বলুন মহামান্য ইবান।
এই সুদীর্ঘ অভিযানে আমি একা, ভেবেছিলাম মহামান্য রিতুন ক্লিসের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাব, কিন্তু দেখতে পেলে কী হলো?
আমি দুঃখিত মহামান্য ইবান।
আসলে তুমি দুঃখিত নও ফোবি। তোমার দুঃখিত হবার ক্ষমতাও নেই।
আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য ইবান।
এই মহাকাশযানে সময় কাটানো নিয়ে আমার খুব বড় সমস্যা হয়ে যাবে। খুব বড় সমস্যা।
আমি তখন ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করি নি যে আমার এই কথাটি আসলে ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হবে।
এরপরের কয়দিন অবশ্যি আমার সময় কাটানো নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হলো না, মহাকাশযানটি প্রয়োজনীয় গতিবেগ অর্জন করে ফেলেছে এখন ইঞ্জিন দুটো বন্ধ করে দিতে হবে। মহাকাশযান পরিচালনার নিয়মকানুনে ইঞ্জিন দুটো হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে। এর আগে আমি কখনোই একা কোনো মহাকাশযানে ছিলাম না, কাজেই নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়েছে। এবারে সে-ধরনের কোনো সমস্যা নেই, কাজেই আমি ইঞ্জিন দুটো এক সাথে হঠাৎ করে বন্ধ করে দেবার প্রস্তুতি নিলাম। ফোবি আমার পরিকল্পনা আন্দাজ করে আমাকে সাবধান করার চেষ্টা করল, বলল, মহামান্য ইবান, মহাকাশযানের ইঞ্জিন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া চতুর্থ মাত্রার অনিয়ম।
তার মানে জানো?
জানি মহামান্য ইবান।
তার মানে এটি মহাকাশযানের কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করবে না।
কিন্তু আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
মনে হয় না। সেই ছেলেবেলা উঁচু দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়তাম— হঠাৎ করে ভরশূন্য পরিবেশের অনুভূতি খুব। চমৎকার অনুভূতি। আমার মনে হয় আমার ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে যাবে।
আপনি ছাদে গিয়ে আঘাত করবেন, আপনার সাথে সাথে সকল খোলা যন্ত্রপাতি ছাদে আঘাত করবে, সমস্ত মহাকাশযান প্রচণ্ড একটা ঝাকুনিতে কেঁপে উঠবে, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি—
আহ্ ফোবি, তুমি থামবে? আমি একটা বাচ্চা খোকা নই আর তুমি আমার মা নও! তুমি যদি ভুলে গিয়ে থাক তাহলে তোমাকে মনে করিয়ে দিই, আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
ফোবি নরম গলায় বলল, আমি আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান প্রদর্শন করছি না মহামান্য ইবান, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।
চমৎকার! তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো, আমি আমার দায়িত্ব পালন করি!
আমি শরীরকে আসন্ন ঘটনার জন্যে প্রস্তুত করে সুইচকে স্পর্শ করে এক সাথে দুটো ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম। মনে হলো সাথে সাথে মহাকাশযানে প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল, প্রচণ্ড শব্দ করে মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল, এবং আমি আক্ষরিক অর্থে উড়ে গিয়ে ছাদে আঘাত করলাম, মহাকাশযানের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে আমি শারীরিক কোনো আঘাত পেলাম না, তবে উড়ে আসা নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, আমার অভুক্ত খাবার, জমে থাকা জঞ্জাল এবং অব্যবহৃত পোশাক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বেশ বেগ পেতে হলো।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ভাসমান যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জঞ্জাল সরিয়ে আমি ঘরটিকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করতে বেশ কিছু সময় লাগল। ভেসে ভেসে আবার নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে এসে ফোবিকে বললাম, দেখলে, এটি কোনো ব্যাপার নয়।
দেখলাম। তবে আপনি সতর্ক না থাকলে উড়ে আসা যন্ত্রপাতি থেকে আঘাত পেতে পারতেন।
কিন্তু আমি সতর্ক থাকব না কেন?
সেটি অবশ্যি সত্যিই বলেছেন।
আমি পদার্থ-প্রতিপদার্থের অব্যবহৃত জ্বালানি চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করলাম। যাত্রাপথটি ছক করে নিউট্রন স্টারে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে সেটি বের করে নিলাম, পুরো মহাকাশযানের খুঁটিনাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে মহাকাশযানের অধিনায়কের দৈনন্দিন কাজ করতে শুরু করলাম। মহাকাশযানে পুরোপুরি একা থাকার একটি সুবিধে রয়েছে যেটা আমি মাত্র টের পেতে শুরু করেছি, এখানে আমার এখন কোনো নিয়ম মানতে হয় না।
সমস্ত কাজ শেষ করতে করতে বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, দীর্ঘদিন মহাকর্ষ বলের মাঝে থেকে হঠাৎ করে ভরশূন্য পরিবেশে এসে যাওয়ায় অভ্যস্ত হতে একটু সময় নিচ্ছে। অধিনায়কের দৈনন্দিন তথ্য প্রবেশ করে আমি ঘুমানোর আয়োজন করলাম, এতদিন তবু একটু স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঘুমিয়েছি, এখন আর তারও প্রয়োজন নেই, আমি শূন্যে শুয়ে পড়তে পারি, ভেসে ভেসে দূরে কোথাও না চলে যাই সে-জন্যে একটা ফিতা দিয়ে একটা পা কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে বেঁধে নিলাম। আমি শূন্যে ভাসতে ভাসতে ঘুমানোর জন্যে চোখ বন্ধ করেছি তখন আবার ফোবির কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান, আপনি কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ছেন। এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য।
ফোবি। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি আমার মা নও, তুমি আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার কোনো অভিভাবকও নও। আমাকে বিরক্ত কোরো না, ঘুমুতে দাও।
ফোবি আমাকে আর বিরক্ত করল না এবং আমি কিছুক্ষণের মাঝেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম, কেন আমার হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল আমি জানি না। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে। আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যেতে গিয়ে মনে পড়ল আমি আসলে বিছানায় শুয়ে নেই, শূন্যে ঝুলে আছি। আমি তখন চোখ খুলে তাকালাম এবং হঠাৎ করে আতঙ্কে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মূল আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে বলে এখানে আবছা এক ধরনের অন্ধকার, ইঞ্জিনগুলো বন্ধ করে দেয়ার ফলে কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। এই ভয়ংকর নৈঃশব্দ এবং আলো-আঁধারিতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি থেকে একজন তরণী স্থির হয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।