ঝায়ের ঘরের সামনে গোলমাল আরো বাড়তে থাকে। শান্তি রক্ষা রবোট দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না বলে বেশ কিছু পুলিশ রবোট এনে নামিয়ে দেওয়া হল। তারা বেশ রূঢ় ধরনের, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং থলথলে শূড়ের মত নাক মুচড়ে তারা কিছুক্ষণের মাঝেই ভীড় ফাঁকা করে দিল।
পরের দুইদিন কী হল ঝা জানতে পারল না তবে প্রত্যেক দিন তাকে দেখতে যে রকম হাজার হাজার মানুষ এসে ভীড় জমাতো সেরকম কেউ ভীড় জমালো না। ঝা নিজের ঘরে বসে, ভাল-মন্দ খেয়ে এবং ভিডিও স্ক্রিনে শূড়ের মত লম্বা নাকের পরিচর্যার উপরে নানা ধরনের অনুষ্ঠান শুনে শুনে দিন কাটিয়ে দিল। তৃতীয় দিন খুব ভোরেই তার ঘরের দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল কয়েকজন মানুষ। তাদের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, কয়েকজন পুলিশ এবং কিছু শান্তিরক্ষাকারী রবোট, সবার পিছনে মোটাসোটা দয়ালু চেহারার কয়েকজন মহিলা। সরকারি কর্মচারীদের মাঝে যে সবচেয়ে উচ্চপদস্থ সে ঝাকে দেখে খুব। ঘাবড়ে গেলেও মুখে ভদ্রতার একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আমাদের বিচার বিভাগ রায় দিয়েছে তোমাকে এভাবে পরিদর্শন করানো মানবতা বিরোধী কাজ। কাজেই তোমাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে।
ঝা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং ভয় পেয়ে সবাই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ঝা কোন মতে নিজের উচ্ছাসকে সামলে নিয়ে বলল, সত্যি?
সত্যি। তোমাকে তোমার নিজের দেশে ফিরে যেতে সাহায্য করা হবে।
ঝা আনন্দে ঝলমল করে আবার একটা ছোট লাফ দিয়ে ফেলল এবং উপস্থিত সবাই আবার ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। পুলিশ রবোটটি বলল, যারা আপনাকে ধরে এনেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
মোটাসোটা দয়ালু চেহারার মহিলাটি এক পা এগিয়ে এসে বলল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি এখনো তোমাকে দেওয়া হয় নি।
কী?
আমরা তোমার একটি ব্যাপারে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম, সরকার আমাদের আবেদন রক্ষা করেছেন।
কী আবেদন?
যেহেতু তোমার নাক নেই—তোমার চেহারা অত্যন্ত কুৎসিত। তোমার নিজের ভিতরে সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই গভীর দুঃখ রয়েছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম সরকারি খরচে অস্ত্রোপচার করে তোমাকে একটি সত্যিকার নাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে। সরকার রাজী হয়েছে।
ঝায়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল, আমতা আমতা করে বলল, কী—কী বললে? নাক লাগিয়ে দেবে।
হ্যাঁ! সত্যিকারের নাক। নরম তুলতুলে পেলব একটি নাক। ভাব বিনিময়ের সময় তুমি আমাদের মত সেটা নাড়তে পারবে, দোলাতে পারবে।
ঝা বার কয়েক ঢোক গিলে আর্তনাদ করে বলল, লাগবে না আমার নাক। আমার যেটা আছে সেটাই ভাল।
দয়ালু চেহারার মহিলা তার পুরুষ্ট ড়ের মত নাক দুলিয়ে বলল, আমাদের উপর অভিমান কেন করছ? তোমার উপর যে অবিচার করা হয়েছে তার খানিকটা অন্তত আমাদের ক্ষমা করিয়ে নেবার সুযোগ করে দাও।
আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার নাক লাগবে না, লাগবে না।
উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী জিব দিয়ে চুক চুক করে বলল, আহা বেচারা, এমনিতেই নিজের চেহারা নিয়ে নিজের ভিতরে গভীর হীনমন্যতা বোধ তার উপর সেটি নিয়ে এক ধরনের প্রদর্শনী সব মিলিয়ে মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। নিজের ভিতর কিভাবে একটি রাগ পুষে রেখেছে দেখেছ?
দয়ালু চেহারার মোটাসোটা মহিলা বলল, ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। দশজনের মত যখন তারও একটা লম্বা পেলব তুলতুলে নাক হবে সে সব দুঃখ ভুলে যাবে।
১১. ঝা অপারেশন থিয়েটারে
ঝা অপারেশন থিয়েটারে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। কিছুতেই সে তার নাকে অস্ত্রোপচার করতে দিতে রাজী হচ্ছিল না বলে তাকে তার বিছানার সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার বিশাল শক্তিশালী শরীর নিয়ে সে বিছানাসহই প্রায় ওলট পালট খাচ্ছিল বলে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে রাখা আছে। আধো ঘুমে তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে আছে তার মাঝে সে ঘোলা চোখে অস্ত্রোপচারকারী রবোট এবং ডাক্তারকে দেখার চেষ্টা করল। উপর থেকে তীব্র আলো এসে পড়ছে তাই ভাল করে সে তাদের চেহারা দেখতে পেল না কিন্তু যেটুকু দেখতে পেল তাতে মনে হল সে এই রবোট এবং ডাক্তারকে আগে দেখেছে। কোথায় দেখেছে সে কিছুতেই মনে করতে পারল না ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে তার মস্তিষ্ক চিন্তাও করতে পারছে না। চিন্তা করতে ইচ্ছেও করছে না, পুরো ব্যাপারটা একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মত। সাধারণ দুঃস্বপ্ন ভেঙে গেলে সব ঝামেলা মিটে যায় এই দুঃস্বপ্ন সেরকম নয়। এটা ভেঙে যাবার পর দেখা যায় নতুন দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছে। গভীর হতাশার মাঝে ড়ুবে যেতে যেতে ঝা অপারেশান থিয়েটারে জ্ঞান হারাল।
ঝায়ের জ্ঞান হবার পর সে নিজেকে নতুন একটা ঘরে আবিষ্কার করে। চারদিকে সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা হাত দিয়ে নিজের নাক স্পর্শ করার চেষ্টা করে দেখল তার দুই হাত শক্ত করে বিছানার সাথে বাধা। ঝা খানিকক্ষণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে কোন সুবিধে করতে না পেরে বিকট স্বরে একটা চিৎকার করল এবং সাথে সাথেই ডাক্তার, নার্স এবং অস্ত্রোপচারকারী রবোট ছুটে এসে ঢুকল। নার্স নাক দুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?
ঝা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার সর্বনাশ কী হয়ে গেছে?
নার্স শান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল, সর্বনাশ হবে কেন? কী চমৎকার তুলতুলে কোমল একটা নাক লাগিয়েছে তোমার, নাড়াও দেখি একটু—