প্রশ্নটি অত্যন্ত সহজ এবং সরল কিন্তু এর উত্তরটি সহজ কিংবা সরল নয়। আমার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে যে এই প্রশ্নটির উত্তর কারোই জানা নেই। কিন্তু মিত্তিকাকে আমি সেকথা বলতে পারি না। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে এরকম পরিবেশে যে-ধরনের উত্তর দেবার কথা আমি সেরকম একটি দিলাম। বললাম, পুরো ব্যাপারটি বিশ্লেষণ না করে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।
মিত্তিকা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, তার মানে ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে?
মানুষকে মেরে ফেলা এত সহজ ব্যাপার নয়।
কিন্তু তুমি তো মানুষকে মেরে ফেলার জন্যে একটা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
আমি এই কথার কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না উত্তর দেয়ার সময় হলো না, কারণ ততক্ষণে আমরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে গেছি। নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে একজন মানুষ আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটি নিশ্চয়ই ম্যাঙ্গেল কাস।
প্রথমেই আমার যে কথাটি মনে হলো সেটি হচ্ছে ইচ্ছে করলেই আমি তাকে এখনই গুলি করে মেরে ফেলতে পারি। এই ধরনের একটা কথা আমার মাথায় এসেছে বলে পরমুহূর্তে হঠাৎ করে আমার নিজের উপর একধরনের ঘৃণাবোধের জন্ম হলো। আমি কিছু বলার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস ধীরে ধীরে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, ভরশূন্য পরিবেশে তার সহজে ঘােরার ভঙ্গি দেখে আমি বুঝতে পারলাম সে তার জীবনের দীর্ঘ সময় মহাকাশযানে কাটিয়েছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মানুষটি সুদর্শন বলে শুনেছিলাম এবং আমি দেখতে পেলাম কথাটি সত্য। তার মাথায় কালো চুল, খাড়া নাক, এবং গভীর নীল চোখ। গায়ের রঙ তামাটে এবং মুখে একধরনের চাপা হাসি। আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম মানুষটি সুদর্শন হলেও সেখানে একধরনের বিচিত্র কদর্যতা লুকিয়ে আছে। সেই কদর্যতাটি কেথায় তার চোখের দৃষ্টিতে নাকি মুখের চাপা হাসিতে আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। মানুষটি আমার চোখের দিকে তাকাল এবং তার মুখের হাসিটি আরো বিস্তৃত করে বলল, তোমাকে আমি একটি সুযোগ দিয়েছিলাম, তুমি সেই সুযোগ গ্রহণ করলে না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা বলার ভঙ্গিটি অত্যন্ত বিচিত্র। মনে হয় প্রত্যেকটা শব্দ আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করে এবং কথাটি শেষ হবার পরও মনে হয় তার কথা এখনো শেষ হয় নি।
কোনো একটি বিচিত্র কারণে ম্যাঙ্গেল ক্বাস কী বলছে আমি সেটা বুঝতে পারলাম এবং সেজন্যে আবার আমার নিজের উপর আবার একটু ঘৃণাবোধের জন্ম হলো। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখের ভঙ্গি খুব ধীরে ধীরে পবির্তিত হলো, সে মুখের হাসি সরিয়ে সেখানে একধরনের অনুকম্পার ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে অস্ত্র ছিল, তুমি কেন আমাকে হত্যা করলে না?
যদি তোমাকে হত্যা করার প্রয়োজন হতো, আমি তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে হত্যা করতাম ম্যাঙ্গেল কাস।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নেড়ে আবার আলাদা আলাদাভাবে একটি একটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আমি কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াই হত্যা করতে পারি।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কী চাও?
আপাতত এই মহাকাশযানটির কর্তৃত্ব চাই। এটিকে আমার নিজের এলাকায় নিতে চাই।
আমি দুঃখিত ম্যাঙ্গেল ক্বাস সেটি সম্ভব নয়। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
আমার কথা শেষ হবার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার ডান হাত উপরে তুলে আমার মাথার উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, এবং হঠাৎ করে আমি ভয়ংকর আতংকে শিউরে উঠলাম, আমি বুঝতে পারলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন হাইব্রিড২৪, একই সাথে যন্ত্র এবং মানুষ। তার শরীরের ভেতরে অস্ত্র, সেই অস্ত্র ব্যবহার করে সে তার আঙুলের ভেতর দিয়ে ভয়ংকর বিস্ফোরক ছুড়ে দিতে পারে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ বিদ্যুঝলকের মতো তার আঙুল থেকে বিস্ফোরক ছুটে এল। আমি মিত্তিকাকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নিচে ঝাপিয়ে পড়লাম, মাথার উপর দিয়ে বিস্ফোরক ছুটে গেল এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়াল চূর্ণ হয়ে গেল।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার হাত নামিয়ে আনে, আমি দেখতে পেলাম তার আঙুলের ডগা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে, শরীরের ভেতরে বিস্ফোরক লুকানো থাকে, চামড়া ভেদ করে সেটি বের হয়ে এসেছে। ভরশূন্য পরিবেশে আমি কয়েকবার লুটোপুটি খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেল থেকে সাবলীল ভঙ্গিতে একটি লাফ দিয়ে একেবারে আমার সামনে এসে হাজির হলো— আমি ততক্ষণে উরু থেকে আমার অস্ত্রটি বের করে এনেছি। ম্যাঙ্গেল কৃাসের দিকে সেটি তাক করে বললাম, তুমি দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও ম্যাঙ্গেল ক্বাস।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস এমনভাবে হেসে উঠল যেন আমি অত্যন্ত মজার একটা কথা বলেছি। আমি কঠোর মুখে বললাম, আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি তুমি দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও–
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল এবং সে হাত উপরে না তুলে খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে চিৎকার করে বললাম, খবরদার–
ম্যাঙ্গেল কাস ভক্ষেপ করল না। ধীরে ধীরে তার হাত আমার দিকে তুলে ধরতে শুরু করল এবং আমি তখন মরিয়া হয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির ট্রিগার টেনে ধরলাম। ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেল এবং ম্যাঙ্গেল কাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়ল। আমি তখনো থরথর করে কাঁপছি, জীবনে কখনো কোনো মানুষকে নিজ হাতে খুন করতে হবে ভাবি নি। আমি গভীর বিতৃষ্ণা নিয়ে আবিষ্কার করলাম ব্যাপারটি এমন কিছু কঠিন নয়। মিত্তিকা আমার হাত ধরে বলল, ইবান।