টুকি এবং ঝা বিশেষ মহাকাশচারীর পোশাক পরে তাদের জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারে বসে আছে। রোবি তাদের জীবন ধারণের সহায়ক যন্ত্রপাতিগুলো তাদের পোশাকের সাথে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের শরীরে সমস্ত তথ্য মূল কম্পিউটারের ডাটাবেসে সংগৃহীত হচ্ছে। মহাকাশযানটির ভিতরে একটা লাল আলো একটু পর পর জ্বলে উঠছে। উপরে একটা বড় ঘড়িতে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে, যে সংখ্যাটি দেখানো হচ্ছে সেটি কমতে কমতে যখন শূন্য হয়ে যাবে সেই মুহূর্তে মহাকাশযানটি হাইপার ডাইভ দিয়ে বিশাল দূরত্ব পার হয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। প্রচলিত বিজ্ঞান ব্যাপারটিকে এখনো সত্যিকার অর্থে আয়ত্ত করতে পারে নি, দুর্ঘটনা প্রায় নিত্যনৈমত্তিক। হাইপার ডাইভ দিয়ে যেখানে পৌঁছানোর কথা সেখানে না পৌঁছে বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও পৌঁছে যাওয়া অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। আরো একটি ব্যাপার ঘটে যায় মাঝে মাঝে, সময় নিয়ে গোলমাল হয়ে যায়—একদিন রওনা দিয়ে আগের দিন পৌঁছে যাবার মত।
শেষ মুহূর্তে রোবি সমস্ত মহাকাশযানে ছোটাছুটি করতে লাগল। মূল ইঞ্জিন চালু করে কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুকে পড়ে চিৎকার করে বলল, হাইপার ডাইভের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান মহামান্য টুকি এবং মহামান্য ঝা!
টুকি এবং ঝা শক্ত করে তাদের চেয়ারে হাতল চেপে ধরল, মহাকাশযানের গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে, বড় বড় ইঞ্জিনগুলো প্রচণ্ড শব্দে গর্জন করতে শুরু করেছে, মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপছে মনে হচ্ছে বুঝি ভেঙে পড়বে যে কোন মুহূর্তে। টুকি এবং ঝা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেয়ালে লাগানো বড় ঘড়িতে সংখ্যাটি কমে আসছে দ্রুত। কমতে কমতে সংখ্যাটি শূন্যে এসে স্থির হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল সাথে সাথে পুরো মহাকাশযানটি দুলে উঠল একবার, টুকি
এবং ঝা জ্ঞান হারালো সাথে সাথে।
টুকি এবং ঝায়ের যখন জ্ঞান হল তারা তখন সৌরজগতের মাঝে ঢুকে পড়েছে, মহাকাশযানটি মঙ্গল গ্রহের পাশে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের উপর ঝুকে আছে, কোন একটা কিছু দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে। টুকি চেয়ারের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, সবকিছু ঠিক আছে রোবি?
বুঝতে পারছি না।
কী বুঝতে পারছ না?
সৌরজগতে আমরা ঢুকে গেছি, মঙ্গল গ্রহের পাশে দিয়ে ছুটে যাচ্ছি কিন্তু তবুও হিসেব মিলছে না।
কী হিসেব মিলছে না?
গ্রহগুলো যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই।
কোথায় আছে?
অন্য জায়গায়।
ঝা শুকনো মুখে বলল, তার মানে কী?
মনে হচ্ছে সময় নিয়ে গোলমাল হয়ে গেছে। আমরা আগে চলে এসেছি।
কিসের আগে?
সময়ের আগে।
টুকি চিন্তিত মুখে বলল, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পার না? জিজ্ঞেস করতে পার না আজকে কত তারিখ, কি বৃত্তান্ত?
সেটাই চেষ্টা করছি মহামান্য টুকি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কিছুতেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে–
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখতে পারছে না। পৃথিবীর চোখে আমরা অদৃশ্য।
টুকি নিজের চেয়ার থেকে উঠে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, কী বলছ তুমি?
আপনি নিজেই দেখুন মহামান্য টুকি। আমরা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বলের কারণে আমাদের গতিপথ বামদিকে বেঁকে যাবার কথা কিন্তু সেটা বেঁকে যাচ্ছে না। আমরা সোজাসুজি এগিয়ে যাচ্ছি।
টুকি ব্যাপারটা বুঝতে পারল না কিন্তু তবু জিজ্ঞেস করল, এরকম হওয়ার মানে কী?
মানে আমরা এখনো প্রকৃত জগতে প্রবেশ করি নি। অতিপ্রাকৃত জগতে আছি।
প্রকৃত জগতে কখন ঢুকব?
আমি জানি না মহামান্য টুকি। এ ধরনের ব্যাপার খুব বেশি ঘটে নি। তাই কেউ ঠিক জানে না।
ঝা-ও নিজের চেয়ারে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এসে বলল, এখন কী হবে রোবি? আমরা কী মরে যাব?
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মরে যাওয়ার ব্যাপারটি আমি ভাল বুঝি না। তবে বাস্তব এবং অবাস্তব জগৎ বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা এখন অবাস্তব জগতে আছি—এক অর্থে বলতে পারেন। আমরা মরে আছি।
মরে আছি? ঝা আর্তনাদ করে বলল, মরে আছি মানে আবার কী?
আমরা যদি বাস্তব জগতে ফিরে না আসি তাহলে বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
টুকি এবং ঝা মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইল। মহাকাশযানটি তীব্র গতিতে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় নেই। রোবির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই অবাস্তব অতিপ্রাকৃত জগত থেকে মহাকাশযানটি পৃথিবী ভেদ করে কোন অচেনা জগতে চলে যাবে। টুকি রোবির দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি বলেছ আমরা সময়ের আগে চলে এসেছি?
মনে হচ্ছে তাই।
কত আগে?
রোবি হিসেব করে তারিখটি বলতেই ঝা চমকে উঠে বলল, অসম্ভব।
কী অসম্ভব?
ঐ তারিখে আমরা পৃথিবীতে ছিলাম, চুরি করতে গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল ব্যাংকে।
কিন্তু গ্রহের অবস্থান দেখুন। পৃথিবীর সাথে মঙ্গল গ্রহের আনুপাতিক অবস্থান। বুধ গ্রহ শুক্র গ্রহকে দেখুন–
রোবির কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মহাকাশযানটি প্রচণ্ড শব্দ করে কাঁপতে শুরু করে, মনে হচ্ছে সেটি বুঝি তার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। রোবি মনিটরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, বাস্তব জগতে ঢুকে যাচ্ছি–
টুকি এবং ঝা প্রচণ্ড আঘাতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। কোনমতে নিজেদের সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিন্তু মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনমতেই আর তাল সামলানো যাচ্ছে না। কন্ট্রোল প্যানেলটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে দেখতে পেল মহাকাশযানটির দেয়ালে দেয়ালে আগুনের শিখা জ্বলে উঠছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল তারা তারপর হঠাৎ করে গাঢ় নিঃশব্দ অন্ধকারে ড়ুবে গেল চারিদিক।