সে কোথায়?
তুমি তাকে দেখতে পাবে না।
মিত্তিকা আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না, কেমন জানি ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফোবিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী সম্ভাবনার কথা বলছ?
আপনি যখন ফোবিয়ানের দুটি ইঞ্জিন একসাথে বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন প্রচণ্ড ঝাকুনিতে কোনো একটি শীতল ক্যাপসুল খুলে গিয়েছে, নিরাপত্তা সার্কিট তখন ভেতরের মানুষটিকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না। সেটা খুব সম্ভবযোগ্য মনে হচ্ছে না। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা কী?
রিতুন ক্লিসকে যখন আমরা নিজেকে নিজে অপসারণক্ষমতা দিয়েছি তখন নিউরাল নেটওয়ার্কের স্মৃতির একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার ফল হিসেবে শীতল ক্যাপসুলের মানুষেরা জেগে উঠছে।
সর্বনাশ!
মিত্তিকা একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করে গলার স্বর উঁচু করে বলল, সর্বনাশ কেন?
তোমাকে নিয়ে আমি সর্বনাশ বলছি না।
তাহলে কাকে নিয়ে সর্বনাশ বলছ?
তোমাদের সাথে ম্যাঙ্গেল ক্বাস নামে একজন ভয়ংকর ডাকাত রয়েছে, তাকে নিয়ে বলছি। এই মানুষটি যদি জেগে উঠে থাকে তাহলে আমাদের খুব বড় বিপদ।
ফোবি নিচু গলায় আমাকে ডাকল, মহামান্য ইবান।
বল।
কিছু-একটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে। কার্গো-বেতে যোগযোগ করা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
আমি হঠাৎ করে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করলাম, সত্যিই যদি মিত্তিকার মতো ম্যাঙ্গেল ক্বাসও জেগে উঠে থাকে তাহলে কী হবে? আমি চাপা গলায় ডাকলাম, ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
আমার একটু কার্গো বেতে যেতে হবে।
ফোবি কোনো কথা বলল না।
কী হয়েছে নিজের চোখে দেখে আসতে হবে।
এবারেও ফোবি কোনো কথা বলল না।
ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
আমার মনে হয় খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। অস্ত্রাগার থেকে একটা অস্ত্র নিয়ে যাই। কী বল?
ঠিক আছে।
মিত্তিকা চোখ বড় বড় করে আমাদের কথা শুনছিল, এবারে ভয়ার্ত গলায় বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
কার্গো বেতে। তুমি এখানে একটু অপেক্ষা কর।
না, আমার ভয় করে।
এখানে ভয়ের কিছু নেই।
যদি ভয়ের কিছু না থাকে তাহলে হাতে অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছ কেন?
প্রশ্নটির ভালো কোনো উত্তর ভেবে পেলাম না, মিত্তিকা নিজেই বলল, আমি তোমার সাথে যাব।
তুমি তো ভরশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত নও, ভেসে ভেসে যেতে পারবে না।
ভেসে ভেসে যদি যেতে না পারি তাহলে এখানে এসেছি কেমন করে?
আমি এই প্রশ্নটারও উত্তর দিতে পারলাম না, মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক আছে চল।
আমি মিত্তিকাকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মূল করিডোর ধরে ভেসে ভেসে ফোবিয়ানের মাঝামাঝি সুরক্ষিত ঘরটি থেকে একটা শক্তিশালী অস্ত্র তুলে নিলাম, লেজার রশ্মি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ করে শক্তিশালি বিস্ফোরক ছুড়ে দেবার। একটি অতি প্রাচীন কিন্তু কার্যকর অস্ত্র।
অস্ত্রটি উরর সাথে বেঁধে নিয়ে আবার আমি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে থাকি, ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে যাওয়া নিয়ে মিত্তিকা যদিও খুব বড়গলায় কথা বলেছে কিন্তু আসলে অভ্যস্ত না থাকায় সহজে এগিয়ে যেতে পারছিল না, আমি তাকে একহাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম।
কার্গো বে-এর দরজা হাট করে খোলা, ভিতরে আবছা অন্ধকার। আমি আলো জ্বালালাম, ঘরের মাঝামাঝি একটা ক্যাপসুল ওলটপালট খেয়ে ভাসছে। ক্যাপসুলটি হা করে খোলা। আমি চাপাগলায় জিজ্ঞেস করলাম, মিত্তিকা, এটা কি তোমার ক্যাপসুল?
মিত্তিকা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমারটা ওই পাশে।
আমি উর থেকে খুলে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে একটা ঝটকা দিয়ে ক্যাপসুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। ক্যাপসুলের দরজা খোলা, ভেতরে কেউ নেই। ক্যাপসুলের পাশে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের নাম লেখা— এটাতে তাকে আটকে রাখা ছিল।
ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে।
এই মহাকাশযানের কোথাও সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
৪. মহাকাশযানের নির্জন করিডোর
আমি মিত্তিকাকে নিয়ে মহাকাশযানের নির্জন করিডোর ধরে ফিরে আসছিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই মহাকাশযানের কোথাও লুকিয়ে আছে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে অস্ত্র হাতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ধরনের একটা আশংকায় আমার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধকধক করে শব্দ করতে থাকে। করিডোরের মাঝামাঝি এসে আমি চাপাগলায় ফোবিকে ডাকলাম, ফোবি।
ফোবি আমার কানের কাছে থেকে উত্তর দিল, বলুন মহামান্য ইবান।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস শীতল ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে গেছে।
আমি জানি।
তুমি কেমন করে জানো? কার্গো বেতে তো নিউরাল নেটওয়ার্কের যোগাযোগ নেই।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে।
আমি চাপাগলায় চিৎকার করে বললাম, কী বললে?
বলেছি ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে।
আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না, অবিশ্বাসের গলায় বললাম, কী বললে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে?
ঠিক করে বললে বলতে হয় ভেসে আছে।
কেন?
মনে হয় তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমার জন্যে? আমার জন্যে কেন?
যতদূর মনে হয় মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণটি নিতে চায়।
ওর কাছে কি কোনো অস্ত্র আছে?
নেই।
একেবারে খালি হাতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে?
হ্যাঁ। মানুষটি খুব আত্মবিশ্বাসী।
তুমি কীভাবে জানো?
ফোবি একটু ইতস্তত করে বলল, মানুষের চরিত্রের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য আমাদের বিশেষ করে প্রস্তুত করা হয়।
ও।
আমি মিত্তিকার দিকে তাকালাম, সে পুরো ব্যাপারটি এখনো বুঝতে পারছে না, খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি আতঙ্ক নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো মুখে বলল, এখন কী হবে?