কী হলো?
ঐ দেখ–
আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের গালের চামড়াকে ধরে টেনে লম্বা করে ফেলতে থাকে, আমি সবিস্ময়ে দেখলাম গলিত পলিমারের মতো সেটা উপরে উঠে আসছে, বেশ খানিকটা উপরে তুলে এনে ছেড়ে দিতেই সেটা শব্দ করে আবার রবারের মতো নিচে নেমে এল। মিত্তিকা শিউরে উঠে আমাকে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বলল, দানব, নিশ্চয়ই দানব।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, বলল, না। দানব না। হাইব্রিড। আধা যন্ত্র আধা মানুষ। আমার চামড়ার উপর সূক্ষ্ম বায়োমারের আস্তরণ রয়েছে। সেটাকে ভেদ করে যাবার মতো কোনো বিস্ফোরক নেই। আমাকে হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয়ে নি মেয়ে।
আমি হতচকিতের মতো তাকিয়ে রইলাম, ম্যাঙ্গেল কাসের চোখ দুটি হঠাৎ হিংস্র পশুর মতো জ্বলে ওঠে, সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আঙুল নির্দেশ করে বলল, কিন্তু তোমার মতো মানুষকে সহস্রবার ছিন্নভিন্ন করে দেবার। মতো অস্ত্র আমার দেহে আছে।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে আরো এক পা এগিয়ে এল তারপর ফিসফিস করে বলল, কিন্তু আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব না। কারণ তোমাকে আমার প্রয়োজন।
আমি স্থির চোখে ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আমি কি তোমার নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে পারি?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল, বলল, নিশ্চয়ই পেতে পারি। এই মেয়েটিকে আমি সেজন্যে শীতল ঘর থেকে বের করে এনেছি। তুমি নিশ্চয়ই এরকম কমবয়সী একটি মেয়ের শরীরকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখতে চাও না।
আমি চুপ করে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস চাপাগলায় বলল, চাও ইবান?
মিত্তিকা আমাকে ধরে আর্তচিৎকার করে থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি মাথা নাড়লাম, না চাই না।
চমৎকার।
ম্যাঙ্গেল কাস এবারে শূন্যে ভেসে আবার নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের কাছে ফিরে গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বিশ্রাম নিতে যাও। আমার যখন প্রয়োজন হবে আমি তোমাদের ডাকব।
আমি মিত্তিকাকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার ডাকল, ইবান।
বল।
তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি রেখে যাও। বুঝতেই পারছ এটি তোমার জন্যে একটি জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু নয়।
আমি হাতের অস্ত্রটি ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে ছুড়ে দিলাম, সে হাত দিয়ে সেটিকে সরিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর ঝুঁকে পড়ল, অস্ত্রটি সত্যি-সত্যি অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালের মতো ঘরে পাক খেয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে।
প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মিত্তিকাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে একটা বিশ্রামঘরে শুইয়ে আমি নিজের ঘরে ফিরে এসেছি। অধিনায়কের জন্যে আলাদা করে রাখা আমার এই ঘরটিতে আমি খুব একটা আসি নি। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আমি চমকে উঠলাম, আমার বিছানার পাশের আরামদায়ক চেয়ারে কেউ-একজন বসে আছে। আমাকে দেখে মানুষটি ঘুরে তাকাল এবং আমি তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটি রিতুন ক্লিস, সত্যিকারের মানুষ নন, তার হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মহামান্য রিতুন ক্লিস, আপনি?
হ্যাঁ আমি।
আমি ভেবেছিলাম আপনি এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে মুক্তি নিয়ে আমাদের এখান থেকে চলে গেছেন।
হ্যাঁ, আমি মুক্তি চেয়েছিলাম, কিন্তু যে কারণে তুমি আমাকে হত্যা করতে পার নি, ঠিক সেই কারণে আমিও নিজেকে হত্যা করতে পারি নি। তা ছাড়া
তা ছাড়া?
তা ছাড়া ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাজ দেখে হঠাৎ আমার একটু কৌতূহল হলো, ইচ্ছে হলো সে কী করে দেখি।
দেখেছেন?
হ্যাঁ দেখেছি। গত দুইশ বছরে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের সময় হাইব্রিড ছিল না। অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রক্রিয়া। অত্যন্ত বিচিত্র একটি ধারণা।
আমি একটি নিঃশ্বাস ফেললাম। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছে ইবান।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এটি কি বিচলিত হওয়ার মতো ব্যাপার নয়? আমি একটি মহাকাশযানের অধিনায়ক। সেই মহাকাশযানের শীতল ক্যাপসুল থেকে একটি দস্যু বের হয়ে পুরো মহাকাশযানটি দখল করে ফেলল। আমাকে এখন তার কথা শুনতে হবে, তা না হলে সে মানুষ খুন করে ফেলবে।
রিতুন ক্লিস শব্দ করে হাসলেন, বললেন, জীবনকে এত গুরত্ব দিয়ে নিতে হয় না। একটি দস্যুর যা করার কথা সে তাই করেছে। তুমি একটি মহাকাশযানের অধিনায়ক, তোমার যা করার কথা তুমি তাই কর।
আমি কী করব?
আমি সেটা কেমন করে বলি? তবে তুমি কী কর আমি সেটাও দেখার জন্যে খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছি।
মহামান্য রিতুন, আপনি সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান মানুষ। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, শুধুমাত্র পরিশ্রম করে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আমি বড় বিপদ দেখি নি, কীভাবে সেটার মুখোমুখি হতে হয় জানি না।
সেটা কেউই জানে না ইবান। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটা শিখতে হয়।
আমি আপনার কাছে সাহায্য চাই মহামান্য রিতুন।
মহামান্য রিতুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের এই পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে একটি পরাবাস্তব নাটিকার মতো আমি এর একজন দর্শক। এর ভালো-মন্দে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এতে অংশ নিতে পারব না ইবান। আমি শুধু দেখে যাব।