মিত্তিকা আতঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় আছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস?
এসো আমার সাথে, দেখবে।
না। মিত্তিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দেখব না, আমি দেখব না।
দেখতে না চাইলে দেখো না, কিন্তু আমার মনে হয় এখন যদি তাকে দেখো তোমার খুব খারাপ লাগবে না।
কেন?
কারণ সে আর হাইব্রিড মানুষ নেই। তার ভেতরের যেটুকু অংশ যন্ত্র ছিল সেটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যেটা একসময় তার শক্তি ছিল এখন সেটা তার দুর্বলতা।
মিত্তিকা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো সে আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কে তাকে ধ্বংস করল? কীভাবে করল? কখন করল?
সে অনেক বড় ইতিহাস। আমি একটু হেসে বললাম,তুমি আমার সাথে চলো নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
মিত্তিকা অপারেশন থিয়েটার থেকে নেমে এল। আমি তার হাত ধরে তাকে নিয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকলাম।
ক্লদ এবং মুশ আলাদা আলাদা দুটি চেয়ারে বসেছিল, তাদের হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধা। আমাকে দেখে ক্লদ বলল, মহামান্য অধিনায়ক, আমার হাত দুটো খুলে দেবেন?
কেন?
অনেকক্ষণ থেকে আমার নাকের উপরের অংশ চুলকাচ্ছে।
আমি রক্তে মাখামাখি হয়ে থাকা এই মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করলাম, একসময়ে নিশ্চয়ই তারা চমৎকার মানুষ ছিল, ম্যাঙ্গেল কাস তাদেরকে আধা-মানুষ আধা-জন্তুতে পরিণত করে দিয়েছে। আমি জানি না তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা আবার ঠিক করে দিয়ে আবার তাদের স্বাভাবিক মানুষে তৈরি করে দেয়া যাবে কি না।
ক্লদ আবার অনুনয় করে বলল, মহামান্য অধিনায়ক ইবন, আপনি কি আমার হাত দুটি খুলে দেবেন?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না ক্লদ। সেটি সম্ভব নয়। আমি ঠিক জানি না তোমরা ব্যাপারটির গুর ত্বটুকু ধরতে পেরেছ কি না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস তোমাদের মস্তিষ্কে একধরনের অস্ত্রোপচার করে তোমাদের স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা অনেকটুকু নষ্ট করে দিয়েছে। আমার পক্ষে এখন কোনো ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।
ক্লদ কাতর মুখে বলল, আপনি বিশ্বাস কর ন মহামান্য ইবান আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না।
মুশও গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমিও ক্ষতি করব না।
আমিও মাথা নাড়লাম, আমি দুঃখিত ক্লদ এবং মুশ, তোমাদের আরো একটু কষ্ট করতে হবে। আমি কিছুক্ষণের মাঝে তোমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করব।
ক্লদ এবং মুশ নেহায়েৎ অপ্রসন্ন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি মিত্তিকাকে নিয়ে আরো একটু এগিয়ে গেলাম, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের একেবারে কোনার দিকে আমি ম্যাঙ্গেল কাসকে বেঁধে রেখেছি। তাপ পরিবহনের টিউবগুলো যেখানে ঘরের মেঝেতে নেমে এসেছে সেখানে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দুটি হাত ছড়িয়ে আলাদা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে, আমি সেখানেও কোনো ঝুঁকি নিই নি, দুটি পা শক্ত করে বেঁধে রেখেছি। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে দেখে মিত্তিকা আতঙ্ক চিৎকার করে আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আমি ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা, ভয় পাবার কিছু নেই। যখন তাকে ভয় পাবার কথা ছিল তখন যেহেতু তাকে ভয় পাও নি এখন ভয় পেয়ো না।
মিত্তিকা ভাঙা গলায় বলল, কিন্তু, দেখো কী বীভৎস! কী ভয়ানক!
আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই বীভৎস, সত্যিই ভয়ানক। একটি চোখ খুলে ঝুলছে, চোখের গর্ত থেকে কিছু ফাইবার বের হয়ে আছে, মুখের ভেতর থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের হয়ে আসছে, কিছু গালের চামড়া ফুটো করে ফেলেছে। হাত এবং পায়ের নানা অংশ থেকে ধাতব অংশ শরীরের চামড়া ফুটো করে বের হয়ে এসেছে, সেসব জায়গা থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস যখন হাইব্রিড় মানুষ ছিল তখন তার যন্ত্র এবং মানব-অংশের মাঝে চমৎকার একটি সমন্বয় ছিল, এখন নেই। এখন দেখে ভিতরে একটি আতঙ্ক হতে থাকে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার ভালো চোখটি দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল, একটি যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে বলল, ইবান, আমি তোমাকে বলছি আমাকে কীভাবে হত্যা করতে হবে। সে কথাগুলো বলল খুব কষ্ট করে তার উচ্চারণ হলো অস্পষ্ট এবং জড়িত।
আমি বললাম, আমি সেটা জানতে চাই না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অনুনয় করে বলল, একটা চতুর্থ মাত্রার অস্ত্র নিয়ে আমার চোখের ফুটো দিয়ে উপরের দিকে লক্ষ্য করে গুলি করলে মস্তিষ্কটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা শুনে মিত্তিকা শিউরে উঠল, আমি তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস, আমি তোমাকে হত্যা করব না। তোমাকে হত্যা করাই যদি আমার উদ্দেশ্য হতো আমি তাহলে তোমাকে ঐ উপগ্রহটিকে তোমার মৃত বন্ধুদের সাথে রেখে আসতে পারতাম।
তুমি তাহলে আমাকে কী করতে চাও?
তোমাকে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে চাই।
আমি ভেবেছিলাম তুমি ভালো মানুষ। তুমি কাউকে কষ্ট দিতে চাও না।
আমি আসলেই কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।
তাহলে কেন তুমি আমাকে হত্যা করছ না?
কারণ আমি দীর্ঘদিন চিকিৎসাবিজ্ঞানের খোঁজ রাখি নি হয়ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে, হয়ত তারা তোমার মস্তিষ্ক সারিয়ে তুলতে পারবে, তুমি হয়ত আবার একজন সাধারণ মানুষ হয়ে যাবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার বিচিত্র যান্ত্রিক মুখ দিয়ে অবিশ্বাসের মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, তুমি সত্যিই সেটা বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ করি।