লুকিয়ে লুকিয়ে টুকি এবং ঝা যে জায়গায় এসে হাজির হয়েছে সেটি জংলা এবং নির্জন। বুকে ভর দিয়ে নিজেদের হাচড় পাচড় করে টেনে টেনে তারা প্রায়। কয়েক কিলোমিটার চলে এসেছে। কনুইয়ের ছাল উঠে গেছে, ঝোপঝাড়ের খোঁচা খেয়ে খেয়ে মুখের জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে, বিছুটি জাতীয় একটা গাছ ভুল করে ছুয়ে ফেলায় টুকির সারা শরীর চুলকাচ্ছে, কাদা পানিতে দুজনেই মাখামাখি এবং খুব সঙ্গত কারণেই টুকির মেজাজ বাড়াবাড়ি রকম খারাপ হয়ে আছে। সে প্রায় একশ বাহান্নবারের মত ঝাকে গালি দিয়ে বলল, রবোটের বাচ্চা রবোট কোথাকার, সাত মাত্রার অপারেশনে কেউ বাথরুমে যায়?
ঝা ছোটখাট ঝোপঝাড়কে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে নিজেকে ছেড়ে ছেচড়ে সামনে নিতে নিতে বলল, আমি কী করব? তুমি জান সিনথেটিক গলদা চিংড়ি আমার পেটে সয় না।
পেটে সয় না তো এতগুলো খেলে কেন?
মনোসোডিয়াম গ্লুকোমেট দিয়ে ঝাল করে বেঁধেছে। জিবের স্বাদ বেড়ে গেল হঠাৎ—
টুকি রেগেমেগে আরেকটা কী বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। প্যাচপ্যাচে কাদায় আধডোবা হয়ে থেকে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, একেই বলে কপাল। এখন এর মাঝে বৃষ্টি শুরু হল।
ঝা হাসি হাসি মুখে বলল, মৌসুমী বৃষ্টি। একেবারে সময়মত এসেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিউশান একেবারে ধুয়ে নিয়ে যাবে।
টুকি রেগেমেগে বলল, তোমার বৃষ্টির চৌদ্দগুষ্ঠির লিভারে ক্যান্সার হোক।
ঝা মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, এত রেগে যাচ্ছ কেন? কী চমৎকার বৃষ্টি, দেখ না একবার। তিন চার ঘণ্টার মাঝে থেমে যাবে।
তিন চার ঘণ্টা! টুকি মুখ খিচিয়ে বলল, ততক্ষণ আমরা কী করব?
ভিজব। মঙ্গল গ্রহে বৃষ্টিতে ভেজার একটা ট্যুর আছে। সাড়ে সাতশ ইউনিট দিলে দশ মিনিট ভিজতে দেয়। সিনথেটিক বৃষ্টি। আর এইটা হল একেবারে খাঁটি প্রাকৃতিক বৃষ্টি।
টুকি রেগেমেগে আবার কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সামনে আবছা অন্ধকারে উঁচু মতন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে উপরে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। টুকি ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কী?
ঝা পকেট থেকে বাইনোকুলার বের করে চোখে লাগিয়ে খানিকক্ষণ দেখে বলল, একটা দালান।
এই জংলা জায়গায় দালান তৈরি করেছে কোন আহাম্মক? আর এইটা যদি দালানই হবে তাহলে দরজা জানালা কই?
মানুষের খেয়াল! ঝা উদাস গলায় বলল, মনে নাই নাইন্টি-নাইনে একটা বাড়িতে চুরি করলাম, পুরো বাসাটা একটা থালার মতো, ছাদ নেই।
টুকি কোন কথা না বলে উবু হয়ে বসে বলল, এটা যদি সত্যি দালান হয় তাহলে এই বৃষ্টির মাঝে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। আমি এই দালানে বসে বিশ্রাম নেব।
যদি কেউ থাকে? টুকি মেঘস্বরে বলল, থাকলে ঘাড় ধরে বের করে দেব।
ঝা ভয়ে ভয়ে বলল, এত কষ্ট করে এত বড় একটা দাও মারলাম আর এখন যদি ছোট খাট বৃষ্টির জন্যে ধরা পড়ে যাই
সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। টুকি পাখির খাঁচার মত তার টিংটিংয়ে বুকে সজোরে একটা থাবা দিয়ে বলল, এই বান্দা কোনো কাঁচা কাজ করে না। ব্রেন ট্রান্সপ্ল্যান্ট আইনসিদ্ধ হলে আমার ব্রেন এতদিনে লাখ দুই লাখ ইউনিটে বিক্রি হতো।
দালানটা দেখতে নিরীহ মনে হলেও ভিতরে ঢোকা খুব সহজ হল না। দালানটা ঘিরে প্রথমে কাটাতারের বেড়া, তারপর গোপন ইলেক্ট্রিক লাইন, সবশেষে উঁচু দেওয়াল। তারা ঘাঘু চোর না হলে প্রথমেই ধরা পড়ে যেতো সে। ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সাবধানে উঁচু দালানটার কাছে এসে তারা কোন দরজা খুঁজে পেল না। তখন মৌসুমী বৃষ্টি আরো চেপে এসেছে, অধৈর্য হয়ে এক্সরে লেজার দিয়ে কেটে একটা দরজা প্রায় বের করে ফেলছিল ঠিক তখন ঝা। দরজা খোলার গোপন ফুটোটা আবিষ্কার করে ফেলল। টুকি তার মাস্টার কী ভিতরে ঢুকিয়ে চাপ দিতেই খুট করে দরজা খুলে গেল।
ভিতরে আবছা অন্ধকার। সাধারণ ঘরবাড়ি দেখতে যেরকম হয় দালানটির ভিতরে মোটেও সেরকম নয়—এটি যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। টুকি এবং ঝা অনেক খুঁজেও ওপরে ওঠার এলিভেটরটি খুঁজে পেল না। তখন বাধ্য হয়ে পায়ে সাকশান জুতো লাগিয়ে তারা পাইপ বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। খানিকদূর উঠেই অবশ্য তারা একটা সিড়ি আবিষ্কার করে, সেই সিড়ি ধরে মোটামুটিভাবে দালানটার একেবারে উপরে উঠে এল। নানা স্তরে নানা রকম ঘর পার হয়ে এলেও তারা আরাম করে বসার মত কোন জায়গা খুঁজে পেল না। যখন তারা প্রায় আশা ছেড়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন হঠাৎ করে দুজন মানুষের কথোপকথন শুনে টুকি এবং ঝা পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল মাঝারী আকারের একটা ঘরে ভারী আরামদায়ক দুটি চেয়ারে প্রায় গা ড়ুবিয়ে দুজন বুড়োমানুষ খোশগল্প করছে। মানুষ দুজন টুকি এবং ঝাকে দেখে প্রায় ভূত দেখার মত চমকে উঠে বলল, তোমরা কে?
টুকি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বুড়োমতন একজন ধমক দেয়ার মত করে বলল, তোমরা এখানে কী করছ?
টুকি এবং ঝা পেশাদার চোর, তাদের সব কাজকর্ম হয় মানুষের অগোচরে। এরা সাধারণত মানুষের দেখা পায় না এবং হঠাৎ করে কোন মানুষ ধমকে। উঠলে খুব স্বাভাবিক কারণেই তারা ভয় পেয়ে যায়। এবারও দুজনেই ভিতরে ভিতরে একটু ভয় পেয়ে গেল, টুকি ভয়টা গোপন করে তার ব্যাগ থেকে মাঝারী আকারের একটা অস্ত্র বের করে গলার স্বর মোটা করে বলল, একটা কথা বললে ঘিলু বের করে দেব।
ঝা অস্ত্রটার দিকে এক নজর তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, এটা তো ট্রাংকুলাইজার গান। এটা দিয়ে কী ঘিলু বের হবে?