ন্যাড়া মাথা রিক গার্নার রিভলবারটা ধরে একটা আঁকুনি দিয়ে বলল, “আমি এই নির্বোধ মেয়েকে খুন করে ফেলব, নর্দমার কীট, পারলে তুই তাকে রক্ষা কর।”
নীল আলোর ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা এলিয়েন তিতুনি স্থির দৃষ্টিতে রিক গার্নারের দিকে তাকিয়ে রইল। তিতুনিকে বাঁচানোর জন্যে এই শক্তিবলয় থেকে বের হলেই এটমিক ব্লাস্টার দিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। পৃথিবীর মানুষ কত যত্ন করে, কত নিখুঁতভাবে ধ্বংস করার জন্যে কত রকম যন্ত্র তৈরি করেছে।
রিক গার্নার চিৎকার করে বলল, “নরকের কীট, আমি তিন পর্যন্ত গুনব, তারপর গুলি করে এই নির্বোধ মেয়ের খুলি উড়িয়ে দেব।” এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সে চিৎকার করে গুনল, “ওয়ান”, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “টু, তারপর দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “থ্রি”-তারপর ট্রিগার টেনে তিতুনির মাথায় গুলি করে দিল।
তিতুনির সামনে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায়, চারপাশে অনেক মানুষ, তাদের চিৎকার, তার চুলের মুঠি ধরে রাখা রিক গার্নার, মাথার মাঝে রিভলবারের কালো নল, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আম্মু, আলু, টোটন–তাদের আতঙ্কিত দৃষ্টি। বাসার সামনে আকাশ থেকে নেমে আসা নীল আলোর একটা টানেল, সেই টানেলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এলিয়েন মেয়েটি, বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার চোখ দুটো স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষের চিৎকার, কোলাহল, যন্ত্রের ভোঁতা শব্দ, পোড়া গন্ধ, সবকিছু হঠাৎ থেমে গেল। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই।
তিতুনি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল, চারপাশ পুরোপুরি নৈঃশব্দে ঢেকে যাওয়া একটা পৃথিবী, তার মাঝে সবকিছু একটা ছবির মতো স্থির হয়ে আছে, আর সেই ছবির দৃশ্যের মাঝে ঢেউয়ের মতো ভেসে ভেসে আসছে এলিয়েন মেয়েটি। মনে হচ্ছে যোজন যোজন সময় পরে এলিয়েন মেয়েটি তার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করল। তার খুব কাছে এসে তার কপালে কপালে চুঁইয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কী মরে গেছি?”
“না।” এলিয়েন মেয়েটি মাথা নাড়ল, “না তিতুনি, তুমি মরে যাওনি।”
“তাহলে আমার চারপাশে এ রকম কেন? কোনো শব্দ নেই কেন? সবাই ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
“তোমাকে বাঁচানোর জন্যে আমি সময়কে স্থির করে দিয়েছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” এলিয়েন মেয়েটি তার চুল ধরে থাকা ড, মর্গানের হাতটা সরিয়ে তাকে মুক্ত করে। রিভলবারের নল থেকে তাঁর মাথাটা সরিয়ে আনে। তারপর বলল, “এই দেখো রিভলবার থেকে বুলেট বের হয়ে তোমার মাথায় আঘাত করতে যাচ্ছিল, মাঝপথে থেমে গেছে।”
তিতুনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী অবাক লাগছে দেখতে।
এলিয়েন তিতুনি সাবধানে শূন্যে ঝুলে থাকা বুলেটটা ধরে তিতুনির হাতে দেয়, বলল, “নাও। দেখো এখনো গরম হয়ে আছে। আরেকটু হলে এটা তোমার মাথায় ঢুকে যেত।”
তিতুনি এলিয়েনের দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাংকু, আমাকে বাঁচানোর জন্যে।”
এলিয়েন মেয়েটি হাসল, বলল, “যখন আমি থাকব না, তখন নিজেকে দেখে-শুনে রেখো।”
“রাখব।”
তিতুনি অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাল, চারপাশে সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মুর মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, আব্বু ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন, টোটনের চোখে-মুখে অবিশ্বাস। সবাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
রিক গার্নারের মুখে হিংস্র একটা ভঙ্গি, চোখগুলো লাল, মুখের ফাঁক দিয়ে জিভ বের হয়ে আছে। বব ক্লাইডের মুখ কুঁচকে আছে, এটমিক ব্লাস্টারটা দুই হাতে ধরে রেখেছে। এদিকে-সেদিকে অনেক মানুষ, সবাই বিচিত্র ভঙ্গিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এলিয়েন মেয়েটি চারিদিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার এখন যেতে হবে তিতুনি।”
তিতুনির চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল, বলল, “তুমি চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে।”
এলিয়েন বলল, “হবে না। যাবার আগে আমি তোমার স্মৃতি মুছে দিয়ে যাব। সবার স্মৃতি মুছে দিয়ে যাব।”
তিতুনি বলল, “না, প্লিজ না। আমার স্মৃতি মুছে দিও না। আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই।”
এলিয়েন মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “না, তিতুনি এটা হয় না। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে কখনো কোনোদিন এই নিয়ম ভাঙা হয়নি, তুমি আমাকে এই অনুরোধ করো না। আমাকে সবার সব স্মৃতি মুছে দিতে হবে।”
তিতুনি প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, “প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ-তুমি আমার স্মৃতি মুছে দিও না। আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই।”
এলিয়েন মেয়েটি তিতুনির হাত ধরে বলল, “আমাকে বিদায় দাও তিতুনি। আমি যাই।”
তিতুনি মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। গালে ঠোঁট স্পর্শ করল, চুলে হাত বুলিয়ে দিল, তারপর চোখ মুছে বলল, “বিদায়। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো।”
এলিয়েন মেয়েটি তিতুনির হাত ছেড়ে দিয়ে নীল আলোটার দিকে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি পৌঁছে সে একবার ঘুরে তাকাল, হাত নাড়ল। তিতুনি অবাক হয়ে দেখল এলিয়েন মেয়েটির চোখের নিচে চিকচিক করছে পানি।
এলিয়েন মেয়েটি তারপর নীল আলোর বলয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত ধীরে ধীরে দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়-তার শরীর তখন ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে শরীরটা হঠাৎ উপরে উঠতে থাকে, দেখতে দেখতে সেটি নীল আলোর টানেলের ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে ছুটে যেতে থাকে। দেখতে দেখতে সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। তিতুনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে-তাকিয়েই থাকে।