ঘটনাটি শুনে টুকি এবং ঝায়ের মন করুণায় দ্রবীভূত হয়ে গেল এবং রোবি হাউমাউ করে মাথাকুটে কাঁদতে শুরু করল। বিপদগ্রস্থ পরিবারটিকে সাহায্য করার জন্যে একটা পরিকল্পনা করা হল। পরিকল্পনাটি এরকম : মহাকাশযানটির কাছাকাছি গিয়ে তারা সেটাকে মাঝখানে রেখে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকবে এবং ঝা ছোট একটা স্কাউটশীপ নিয়ে বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে যাবে। সেখানকার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে তাদেরকে নিয়ে নিজেদের মহাকাশযানে ফিরে আসবে। তারপর তাদের নিজেদের গ্রহ বা আবাসস্থলে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী স্কাউটশীপে করে ঝা বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে হাজির হল। কন্ট্রোল প্যানেলে রোবি এবং টুকি তার সাথে যোগাযোগ করছিল। ঝা পেশাদার মহাকাশচারী নয় কাজেই তাকে কেমন করে ডক করতে হয়, কেমন করে লগ করে বাতাসের চাপের সমতা আনতে হয়, কেমন করে মহাকাশযানের বৃত্তাকার দরজা খুলতে হয়, সবকিছুই বলে দিতে হচ্ছিল। স্কাউটশীপের যোগাযোগ মডিউল দিয়ে টুকি এবং রোবি ঝাকে দেখতে পাচ্ছিল, তারা তাকে তার বিশাল দেহ নিয়ে মহাকাশযানের ভিতরে ঢুকে যেতে দেখল, প্রায় সাথে সাথেই হঠাৎ করে ঝায়ের সাথে সমস্ত যোগাযোগ কেটে গেল। টুকি অবাক হয়ে বলল, কী হল? যোগাযোগ কেটে গেল কেন?
বুঝতে পারছি না। রোবি যোগাযোগ ফিরে পাবার জন্যে নানারকম যন্ত্রপাতি টেপাটেপি করতে থাকে কিন্তু কোন লাভ হল না। হঠাৎ করে তারা স্কাউটশীপের ক্যামেরায় দেখতে পেল মহাকাশযানের বৃত্তাকার দরজাটি সশব্দে বন্ধ হয়ে গেছে, শুধু তাই নয়, যে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত অবস্থায় মহাকাশে ঝুলে থাকার কথা সেটি গর্জন করে তার ইঞ্জিনগুলো চালু করে মহাকাশে ছুটে যেতে শুরু করে।
রোবি টুকির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখেছ?
টুকি, হ্যাঁ!
ঝা গিয়ে মহাকাশযানটাকে ঠিক করে দিয়েছে। চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে! রোবি তার গলায় বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে বলল, আমি ভাবতাম ঝা গবেট ধরনের মানুষ। আসলে সে বড় মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার।
টুকি রোবির দিকে তাকিয়ে বলল, ঝা মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার নয়, এই মহাকাশযানটি আমাদের ধোকা দিয়েছে। ঝাকে ধরে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই মহাকাশ দত্যু হবে।
সর্বনাশ! কী করব এখন?
