- বইয়ের নামঃ ক্রোমিয়াম অরণ্য
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে
ক্রোমিয়াম অরণ্য – সায়েন্স ফিকশন / কল্পবিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পূর্বকথা
শরতের এক রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্নে গভীর আকাশ থেকে নিচে নেমে এল একটি শুভ্র গোলক। মাটির কাছাকাছি এসে প্লুটোনিয়ামের সেই তুষারশুভ্র গোলক ফেটে পড়ল এক ভয়ঙ্কর আক্রোশে, ভয়াবহ পারমাণবিক বিস্ফোরণে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি নগরী। মানুষের হাহাকারে পৃথিবীর বাতাস ভারি হয়ে এল সেই বিষণ্ণ অপরাহ্নে। মানুষ কিন্তু তবু থেমে রইল না। প্রতিশোধের হিংস্র জিঘাংসা নিয়ে একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল লক্ষ লক্ষ বছরে সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল পরদিন সূর্য ওঠার আগে। পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধুলার মতো উড়ে গেল পৃথিবীর জনপদ, সুরম্য অট্টালিকা, আকাশছোঁয়া নগরী।
তারপর বহুকাল পার হয়ে গেছে। পৃথিবী এখনো এক আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ধ্বংসস্থূপ। সেই প্রাণহীন ধ্বংসস্তূপে এখনো ধিকিধিকি করে জ্বলে আগুন, ঘুরে ঘুরে আকাশে ওঠে কালো ধোঁয়া। তার মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় বিবর্ণ, রং ওঠা নিয়ন্ত্রণহীন কিছু খেপা রবোট। সমুদ্র, হ্রদ আর নদীতে দূষিত পানি, বিষাক্ত মাটি, বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা আর তার মাঝে ধুকে ধুকে বেঁচে আছে কিছু মানুষ। সেই মানুষের জীবন বড় কঠোর, বড় নির্মম। তাদের চোখে কোনো স্বপ্ন নেই, তাদের মনে কোনো ভালবাসা নেই। তারা এক দিন এক দিন করে বেঁচে থাকে পরের দিনের জন্যে। প্রাণহীন, ভালবাসাহীন, শুষ্ক, কঠিন, নিরানন্দ ভয়ঙ্কর এক জীবন।
পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই অল্প কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে গ্রুস্টান–ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাওয়া পৃথিবীজোড়া সুরক্ষিত কম্পিউটারের ঘাটিগুলোর যোগসূত্র। কোয়ার্টজের তন্তুতে অবলাল রশ্মিতে পরিব্যাপ্ত এক অবিশ্বাস্য শক্তিশালী অপারেটিং সিস্টেম।
০১.
ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি স্থির চোখে সামনে তাকিয়েছিলাম। যতদূর চোখ যায় ততদূর এক বিশাল বিস্তৃত ধ্বংসস্তৃপ নিথর হয়ে পড়ে আছে। প্রাণহীন শুষ্ক নিষ্করুণ ভয়ঙ্কর একটি ধ্বংসস্থূপ। শুধুমাত্র মানুষই একটি সভ্যতাকে এত যত্ন করে গড়ে তুলে আবার এত নিখুঁতভাবে সেটি ধ্বংস করতে পারে। শুধুমাত্র মানুষ।
বেলা ডুবে গেলে আমি ধসে যাওয়া ভাঙা কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ক্রোমিয়ামের এই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকি। পৃথিবীর বাতাস পুরোপুরি দূষিত হয়ে গেছে, অসংখ্য ধূলিকণায় সারা আকাশে একটি ঘোলাটে রং, সূর্য ডুবে যাবার আগে সূর্যালোক বিচ্ছুরিত হয়ে হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্যে আকাশে বিচিত্র একটি রং খেলা করতে থাকে। সেই অপার্থিব আলোতে সামনের আদিগন্ত বিস্তৃত ভয়াবহ এই ধ্বংসস্তূপকে কেমন যেন রহস্যময় দেখায়। দীর্ঘ সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ এই প্রাণহীন ধ্বংসস্তুপকে একটি জীবন্ত প্রাণীর মতো মনে হতে থাকে। মনে হয় এক্ষুনি যেন সেটি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। আমি এক ধরনের অসুস্থ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকি, কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না।
সূর্য ডুবে যাবার পর হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তখন আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী ধ্বংস হয়ে গেছে, বেঁচে আছে কিছু বিষাক্ত বৃশ্চিক এবং কুৎসিত সরীসৃপ। রাতের অন্ধকারে তারা জঞ্জালের ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। আমি নেমে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম ঠিক তখন নিচে থেকে রাইনুক নিচু স্বরে ডাকল, কুশান, তুমি কি উপরে?
