তিতুনি নিজেকে বোঝাল পুরোটাই নিশ্চয়ই একটা কল্পনা, এখানে ভয় পাবার কিছু নেই। তারপরেও তিতুনি ঠিক করল সে এখন চলে যাবে। দরকার হলে একটু পরে বড় মানুষদের নিয়ে আসবে। কিন্তু হঠাৎ করে তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল, মনে হলো সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। সে কাছাকাছি একটা গাছকে ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। তিতুনির মনে হতে থাকে তার মাথার ভেতরে যেন হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে কথা বলছে, সে সবার কথা শুনছে কিন্তু কারো কথাই বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাঁপসা হয়ে যায়, তার মনে হতে থাকে, সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল তখন, খুব ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। তিতুনি আবার চারিদিকে তাকাল। চারিদিকে সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। শক্ত পুড়ে যাওয়া মাটি, গোল একটা গর্ত, সেখান থেকে চৌচির হয়ে যাওয়া মাটি, গর্তের মুখে ছোট-বড় স্বচ্ছ স্ফটিক। কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিতুনি গর্তের ভেতর তাকিয়ে রইল, তখন হঠাৎ করে মনে হলো গর্তের ভেতর কিছু একটা যেন নড়ে উঠল। তিতুনির আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, একটা চিৎকার দিয়ে সে ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু কী আশ্চর্য-সে নড়তে পারল না। চোখ বড় বড় করে সে গর্তটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে স্পষ্ট শুনতে পেল গর্তটার ভেতরে একটা খচমচ শব্দ হচ্ছে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ভেতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসছে।
প্রথমে একটা হাত বের হয়ে এলো, ঠিক মানুষের হাত, দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা বড় মানুষের হাত না, কম বয়সী একটা বাচ্চার হাত। তারপর আরেকটা হাত বের হয়ে গর্তটার মুখটা ধরে নিজেকে টেনে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে মাথার কালো চুল, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে বাচ্চাটা তার শরীরের অর্ধেকটা বের করে আনে। তিতুনি অবাক হয়ে দেখল ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে, তার দিকে পিছনে ফিরে বসেছে বলে চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটা আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রায় পুরো শরীরটা বের করে গর্তের উপরে বসে পড়ল, পা দুটো শুধু গর্তের মাঝে ঝুলে আছে। তারপর মেয়েটা ঘুরে তিতুনির দিকে তাকাল। তিতুনির মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়, গর্ত থেকে যে মেয়েটা বের হয়ে এসেছে সেই মেয়েটা আরেকটা তিতুনি। তিতুনির মতো দেখতে একটি মেয়ে নয়, পুরোপুরি তিতুনি। সে নিজে।
তিতুনির মনে হলো সে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিবে, কিন্তু সে এত অবাক হয়েছে যে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল, গলা থেকে কোনো শব্দ হলো না। গর্তে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ শান্ত দৃষ্টি, তিতুনিকে দেখে সে মোটেও অবাক হচ্ছে না।
তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে। একটু পিছিয়েই সে এক দৌড়ে বাসায় চলে যাবে। বড় একটা গাছের কাছে এসে সে গাছটার আড়ালে লুকিয়ে গেল। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে সে আরো একবার উঁকি দিয়ে তাকাল। তিতুনি মনে মনে আশা করছিল যে সে দেখবে আসলে গর্তটার উপরে কেউ বসে নেই, সব তার চোখের ভুল। কিন্তু তিতুনি দেখল গর্তটার উপরে পা ঝুলিয়ে এখনো সেই তিতুনিটা বসে আছে। তার চোখে চোখ পড়তেই পা ঝুলিয়ে বসে থাকা তিতুনিটা একটু হাসার চেষ্টা করল, ঠিক তিতুনি যে রকমভাবে হাসে।
তিতুনি একটা দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল, আবার মেয়েটার দিকে তাকাল, মেয়েটা এখনো শান্তভাবে বসে পা দোলাচ্ছে, মাথা তুলে গাছগুলো দেখছে। তিতুনি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর একটা খুব সাহসের কাজ করে ফেলল, জিজ্ঞেস করল, “এই, তুমি কে?”
তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা মাথা ঘুরে তাকাল, বলল, “কে? আমি?” গলার স্বর হুবহু তিতুনির মতো।
তিতুনি বলল, “হ্যাঁ। তুমি।”
মেয়েটা বলল, “কেন, আমি তিতুনি!”
ঠিক কী কারণ জানা নেই মেয়েটার কথা শুনে তিতুনির ভয়টা কেটে কেমন যেন একটু রাগ উঠে যায়। সে গলা উঁচিয়ে বলল, “না। তুমি তিতুনি না। আমি তিতুনি।”
মেয়েটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। একটু মাথা চুলকে বলল, “তাহলে আমি কে?”
মেয়েটাকে এ রকম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতে দেখে তিতুনির সাহস আরেকটু বেড়ে গেল, গলা আরেকটু উঁচিয়ে বলল, “আমি কেমন করে বলব তুমি কে? তুমি বলো তুমি কে?”
তিতুনির মতো মেয়েটাকে বেশ চিন্তিত দেখাল, তিতুনি যেভাবে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করে ঠিক সেভাবে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আগে তুমি শুধু একা তিতুনি ছিলে। এখন আমি আর তুমি দুইজনেই তিতুনি। দুইটা তিতুনি।”
তিতুনি রেগে উঠে বলল, “না। দুইজন তিতুনি হয় না। একজন মানুষ কখনো দুইটা হয় না।”
“হয় না?”
“না।”
“কিন্তু এই যে হলো, তুমি এক তিতুনি আমি আরেক তিতুনি।”
তিতুনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সাবধানে বড় গাছটার পিছন থেকে বের হয়ে এলো। সাবধানে এক পা এগিয়ে এসে বলল, “তুমি বলো তুমি কে? বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ?”
মেয়েটা খানিকক্ষণ মাথা চুলকাল, তারপর খানিকক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমিও তিতুনি। কিন্তু তুমি বলছ আমি তিতুনি না। তাহলে এখন আমি জানি না আমি কে।”
“তাহলে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ?” আস্তে আস্তে তিতুনির সাহস বেড়ে যেতে থাকে। তিতুনি যেটাই বলছে মেয়েটা সেটাই মেনে নিচ্ছে, তাই তার ভয়টাও কমে গিয়ে কৌতূহল বাড়তে থাকে।