ওটার পিছু পিছু যেতে হবে। তাড়াতাড়ি।
রোবি তাড়াতাড়ি কন্ট্রোল প্যানেলের উপর ঝুকে পড়ে মহাকাশযানটির গতিপথ পরিবর্তন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
১০. মহাকাশযানের গোল দরজাটা
মহাকাশযানের গোল দরজাটা সাধারণ মানুষদের মাপে তৈরি, এর ভিতর দিয়ে বিশাল শরীরকে ঢোকাতে ঝায়ের রীতিমত বেগ পেতে হল। বিধ্বস্ত মহাকাশযানটির ভিতরে কৃত্রিম মহাকর্ষ বল তৈরি করে রাখা ছিল বলে সে শেষ পর্যন্ত তার পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল। ভিতরে অসহায় একটা পরিবার থাকার কথা কিন্তু ঝা অবাক হয়ে দেখল দুজন ষভাগোছের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে কালো এক ধরনের অস্ত্র। ঝায়ের যেটুকু ভয় পাওয়ার কথা ছিল সে তার থেকে অনেক বেশি ভয় পেল মানুষ দুজনের চেহারা দেখে, তারা দেখতে হুঁবহুঁ মানুষের মত কিন্তু যেখানে নাক থাকার কথা সেখানে নাকের বদলে একটা শুড়। সেই বঁড়টি সাপের মত কিলবিল করে নড়ছে। ঝা যখন একটা বিকট চিৎকার করে পিছন দিকে লফিয়ে সরে এল ঠিক তখন সেই মানুষ দুজনও বিকট চিৎকার করে পিছনে সরে গেল। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ঝা সাহস সঞ্চয় করে বলল, তোমাদের নাকে কী হয়েছে?
মানুষ দুজন বলল, আমাদের নাকে কিছু হয় নি কিন্তু তোমার নাক এভাবে কেটেছ কেন?
কোন কিছু বুঝতে ঝায়ের একটু সময় বেশি লাগে কিন্তু এবারে সে একবারেই বুঝে গেল যে এই মানুষ দুজনের ধারণা মানুষের নাক হাতির শূড়ের মত কিলবিলে হওয়া উচিত এবং তাদের কাছে মনে হচ্ছে কোন কারণে ঝায়ের নাক কাটা গেছে। ঝা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার নাক কাটি নাই, আমার নাক এরকম।
মানুষ দুজন তাকে ঠিক বিশ্বাস করল বলে মনে হল না, এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে একটা কিম্ভুতকিমার জন্তু। মানুষগুলো হাতের অস্ত্র তাক করে রেখে বলল, তোমার অসুবিধা হয় না?
না। হয় না। কিন্তু আমরা তো সেটা নিয়ে কথা বলতে আসিনি। এখানে একটা পরিবার থাকার কথা মহাকাশ দস্যু যাদের ধরে এনেছিল।
ষন্ডাগোছের মানুষ দুজনের মাঝে যে বেশি লম্বা সে তার নাক কিংবা শূড় যেটাই বলা হোক, নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল, মহাকাশ দস্যু এখনি কাউকে ধরে নেবে।
কাকে?
তোমাকে! বলে দুজনই হা হা করে হাসতে লাগল, হাসির তালে তালে তারা তাদের লম্বা নাক উপরে তুলে নাচাতে লাগল। ঝা স্বীকার না করে পারল
যে লম্বা এবং কিলবিলে একটা নাক দিয়ে মনের ভাব অনেক জোড়ালো ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। ঝা শুকনো মুখে বলল, আমাকে ধরে নেবে?
হ্যাঁ! এটা আসলে দস্যু জাহাজ, আমরা বেকুব ধরনের মহাকাশচারীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করি।
কিন্তু এখানে আমার জন্যে কেউ মুক্তিপণ দেবে না।
না দিক। তোমার মত নাকখসা মানুষকে চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয়া যাবে, দশটা মুক্তিপণের সমান টাকা উঠে আসবে সেখান থেকে।
কিন্তু–
কোন কিন্তু টিন্তু নেই নাক-খসা দানব, দুই হাত উপরে তুলে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়।
ঝা মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কী না একবার চিন্তা করল, কিন্তু কিলবিলে থলথলে নাকে ঘুষি মারার কথা চিন্তা করেই কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠল। কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল ঝায়ের হাত পিছন দিকে শক্ত করে বেঁধে একটা ছোট ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। আর বিধ্বস্ত দেখানো মহাকাশযানটি গর্জন করে ছুটে চলেছে কোন একটি অজানা গন্তব্যস্থলের দিকে।