যদি গোবর থাকে, তাহলে তোমার মাথার মাঝে মানুষের ইয়ে–”
টোটন বলল, “কী বললি? কী বললি তুই?”
“বলেছি, তোমার মাথার মাঝে মানুষের ইয়ে-মানে বাথরুম।”
টোটন হুংকার দিয়ে বলল, “আম্মু দেখেছ, দেখেছ তিতুনি কী বলছে?”
কিন্তু আম্মু আর আব্বুর তখন কার মাথার মাঝে গোবর আর কার মাথার মাঝে মানুষের ইয়ে সেটা শোনার আগ্রহ নাই। তারা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। অন্যান্য বাসা থেকেও মানুষজন বের হয়ে এসেছে, আব্বু আর আম্মু তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সবাই পুরো ব্যাপারটাকে একটা ভূমিকম্প বলেই ধরে নিয়েছে। শুধু তিতুনি জানে এটা ভূমিকম্প না, আকাশ থেকে কিছু একটা প্রচণ্ড বেগে তাদের বাসার পিছনে গাছগুলোর ভেতর দিয়ে মাটিতে পড়েছে। এটা নিশ্চয়ই একটা উল্কা। কেউ এই উল্কাটার কথা জানে না, শুধু তিতুনি জানে। অন্য যেকোনোদিন হলে সে এটা সবাইকে বলে দিত, তারপর সবাই মিলে বাসার পিছনে গিয়ে মাটিতে গেঁথে যাওয়া সেই উল্কাটা খুঁজে বের করত।
কিন্তু আজকে সবাই মিলে তিতুনির সাথে যে রকম ব্যবহার করেছে তার কারণে সে কাউকে কিছু বলল না। যখন কেউ থাকবে না তখন সে একা গিয়ে দেখবে উল্কাটা কোথায় পড়েছে। যদি পারে সে উল্কাটাকে বের করবে। উল্কা কত বড় হয় কে জানে। দেখতে কেমন হয় সেটাই বা কে জানে।
তিতুনি নিজের ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করে।
একটু আগে তার খুব মন খারাপ ছিল, এখন আর মন খারাপ নাই। মন খারাপের বদলে এখন তার ভেতরে উত্তেজনা আর কৌতূহল।
তিতুনি বাসার ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো।
০২. বাসার সবাই যখন নিজেরা
বাসার সবাই যখন নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তখন তিতুনি বাসা থেকে বের হয়ে এলো। তারা যেখানে থাকে সেটা একটা গ্রামও না আবার শহরও না। তিতুনি অবশ্য শহর খুব বেশি দেখে নাই, তাই শহর কী রকম হয় ভালো করে জানে না। শহর বলতে সে শুধু ঢাকা শহরকে দেখেছে-মানুষের ভিড়, একটার পাশে আরেকটা ঘিঞ্জি বিল্ডিং একবার দেখেই তার শহর দেখার শখ মিটে গেছে। তিতুনিদের বাসাটা ফাঁকা একটা জায়গায়, বাসার পিছনে বড় বড় গাছ, বলা যায় রীতিমতো জঙ্গল। এই জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নাই কিন্তু অনেক পাখি আছে। গাছে কাঠবিড়ালী আছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা ফাজিল টাইপের বানর আসে। রাত্রে মাঝে মাঝে শেয়াল ডাকে। সে যখন স্কুলে যায় তখন উঁচু একটা সড়ক ধরে হেঁটে যায়। সড়কটার দুই পাশে বড় বড় গাছ। স্কুলে বিশাল মাঠ, পিছনে বিরাট দিঘি। তিতুনি বড় হয়েছে খোলা জায়গায় গাছপালার ভেতরে। সে গাছে উঠতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, খালি পায়ে ধান ক্ষেতে দৌড়াতে পারে।
তিতুনি বাসা থেকে বের হয়ে ঘুরে বাসার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে দেখল কেউ তাকে লক্ষ করছে কি না। যখন দেখল কেউ তাকে দেখছে না তখন সে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের মতো জায়গাটায় ঢুকে গেল। কেউ দেখলেও অবশ্য কোনো সমস্যা নেই, সবাই জানে তিতুনি একা একা এই জায়গাটাতে অনেক সময় কাটায়। একটা গাছ থেকে সে দড়ি দিয়ে দোলনা ঝুলিয়েছে সেখানে দোল খায়। লটকনের সময় একটা লটকন গাছে বসে বসে জংলি টক লটকন খায়। বৃষ্টি হলে একটু কাদা হয়ে যায়, আগাছা বেড়ে যায়, জোঁক বের হতে থাকে, তখন সে এখানে বেশি ঢুকে না। এখন বৃষ্টি নেই, শুকনো আবহাওয়া, নিচে শুকনো পাতা, পায়ের নিচে কুড়মুড় শব্দ করে পাতাগুলো যখন গুঁড়ো হয়ে যায়, তিতুনির তখন কেমন জানি আনন্দ হয়।
