আব্বু বললেন, “তিতুনি, তুমি কেন টোটনকে জ্বালাচ্ছ?”
আম্মু বললেন, “ছিঃ! তিতুনি ছিঃ। সবার সামনে বসে এ রকম মিথ্যে কথা বলছ? এত বড় হয়েছ, এখনো এক গ্লাস পানি হাত দিয়ে ঠিক করে ধরতে পারো না? সকালবেলা একটা গ্লাস ভেঙে ফেললে! আমার সেটের গ্লাস। আবার টোটনের দোষ দিচ্ছ?”
টোটন বলল, “পাজি মেয়ে। মিথ্যুক মেয়ে।”
আব্বু বললেন, “ব্যস অনেক হয়েছে।”
আম্মু বললেন, “যাও ঝাড় নিয়ে এসে ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করো। শাস্তি না দিলে তুমি শিখবে না।”
টোটন বলল, “যা। ঝাড় আন। ঝাড়দারনী।”
তিতুনি ঝাড় দিয়ে ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করল। টেবিল মুছে দিল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে ছাদের রেলিংয়ে মুখ রেখে দূরে তাকিয়ে রইল। দূরে তাকিয়ে তাকিয়ে তিতুনি কল্পনা করে যে একদিন সে যখন বড় হয়ে অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে, যখন তার অনেক টাকা পয়সা হবে, তখন সে দুই ট্রাক বোঝাই করে কাঁচের গ্লাস নিয়ে আসবে-আজকে যে গ্লাসটা ভেঙেছে ঠিক সে রকম গ্লাস। তারপর বাসায় যখন কেউ থাকবে না তখন সেই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কাঁচের গ্লাস দিয়ে বাসাটা বোঝাই করে দেবে। আম্মু আর আব্বু যখন বাসায় এসে দরজা খুলে বাসায় ঢুকতে যাবে তখন অবাক হয়ে দেখবে বাসাভর্তি শুধু গ্লাস আর গ্লাস-ভেতরে ঢোকারও জায়গা নেই। আম্মু অবাক হয়ে বলবে, “এখানে এত গ্লাস কোথা থেকে এলো?”
তখন তিতুনি আড়াল থেকে বের হয়ে বলবে, “আমি এনেছি।”
আম্মু আর আব্বু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবেন, “কেন? তিতুনি, কেন তুমি এতগুলো গ্লাস এনেছ?”
তখন তিতুনি বলবে, “মনে আছে, আজ থেকে বিশ বছর আগে একদিন আমার হাত থেকে পড়ে একটা গ্লাস ভেঙে গিয়েছিল? সেদিন তোমরা আমাকে কত বকাবকি করেছিলে মনে আছে? আমাকে দিয়ে সেই ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করিয়েছিলে মনে আছে?”
আম্মু বলবে, “না তিতুনি, আমার মনে নাই।”
আব্বুও বলবে, “কই? আমার তো মনে পড়ছে না!”
তখন তিতুনি বলবে, “তোমাদের মনে না থাকতে পারে আম্মু আর আব্ব, কিন্তু আমি সেটা ভুলি নাই। আমি কখনো ভুলব না। বিশ বছর আগে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি কখনো আমার ক্ষমতা হয় তাহলে আমি তোমাদের বাসা ভর্তি করে গ্লাস দিয়ে যাব। গ্লাস আর গ্লাস আর গ্লাস। আমার ক্ষমতা হয়েছে, তাই তোমাদের বাসা ভর্তি করে গ্লাস দিয়ে যাচ্ছি। তোমরা এই গ্লাস নিয়ে সুখে থেকো। আমি গেলাম।”
আম্মু তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলবে, “কোথায় গেলি?”
“আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে। তোমরা আমাকে আর পাবে না।”
তখন আম্মু আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলবে, “আমরা তাহলে কাকে নিয়ে থাকব?”
