- বইয়ের নামঃ ক্রোমিয়াম অরণ্য
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে
ক্রোমিয়াম অরণ্য – সায়েন্স ফিকশন / কল্পবিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পূর্বকথা
শরতের এক রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্নে গভীর আকাশ থেকে নিচে নেমে এল একটি শুভ্র গোলক। মাটির কাছাকাছি এসে প্লুটোনিয়ামের সেই তুষারশুভ্র গোলক ফেটে পড়ল এক ভয়ঙ্কর আক্রোশে, ভয়াবহ পারমাণবিক বিস্ফোরণে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি নগরী। মানুষের হাহাকারে পৃথিবীর বাতাস ভারি হয়ে এল সেই বিষণ্ণ অপরাহ্নে। মানুষ কিন্তু তবু থেমে রইল না। প্রতিশোধের হিংস্র জিঘাংসা নিয়ে একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল লক্ষ লক্ষ বছরে সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল পরদিন সূর্য ওঠার আগে। পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধুলার মতো উড়ে গেল পৃথিবীর জনপদ, সুরম্য অট্টালিকা, আকাশছোঁয়া নগরী।
তারপর বহুকাল পার হয়ে গেছে। পৃথিবী এখনো এক আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ধ্বংসস্থূপ। সেই প্রাণহীন ধ্বংসস্তূপে এখনো ধিকিধিকি করে জ্বলে আগুন, ঘুরে ঘুরে আকাশে ওঠে কালো ধোঁয়া। তার মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় বিবর্ণ, রং ওঠা নিয়ন্ত্রণহীন কিছু খেপা রবোট। সমুদ্র, হ্রদ আর নদীতে দূষিত পানি, বিষাক্ত মাটি, বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা আর তার মাঝে ধুকে ধুকে বেঁচে আছে কিছু মানুষ। সেই মানুষের জীবন বড় কঠোর, বড় নির্মম। তাদের চোখে কোনো স্বপ্ন নেই, তাদের মনে কোনো ভালবাসা নেই। তারা এক দিন এক দিন করে বেঁচে থাকে পরের দিনের জন্যে। প্রাণহীন, ভালবাসাহীন, শুষ্ক, কঠিন, নিরানন্দ ভয়ঙ্কর এক জীবন।
পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই অল্প কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে গ্রুস্টান–ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাওয়া পৃথিবীজোড়া সুরক্ষিত কম্পিউটারের ঘাটিগুলোর যোগসূত্র। কোয়ার্টজের তন্তুতে অবলাল রশ্মিতে পরিব্যাপ্ত এক অবিশ্বাস্য শক্তিশালী অপারেটিং সিস্টেম।
০১.
ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি স্থির চোখে সামনে তাকিয়েছিলাম। যতদূর চোখ যায় ততদূর এক বিশাল বিস্তৃত ধ্বংসস্তৃপ নিথর হয়ে পড়ে আছে। প্রাণহীন শুষ্ক নিষ্করুণ ভয়ঙ্কর একটি ধ্বংসস্থূপ। শুধুমাত্র মানুষই একটি সভ্যতাকে এত যত্ন করে গড়ে তুলে আবার এত নিখুঁতভাবে সেটি ধ্বংস করতে পারে। শুধুমাত্র মানুষ।
বেলা ডুবে গেলে আমি ধসে যাওয়া ভাঙা কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ক্রোমিয়ামের এই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকি। পৃথিবীর বাতাস পুরোপুরি দূষিত হয়ে গেছে, অসংখ্য ধূলিকণায় সারা আকাশে একটি ঘোলাটে রং, সূর্য ডুবে যাবার আগে সূর্যালোক বিচ্ছুরিত হয়ে হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্যে আকাশে বিচিত্র একটি রং খেলা করতে থাকে। সেই অপার্থিব আলোতে সামনের আদিগন্ত বিস্তৃত ভয়াবহ এই ধ্বংসস্তূপকে কেমন যেন রহস্যময় দেখায়। দীর্ঘ সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ এই প্রাণহীন ধ্বংসস্তুপকে একটি জীবন্ত প্রাণীর মতো মনে হতে থাকে। মনে হয় এক্ষুনি যেন সেটি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। আমি এক ধরনের অসুস্থ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকি, কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না।
সূর্য ডুবে যাবার পর হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তখন আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী ধ্বংস হয়ে গেছে, বেঁচে আছে কিছু বিষাক্ত বৃশ্চিক এবং কুৎসিত সরীসৃপ। রাতের অন্ধকারে তারা জঞ্জালের ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। আমি নেমে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম ঠিক তখন নিচে থেকে রাইনুক নিচু স্বরে ডাকল, কুশান, তুমি কি উপরে?
এটি আমাদের বসতির নির্জন অংশটুকু, এখানে আশপাশে কেউ নেই, নিচু গলায় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই–কিন্তু তবুও সবাই নিচু গলায় কথা বলে। সবার ভিতরে সবসময় কেমন এক ধরনের অস্পষ্ট আতঙ্ক, কারণটি কে জানে। আমিও নিচু গলায় বললাম, হ্যাঁ রাইনুক, আমি এখানে।
নিচে নেমে আস।
আসছি।
আমি আবছা অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলে নিচে নেমে আসতে আসতে বললাম, তুমি কেমন করে জান আমি এখানে?
তোমার ঘরে গিয়েছিলাম। ক্রিশি বলেছে।
ও।
রাইনুক তরল গলায় হেসে বলল, আমি কখনো বুঝতে পারি না তুমি কেন ক্রিশির মতো একটা রবোটকে নিজের সাথে রেখেছ!
কেন, কী হয়েছে? ক্রিশি খুব ভালো রবোট।
তৃতীয় প্রজাতির কপোট্রন, একটি কথা দশবার করে বলতে হয়। চতুর্থ শ্রেণীর যোগাযোগ মডিউল–আমার মনে হয় তুমি যদি এখন ভালো একটা রবোটের জন্যে আবেদন করে দাও কিছুদিনের মাঝে একটা পেয়ে যাবে।
আমার বেশ চলে যায়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ভালো রবোটের কোনো প্রয়োজন নেই। ভালো রবোট দিয়ে আমি কী করব?
ঠিক। রাইনুক খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি রোজ ওই উপরে উঠে বসে থাক কেন? যদি কোনোদিন পা হড়কে পড়ে যাও? যদি হাতপা কিছু ভেঙে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। অস্ত্রোপচারের রবোটের কপোট্রন কোন মডেলের তুমি জান?
জানি।
লিয়ানার কাছে শুনেছি ওষুধপত্রও নাকি খুব কমে এসেছে।
আমি কোনো কথা বললাম না। রাইনুক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চল যাই।