তিতুনি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এবারে নাহার বলল, “একজন এলিয়েন হয়ে তুমি যে হুবহু মানুষের একটা ফর্ম নিয়েছ সেটা একদিক দিয়ে আমাদের জন্যে ভালো অন্যদিক দিয়ে আমাদের জন্যে অনেক বড় সমস্যা।”
মাথাভরা পাকা চুল বিদেশিটা ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বলল, নাহার মাথা নাড়ল, তারপর তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এলিয়েন হয়ে তুমি শুধু যে মানুষের ফর্ম নিয়েছ তা নয়, তুমি বারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের ফর্ম নিয়েছ, শুধু যে শারীরিক ফর্ম তা নয়, তোমার মানসিক ফর্ম বারো বছরের, বুদ্ধিমত্তা বারো বছরের। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে হলে বারো বছরের বাচ্চার সাথে যেভাবে কথা বলার কথা সেভাবে কথা বলতে হয়। এখন পর্যন্ত তোমার ভেতরে এলিয়েনসুলভ ক্ষমতার কোনো চিহ্ন আমরা পাইনি।”
তিতুনি মনে মনে বলল, “কেমন করে পাবে! আমি যদি এলিয়েন হতাম তাহলে না পেতে।” মুখে কোনো কথা না বলে মাছের মতো চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রইল।
পাকা চুলের মানুষটা নাহারকে আবার কিছু একটা বলল, নাহার সেটা শুনে তিতুনিকে সেটা বোঝাতে থাকে, “প্রফেসর বব ক্লাইড বলছেন তার ধারণা ছিল একজন এলিয়েন যখন মানুষের ফর্ম নেয় তখন বাইরের ফর্মটা নেয়। ভেতরের ফর্মটা ঠিক থাকে। তোমার বেলা সেটা পাওয়া যাচ্ছে না, তুমি ইউনিভার্সাল ল্যাংগুয়েজ বোঝো না, সাইন ল্যাংগুয়েজ বোঝে না, ইংরেজি কিংবা ফ্রেঞ্চও বোঝো না। তোমার সাথে শুধু বাংলায় কথা বলতে হয়।”
শামীম বলল, “আমরা বাংলাতেই বলব কোনো সমস্যা নেই।”
এবারে ন্যাড়া মাথা মানুষটা কিছু একটা বলল, শামীম সেটা তিতুনিকে অনুবাদ করে শোনাল, “কিন্তু তুমি যেহেতু এলিয়েন, কাজেই এলিয়েনের নীলনকশা তোমার ভেতরে আছে। কোথাও না কোথাও কোড করা আছে। আমাদের সেটা দরকার।”
নাহার বলল, “আমরা তোমার শরীরের বাইরে থেকে স্যাম্পল নিয়েছি, এবারে ভেতর থেকে স্যাম্পল নেব। হার্ট কিডনি লিভার লাংস এবং ব্রেন টিস্যু।”
তিতুনি আঁতকে উঠল, বলে কী এরা? এখন তাকে কেটেকুটে ফেলবে? সে চোখ বড় বড় করে মানুষগুলোর দিকে তাকাল।
বিদেশিগুলো হড়বড় করে আরো কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর নাহার আর শামীম সেগুলো অনুবাদ করে শোনাতে লাগল। তারা বলল, “তোমার মস্তিষ্কের টিস্যু স্যাম্পল নেয়ার জন্যে তোমার খুলিতে ড্রিল করতে হবে, সত্যিকারের মানুষের বেলাতে কখনোই এ রকম একটা কিছু চেষ্টা করা হতো না-কিন্তু তুমি যেহেতু সত্যিকার মানুষ নও, তুমি যেহেতু একটা এলিয়েন, তোমার বেলায় এটা চেষ্টা করতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
“তুমি যেহেতু বারো বছরের একটা শিশুর ফর্ম নিয়েছ তোমাকে অচেতন করেই আমাদের এই প্রক্রিয়াটা করা উচিত, কিন্তু আমরা তোমাকে অচেতন করব না দুটি কারণে। বিষয়টিতে যদি তুমি বাধা দিতে চাও তাহলে তোমাকে কোনো একধরনের এলিয়েন শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। আমরা সেটি দেখতে চাই, আমরা সেটি রেকর্ড করতে চাই।
“এছাড়াও দ্বিতীয় কারণটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কখনো ভাবিনি তোমাকে আমরা আটকে ফেলতে পারব। কিন্তু আমরা খুবই অবাক হয়ে লক্ষ করেছি আমরা আমাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে তোমাকে আটকে ফেলতে পেরেছি। আমাদের আরো কিছু যন্ত্রপাতি আছে, আমরা তোমার উপর সেগুলো ব্যবহার করতে চাই। আশা করছি বিজ্ঞানের গবেষণায় আমরা তোমার সহায়তা পাব।”
কথা শেষ করে শামীম তার মাথায় লাগানো হেলমেটটার দিকে এগিয়ে গেল। তিতুনি হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে ধরেই নিয়েছিল বিপদের সময় এলিয়েন তিতুনি তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু এরা তার মাথায় ড্রিল করতে চলে আসছে, এখনো এলিয়েন তিতুনির দেখা নেই, ব্যাপারটা কী? তিতুনি তখন গরম হয়ে বলল, “তুমি খালি আমার মাথায় ড্রিল করার চেষ্টা করে দেখো, আমি যদি তোমাদের ঠ্যাং ভেঙে না দেই!”
তিতুনির কথাটা শেষ হবার আগেই খটাশ করে একটা শব্দ হলো আর ডক্টর শামীম দড়াম করে নিচে পড়ে গেল, নিজের পা ধরে তখন সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। নাহার আর তার সাথে অন্যরাও তার কাছে ছুটে এলো, নাহার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
“পা, আমার পা!”
“কী হয়েছে তোমার পায়ের?”
“মনে হয় ভেঙে গেছে-মনে হয় এলিয়েনটা আমার পা ভেঙে দিয়েছে!”
তিতুনি অবাক হয়ে বলল, “আমি মোটেও তোমার পা ভাঙিনি-শুধু বলেছি ভেঙে দেব।”
শামীম তখন সাবধানে তার পা নাড়াল, তারপর ভাঙা গলায় বলল, “না ভাঙে নাই। কিন্তু আমার মনে হলো ভেঙে গেছে-খটাশ করে শব্দ হলো।”
বিদেশি দুইজন তখন শামীমের হাত ধরে তাকে দাঁড় করাল। নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে শামীম ভয়ে ভয়ে তিতুনির দিকে তাকাল। বিদেশি দুইজন তখন গলা নামিয়ে নিজেদের ভেতর কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর চোখের কোনা দিয়ে তিতুনিকে দেখল। তারপর নাহারকে বলল, “তুমি একটা সিরিঞ্জে করে দশ মিলিগ্রাম রিটাটিল নিয়ে এসো, আমি দেখতে চাই এই এলিয়েনটাকে অচেতন করা যায় কি না।”
নাহার ইতস্তত করে বলল, “কাজটা কি ঠিক হবে?”
বিদেশিগুলো বলল, “অবশ্যই ঠিক হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাঝে কোনো শর্টকাট নেই।”
তিতুনি বিদেশির কথাগুলো বুঝতে পারেনি কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গি দেখে অনুমান করল তাকে নিয়ে তারা কিছু একটা আপত্তিকর কাজ করতে যাচ্ছে। সে চোখ পাকিয়ে বলল, “তোমরা কী করতে চাইছ?”