লিহান অবাক হবার ভান করে বলল, তাতে কী হয়েছে? মহাজগতে মানুষ ছাড়াও যে প্রাণী রয়েছে সেটি তো আর নতুন কোনো ব্যাপার নয়!
না সেটি নতুন ব্যাপার নয়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু সেই প্রাণী যদি বুদ্ধিমান হয়, সেই প্রাণী যদি ভয়ঙ্কর হয়, সেই প্রাণী যদি মানুষের প্রতি শত্র ভাবাপন্ন হয় এবং মানুষ যদি সেই প্রাণী সম্পর্কে কিছু না জানে তাহলে মানুষ তাদের ধারেকাছে যায় না। সে-সম্পর্কে সুস্পষ্ট মহাজাগতিক আইন রয়েছে। আমাকে সেদিক দিয়ে পাঠিয়ে তোমরা মহাজাগতিক আইন ভাঙার চেষ্টা করছ।
লি-হানের মুখ একটু অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। সে শীতল গলায় বলল, তুমি যদি যেতে না চাও তাহলে যাবে না, আমি ভেবেছিলাম এটি তোমার জন্যে একটি চমৎকার সুযোগ।
কোনটি সুযোগ আর কোনটি আমাকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র সেই সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে দাও। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পঞ্চম মাত্রার এই মহাকাশযানে আমাকে কী কারগো নিতে হবে?
লিহান বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমি বাজী ধরে বলতে পারি সেই কারগো হবে দূষিত, বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক কোনো জিনিস। যে জিনিস ধ্বংস হয়ে গেলে তোমাদের কারো কোনো মাথাব্যথা হবে না। হয়ত এমনও হতে পারে যে তোমরা চাও সেই কারগো ধ্বংস হয়ে যাক।
লি-হান এবারে তার মুখ একটু কঠিন করে বলল, তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছ ইবান। এই অভিযানের কারগো খুব গুরত্বপূর্ণ।
সেটি কী?
তুমি যতক্ষণ এই যাত্রাপথে যেতে রাজি না হচ্ছ আমি তোমাকে সেটা বলতে পারব না।
কিন্তু আমি যতক্ষণ জানতে না পারছি আমাকে কী কারগো নিয়ে যেতে হবে ততক্ষণ আমি রাজি হতে পারছি না।
লি-হান ভুরু কুঁচকে কতক্ষণ কিছু-একটা চিন্তা করে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি তোমাকে বলছি। তোমার কারগো আসলে জীবন্ত একজন মানুষ।
মানুষ?
হ্যাঁ। মানুষটির নাম হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হচ্ছে—
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমাকে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের পরিচয় দিতে হবে না, আমি তাকে চিনি।
তুমি দেখেছ আমার ধারণা সত্যি? মহাকাশযানের কারগো সত্যি-সত্যি দূষিত, বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক?
লি-হান শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কোনো কথা বলল না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, বেগুনি রংয়ের আলোটাতে একটা কালচে গা-ঘিনঘিন-করা ভাব। চলে এসেছে, দেখেই কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই সময়কার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ মহাকাশ-দস্যু। সাধারণত একটি স্বার্থ নিয়ে দুদলের মাঝে সংঘর্ষ বেধে যায় এবং একদল অন্য দলকে দস্যু বলে সম্বোধন করে। মহাজাগতিক অনেক কলোনিতেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে ছোট ছোট মানবগোষ্ঠী বিদ্রোহ করেছে এবং অনেক সময় তাদেরকে দস্যু আখ্যা দিয়ে খুব নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের ব্যাপারটি সেরকম নয়— সে প্রকৃত অর্থেই দস্যু, ছোট সুগঠিত একটা দল নিয়ে সে মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি থাকে, অত্যন্ত কৌশলে সে আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশযানগুলোকে দখল করে নেয়। মহাকাশযানের কুদের প্রতি আমানুষিক নিষ্ঠুরতা নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। মানুষটি সুদর্শন এবং বুদ্ধিমান, আধুনিক প্রযুক্তি সে খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে। মানুষের মস্তিষ্কের উপর তার মৌলিক গবেষণা রয়েছে বলেও শোনা যায়। মহাজাগতিক প্রতিরক্ষাবাহিনী অনেকদিন থেকে তাকে ধরার চেষ্টা করছিল এবং মাত্র কিছুদিন আগে তাকে ধরতে পেরেছে। বিচারের জন্যে তাকে আঞ্চলিক কেন্দ্রে পাঠাতে হবে— আমি অবশ্যি মনে করি এত ঝামেলা না করে প্রতিরক্ষাবাহিনীই তার বিচার করে শাস্তি দিয়ে ফেলতে পারত। এই ভয়ঙ্কর মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখা আসলে বিপদকে ঘরে টেনে আনা ছাড়া আর কিছু নয়।
আমার সামনে বসে থাকা লি-হান এবারে একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সত্যিই যেতে চাও না?
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো চরিত্রকে নিয়ে যাওয়াটা কি তুমি খুব আকর্ষণীয় কাজ মনে কর?
কিন্তু তাকে শীতল করে পাথরের মতো জমিয়ে ফেলা হবে, টাইটেনিয়ামের ভল্টের মাঝে পাকাপাকিভাবে আটকে রাখা হবে। মহাকাশযানের কারগো-বে তে তাকে মালপত্র হিসেবে নেয়া হবে— মানুষ হিসেবে নেয়া হবে না।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, সত্যি কথা বলতে কী তোমরা যদি মানুষটিকে শীতলঘরে করে না নিতে, যদি তার সাথে কথা বলা যেত তাহলে আমার একটু আগ্রহ ছিল। আমি কথা বলে দেখতাম এই ধরনের মানুষেরা কীভাবে চিন্তা করে।
না, তোমার সেই সুযোগ নেই। লি-হান মাথা নেড়ে বলল, একেবারেই নেই।
মহাকাশযানের অন্য কুদের কীভাবে বেছে নিচ্ছ?
আমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ করে লি-হান নিজের নখের দিকে তাকিয়ে সেটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করল এবং আমি বুঝতে পারলাম এ-ব্যাপারেও নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা রয়েছে। আমি আবার টের পেলাম আমার ভিতরে। একটা শীতল ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে কষ্ট করে শান্ত করে আমি একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে বললাম, এই ক্রুয়ের ব্যাপারটাও তাহলে আমি অনুমান করার চেষ্টা করি। আমার ধারণা এই অভিযানে ক্রু হিসেবে যাবে এমন কিছু মানুষ যাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। আমার মতো—