তিতুনি তখন মুখ শক্ত করে বলবে, “তোমরা আমাকে কখনো ভালোবাস নাই। আদর করো নাই। তোমাদের কাছে আমার থেকে বেশি আদরের জিনিস হচ্ছে এই গ্লাস। তোমরা এই গ্লাস নিয়ে থাকো।”
আব্বু বলবে, “কিন্তু একজন মানুষ তার সন্তান ছাড়া শুধু গ্লাস নিয়ে কেমন করে থাকবে মা তিতুনি?”
তখন তিতুনি বলব, “কেন আব্বু? তোমাদের সন্তান টোটন তো আছে। তোমরা তাকেই যখন বেশি ভালোবাস তাকে নিয়েই থাকো।”
তখন আম্মু হাউমাউ করে কেঁদে বলবে, “কিন্তু টোটন তো বড় সন্ত্রাসী। টোটন তো ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পাবলিক গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে দিয়েছে। পুলিশ আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। সে তো মানুষ নামের কলঙ্ক।”
তিতুনি তখন হা হা করে হেসে উঠে বলবে, “আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি যখন ছোট একটা মেয়ে ছিলাম, যখন তোমাদের ছেলে টোটন আমার উপরে সন্ত্রাসী হয়ে অত্যাচার করেছে, তখন তোমরা তো একবারও আমার পাশে দাঁড়াও নাই। সন্ত্রাসী টোটনের অত্যাচার থেকে আমাকে রক্ষা করো নাই। তখন যদি তাকে শাসন করতে তাহলে আজ সে এত বড় সন্ত্রাসী হতো না। দেশের মানুষ তাকে চান্দি ছোলা টোটন বলত না।”
আম্মু তখন বলত, “আমার ভুল হয়েছে। ভুল হয়েছে মা তিতুনি। তুই আমাদের ক্ষমা করে দে।”
তিতুনি যখন এই দৃশ্যটা কল্পনা করছে ঠিক তখন হঠাৎ বিকট শব্দ করে গাছের ডাল-পাতা ভেঙে কিছু একটা প্রচণ্ড বেগে মাটিতে আঘাত করল। সমস্ত বাসা থরথর করে কেঁপে উঠল, ঝনঝন শব্দ করে অনেকগুলা কাঁচের জানালা ভেঙে গেল। গাছে বসে থাকা অনেকগুলো পাখি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল। বাসার ভেতর থেকে আব্বু-আম্মু আর টোটন চিৎকার করে উঠল। তিতুনি শুনল দরজা খুলে সবাই বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, টোটন “ভূমিকম্প ভূমিকম্প করে চিৎকার করছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তিতুনির কয়েক সেকেন্ড লাগল, যখন বুঝতে পারল তখন ছাদের অন্য পাশে গিয়ে তিতুনি নিচের দিকে তাকায়। বাসার সামনে খোলা জায়গাটাতে আব্বু-আম্মু আর টোটন দাঁড়িয়ে আছে। তিতুনি দেখল, আম্মু পাগলের মতো তার নাম ধরে ডাকছেন।
তিতুনি ছাদ থেকে বলল, “আম্মু, আমি এখানে।”
টোটন বলল, “তাড়াতাড়ি নাম গাধা কোথাকার।”
তিতুনি বলল “কেন?”
টোটন বলল, “গাধা, তুই জানিস না ভূমিকম্প হলে বাসার বাইরে থাকতে হয়?”
তিতুনি বলল, “এটা ভূমিকম্প না।”
টোটন বলল, “এটা ভূমিকম্প না মানে? দেখছিস না কীভাবে বাসা কাঁপছে! মাথার মাঝে গোবর?”
তিতুনি বলতে যাচ্ছিল সে দেখেছে আকাশ থেকে প্রচণ্ড বেগে কিছু একটা তাদের বাসার পিছনে পড়েছে, কিন্তু মাথার মাঝে গোবর শুনে তিতুনির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, “আমার মাথার মাঝে