এটি আমাদের বসতির নির্জন অংশটুকু, এখানে আশপাশে কেউ নেই, নিচু গলায় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই–কিন্তু তবুও সবাই নিচু গলায় কথা বলে। সবার ভিতরে সবসময় কেমন এক ধরনের অস্পষ্ট আতঙ্ক, কারণটি কে জানে। আমিও নিচু গলায় বললাম, হ্যাঁ রাইনুক, আমি এখানে।
নিচে নেমে আস।
আসছি।
আমি আবছা অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলে নিচে নেমে আসতে আসতে বললাম, তুমি কেমন করে জান আমি এখানে?
তোমার ঘরে গিয়েছিলাম। ক্রিশি বলেছে।
ও।
রাইনুক তরল গলায় হেসে বলল, আমি কখনো বুঝতে পারি না তুমি কেন ক্রিশির মতো একটা রবোটকে নিজের সাথে রেখেছ!
কেন, কী হয়েছে? ক্রিশি খুব ভালো রবোট।
তৃতীয় প্রজাতির কপোট্রন, একটি কথা দশবার করে বলতে হয়। চতুর্থ শ্রেণীর যোগাযোগ মডিউল–আমার মনে হয় তুমি যদি এখন ভালো একটা রবোটের জন্যে আবেদন করে দাও কিছুদিনের মাঝে একটা পেয়ে যাবে।
আমার বেশ চলে যায়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ভালো রবোটের কোনো প্রয়োজন নেই। ভালো রবোট দিয়ে আমি কী করব?
ঠিক। রাইনুক খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি রোজ ওই উপরে উঠে বসে থাক কেন? যদি কোনোদিন পা হড়কে পড়ে যাও? যদি হাতপা কিছু ভেঙে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। অস্ত্রোপচারের রবোটের কপোট্রন কোন মডেলের তুমি জান?
জানি।
লিয়ানার কাছে শুনেছি ওষুধপত্রও নাকি খুব কমে এসেছে।
আমি কোনো কথা বললাম না। রাইনুক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চল যাই।
কোথায়?
মনে নেই আজ গ্রুস্টান দেখা দেবে?
কিন্তু সে তো মাঝরাতে।
একটু আগে যদি না যাই বসার জায়গা পাব না।
তাই বলে এত আগে?
এত আগে কোথায় দেখলে? রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, খাবারের ঘর থেকে খাবার তুলে নিতে দেখবে কত সময় চলে যাবে। চল যাই।
আমি আর কিছু বললাম না। রাইনুকের সাথে কোনোকিছু নিয়ে তর্ক করা যায় না। সে অল্পতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সবকিছুকে সে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে নেয়। পৃথিবী যদি এভাবে ধ্বংস না হয়ে যেত সে নিশ্চয়ই খুব বড় একটি প্রতিষ্ঠানে খুব দায়িত্বশীল একজন মানুষ হত। অনেক বড় বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার। রকেট বিশেষজ্ঞ বা মহাকাশচারী। কিন্তু এখন সে আর কিছুই হতে পারবে না, ধ্বংসস্তূপের আড়ালে আড়ালে সে বেঁচে থাকবে। ধসে পড়া বারোয়ারী খাবারের ঘরে বিস্বাদ খাবারের জন্যে হাতাহাতি করবে। বিবর্ণ কাপড় পরে ঘুরে বেড়াবে। প্রাচীন নির্বোধ রবোটের সাথে অর্থহীন তর্ক করে অনুজ্জ্বল টার্মিনালের সামনে বসে থেকে বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে নিতে একদিন সে নিঃশেষ হয়ে যাবে। যেভাবে আরো অনেকে নিঃশেষ হয়েছে।
আমি আর রাইনুক পাশাপাশি হাঁটছি হঠাৎ সে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কুশান–
কী?
তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
কর।
তোমার কি মনে হয় না আমাদের জীবনের কোনো অর্থ নেই?
রাইনুকের গলার স্বরে এক ধরনের হাহাকার ছিল যেটি হঠাৎ আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে, তার জন্যে হঠাৎ আমার বিচিত্র এক ধরনের করুণা হতে থাকে। আমি কোমল গলায় বললাম, না রাইনুক, সেটা সত্যি নয়।
কেন নয়?
একজন মানুষের যখন কিছু করার থাকে না তখন তার জীবন অর্থহীন হয়ে যায়। আমাদের তো এখন অনেক কিছু করার আছে।
কী করার আছে?
বেঁচে থাকার জন্যে কত কী করতে হয় আমাদের প্রতি মুহূর্তে একটা করে নূতন পরীক্ষা, একটা করে নূতন যুদ্ধ!
এটাকে তুমি জীবন বল?
