এই মহাকাশযানটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এর মাঝে কোনো মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়।
কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ মানুষ বেঁচে আছে।
হ্যাঁ, কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব হলো? আমি বুঝতে পারছি না।
এটা নিয়ে এখন মাথা না ঘামিয়ে চলো ভিতরে যাওয়া যাক।
চল।
আমরা ঘুরে ঘুরে ভেতরে ঢোকার দরজা খুঁজে বের করলাম, সেই দরজা ধাক্কা দিতেই সেটা কঁাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে সবুজ রংয়ের ধুলোর আস্তরণ এবং ঘােলাটে একধরনের অন্ধকার। মাথায় লাগানো উজ্জ্বল। আলোতে দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে থাকি, প্রথমে আমি, আমার পিছনে মিত্তিকা এবং সবার শেষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু আমাদের সবার হাত অস্ত্রের ট্রিগারে চলে এসেছে, এই বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে একধরনের অশুভ আতংকের চিহ্ন রয়েছে।
সর করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা আরো বড় একটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, শক্ত দরজা এমনিতে খোলা যাচ্ছিল না, পা দিয়ে কয়েকবার লাথি দেবার পর সেটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকালাম, এখানেও কেউ নেই। আমরা মোটামুটি একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে এটি বাঁকা হয়ে আছে, একসময় এখানে আলো এবং বাতাস ছিল এখন কোথাও কিছু নেই, একটি থমথমে নীরবতা।
মিত্তিকা আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, আমার ভয় করছে।
আমি তার পিঠে হাত দিয়ে বললাম, ভয়ের কিছু নেই মিত্তিকা। আমরা আছি না?
জানি, তবু কেমন জানি ভয় লাগছে।
ভয় লাগার ব্যাপারটি হাস্যকর বোঝানোর জন্যে আমি শব্দ করে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পদ্ধতিটা খুব ভালো কাজ করল না।
ঢাল বেয়ে সাবধানে নিচে নেমে এসে আমরা আধা গোলাকার আরেকটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, এই দরজার ফাক দিয়ে হলদে রংয়ের ঘােলাটে একধরনের আলো বের হচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস খুশি-খুশি গলায় বলল, এই যে, সবাই নিশ্চয়ই এখানে আছে।
আমি দরজাটিতে হাত দিয়ে শব্দ করলাম, এবং ভেতর থেকে একধরনের শব্দ হলো, মনে হলো কেউ একজন প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি সাবধানে দরজাটি ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকলাম, মাঝারী অসমতল একটি ঘর, সম্ভবত ইঞ্জিন কক্ষ। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন মানুষ ছিন্নভিন্ন পোশাকে, ধুলো এবং কালি মাখা অবস্থায়। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। মানুষগুলোর বসে থাকার মাঝে একধরনের অস্বাভাবিকতা রয়েছে যেটি দেখে আমার বুকের মাঝে ধক করে উঠল।
আমার পিছু পিছু মিত্তিকা এবং সবার পরে ম্যাঙ্গেল কাস ঘরটিতে এসে ঢুকল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে খুব বিচলিত মনে হলো না, কিন্তু মিত্তিকা ছোট একটা আর্তচিৎকার করে আমাকে পিছন থেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আমি নিচু গলায় বললাম, কী হয়েছে মিত্তিকা?
মিত্তিকা কাঁপা গলায় বলল, এরা কারা? আমার ভয় করছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, বাড়াবাড়ি ভয় পাবার কিছু নেই, এরা আমার লোকজন। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দুই হাত ওপরে তুলে অভিবাদন করার ভঙ্গি করে বলল, কী খবর, কেমন আছ তোমরা?
মানুষগুলো যারা সংখ্যায় ছয়জন, যাদের মাঝে পুরষ, মহিলা এবং পুর ষও নয় মহিলাও নয় এরকম মানুষ রয়েছে, ম্যাঙ্গেল কৃাসের অভিবাদনে খুব বেশি অনুপ্রাণীত হলো না। কাছাকাছি যে বসেছিল শুধুমাত্র সে যান্ত্রিকভাবে একটা হাত উপরে তুলল।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস গলার স্বরে আরো আন্তরিকতা ফুটিয়ে বলল, তোমরা এই ভয়ংকর দুর্ঘটনায় বেঁচে যাবে সেটা আমি আশা করি নি, বলা যেতে পারে এটি একটি ম্যাজিকের মতো।
মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না, পিছনে বসে থাকা একজন মানুষ, যার শারীরিক গঠন দেখে মহিলা বলে অনুমান করলাম— ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিজে থেকে আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, খিলা অনেকদিন পর তোমাদের দেখা পেলাম। তোমাদের আর দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।
খিলা নামের মেয়েটি খসখসে গলায় বলল, আমাদের নিয়ে যাবে?
মেয়েটির গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠলাম, গলার স্বরটি আশ্চর্য রকমের প্রাণহীন এবং যান্ত্রিক।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ নিয়ে যাব। অবশ্যি নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাবে?
আমার সাথে। আমাদের দল আবার নতুন করে তৈরি করব। সবাই মিলে নতুন অভিযান হবে। নতুন অস্ত্র, নতুন। প্রযুক্তি অনেক পরিকল্পনা আছে।
সামনে বসে থাকা ভয়ঙ্করদর্শন মানুষটি মুখ উঁচু করে মোটা গলায় বলল, মানুষ থাকবে সেখানে?
মানুষ? ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে বলল, মানুষ থাকবে না কেন ইরি। অবশ্যই থাকবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা শুনে ইরি নামের ভয়ংকরদর্শন মানুষটি হঠাৎ কেমন জানি খুশি হয়ে উঠল, সে তার শরীর দুলিয়ে বিচিত্র একটি আনন্দহীন হাসি হাসতে শুরু করে। ইরি নামের মানুষটির হাসি দেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা আরো কয়েকজন মানুষ হাসতে শুরু করে, আনন্দহীন ভয়ংকর একধরনের হাসি, শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তাদের হাসি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তোমরা এতদিন এখানে কেমন ছিলে বল?
প্রথমে কেউ কোনো কথা বলল না, এবং হঠাৎ করে পিছন থেকে না-পুরষ না-মহিলা এই ধরনের সবুজ রংয়ের চুলের একটি মানুষ বলল, জানি না।