- বইয়ের নামঃ জলজ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
জলজ
য়ুল। ঘুম থেকে ওঠ।
য়ুলের মনে হয় অনেকদূর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকছে। গলার স্বরটি চেনা কিন্তু সেটি কার য়ুল মনে করতে পারল না। য়ুল গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে আবার অচেতনতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল, তখন সে শুনতে পেল আবার তাকে কেউ একজন ডাকল, য়ুল। ওঠ।
য়ুল প্রাণপণ চেষ্টা করে জেগে উঠতে, মনে করতে চেষ্টা করে সে কে, সে কোথায়, কে তাকে ডাকছে, কেন তাকে ডাকছে। কিন্তু তার কিছুই মনে পড়ে না। সে অনুভব করে এক গভীর জড়তায় তার দেহ আর চেতনা যেন কোথাও অবরুদ্ধ হয়ে আছে, তার ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
ওঠ য়ুল। আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছি।
পৃথিবী! হঠাৎ করে য়ুলের সব কথা মনে পড়ে যায়, পৃথিবী হচ্ছে সূর্য নামক সাদামাঠা একটা নক্ষত্রের মহাকর্ষে আটকে থাকা নীলাভ একটি ছোট গ্রহ। যে গ্রহে তার পূর্বপুরুষ মানুষের জন্ম হয়েছিল। যে মানুষ রোবটদের নিয়ে ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জে বসতি করেছে দুই শতাব্দী আগে। সেই ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে সে ফিরে যাচ্ছে পৃথিবীতে। সূর্য নামক সাদামাঠা একটি নক্ষত্রের কক্ষপথে আটকে থাকা তৃতীয় গ্রহটিতে।
য়ুল খুব ধীরে ধীরে তার চোখ খুলে তাকাল, তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে একটি ধাতব মুখ। সেই ধাতব মুখে তার জন্য উৎকণ্ঠা, তার জন্য মমতা।
য়ুলকে চোখ খুলতে দেখে ধাতব মুখটি আরো নিচু হয়ে এল, শীতল ধাতব হাতে তার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, তুমি প্রায় এক যুগ থেকে ঘুমিয়ে আছ য়ুল। তোমার এখন ওঠার সময় হয়েছে।
য়ুল ধাতব মুখ, তার শীতল স্পর্শ এবং কোমল কণ্ঠটি চিনতে পারে। এটি ক্রন, একজন রোবট ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে তার সাথে এসেছে। প্রায় একযুগ দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানে তাকে একা একা আসতে দেয় নি ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জের বিজ্ঞান একাডেমি। তার সাথে দিয়েছে একজন রোবট, যার নাম ক্রন এবং একজন আধা জৈবিক আধা যান্ত্রিক বায়োবট যার নাম কীশ। বার্ধক্য তাদের স্পর্শ করে না বলে গত এক যুগ তারা এই মহাকাশযানের শূন্য করিডোরে অপেক্ষা করেছে, ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছে, শীতল ঘরের কালো ক্রোমিয়াম ক্যাপসুলে য়ুলের দেহকে চোখে চোখে রেখেছে। য়ুল ক্রনের ধাতব অথচ কোমল মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভালো আছ ক্ৰন?
হ্যাঁ। আমি ভালো আছি।
কীশ কোথায়? কীশ ভালো আছে?
কীশ মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। সেও ভালো আছে।
য়ুল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্ৰন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন তুমি কথা বলবে না য়ুল। তুমি চুপ করে শুয়ে থাকবে। তুমি প্রায় এক যুগ শীতল ঘরে ঘুমিয়ে ছিলে। তোমার দেহকে খুব ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলতে হবে।
আমি তো জেগেই আছি!
তোমার মস্তিষ্ক জেগে আছে, কিন্তু তোমার দেহ এখনো জেগে ওঠে নি। আমাকে একটু সময় দাও আমি তোমার দেহকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলব।
বেশ।
য়ুল ক্রোমিয়ামের কালো ক্যাপসুলে নিশ্চল হয়ে রইল। সে খুব ধীরে ধীরে অনুভব করে তার দেহে আবার প্রাণ ফিরে আসছে। শরীরের ভিতরে এক ধরনের উষ্ণতা বইতে শুরু করেছে, হাত, পা, বুক, পিঠে এক ধরনের জীবন্ত অনুভূতির জন্ম হয় এবং একসময় খুব ধীরে ধীরে সে নিজের ভিতরে হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পায়। সে বুকভরে একটি নিশ্বাস নিয়ে খুব ধীরে ধীরে নিজের দুই হাত চোখের সামনে মেলে ধরল, আঙুলগুলো একবার মুষ্টিবদ্ধ করে। আরেকবার খুলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রনকে বলল, আমি পুরোপুরি জেগে উঠেছি ক্রন।
ক্রন ক্যাপসুলের ওপরে লাগানো কিছু মনিটরে চোখ বুলিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি জেগে উঠেছ। তুমি এবারে উঠে দাঁড়াতে পার।
য়ুল খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ক্ৰন তাকে হাত ধরে শীতল মেঝেতে নামিয়ে এনে উজ্জ্বল কমলা রঙের একটি নিও পলিমারের পোশাক দিয়ে তার দেহকে ঢেকে দেয়। য়ুল মহাকাশযানের দেয়াল স্পর্শ করে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি কাঁপন অনুভব করছি। মহাকাশযানের ইঞ্জিন চালু করা হয়েছে?
হ্যাঁ। পৃথিবীতে নামার জন্য গতিপথ পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
ও।
আমরা চেয়েছিলাম তুমি পৃথিবীকে দেখ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে যখন যাবে সেই উত্তাপ অনুভব কর। এই গ্রহটিতে তোমার এবং আমার সবার পূর্বপুরুষের জন্ম। হয়েছিল।
হ্যাঁ। য়ুল কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, হ্যাঁ আমি পৃথিবীকে সত্যি সত্যি দেখতে চাই।
এস আমার সাথে। আমার হাত ধর।
য়ুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তার প্রয়োজন নেই ক্রন। আমার মনে হয় আমি নিজের ভারসাম্য ফিরে পেয়েছি।
য়ুল একটু টলতে টলতে হেঁটে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর কীশ ঝুঁকে কিছু একটা দেখছিল, পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে য়ুলকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল, য়ুল! ঘুম ভাঙল তা হলে?
হ্যাঁ, ভেঙেছে!
আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি এসে গেছি। কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথিবীর কক্ষপথে আটকে যাব।
চমৎকার! কত বড় কক্ষপথ?
চেষ্টা করছি কাছাকাছি যাবার। এক শ ইউনিট, বায়ুমণ্ডলটা পার হয়েই।