জীবন বড় আপেক্ষিক। তার কোনো চরম অবস্থান নেই। তুমি এই জীবনকে যেভাবে দেখবে সেটাই হবে তার অবস্থান।
রাইনুক কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, অন্ধকারে আমি তার চোখ দেখতে পেলাম না কিন্তু আমি জানি তার দৃষ্টি ক্রুদ্ধ!
.
খাবারের ঘরটিতে খুব ভিড়। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে সবাই ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে, একটি প্রতিরক্ষা রবোট স্ক্যানার হাতে নিয়ে মিছেই ছুটোছুটি করে রেটিনা স্ক্যান করে সবার পরিচয় নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করছিল। ভিতরে খাবার পরিবেশনকারী রবোটগুলো খাবারের ট্রে নিয়ে অর্থহীনভাবে ছুটোছুটি করছে, ট্রের উপরে গাঢ় বাদামি রঙের চতুষ্কোণ বিস্বাদ খাবার।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে আমরা ভিতরে ঢুকে নিজের অংশের খাবারটুকু প্লেটে তুলে নিই। একটি ছোট বোতলে করে একটি রবোট আমাদের খানিকটা লাল রঙের তরল ধরিয়ে দিল, ভিতরে কী আছে কেউ জানে না, দীর্ঘদিন থেকে তবুও আমরা সেটা বিশ্বাস করে খেয়ে আসছি। ঘরের ভিতরে ভাপসা গরম, বসার জায়গা নেই। খাবারের ট্রে নিয়ে আমরা ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। কী অকিঞ্চিৎকর খাবার আর কী মন খারাপ করা পরিবেশ! শরীরের জন্যে পুষ্টিকর! তা না হলে মানুষ কেমন করে এই খাবার দিনের পর দিন খেয়ে যেতে পারে? রবোট হয়ে কেন জন্ম হয় নি ভেবে মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। তাহলে কানের নিচে একটা সৌর ব্যাটারি লাগিয়ে খাবারের কথা ভুলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার রবোট হয়ে জন্ম হয় নি তাই মাঝে মাঝেই আমার খুব ইচ্ছে করে একটা হ্রদের পাশে বসে আগুনে ঝলসিয়ে একটি তিতির পাখি খেতে, সাথে যবের রুটি আর আঙুরের রস! আমি কখনো এসব খাই নি, প্রাচীন গ্রন্থে এর উল্লেখ দেখেছি, ডাটাবেসে ছবি রয়েছে, মনে হয় নিশ্চয়ই খুব উপাদেয় খাবার হবে।
লাল রঙের পানীয়টুকু ঢক ঢক করে খেয়ে আমি আর রাইনুক খাবারের টুকরো দুটি হাতে নিয়ে বের হয়ে আসি। বাইরে অন্ধকার, স্থানে স্থানে ছোট ছোট সৌর সেল দিয়ে খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রাখা আছে, খুব লাভ হয়েছে মনে হয় না। বরং মনে হয় তার আশপাশে অন্ধকার যেন আরো জমাট বেঁধে আছে। যদি কোনো আলো না থাকত তাহলে সম্ভবত অন্ধকারে আমাদের চোখ সয়ে আসত, আমরা আরো স্পষ্ট দেখতে পারতাম। কিন্তু মানুষ মনে হয় অন্ধকারকে সহ্য করতে পারে না, যত অল্পই হোক তাদের একটু আলো দরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের রবোটের মতো অবলাল সংবেদী চোখ নেই।
গ্রুস্টান আমাদের দেখা দেবার জন্যে শহরের মাঝামাঝি প্রাচীন হলঘরটি বেছে নিয়েছে। হলঘরের এক অংশ খুব খারাপভাবে ধসে যাবার পরও সামনের অংশটুকু মোটামুটি অবিকৃতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই হলঘরটিতে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ বসতে পারত, এখন সেটি সম্ভব নয়–তার প্রয়োজনও নেই। আমাদের এই বসতিতে সব মিলিয়ে তেষট্টি জন মানুষ, যার মাঝে বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং অনেকগুলো রবোট। পারমাণবিক ব্যাটারির অভাব বলে বেশিরভাগ রবোটকেই অচল করে রাখা আছে, নেহাত প্রয়োজন না হলে সেগুলো চালু করা হয় না।
প্রাচীন হলঘরটিতে এর মাঝেই লোকজন আসতে শুরু করেছে। বসার জন্যে কোনো আসন নেই, শক্ত পাথরের মেঝেতে পা মুড়ে বসতে হয়। সামনে একটি লাল কার্পেট বিছিয়ে। রাখা হয়েছে; বাম পাশে একটি যোগাযোগ মডিউল, ডান পাশে প্লাটিনামের একটি পাত্রে গাঢ় সবুজ রঙের এক ধরনের পানীয়। এটি লিয়ানার জন্যে নির্ধারিত জায়গা, সে এই বসতির তেষট্টি জন মানুষ এবং কয়েক শতাধিক সচল ও অচল রবোটের দলনেত্রী। সে এখনো আসে নি। তার জন্যে জায়গা আলাদা করে রাখা হয় তাই আগে থেকে এসে অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজনও নেই।
