টুকি নরম একটা চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। আলস্যে চোখ আধবোজা হয়ে আছে, সে অবস্থাতেই চোখ অল্প খুলে ডাকল, রোবি।
রোবি কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ছুটে এসে বলল, বলুন মহামান্য টুকি। আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি?
আপাতত এক গ্লাস তরল পানীয় নিয়ে এস তারপর কিনিস্কীর নবম সিম্ফোনীটা লাগিয়ে দাও।
রোবি টুকির জন্যে নবম সিম্ফোনী লাগিয়ে দিয়ে তরল পানীয় আনার জন্যে ছুটে গেল। ক্লাসিক্যাল সংগীত ঝায়ের মোটেই পছন্দ নয়। বিরক্ত হয়ে বলল, দিনরাত এসব কী প্যানপ্যানানি শোন? মেজাজ গরম হয়ে যায়।
টুকি চোখ অল্প একটু খুলে বলল, না হলে করবটা কী? এই মহাকাশযানে আর কিছু করার আছে?
কথাটা সত্যি, ঝা আর কিছু বলতে পারে না। টেবিলে রাখা বড় একটা গলদা চিংড়ির কাটলেট নিয়ে চিবুতে শুরু করে। রোবি কিছুক্ষণের মাঝেই টুকির জন্যে তরল এক গ্লাস পানীয় নিয়ে আসে। টুকি সেটায় চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরামের এক ধরনের শব্দ করল।
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ স্ক্রিণটা পরীক্ষা করে বলল, আমরা এখন এম সেভেন্টি ওয়ানের মানুষের শেষ কলোনীটা পার হয়ে যাচ্ছি।
ঝা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাও।
রোবি বলল, মহামান্য ঝা, মানুষের এই বসতি থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ওসব বলে লাভ নেই। মানুষের যে কোন বসতি বিপজ্জনক।
রোবি মধুর গলায় বলল, কিন্তু এই বসতিটি সত্যিই শান্তিপূর্ণ বসতি। এদের মাঝে কোনই বিপদ নেই।
টুকি চোখ খুলে বলল, কেন এই কথা বলছ?
এই বসতির মানুষ হচ্ছে, সৃষ্টি জগতের মানুষদের মাঝে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ মানুষ। তারা এত শান্তিপূর্ণ মানুষ যে এদের সমাজে কোন অস্ত্র নেই।
কোন অস্ত্র নেই?
না।
তাহলে চোর ডাকাতদের ধরে কেমন করে?
এদের সমাজে কোন চোর-ডাকাত নেই।
টুকি সোজা হয়ে বসে বলল, চোর-ডাকাত নেই? কী বলছ তুমি?
সত্যি কথাই বলছি মহামান্য টুকি। এই দেখুন গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। এই সমাজে চোর ডাকাত অপরাধী নেই, পুলিশ শান্তিরক্ষার মানুষও নেই।
টুকি জ্বলজ্বলে চোখে ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝা, শুনেছ কথাটা। মানব সমাজ অথচ কোন চোর-ডাকাত নেই। পুলিশ নেই।
ঝা একটা হাই তুলে বলল, নীচু ধরনের সমাজ। আনন্দ উত্তেজনাহীন সমাজ। খোঁজ নিয়ে দেখ সেখানে ধন-সম্পত্তিও নেই। সবাই মাদুরে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করছে।
রোবি বলল, আমার বেয়াদবী মাপ করবেন মহামান্য ঝা, কিন্তু গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে লেখা রয়েছে এখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদগুলো রয়েছে। অতুলনীয় ঐশ্বর্য।
এবারে ঝাও সোজা হয়ে বসল। টুকির দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছ টুকি?
শুনেছি।
কী মনে হয়?
অতুলনীয় ঐশ্বর্য অথচ চোর-ডাকাত নেই, পুলিশও নেই। মনে হচ্ছে আমাদের জন্যে কেউ একটা দাও মারার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ঝা দুই হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলল, শুয়ে বসে থেকে থেকে শরীর ম্যাদা মেরে গেছে, চল একটা দাও মেরে আসি।
টুকি মাথা নেড়ে বলল, যে সমাজে চোর-ডাকাত নেই তাদেরকে ডাকাতি সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে আসাই উচিত। না হয় তাদের জ্ঞানভাণ্ডার অপূর্ণ থেকে যাবে।
ঝা দাঁত বের করে হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। কিভাবে করবে কাজটা?
খুব সোজা। ভারী কয়টা অস্ত্র নিয়ে গিয়ে হাজির হব কিছু সোনাদানা একত্র করে হুংকার দিয়ে বলব, কেউ কাছে আসেলেই গুল্লি।
ঝা একটু ইতস্তত করে বলল, কাজটা গোপনে করলে হত না?
সারাজীবন তো গোপনেই কাজ করলাম। একবার প্রকাশ্যে করে দেখি না কেমন লাগে। এই রকম সুযোগ আর কখনো পাবে বলে মনে হয়?
তা ঠিক।
রোবি বেশ মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথা শুনছিল এবারে সুযোগ পেয়ে বলল, আপনারা এই শান্তিপূর্ণ মানব বসতির উপরে হামলা করবেন বলে মনে হয়?
হ্যাঁ। আপত্তি আছে তোমার?।
কী যে বলেন আপনারা–আমার কেন আপত্তি থাকবে? অত্যন্ত চমৎকার একটা কাজ হবে। অত্যন্ত আনন্দদায়ক কাজ।
তাহলে আর দেরী করা যায় না। যাও—স্কাউটশীপটাকে রেডি কর, কিছু ভাল ভাল অস্ত্র নিয়ে আস। ছোট মাঝারী আর লম্বা রেঞ্জের অস্ত্র।
এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
ঘন্টা খানেক পরে দেখা গেল টুকি এবং ঝা রোবিকে নিয়ে ছোট একটা স্কাউটশীপে করে সোনাদানা ডাকাতি করার জন্যে উড়ে চলেছে।
গ্রহটি ছোট এবং মসৃণ। উপর দিয়ে দুবার পাক খেয়ে এসে টুকি বলল, এইটাই সেই গ্রহ? মানুষজন কোথায়?
ভিতরে।
ভিতরে? গ্রহের ভিতরে মানুষ থাকে নাকি? মানুষ থাকবে গ্রহের উপরে।
এই গ্রহটির আকার এত ছোট যে এর কোন বায়ুমণ্ডল নেই। তাই এর বাইরে কেউ থাকতে পারে না। সবাই ভিতরে থাকে। তা ছাড়া এত ছোট গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বলতে গেলে নেই; সেজন্যে বাইরে থাকার কোন ঝুকি নেই।
ঝা বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝে না, ইতস্তত করে বলল, যদি বাইরে মাধ্যাকর্ষণ না থাকে তাহলে কিভাবে ভিতরে থাকবে?
রোবি বলল, গ্রহটিকে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয় তখন সেন্ট্রিফিউগাল বলের কারণে ভিতরে এক ধরনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করা যায়।
ঝা কিছুই না বুঝে বলল, অ।
টুকি চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু গ্রহের ভিতরে ঢুকব কেমন করে?
নিশ্চয়ই ঢোকার একটা কিছু রাস্তা আছে। রোবি তার টেলিস্কোপিক চোখ ব্যবহার করে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়, খানিকক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলল, পাওয়া গেছে। ঐ যে একটা গোল গর্ত।