আমি ভিডি টিউবের সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর একরকম জোর করে মাথা থেকে সবকিছু বের করে দিলাম— দিনটি মাত্র শুরু হয়েছে, নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে একেবারেই নেই।
ভোরবেলা আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশযানের একটি প্রদর্শনীতে যাবার কথা ছিল। সেখানে রওনা দেবার আগেই ভিডি টিউব। থেকে একটি জরুরি সংকেত এল। এই কলোনির আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালকে লি-হান আমার সাথে কথা বলতে চায়— ভিডি টিউবে নয়, সরাসরি। আমি টিউবটি তুলে রেখে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। সরাসরি কথা বলার একটিই অর্থ, কোনো একটি আন্তঃনক্ষত্র অভিযানের চুক্তি পাকাপাকি করে ফেলা। আমি মাত্র একটি অভিযান শেষ করে এসেছি, নতুন করে কোথাও যাবার আগে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলাম সেটি আর সম্ভব হবে বলে মনে। হয় না।
ঘণ্টাখানেকের মাঝে আমার পরিচালকের সাথে দেখা হলো, মধ্যবয়স্ক হাসি খুশি মানুষ, আমাকে দেখে হাত উপরে তুলে আনন্দ প্রকাশ করার একটি ভঙ্গি করে বলল, এই যে ইবান, তোমাকে পেয়ে গেলাম!
আমি হেসে বললাম, লি-হান, তুমি এমন ভান করছ যে আমাকে পেয়ে যাওয়া খুব সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার!
অবশ্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার! এই পোড়া কলোনিতে কি মানুষ থাকে? একজন একজন করে সবাই সরে পড়ছে!
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, চারপাশে বেগুনি রংয়ের একধরনের চাপা আলো, বহু উপরে বায়োডোমের উপর গ্রহটির প্রলয়ঙ্করী আবহাওয়া হুটোপুটি খাচ্ছে। চেষ্টা করলে এখান থেকেও সেই বাতাসের হুটোপুটি শোনা যায়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ঠিকই বলেছ। এই কলোনিটা আসলে মানুষের থাকার অযোগ্য। আমার সবসময় কী ভয়। হয় জানো?
কী?
একদিন এই বায়োডোম ধসে পড়বে আর আমরা সবাই ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারা পড়ব। ঠিক গ্রিশিন গ্রহের কলোনির মতো।
লি-হান হা হা করে হেসে বলল, তোমাকে যেন ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারা যেতে না হয় সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছি। পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানে করে তোমাকে এই কলোনি ছেড়ে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি জানো আমার পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান চালানোর লাইসেন্স নেই।
আমরা সেই লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেব।
আমি ভুরু কুঁচকে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালক লি-হানের দিকে তাকালাম, লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেবে?
হ্যাঁ।
কেন?
কারণ এটি জরুরি। তা ছাড়া আমরা তোমার ফাইল খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, আমাদের কমিটি মনে করে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে। তোমার কোনো জিনেটিক প্রাধান্য নেই, কিন্তু সেটি ছাড়াই তুমি অনেক ওপরে চলে এসেছ— কমিটি সেটা খুব বড় করে দেখেছে।
আমি তীক্ষ্ণ চোখে লি-হানের চোখের দিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করলাম। আমি জানি যাদের জিনেটিক প্রাধান্য নেই তাদেরকে প্রায় মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না। লি-হান আমার সাথে কোনো কারণে মিথ্যে কথা বলছে। লি-হান আমার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, আমার মনে হয় এটি তোমার জন্যে চমৎকার একটি সুযোগ। পরবর্তী কমিটি অন্যরকম হতে পারে তারা তোমাকে সেই সুযোগ না-ও দিতে পারে।
আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমার মা আমাকে জন্ম দেবার আগে জিনেটিক কোডিংয়ে। বুদ্ধিশুদ্ধি বিশেষ কিছু দেন নি! আমি সম্ভবত অন্য মানুষের তুলনায় খানিকটা নির্বোধই— কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে এখানে অন্য ব্যাপার রয়েছে।
লিহান অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বলল, অন্য কী ব্যাপার?
আমি আমার স্বল্প বুদ্ধি দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। আমার ধারণা এই অভিযানের খুঁটিনাটি জানতে পারলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন মনে করো আমার প্রথম কৌতূহল গন্তব্যস্থান নিয়ে আমাকে মহাকাশযান নিয়ে কোথায় যেতে হবে?
লি-হান আমার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, রিশি নক্ষত্রের কাছে যে গ্রহাণুপুঞ্জ আছে। সেখানে।
আমি চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে বললাম, কী বললে? রিশি নক্ষত্রের কাছে?
লি-হান দুর্বল গলায় বলল, হ্যাঁ।
তার মানে আমাকে যেতে হবে মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে দিয়ে?
হ্যাঁ, তা ছাড়া উপায় নেই। দুই পাশে দুটি ব্ল্যাকহোল থাকায় যাত্রাপথটা হয় ঠিক মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে দিয়ে। আমি স্বীকার করছি এত কাছাকাছি দুটি ব্ল্যাকহোল থাকলে যাত্রাপথ বিপজ্জনক।
আমি লি-হানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করছ। তুমি খুব ভালো করে জানো ব্ল্যাকহোল কোনো সমস্যা নয়, গত একশ বছর থেকে মানুষ ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ শক্তি ব্যবহার করে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে। সমস্যা অন্য জায়গায়।
লি-হান চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, সমস্যা কোথায়?
তুমি খুব ভালো করে জানো কোথায়। ঐ অঞ্চলে মানুষের কলোনি বিদ্রোহ করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। পুরো এলাকাটা এখন ছোট-বড় একশটা মহাকাশ- দস্যুর আখড়া। গত দশ বৎসরে এই পথ দিয়ে যত মহাকাশযান গেছে তার অর্ধেক লুট হয়ে গেছে। কোনো ক্রু জীবন্ত ফিরে আসে নি!
তুমি অতিরঞ্জন করছ ইবান।
আমি এতটুকু অতিরঞ্জন করছি না— তোমরা সত্য গোপন করছ তা না হলে সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি হতো। আমি হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি। অনেক কষ্ট করে গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, শুধু কী মহাকাশ-দস্যু? মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জ হচ্ছে অনাবিষ্কৃত এলাকা। সেখানে কোনো একধরনের মহাজাগতিক প্রাণী রয়েছে—