এখানে কেমন করে আটকা পড়ল?
মহাজাগতিক নিরাপত্তারক্ষীর সাথে সংঘর্ষ হয়ে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল।
তারা নিশ্চয়ই খুব সৌভাগ্যবান যে মহাকাশযান বিধ্বস্ত হওয়ার পরও প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস বলল, শুধু সৌভাগ্য নয়, এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কিছু কৃতিত্ব রয়েছে। আমি বলেছি তারা চৌকস।
নিরাপত্তারক্ষী বা সৈনিক কিংবা কলকারখানার চৌকস হলে সেটি আমি বুঝতে পারি কিন্তু একটা দস্যুদলকে যখন চৌকস বলা হয় তার অর্থ ঠিক কী আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু সেটা নিয়ে আমি আর কোনো প্রশ্ন না করাই বুদ্ধিমান কাজ বলে মনে করলাম। আমি স্কাউটশিপের ভল্ট খুলে সেখান থেকে পোশাক বের করে পরে নিতে শুরু করি। এই উপগ্রহের বায়ুমণ্ডলে শুধু যে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই তা নয় এটা রীতিমতো বিষাক্ত। স্কাউটশিপের সামনে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে আমি আমার হাতে তুলে নিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস চোখের কোনা দিয়ে আমাকে লক্ষ করল কিন্তু কিছু বলল না। আমি মোটামুটি একটা হালকা অস্ত্র তুলে নিয়ে মিত্তিকার হাতে তুলে দিলাম, সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
এটা দিয়ে কী করব?
হাতে রাখ, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ব্যবহার করবে।
আমি অস্ত্র ব্যবহার করতে জানি না।
আমি হেসে বললাম, শুনে খুব খুশি হলাম। আশা করছি এই বিদ্যেটা কখনো যেন তোমার শিখতে না হয়। কিন্তু যেটা ব্যবহার করতে জানি না সেটা হাতে নিয়ে কী করব?
এটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র— তোমাকে কিছু করতে হবে না।
মিত্তিকা কী বুঝল কে জানে, শেষপর্যন্ত অস্ত্রটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে পিঠে ঝুলিয়ে নিল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস অস্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখে ভারী একটা অস্ত্র হাতে তুলে নিল, তার হাতে অস্ত্র নেয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল সে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এই অস্ত্র হাতে কাটিয়েছে।
স্কাউটশিপের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আমরা জরুরি সরবরাহের ব্যাক পেকটি পিঠে নিয়ে গোলাকার দরজার কছে এসে দাঁড়ালাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে আগে বের হওয়ার জন্যে ইঙ্গিত করল— সেটাই স্বাভাবিক। আমার পিছু পিছু মিত্তিকা এবং সবার শেষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস নেমে এল।
বাইরে একধরনের অস্থিতিশীল আবহাওয়া, হুহু করে সবুজ রংয়ের একধরনের বাতাস বইছে। আকাশে সবসময়ে। একধরনের আলো, কখনো বাড়ছে কখনো কমছে বলে চোখের রেটিনা কিছুতেই অভ্যস্ত হতে পারছে না। চারিদিকে ধূসর উঁচুনিচু প্রান্তর, নানা আকারের পাথর, কিছু কিছু একধরনের তরলে ডুবে আছে, তরলের ভিতর থেকে বড় বড় বুদবুদ বের হয়ে আসছে মিত্তিকা ঠিকই বলেছে, নরক বলা হলে চোখের সামনে যে ছবিটি ফুটে ওঠে সেটি অনেকটা এরকম।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলের মানুষদের সংকেত এখন অনেক শক্তিশালী, ইচ্ছে করলে তাদের চেহারাও দেখা যাবে। কিন্তু আমরা আর সে চেষ্টা না করে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের চোখের সামনে লাগানো গ্যালাক্টিক অবস্থান নির্ধারণ মডিউলে ২৮ দেখতে পাচ্ছি কমপক্ষে তিরিশ মিনিটের মতো হাঁটতে হবে। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কেমন লাগছে মিত্তিকা?
মিত্তিকা বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই পোশাক পরে অভ্যাস নেই তো তাই খুব সুবিধে করতে পারছি না।
আমি উৎসাহ দিয়ে বললাম, কে বলছে পারছ না? এই তো চমৎকার হাঁটছ।
কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে।
কমবয়সী এই মেয়েটির জন্যে আমার মায়া হলো, শুধুমাত্র ভাগ্যের দোষে মহাজাগতিক একজন দস্যুর হাতে ধরা পড়ে তার এক অজানা উপগ্রহের অস্থিতিশীল আবহাওয়ার মাঝে হেঁটে হেঁটে আরো কিছু ঘাঘু অপরাধীদের উদ্ধার করতে যেতে হচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সাথে তার সঙ্গীসাথিরা একত্র হলে পুরো পরিবেশটা কেমন হবে চিন্তা করে আমি নিজের ভিতরে একধরনের অশান্তি বোধ করতে শুরু করেছি।
আমি মিত্তিকার পিঠে হাত দিয়ে বললাম, এই তো আমরা এসে গেছি।
কথাটি পুরোপুটি সত্যি নয় কারণ তার পরেও আমাদের প্রায় আরো একঘণ্টা হাঁটতে হলো এবং উপগ্রহের বৈরী আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন হঠাৎ করে চোখের সামনে বিধ্বস্ত একটা মহাকাশযান দেখতে পেলাম।
মহাকাশযানটি নিশ্চয়ই অনেকদিন আগে এখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, কারণ পুরো মহাকাশযানটি ধূসর এবং সবুজাভ ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। আমি একটু অবাক হয়ে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে রইলাম কারণ এটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে এর ভিতরে কোনো মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়। মহাকাশযানের মূল অক্ষটি ভেঙে গিয়েছে, বিস্ফোরণের ফলে যে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে তার ভিতর দিয়ে মহাকাশযানের পুরো বাতাস বের হয়ে যাবার কথা। এরকমভাবে বিধ্বস্ত হওয়া মহাকাশযান কিছুতেই বায়ুনিরোধক থাকতে পারে না। আমি মহাকাশযানের দেয়ালের দিকে তাকালাম, প্রচণ্ড উত্তাপে এটি দুমড়ে মুচড়ে গলে গিয়েছে, একটি মহাকাশযানের এই ধরনের উত্তাপ সহ্য করার কথা নয়, এর নিরাপত্তার পুরো ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। এই প্রলয়কাণ্ডে কোনোভাবেই মহাকাশযানের কোনো অভিযাত্রীর বেঁচে থাকার কথা নয়। আমি সবিস্ময়ে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললাম, কী আশ্চর্য!
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল, কোনটি কী আশ্চর্য?