কয়েকদিন পরের কথা। ঝা একটা ছোট ঘরে বসে আছে, ঘরের একদিকে স্বচ্ছ দেওয়াল সেখানে অনেক মানুষের ভীড় সবারই নাকের জায়গায় একটা শূঁড়। কারো শূঁড় লম্বা, কারো খাটো। কারো শূঁড় মোটা কারো সরু। কারো শূঁড় তেল চিকচিকে, কারো শূঁড় খসখসে বিবর্ণ। সবার শূঁড়ই নড়ছে, দেখে মনে হয় নাকে বুঝি একটা সাপ কামড়ে ধরে কিলবিল করছে। প্রথম প্রথম দেখে ঝায়ের শরীর গুলিয়ে আসত, আজকাল অভ্যাস হয়ে আসছে, ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাক নেই কেন?
ঝা কোন উত্তর দিল না। সে এই ছোট ঘরটাতে বসে থাকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাকে দেখতে আসে, যারা আসে তাদের অনেকেই এই প্রশ্নটা করে, এর কোন উত্তর তার জানা নেই। যারা তাকে দেখতে এসেছে সবাই টিকেট কিনে এসেছে তাদের ধারণা নাক খসা দানব নামের এই বিচিত্র প্রাণীটির মুখ থেকে তাদের কোন একটা উত্তর পাওয়ার অধিকার আছে। সবাই যে একটি প্রশ্নই করে তা নয়, অনেকে বৈজ্ঞানিক প্রশ্নও করে থাকে। যেমন একদিন একজন প্রশ্ন করল, আমাদের এই গ্রহে যে বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে সেটাকে পরিশোধন করার জন্যে ধীরে ধীরে আমাদের এই চমৎকার সুন্দর নাকটিকে তৈরি করা হয়েছে, এটি আসলে একটি ফিল্টার। বিষাক্ত গ্যাস ফিল্টার ছাড়া তুমি বেঁচে আছ কেমন করে?
ঝা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি এই গ্রহের মানুষ নই।
তোমার গ্রহের নাম কী? সেটি কোথায়?
ঝা তার গ্রহের নাম জানলেও সেটি কোথায় ভাল করে জানে না বলে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। দর্শকদের মাঝে যাদের শূড়ের মত নাকটি বেশ কোমল পেলব এবং লম্বা তারা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, সুন্দর নাকের অধিকারীরা সমাজে একটা বিশেষ স্থান দখল করে থাকে। তোমার যে নাক নেই। সেই জন্যে তুমি কী সমাজে অপাংতেয়?
ব্যবসায়ী ধরনের একজন একদিন জিজ্ঞেস করল, নাককে কোমল এবং পেলব করার বিশেষ ধরনের ক্রীম রয়েছে, নাককে লম্বা করার জন্যে বিশেষ ধরনের মালিশের তেল রয়েছে, নাককে সতেজ রাখার জন্যে বিশেষ ধরনের ওষুধ রয়েছে, এগুলো আমাদের গ্রহে বিশাল শিল্প গড়ে তুলেছে। আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখছে। তোমাদের গ্রহের অর্থনীতি কী রকম?
ঝা আবার নিঃশ্বাস ফেলল, সে একজন পেশাদার চোর, পৃথিবীর অর্থনীতি, সমাজনীতি বা রাজনীতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় নি। অর্থনীতি যেরকমই হোক, চুরি করার মত জিনিসপত্র সবসময়েই ছিল।
ষন্ডা গোছের বদমেজাজী চেহারার একজন মানুষ একদিন ঝাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা যখন একজন আরেকজনকে গালিগালাজ করি নাক নিয়ে অনেক কিছু বলি। যেমন এখানকার প্রিয় গালি নাক-কাটা তোমরা কী বলে গালি দাও?
পৃথিবীতে কী বলে একে অন্যকে গালিগালাজ করে সেটা সম্পর্কে ঝায়ের মোটামুটি ভাল ধারণা আছে কিন্তু ছোট একটা ঘরে প্রদর্শনীর বস্তু হয়ে তার সেটা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে করল না। ষন্ডা গোছের বদমেজাজী চেহারার মানুষটি মনে হল কোন একটা উত্তর না নিয়ে যাবে না, সে আবার জিজ্ঞেস করল, কী হল? আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন নাক-কাটা?
ঝায়ের হঠাৎ খুব মেজাজ খারাপ হল, মানুষটার দিকে তেড়ে উঠে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
মোটাসোটা একজন মহিলা ড়ের মত লম্বা নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাজটা একেবারে ভাল হচ্ছে না।
আরেক জন বলল, কোন কাজটা?
এই যে একজন মানুষকে শুধুমাত্র তার শারীরিক বিকলঙ্গতার জন্যে দশজন মানুষের কাছে দেখানো হচ্ছে।
বয়স্ক একজন মানুষ সমবেদনার ভঙ্গীতে খুঁড়টাকে একবার নাড়িয়ে নিয়ে বলল, নাক নেই বলে মানুষটার চেহারা খারাপ হতে পারে কিন্তু তাই বলে যে তার মনে দুঃখ কষ্ট নেই সেটা তো সত্যি না।
ঠিক আমরা যেভাবে কাদি প্রায় সেভাবেই কাঁদছে, নাক নেই বলে সেটাকে ফোস ফোস করে দুলাতে পারছেনা।
মোটাসোটা মহিলাটি নরম গলায় বলল, কিন্তু দেখ, চোখ থেকে ঠিকই পানি বের হচ্ছে। আহা বেচারা!
ঝায়ের ভেউ ভেউ করে কান্না দেখেই হোক আর মোটাসোটা মহিলার নরম গলার কথা শুনেই হোক উপস্থিত দর্শকদের মাঝে হঠাৎ একটা সমবেদনার ভাব চলে এল। তাদের কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল:
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও,
নাক-কাটা দানবকে ছেড়ে দাও–
হৈ চৈ চেচামেচি দেখে শান্তি রক্ষার রবোটগুলো এসে ভীড় জমাতে থাকে, তারা ভীড় ভেঙে দেবার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারে না, ভীড় আরো বেড়েই যেতে থাকে। দর্শকদের বেশির ভাগই এখন ঝায়ের পক্ষে। পারলে তারা এক্ষুণি ঝাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে। উপস্থিত মানুষের সমবেদনা পেয়ে ঝায়ের মনটা আরো ভার হয়ে আসে সে নিও পলিমারের আস্তিনে চোখ নাক মুছে কাতর চেহারা করে ভীড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে পেল, মোটাসোটা দয়ালু চেহারার মহিলারা একত্র হয়ে তাদের খুঁড় নেড়ে নেড়ে উঁচু গলায় কথা বলছে। বাড়াবাড়ি দয়ালু একজনের চেহারায় একটু জাঁদরেল ভাব চলে এসেছে সে হাত উপরে তুলে চিৎকার করে বলছে, মানুষকে ঘৃণা করতে হয় না। নাককাটা এই দানবের চেহারা যত কুশ্রীই হোক, তার থলথলে মোটা শরীর দেখে আমাদের ভিতরে যত ঘৃণাই জেগে উঠুক আমাদের তবুও একতাবদ্ধ হয়ে এই কুৎসিত মানুষটাকে উদ্ধার করে তার আপন দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। যে। ভাবেই হোক—