আমি চিঙ্কার করে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আমি ততক্ষণ। পুরোপুরি জেগে উঠেছি, আমি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি না। আমার সামনে একটি তরণী ভাসছে। একটুকরা নিওপলিমার দিয়ে শরীরকে ঢেকে রেখেছে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পরিশোধিত বাতাসের প্রবাহে সেই কাপড়টা উড়ছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে তরণীটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক কোনো প্রতিচ্ছবি নয়— তাহলে আমি দেখতে পেতাম দেয়ালের ভিডি টিউব থেকে আলো বের হয়ে আসছে। এটি সত্যি-সত্যি রক্তমাংশের একজন তরণী।
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
আমার কথায় মেয়েটি ভয়ানক চমকে উঠল এবং আমি দেখতে পেলাম তার মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্কের ছায়া পড়েছে। মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি কে?
আমি বললাম, আমার নাম ইবান। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
অধিনায়ক? মেয়েটা খুব অবাক হয়ে বলল, অধিনায়ক তুমি?
হ্যাঁ।
তাহলে তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?
আমি অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, ঘুমানোর আগে আমি যেন ভেসে কোথাও না চলে যাই সে-জন্যে ফিতা দিয়ে একটা পা বেঁধে রাখার ব্যাপারটি মেয়েটিকে বিস্মিত করেছে। আমি পা থেকে ফিতাটি খুলে বললাম, কোথাও যেন ভেসে চলে না যাই সেজন্যে বেঁধে রেখেছিলাম।
কেন তুমি ভেসে চলে যাবে? আমি শুনেছি মহাকাশযানে অধিনায়কদের খুব সুন্দর ঘর থাকে।
তুমি ঠিকই শুনেছ—
তাহলে তুমি সেখানে না ঘুমিয়ে এখানে নিজেকে বেঁধে রেখে শূন্যে ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছ কেন?
আমি ঠিক নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যে এরকম বিচিত্র একটা পরিবেশে আমি এধরনের আলাপে জড়িয়ে পড়ছি। আমি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, দেখ, এসব ব্যাপার নিয়ে আমরা পরেও কথা। বলতে পারব। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমার জানা প্রয়োজন তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে হাজির হয়েছ।
মেয়েটি আমার প্রশ্ন শুনে কেন জানি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বলল, তুমি যদি মহাকাশযানের অধিনায়ক হয়ে থাক তাহলে তোমার জানা উচিত আমি কোথা থেকে হাজির হয়েছি।
আমি বিপন্ন গলায় বললাম, দেখতেই পাচ্ছ আমি জানি না। সেজন্যেই ব্যাপারটি জরুরি–
কেন ব্যাপাটি জরুরি?
দাঁড়াও বলছি। তার আগে আমি আলো জ্বেলে নিই।
আমি আলো জ্বালানোর জন্যে একটু এগিয়ে যেতেই মেয়েটি চিৎকার করে বলল, খবরদার তুমি আমার কাছে আসবে না।
আমি একটু অপমানিত বোধ করলাম, কিন্তু এই মুহুর্তে মান-অপমান নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। আমি গলার স্বর শান্ত রেখে বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমি তোমার কাছে আসব না।
নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সুইচ স্পর্শ করামাত্র নিয়ন্ত্রণ কক্ষটি উজ্জ্বল আলোতে ভেসে গেল এবং মেয়েটি হাত দিয়ে নিজের চোখ আড়াল করে দাঁড়াল। আমি দেখতে পেলাম মেয়েটি কমবয়সী এবং অপূর্ব সুন্দরী। মসৃণ ত্বক, কালো চুল এবং সুগঠিত দেহ। মেয়েটির চেহারায় একধরনের নির্দোষ সারল্য রয়েছে যেটি আমি বহুদিন কারো মাঝে দেখি নি। মেয়েটি ভরশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত নয়, প্রতি মুহূর্তে সে ভাবছে সে পড়ে যাবে, কিন্তু ভরশূন্য পরিবেশে কেউ কোথাও পড়ে যেতে পারে না এবং এই বিচিত্র অনুভূতির সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে দাঁড়িয়ে পুরো প্যানেলটিতে একবার চোখ বুলিয়ে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে কি না দেখার চেষ্টা করলাম–কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়ল না। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিও পলিমারের চাদরটি টেনে নিজের শরীরকে ভালো করে ঢাকার চেষ্টা করে বলল, আমার শীত করছে।
এই পাতলা নিওপলিমারের টুকরো দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করলে শীত করতেই পারে। আমি তোমার গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
মেয়েটি কোনো কথা না বলে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
আমার নাম মিত্তিকা।
মিত্তিকা, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
আমি জানি না। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি ঘুম থেকে উঠে ভাসতে ভাসতে এদিকে এসেছি–
তার মানে তুমি কার্গো বেতে রাখা শীতল ক্যাপসুল থেকে উঠে এসেছ?
আমি সেটা জানি না। আমি রিশি নক্ষত্রপুঞ্জে যাবার জন্যে রেজিস্ট্রি করিয়েছিলাম, কথা ছিল সেখানে পৌঁছার পর আমাকে জাগানো হবে। কিন্তু–
মেয়েটি অভিযাগের সুরে আরো কিছু কথা বলতে থাকে কিন্তু আমি ভালো করে সেটা শুনতে পেলাম না, হঠাৎ করে একধরনের অশুভ আশঙ্কায় আমার ভুর কুঞ্চিত হয়ে উঠলাম। আমি চাপা গলায় ডাকলাম, ফোবি।
ফোবি একেবারে কানের কাছ থেকে ফিসফিস করে বলল, বলুন মহামান্য ইবান।
এটা কী করে হলো? এই মেয়েটি ঘুম থেকে জেগে উঠল কেমন করে?
বলতে পারছি না মহামান্য ইবান। আমার দুটি সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে।
কী সম্ভাবনা?
ফোবি উত্তর দেবার আগেই মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় চিল্কার করে উঠল, তুমি কার সাথে কথা বলছ?
আমি মিত্তিকাকে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বললাম, ফোবির সঙ্গে। ফোবি হচ্ছে এই মহাকাশযানের মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ইন্টারফেস।