রবোটগুলো সফটওয়ার এবং প্রসের প্রক্রিয়াগুলো নিজেদের কপোট্রনে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সেগুলো উপভোগ করতে থাকে ব্যাপারটি অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ যখন কিছু উপভোগ করে তাদের চেহারায় তার ছাপ পড়ে। রবোটের বেলায় সেটা সত্যি নয়, অত্যন্ত কঠোর মুখ নিয়ে তারা দীর্ঘ সময় মূর্তির মতো নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের হাত। বা পা একটু নড়ে উঠে চোখের ঔজ্জ্বল্য একটু বেড়ে যায় বা কমে আসে, তার বেশি কিছু নয়। বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে এক ধরনের স্থবিরতা বলে মনে হয়, আসলে সেটি তাদের কপোট্রনে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক ট্রিলিয়ন জটিল হিসেব নিকেশের ফল।
ব্যাপারটি একনাগাড়ে কয়েকদিন চলতে থাকে। আমার তখন কিছু করার থাকে না, ট্রাকিওশানের দূরত্বসীমার মাঝে আমি বাধা পড়ে থাকি। ক্রিশি আছে বলে আমি বেঁচে আছি। আমার জন্যে সে খাবার এনে দেয়, পানীয় এনে দেয়। যখন আমি গম্ভীর হতাশায় ডুবে যেতে থাকি ক্রিশি সম্পূর্ণ অবান্তর অর্থহীন কথা বলে আমাকে হতাশার অন্ধকার গহ্বর থেকে তুলে আনে। ক্রিশিকে নিয়ে রবোটগুলো কখনো কোনো ধরনের কৌতূহল দেখায় নি, রবোটগুলোর কাছে সে একটা কমিউনিকেশান্স মডিউল বা সৌর ব্যাটারি থেকে বেশি কৌতূহলোদ্দীপক কিছু ছিল না।
রবোটগুলো আমাকে গ্রুস্টানের কাছে দুষ্প্রাপ্য কিছু সফটওয়ারের বদলে ধরিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তারা কখনো আমার সাথে সেটা নিয়ে কোনো কথা বলে না। আমি তাদের সাথে আছি, তারা আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে, আমি কয়েকবার ভেবেছি আমাকে নিয়ে কী করবে তাদের জিজ্ঞেস করি কিন্তু একটা যন্ত্রের সাথে নিজের জীবন নিয়ে কথা বলতে প্রতিবারই আমার কেমন জানি বিতৃষ্ণা হয়েছে।
দ্বিতীয়বার তারা যখন মানুষের একটা লোকালয় আক্রমণ করল আমি সাথে যেতে চাই নি কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। রবোটগুলো আক্রমণ করল ভরদুপুরে, গুলি করতে করতে তারা গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়, তাদের হাতে কিছু বিস্ফোরক ছিল সেগুলো চারদিকে ছুঁড়ে দেয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। মানুষেরা চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে থাকে, প্রতিরক্ষা রবোট অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে, মুহূর্তে পুরো এলাকাটি একটা নরকের মতো হয়ে যায়। আমি কাছাকাছি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে নিস্পৃহভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলাম হঠাৎ লাল চুলের কমবয়সী একজন মানুষ আমার কাছে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে বলল, পালাও! পালাও! রবোট এসেছে, রবোট।
আমি অন্যমনস্কভাবে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একবার ইচ্ছে হল তাকে বলি, আমার কোথাও পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই–কিন্তু মানুষটা যেভাবে ছুটে পালাচ্ছে দাঁড়িয়ে আমার কোনো কথা শুনবে বলে মনে হয় না। কাছাকাছি প্রচও একটা বিস্ফোরণ হল, শিস দেয়ার মতো শব্দ করে কানের কাছে দিয়ে কয়েকটা গুলি বের হয়ে গেল, আমি অভ্যাসবশত মাথা নিচু করতে গিয়ে থেমে গেলাম। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কী হবে? যদি বিচ্ছিন্ন একটা গুলি এসে আমাকে শেষ করে দেয় হয়তো সেটাই হবে আমার জন্যে ভালো।
আমি প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ব্যাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
হঠাৎ দেখি একটু আগে লাল চুলের যে মানুষটি ছুটে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এসেছে। গুঁড়ি মেরে মুখের দিকে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ওই রবোটগুলোর সাথে এসেছ?
আমি মাথা নাড়লাম।
আমি তোমাকে চিনি।
আমি অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটা আবার বলল, তুমি কুশান। আমি তোমার ছবি দেখেছি।
লোকটা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দেয়াল থেকে কিছু ভেঙে পড়ল, লোকটা ছিটকে সরে গেল পিছনে। ঠিক তখন আমার ট্রাকিওশানে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি। রবোটগুলো ফিরে যেতে শুরু করেছে। আমাকেও ফিরে যেতে হবে।
আমি ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ফিরে যাচ্ছি হঠাৎ ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে লাল চুলের সেই মানুষটি আবার মাথা বের করে উচ্চৈঃস্বরে কিছু একটা বলল, পরিষ্কার মনে হল সে বলল, তুমি কি আমাকে তোমার সাথে নেবে? কিন্তু সেটা তো সত্যি হতে পারে না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ নিশ্চয়ই আমার সাথে যেতে চাইবে না। নিশ্চয়ই আমি ভুল শুনেছি।
রাত্রিবেলা প্রায় শ খানেক কিলোমিটার দূরে মাটিতে জিনন ল্যাম্প লাগিয়ে রবোটগুলো তাদের লুণ্ঠন করে আনা সফটওয়ার নিয়ে বসে। হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি–যাকে অন্য রবোটেরা বাহাত্তর বলে ডাকে, একটা ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে বলল, এবারে খুব ভালো ভালো সফটওয়ার পেয়েছি। এই যে দেখ গ্যালাক্সি সাত। রিকি ভাষায় লেখা
আমি গ্যালাক্সি সাত একবার ব্যবহার করেছিলাম, খুব যত্ন করে তৈরি করা। বিশ্বজগতের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। গ্রহ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্র, নীহারিকা, নক্ষত্রপুঞ্জ ব্ল্যাকহোলের আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর বাস্তব এক ধরনের অনুভূতি। আমি সচরাচর রবোটগুলোর সাথে কথা বলি না, আজকে কী মনে হল জানি না হঠাৎ বললাম, গ্যালাক্সি সাত চমৎকার সফটওয়ার।
সবগুলো রবোট একসাথে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। বাহাত্তর জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে জান?