আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি জায়গায় মধ্যবয়স্ক একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। মানুষটি একটা ঢিলে আলখাল্লার মতো শাদা পোশাক পরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খুব ধীরে ধীরে সেই মানুষটি আমার দিকে ঘুরে তাকাল। মানুষটিকে দেখে আমি নিজের শরীরে একধরনের শিহরণ অনুভব করলাম কারণ আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি নয়, এটি সত্যিই একজন মানুষ। মানুষটি আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?
আমি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করে বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনি মহাকাশযান ফোবিয়ানে।
আমি এখানে কেন?
আপনার সাথে কথা বলার জন্যে আমি আপনার মস্তিষ্কের ম্যাপিংকে মহাকাশযানের নিউরাল নেটওয়ার্ক উপস্থাপন করেছি।
মহামান্য রিতুনের মুখে হঠাৎ একটি গভীর বেদনার ছায়া পড়ল। তিনি বিষণ্ণ গলায় বললেন, তুমি শুধুমাত্র আমার সাথে কথা বলার জন্যে আমাকে এই ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিবেশে নিয়ে এসেছ?
ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিবেশ?
হ্যাঁ, এটি একজন মানুষের জন্যে একটি ভয়ঙ্কর পরিবেশ, একটি অসহনীয় পরিবেশ।
আমি একটু চমকে উঠে বললাম, আমি আসলে বুঝতে পারি নি এই পরিবেশটি আপনার কাছে এত অসহনীয় মনে হবে।
বুঝতে পার নি? মহাকাশযানের নিউরাল নেটওয়ার্কের বিশাল শূন্যতার মাঝে আমি একা অনন্তকালের জন্যে আটকা পড়ে আছি, আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, শুরু নেই, শেষ নেই এটি যদি অমানবিক না হয় তাহলে কোনটি অমানবিক?
আমি আসলে বুঝতে পারি নি—
মহামান্য রিতুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার চোখের দিকে তাকালেন, বললেন, তুমি বুঝতে পার নি?
না।
বুঝতে চেষ্টা করেছ?
আমি অপরাধীর মতো বললাম, আসলে চেষ্টাও করি নি। আমি ভেবেছিলাম এটি আরো একটি মস্তিষ্কের ম্যাপিং— আসলে আপনি যে সত্যিকার একজন মানুষ হিসেবে আসবেন সেটি একবারও বুঝতে পারি নি।
হ্যাঁ, তুমি বিশ্বাস কর, আমি সত্যিকারের একজন মানুষ। আমি রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্কের ম্যাপিং নই আমিই রিতুন ক্লিস। রক্তমাংসের রিতুন ক্লিস যেটুকু জীবন্ত ছিল আমি ঠিক ততটুকু জীবন্ত।
আমি বিশ্বাস করেছি। আমি আগে বুঝতে পারি নি কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি।
রিতুন ক্লিস আমার দিকে দুই পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী যুবক?
আমার নাম ইবান।
তুমি কে?
আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
রিতুন ক্লিস কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর কাতর গলায় বললেন, ইবান, তুমি আমাকে মুক্তি দাও।
আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললাম, অবশ্যি আমি আপনাকে মুক্ত করে দেব। অবশ্যি দেব। কীভাবে করতে হয়। আমাকে সেটা বলে দেন—
আমাকে এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে নাও। আমার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দাও।
ধ্বংস করে দেব?
হ্যাঁ। আমাকে ধ্বংস করে দাও।
আমি রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে আমার ভিতরে একধরনের আতঙ্ক এসে ভর করল। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ইবান?
আপনি এত জীবন্ত, আপনাকে ধ্বংস করা তো আপনাকে হত্যা করার মতো। আমি কীভাবে আপনাকে হত্যা করব?
রিতুন ক্লিস বিপন্ন গলায় বললেন, তুমি কী বলতে চাইছ ইবান?
আমি— আমি এখন কী করব? আমি আপনাকে এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে মুক্ত করতে চাই, কিন্তু সেটি তো একটা হত্যাকাণ্ডের মতো–
রিতুন ক্লিস কাতর গলায় বললেন, তাহলে কি এখান থেকে আমার মুক্তি নেই?
আপনি কি নিজেকে নিজে মুক্ত করতে পারেন না?
আমি জানি না। আমি যখন বেঁচে ছিলাম তখন প্রযুক্তি এরকম ছিল না। এরকম নিউরাল নেটওয়ার্ক ছিল না, সেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ম্যাপিং করা যেত না।
হয়ত ফোবি বলতে পারবে। আমি উচ্চস্বরে ডাকলাম, ফোবি— ফোবি–
ফোবি নিচু গলায় বলল, বলুন মহামান্য ইবান।
তুমি কি নিউরাল নেটওয়ার্কে এমন ব্যবস্থা করে দিতে পারবে যেন মহামান্য রিতুন ক্লিস নিজেকে নিজে মুছে দিতে পারবেন? অস্তিত্বকে সরিয়ে দিতে পারবেন?
ফোবি উত্তর দিতে কয়েকমুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, নেটওয়ার্কের কোনো প্রক্রিয়া নিজে থেকে নিজে ধ্বংস করা অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। সেটি সচরাচর করা হয় না।
কিন্তু করা কি সম্ভব?
ফোবি আবার কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, হ্যাঁ, অত্যন্ত বিশেষ প্রয়োজনে সেটি করা সম্ভব। আপনি যদি নিজে ঝুঁকি নিয়ে সেটি করতে চান, সেটা করা যেতে পারে।
বেশ, তাহলে তুমি ব্যবস্থা করে দাও যেন মহামান্য ইবান নিজেকে নিজে নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে অপসারিত করতে পারেন।
ফোবি আবার কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, আপনি যদি চান, তাহলে তাই করে দেব।
আমি এবারে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনাকে যেন এই নিউরাল নেটওয়ার্কে আটকা পড়ে থাকতে না হয় তার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে, আপনি নিজেকে নিজে অপসারিত করে নিতে পারবেন।
মহামান্য রিতুন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসার চেষ্টা করে বললেন, তার অর্থ তুমি হত্যা করতে চাও না বলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, একটু হতচকিত হয়ে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ তাহলে তাই হোক।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা রিতুন ক্লিসের প্রতিচ্ছবিটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাকলাম, ফোবি।