নিহন অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, বিড়বিড় করে বলে, আমাকে একটু ধৈর্য দাও। একটু শক্তি দাও। এই হতভাগিনী মেয়েটাকে আমি নিশ্চয়ই খুন করে। ফেলব-কিন্তু তবুও আমাকে আর একটু সহ্য করতে দাও।
বাইরের তীক্ষ্ণ শব্দটির কম্পন হঠাৎ আরো বেড়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কাটুস্কা হিংস্র মুখে নিহনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার নখ দিয়ে মুখ খামচে ধরে চিৎকার করে বলে, তোমার ওই নোংরা চোখ দুটো আমি খুবলে তুলে ফেলব। খামচি দিয়ে মুখের চামড়া তুলে ফেলব।
নিহন আর কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। তার সমস্ত চেতনা অবলুপ্ত হয়ে সেখানে ভয়ঙ্কর অন্ধ এক ধরনের ক্রোধ এসে ভর করেছে। নিজের অজান্তে ধারালো চাকুটা হাতে নিয়ে সে খুব ধীরে ধীরে তার হাত ওপরে তুলেছে। ঠিক তখন কাটুস্কা আবার তাকে আঘাত করল। নিহন প্রস্তুত ছিল না, তাল সামলাতে না পেরে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। হাত দিয়ে নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে নিহন আবার উঠে দাঁড়াতে গিয়ে থেমে গেল। তার। ভেতরকার অন্ধ ক্রোধটি নেই, তার বদলে সেখানে এক ধরনের বিস্ময়! নিহন কাটুঙ্কার দিকে তাকাল, কাটুস্কার সমস্ত মুখ ভয়ঙ্কর ক্রোধে বিকৃত হয়ে আছে। একটি চেয়ার তুলে এনে সে সেটা দিয়ে নিহনকে আঘাত করার চেষ্টা করল। নিহন কোনোভাবে হাত তুলে নিজেকে রক্ষা করে ঘরটার দিকে তাকাল, এটা একটা রেজোনেন্ট কেভিটি। ঘরের মেঝেতে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নেই, ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ঘরের মাঝখানে সেটা সর্বোচ্চ। সে মেঝেতে শুয়ে আছে বলে তার মস্তিষ্কে কোনো স্টিমুলেশন নেই, তাই অন্ধ ক্রোধটিও নেই। কাটুস্কা দাঁড়িয়ে আছে, তীব্র ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তার মস্তিষ্ককে দলিত-মথিত করে ফেলছে, তাই তার ভেতরে ভয়ঙ্কর অন্ধ ক্রোধ। সেই অন্ধ ক্রোধকে দমাতে হলে কাটুস্কাকেও মেঝেতে শুইয়ে ফেলতে হবে।
নিহন গড়িয়ে কাটুস্কার কাছে এগিয়ে যায়, কিছু বোঝার আগে তার পা দুটি জাপটে ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়-ছাড় আমাকে, ছাড়, ছেড়ে দাও বলে চিৎকার করতে করতে কাটুস্কা হঠাৎ থেমে যায়। সে শুনতে পায় নিহন তাকে মেঝেতে চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলছে, শান্ত হও। শান্ত হও, কাটুস্কা।
কাটুস্কা বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী হল? হঠাৎ করে আমার রাগটা কমে গেল কেন?
শুয়ে থাক, তা হলেই হবে।
কেন?
এই ঘরটা আসলে একটা রেজোনেন্ট কেভিটি। এর ভেতরে স্ট্যান্ডিং ওয়েভ তৈরি করা হয়েছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী স্ট্যান্ডিং ওয়েভ। ঘরের মাঝখানে সবচেয়ে বেশি, মেঝেতে কমতে কমতে শূন্য হয়ে গেছে। তাই শুয়ে থাকলে তোমার মস্তিষ্কে সেই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ কোনো স্টিমুলেশন দিতে পারবে না।
কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান?
পড়েছি।
তোমাদের এসব পড়তে হয়?
হ্যাঁ। আমাদের কোয়াকম্পের মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার নেই, তাই অন্য কিছু আমাদের জন্য চিন্তা করে না। আমাদের নিজেদের চিন্তা নিজেদের করতে হয়!
কী আশ্চর্য!
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। তোমরা যেটা কর, সেটা হচ্ছে আশ্চর্য।
কাটুস্কা মেঝেতে মাথা লাগিয়ে শুয়ে থেকে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত, নিহন। খুব দুঃখিত।
কেন?
খামচি দিয়ে তোমার চোখ দুটো খুবলে তোলার চেষ্টা করেছিলাম বলে।
নিহন হেসে ফেলল, এই প্রথম সে হেসেছে এবং তার মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত দেখে কাটুস্কা অবাক হয়ে যায়, একটা মানুষ কেমন করে এত সুদর্শন হতে পারে সে ভেবে পায় না। কাটুস্কা নিচু গলায় বলল, এটা হাসির ব্যাপার না-তুমি হাসছ কেন?
আমি হাসছি কারণ আর একটু হলে আমি আমার চাকুটা দিয়ে তোমাকে ফালা ফালা করে দিতাম। তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খুব বড় উপকার করেছ।
এখন আমরা কী করব? সারাক্ষণ কি এভাবে শুয়েই থাকব?
না, বের হব।
কাটুস্কা বলল, কীভাবে বের হবে? এই ঘরটা বাইরে থেকে তালা মারা।
এটা নম্বর তালা। ভেতর থেকে সঠিক নম্বরটি দেওয়া হলে তালাটি খুলে যাবে না?
হ্যাঁ। খুলে যাবে। কিন্তু নম্বরটি তো তুমি জান না। তা ছাড়া তুমি শুয়ে শুয়ে তালাটি খুলতে পারবে না। খোলার জন্য তোমাকে দাঁড়াতে হবে।
আমি দাঁড়াব।
কেমন করে দাঁড়াবে?
টেবিলের উপর যে টেবিল ক্লথটা আছে সেটার উপর অ্যালুমিনিয়ামের একটা আস্তরণ আছে। আমি এটা আমার মাথায় বেঁধে নেব। সেটা তখন ফ্যারাডে কেজের মতো কাজ করবে।
তার মানে কী?
তার মানে এই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকতে পারবে না।
সত্যি?
নিহন বলল, হ্যাঁ, এই দেখ।
নিহন টেবিলের উপর থেকে টেবিল ক্লথটা টেনে নামিয়ে এনে মাথায় বেঁধে নিয়ে সাবধানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। টেবিল ক্লথটায় এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করে কিন্তু তার বেশিকিছু নয়। নিহন দরজাটার কাছে এগিয়ে গেল।
বাইরে থেকে ঘরটি তালা মেরে রেখেছে। নিহন অনুমান ভর করে একটা সংখ্যা ঢোকাতেই তালাটা খুট করে খুলে গেল। কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে খুললে?
জানি না। আন্দাজে।
কীভাবে আন্দাজ করলে?
যেহেতু এগুলো সব তোমাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে তাই সংখ্যাটা নিশ্চয়ই সাধারণ সংখ্যা হবে না। নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো সংখ্যা হবে। তাই চার অঙ্কের বিশেষ একটা সংখ্যা দিয়ে চেষ্টা করেছি। প্রথম চেষ্টাতেই মিলে গেছে। তোমাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসলে খুব সাদাসিধে টাইপের।