নিহন হেসে বলল, খানিকক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নাও। তারপর কিছু একটা খাও।
নাইনা পানি থেকে মাথা বের করে বলল, আচ্ছা নিহন, আমরা যে রকম পানিতে ভেসে থাকতে পারি স্থলমানবেরা নাকি সে রকম ভেসে থাকতে পারে না?
পারে। তবে সেটা শিখতে হয়। তারা সেটাকে বলে সাঁতার কাটা। সাঁতার কেটে পানিতে ভেসে থাকতে হলে তাদের হাত-পা নাড়তে হয়।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আমরা যে রকম পানিতে শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারি, তারা সে রকম পারে না?
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, তারা পারে না।
কেন পারে না?
আমি ঠিক জানি না। মনে হয় পানিতে থাকার জন্য আমাদের ফুসফুস আকারে বড় হয়ে গেছে, বেশি বাতাস বুকের ভেতর থাকে বলে আমাদের ভেসে থাকা সোজা। তা ছাড়া সমুদ্রের পানিতে লবণ, সেজন্য আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশি-
নাইনা অবাক হয়ে বলল, স্থলমানবের পানিতে লবণ নেই?
না। তাদের পানি বৃষ্টির পানির মতো!
কী আশ্চর্য! নাইনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমার মাঝে মধ্যে খুব স্থলমানবদের দেখার ইচ্ছা করে।
নিহন শব্দ করে হেসে উঠে বলল, এর চেয়ে বল আমার একটা হাঙরের মুখের ভেতর মাথাটা ঢোকাতে ইচ্ছে করে! সেই কাজটাই বরং সহজ আর নিরাপদ।
তোমার কী মনে হয় নিহন? আমরা কি ইয়টের ভেতর স্থলমানদের দেখতে পাব?
উঁহু। আমরা অনেক দূরে থাকব। দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইয়টটা কোন দিকে যায় আমরা শুধু সেটা লক্ষ করতে এসেছি।
নাইনা একটু আদুরে গলায় বলল, আমরা কি একটু কাছে গিয়ে দেখতে পারি না?
না, নাইনা। নিহন গম্ভীর গলায় বলল, আমরা কিছুতেই কাছে যাব না। দূরে থাকব। অনেক দূরে।
নাইনা কোনো কথা বলল না, নিঃশব্দে পানিতে দুই হাত-পা ছাড়িয়ে শুয়ে রইল, তার খানিকটা আশাভঙ্গ হয়েছে। সে ভেবেছিল ইয়টের খুব কাছে গিয়ে স্থলমানবদের দেখবে। তারা কেমন করে হাসে কথা বলে শুনবে। স্থলমানবদের নিয়ে তার অনেক কৌতূহল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডলফিন দুটো ফিরে এল, সমুদ্রের তলদেশ থেকে তারা ভরপেট খেয়ে এসেছে। শুশু তার মুখ দিয়ে ঠেলে নিহনকে জাগিয়ে তোলে। শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে তার চোখে ঘুম নেমে এসেছে সে জানে না। শুও কিছু একটা বলল, কথাটি কী নিহন ঠিক ধরতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, কী বলছ শুশু?
সাদা বড়।
সাদা বড় কিছু দেখেছ?
শুশু মাথা নাড়ল। বলল, ঝিক ঝিক ঝিক।
ও আচ্ছা! নিহন বুঝতে পারে, ডলফিন দুটো ইয়টটা দেখে এসেছে। শুওকে ধরে বলল, ইয়টটা দেখেছ?
হ্যাঁ।
কোন দিকে যাচ্ছে?
শুশু এবং কিকি মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল ইয়টটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাচ্ছে। নিহন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তাদের ভাসমান দ্বীপটি উত্তরে, ইয়ট সেদিকে যাচ্ছে না।
নাইনা বলল, চল, ইয়টটা দেখে আসি।
চল। নিহন আবার নাইনাকে মনে করিয়ে দেয়, মনে আছে তো, আমরা কিন্তু বেশি কাছে যাব না।
মনে আছে নিহন, মনে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডলফিনের পিঠে চেপে নিহন আর নাইনা পানি কেটে ছুটে যেতে থাকে। বহু দূরে যখন ধবধবে সাদা ইয়টটা দেখা গেল তারা দুজন তখন থেমে গেল। নিহন। বলল, আর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখান থেকে দেখি।
নাইনা অনুনয় করে বলল, আর একটু কাছে যাই?
না নাইনা। আর কাছে নয়।
নাইনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।
ডলফিন দুটোকে ছেড়ে দিয়ে তারা চুপচাপ পানিতে শুয়ে থাকে। বহু দূরে ইয়টটাকে আবছা দেখা যাচ্ছে, পানিতে একটা চাপা গুমগুম শব্দ শোনা যায়। ডলফিন দুটো ছাড়া পেয়ে তাদের ঘিরে ছোটাছুটি করতে থাকে, ছোট বাচ্চাদের মতো সেগুলো মাঝে মধ্যে পানি থেকে ঝাঁপ দিয়ে উপরে উঠে যায়। ডলফিন খুব হাসিখুশি প্রাণী। মানুষের কাছাকাছি থাকলে মনে হয় তারা আরো বেশি হাসিখুশি থাকে।
নিহন আর নাইনা পানিতে শুয়ে নিঃশব্দে ইয়টটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখান থেকে মনে হচ্ছে সেটা খুব ধীরে ধীরে যাচ্ছে কিন্তু দুজনেই জানে এটা খুব দ্রুত পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে।
নিহন হঠাৎ পানি থেকে মাথা বের করে আনে। নাইনা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে নিহন?
ইয়টটার ইঞ্জিন বন্ধ করেছে।
কেন?
জানি না। এখানে থেমে যাচ্ছে।
নাইনা চোখ বড় বড় করে তাকাল, সত্যি?
হ্যাঁ। নিহন তীক্ষ্ণ চোখে ইয়টটার দিকে তাকিয়ে থাকে, অনেক দূরে বলে ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার মুখে হঠাৎ দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল, সেটা নাইনার দৃষ্টি এড়াল না। নাইনা জানতে চাইল, কী হয়েছে নিহন?
বহু দূর থেকে ছোট ছোট কয়েকটা ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
কিসের ইঞ্জিন?
বুঝতে পারছি না। স্থলমানবদের কত রকম যন্ত্রপাতি আছে-তার কোনো একটা হবে।
কেন এর শব্দ হচ্ছে?
এখনো বুঝতে পারছি না। ইয়টটা থেমে গেছে। এখানে নোঙর ফেলবে মনে হয়।
হঠাৎ করে শুশু এবং কিকি ভুশ করে তাদের কাছাকাছি ভেসে উঠল। দুটি ডলফিনই উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলতে থাকে, তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নিহন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে শুশু?
আসছে। আসছে।
নিহন অবাক হয়ে বলল, কী আসছে?
এক দুই তিন চার।
চারজন?
শুশু এবং কিকি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। চারজন আসছে।
নিহন এবার ভালো করে তাকাল এবং দেখতে পেল বহু দূর থেকে চারটি কালো বিল্টুর মতো কিছু একটা সমুদ্রের পানিতে ফেনা তুলে ছুটে আসছে।
নাইনা জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কী?
জানি না। মনে হয় কোনো ধরনের জলযান। সমুদ্রের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে।