখে দেই, কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। সে মহাকাশযানের একজন যাত্রী তাকে নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হবে। একজন যাত্রীকে সারাক্ষণ তার শীতল ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে থাকার কথা, আর এখন এই মহাকাশযানের মোটামুটি বিপজ্জনক পরিবেশে তাকে বাইরে রাখা বেআইনি এবং বিপজ্জনক; একজন মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমি কোনো অবস্থাতেই সেটি করতে পারি না। মিত্তিকা নিজেও সেটা জানে কাজেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার দুজন অনুচরকে ঘুম পড়িয়ে দেয়ার পর সে আমাকে বলল, এবার আমার পালা।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ।
মহাকাশযানের যে অবস্থা আমার মনে হচ্ছে তোমাকে সাহায্য করতে পারলে হতো কিন্তু তুমি তো জান আমি মহাকাশযানের কিছুই জানি না।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, আমি জানি। তোমার জানার কথা নয়। আমাকে দীর্ঘদিনে এসব শিখতে হয়েছে।
মিত্তিকা চোখে একটু দুশ্চিন্তা ফুটিয়ে বলল, তুমি কি একা এইসব কাজ শেষ করতে পারবে?
আমার ইচ্ছে হলো বলি, না, পারব না। তুমি আমার পাশে থাকো কিন্তু আমি সেটা মুখ ফুটে বলতে পারলাম। বললাম, পারব মিত্তিকা। আমাকে সাহায্য করার জন্যে সাহায্যকারী রবোটগুলি চালু করে দেব। নিউরাল নেটওয়ার্কে সব তথ্য রাখা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।
মিত্তিকা কিছু বলল না একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, এই মহাকাশযানের যাত্রী হওয়ার কারণে তোমার অনেক দুর্ভোগ হলো মিত্তিকা। ফোবিয়ানের অধিনায়ক হিসেবে আমি আন্তরিকভাবে তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। তুমি যদি চাও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারি।
মিত্তিকা শব্দ করে হেসে বলল, এর প্রয়োজন নেই ইবান, অধিনায়ক হিসেবে তুমি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পার— কিন্তু আমি কী করব? আমার তো কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা নেই, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাব?
ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই মিত্তিকা। আসলে আমরা খুব সৌভাগ্যবান তাই এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর রাখা কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে সৌভাগ্য-বৃক্ষটিকে দেখিয়ে বললাম, এই সৌভাগ্য-বৃক্ষে এতক্ষণ ফুল ফুটে যাওয়া উচিৎ ছিল।
ঠিকই বলেছ। আমরা যে সৌভাগ্যবান সেটা জানার জন্যে আমাদের যেটুকু সময় বেঁচে থাকার দরকার ছিল তুমি থাকলে সেটা সম্ভব হতো না।
আমি কোনো কিছু না বলে একটু হাসলাম। মিত্তিকা একটু এগিয়ে এসে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমার কাছে আরো একটি ব্যাপারে কৃতজ্ঞ ইবান।
কী ব্যাপার?
আমি তোমার কাছে প্রথম দেখতে পেয়েছি যে অন্য মানুষের জন্যে ভালোবাসা থাকতে হয়। নিজের ক্ষতি করে। হলেও অন্যের ভালো দেখতে হয়!