তিতুনি সাবধানে হেঁটে যেতে যেতে চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মোটামুটি কোন জায়গাটাতে উল্কা পড়েছে সে বাসার ছাদ থেকে দেখেছে। যেভাবে পুরো এলাকাটা কেঁপে উঠেছে তাতে মনে হয় জায়গাটা খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবে না।
সত্যি সত্যি তিতুনি জায়গাটা পেয়ে গেল, মাটিতে একটা গর্ত এবং সেই গর্তের চারপাশে ফাটল। পুরো মাটিটা একেবারে ঝলসে গেছে, গাছ, লতাপাতা গরমে পুড়ে গেছে, আগুন যে ধরে যায়নি। সেটাই আশ্চর্য।
তিতুনি হেঁটে হেঁটে গর্তটার কাছে গেল, মনে হলো আশেপাশের মাটিটা পুড়ে একেবারে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল গাছের ডালপালা ভেঙে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে গেছে। তিতুনি গর্তটার কাছে গিয়ে অবাক হয়ে গেল, গর্তটার মুখের কাছে পুরো মাটিটা ঝলসে কাঁচের মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ছোট-বড় কাঁচের টিক দিয়ে কেউ একজন অনেক যত্ন করে এটা তৈরি করেছে। তিতুনি গর্তটার ভেতরে উঁকি দিল, অনেক গভীর গর্ত, বাইরে থেকে ভেতরে কিছু দেখা যায় না। একটা টর্চ লাইট নিয়ে এলে ভেতরে আলো ফেলে দেখা যেত। তিতুনি গর্তের ভেতরে হাত দিয়ে দেখে, গোল গর্তটার পুরোটা প্রচণ্ড তাপে মসৃণ কাঁচের মতো হয়ে গেছে। গর্তটা এখনো গরম। তিতুনি অবাক হয়ে গর্তটার ভেতরে তাকিয়ে রইল।
ঠিক তখন হঠাৎ খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। তিতুনির মনে হলো কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এত বাস্তব অনুভূতি যে তিতুনি মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাল, দেখার চেষ্টা করল কেউ সত্যি সত্যি তার দিকে তাকিয়ে আছে কি না। কেউ কোথাও নেই, চারিদিকে শুধু লম্বা লম্বা গাছ, বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। তিতুনির কেমন জানি একটু ভয় ভয় করতে থাকে। সকালবেলা চারিদিকে দিনের আলোতে ঝলমল করছে, এর মাঝে ভয় পাবার কিছু নেই কিন্তু তারপরও তিতুনির কেমন জানি ভয় ভয় করে। কী নিয়ে ভয় সেটাও সে বুঝতে পারছে না, সেটাই সবচেয়ে অবাক ব্যাপার। তিতুনি কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ করে তার মনে হলো এখানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তার এখানে থাকা ঠিক হবে না। তার এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত কিন্তু সে নড়তে পারছিল না। তার কেন জানি মনে হতে থাকে সামনে মাটি চৌচির করে ফেটে তৈরি হওয়া গর্তটার ভেতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসবে, ভয়ংকর কোনো একটা প্রাণী, যেটা এখন গর্তের ভেতরে ঘাপটি মেরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিতুনির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে।