মেয়েদের দলটি টুকি এবং ঝাকে নিয়ে একটা বড় বাসার সামনে হাজির হল। বাসাটি সম্ভবত টাইরার, কারণ অন্য সব মেয়েরা বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা। করতে লাগল, শুধু টাইরা টুকি এবং ঝাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। সাথে সাথে ভিতর থেকে সুদর্শন কোমল চেহারার একজন পুরুষ মানুষ টাইরার দিকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওগো সোনামনি, তুমি ফিরে এসেছ?
টাইরা মাথা নাড়ল। পুরুষ মানুষটি নিশ্চয়ই টাইরার স্বামী, সে আদুরে। বেড়ালের মত ভঙ্গী করে বলল, টাইরা, সোনামনি আমার, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো?
না।
তোমায় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় এনে দিই?
না, লাগবে না। তুমি বরং এই দুজন পুরুষ মানুষকে দেখ।
টাইরার স্বামী, কোমল চেহারার পুরুষটি এবারে টাইরাকে ছেড়ে দিয়ে টুকি এবং ঝায়ের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, এরা কারা?
লাল পাহাড়ের কাছে পেয়েছি। একেবারে বেপর্দা হয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল।
টাইরার স্বামী লজ্জায় জিবে কামড় দিয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
হ্যাঁ! অত্যন্ত বেশরম মানুষ–নিজে থেকে আমাদের সাথে কথা বলছিল।
কী লজ্জা! কী লজ্জা!
তুমি তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখ, ব্যাপারটা কী? কোথা থেকে এসেছে, কী সমাচার। না জানি বেচারার স্ত্রীরা এখন কোথায় কী দুশ্চিন্তা করছে।
টাইরার স্বামী মুখে একটা কপট রাগের ভান করে বলল, আমি বুঝতে পারি না কী রকম মেয়েমানুষ তাদের স্বামীদের এরকম একলা ছেড়ে দেয়। যদি কিছু একটা হত? যদি তোমাদের সামনে না পড়ে কোন খারাপ মেয়েদের সামনে পড়ত?
টুকি এবং ঝা দেখল টাইরার কোমল চেহারার সুদর্শন স্বামী ব্যাপারটা চিন্তা করে আতংকে কেমন জানি শিউরে উঠে।
টাইরা চলে যাবার পর টুকি এবং ঝা তাদের সারা শরীরে ঢাকা চাদরগুলো খুলে রাখল। টাইরার স্বামী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কারা ভাই? একা একা কী করছ? তোমাদের স্ত্রীরা কই? তোমাদের একা ছেড়ে দিল কেমন করে?
টুকি মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের স্ত্রী নেই।
মানুষটার মুখে হঠাৎ সমবেদনার চিহ্ন ফুটে উঠে, আহা। বিয়ে হয় নি এখনো? কোন মেয়ে পছন্দ করল না?
না, মানে–
মেয়েদের মন জয় করতে হলে একটু চেষ্টা করতে হয়। সেজে গুজে থাকতে হয়, দাড়ি কামিয়ে চুল পরিপাটি করে আচড়াতে হয়, শরীরে পারফিউম দিয়ে সুন্দর কাপড় পরতে হয়। তোমাদের যেরকম রুক্ষ চেহারা, সাথে যেভাবে বেশরম কাপড় পরেছ কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে তোমাদের পছন্দ করবে ভেবেছ?
টুকি বলল, আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানকার নিয়ম-কানুন অন্যরকম।
কোথা থেকে এসেছ তোমরা?
অন্য একটা গ্রহ থেকে। এটা যেরকম এম সেভিন্টিওয়ান–
টাইরার স্বামী বাধা দিয়ে বলল, থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি ওসব বুঝি না। আমরা পুরুষ মানুষেরা ঘর সংসার করি বড় বড় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শুনে কী করব?
টুকি ভুরু কুচকে বলল, তোমরা শুধু ঘর সংসার কর?
টাইরার স্বামী অবাক হয়ে বলল, আর কী করব? একজন পুরুষ মানুষ যদি তার স্ত্রীকে খুশী রাখতে পারে তাহলে তার জীবনে আর কী চাইবার আছে? সারাদিন পরিশ্রম করে স্ত্রী ঘরে এলে তার জন্যে রান্না করে খাবার দেওয়া, পোশাক ধুয়ে রাখা বাচ্চা মানুষ করা—
টুকি এবং ঝা কেমন জানি ভয়ে ভয়ে টাইরার স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক এরকম সময় দরজা খুলে একজন তরুণ এসে ঢুকল, তার চোখে পানি টল টল করছে। টাইরার স্বামী জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?
আমি আর বাইরে যাব না বাবা। কখনো বাইরে যাব না।
আবার বুঝি পাড়ার বখা মেয়েরা–
হ্যাঁ! আমাকে দেখে শীষ দিয়ে এত খারাপ খারাপ কথা বলেছে— তরুণটা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মানুষটি তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাদিস নে বাবা। তোর মাকে বলব দেখি কিছু করতে পারে কী না।
ছেলেটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলে মানুষটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আগের যুগের সেই নিয়ম-নীতি আর নেই। সবার মাঝে কেমন জানি ভোগ লালসা। মাঝে মাঝে যখন বাইরে যাই বুঝতে পারি মেয়েরা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার শরীরের দিকে। মনে হয় চোখ দিয়ে সমস্ত শরীরটাকে চেটে খাচ্ছে।
মানুষটির সারা শরীর বিতৃষ্ণায় কেমন জানি শিউরে উঠল।
টুকি এবং ঝা এতক্ষণে তাদের মহাকাশযানে ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে। মেয়েদের এই সমাজ ব্যবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হলে তাদের দেখে যে যাই মনে করুক তাদের কিছু করার নেই। জেট প্যাক ব্যবহার করে তারা আকাশে উড়ে যাবে। পুরুষদের ঘরের মাঝে আটকে রাখা তাদের কাছে যতই বিচিত্র মনে হোক এখানে এটা ঘটছে। হাজার বছর আগে পৃথিবীতে ঠিক তার উল্টো ব্যাপার ঘটেছিল, মেয়েদেরকে ঘরের মাঝে আটকে রাখ হয়েছিল।
টুকি আর ঝা টাইরার স্বামীর কাছে গিয়ে বলল, তোমাদের এখানে এসে আমাদের খুব ভাল লেগেছে, এখন আমরা যাব।
টাইরার স্বামী চোখে কপালে তুলে বলল, যাবে? কোথায় যাবে? মহাকশনের কথা বলে খুব একটা লাভ হবে না বলে তারা সে চেষ্টা করল। বলল, যেখান থেকে এসেছি।
কিন্তু তোমাদের খাওয়া হয়নি, বিশ্রাম হয়নি–
না হোক। আমরা ফিরে গিয়ে খাব বিশ্রাম নেব।
কোমল চেহারার সুদর্শন মানুষটির চোখে মুখে সত্যিকার দুশ্চিন্তার ছাপ। ফুটে উঠল, বলল, ঠিক আছে যেতে চাও যাবে তবে কিছু না খেয়ে যেতে পারবে না।
মানুষটির গলার স্বরে এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল, টুকি এবং ঝা না করতে পারল না।