আমি আর রাইনুক হলঘরের মাঝামাঝি পা মুড়ে বসে পড়ি। গ্রুস্টান যতবার আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে ততবার আমাদের মেঝেতে পা মুড়ে বসতে হয়েছে। অপার্থিব কোনো ব্যক্তিকে সম্মান দেখানোর এই পদ্ধতিটি প্রাচীন কিন্তু নিঃসন্দেহে কার্যকরী। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম। বেশিরভাগ মানুষই চুপ করে বসে আছে। যারা কথা বলছে তাদের গলার স্বর নিচু এবং চোখে এক ধরনের চকিত দৃষ্টি। একটু পরে পরে মাথা ঘুরিয়ে দেখছে। কান পেতে থাকলে ঘরে নিচু শব্দতরঙ্গের এক ধরনের ভোঁতা শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনো একটি শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাই চালু করা হয়েছে। আমি সামনে তাকালাম, একটু খুঁটিয়ে দেখার পরই চার কোনায় লেজাররশ্মি নিয়ন্ত্রণের জন্যে শক্তিশালী লেন্সগুলো চোখে পড়ল। ঘরের মেঝে থেকে ছোট ঘোট টিউব বের হয়ে এসেছে; তরল নাইট্রোজেনের সাথে জলীয় বাষ্প মিশিয়ে সাদা ধোঁয়ার মতো কিছু বের করা হবে। সংবেদী স্পিকারগুলো অনেক খুঁজেও বের করতে পারলাম না, নিশ্চয়ই সেগুলো হলঘরের দেয়ালে, ছাদে, মেঝেতে যত্ন করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রুস্টানের দেখা দেয়ার সময় পুরো ব্যাপারটির নাটকীয় অংশটুকু খুব যত্ন করে করা হয়।
ঘরে যে মৃদু কথাবার্তা হচ্ছিল হঠাৎ সেটি থেমে যায়, আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি লিয়ানা এসেছে। লিয়ানার বয়স খুব বেশি নয়, অন্তত দেখে মনে হয় না। তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে কিন্তু শরীরটি অপূর্ব। অর্ধস্বচ্ছ নিও পলিমারের একটি কাপড়ের নিচে তার সুডৌল শরীরটি আবছা দেখা যাচ্ছে। সুগঠিত বুক, মেদহীন কোমল দেহ, মসৃণ ত্বক। তার চুলে এক ধরনের ধাতব রং সেগুলো মাথার উপরে ঝুঁটির মতো করে বাঁধা। লিয়ানার চোখের মণি নীল, দেখে মনে হয় সেখানে আকাশের গভীরতা।
লিয়ানা কোনো কথা না বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, আমরা সবাই হাত নেড়ে তার প্রত্যুত্তর দিলাম। সে সামনে রাখা কার্পেটে পা ভাঁজ করে বসে পড়ে, তার ভঙ্গিটি খুব সপ্রতিভ এবং সাবলীল। তাকে দেখতেও বেশ লাগে, পুরুষমানুষের কামনাকে প্রশ্রয় দেয় বলেই কি না কে জানে। আমি যতদূর জানি লিয়ানা একা থাকতে ভালবাসে। মাঝে মাঝে বসতির কোনো সুদর্শন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় কিন্তু কখনো একজনের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
লিয়ানা প্লাটিনামের পাত্র থেকে সবুজ রঙের তরলটি চুমুক দিয়ে খেয়ে যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করতেই ঘরের আলো আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। আমরা লিয়ানার গলার স্বর শুনতে পেলাম, তার গলার স্বরটি একটু শুষ্ক, দীর্ঘ সময় উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে গলার স্বর একটু ভেঙে গেলে যেরকম শোনায় অনেকটা সেরকম। সে চাপা গলায় বলল, মহান গ্রুস্টান আসছেন আমাদের কাছে। তোমরা সবাই আমার সাথে মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন কর মহামান্য গ্রুস্টানকে। গ্রুস্টান! আমাদের জীবন রক্ষাকারী গ্রুস্টান। মহান সর্বশক্তিশালী গ্রুস্টান।
আমরা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বললাম, মহান সর্বশক্তিশালী গ্রুস্টান।
হলঘরের সামনের অংশটুকু এক ধরনের সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যেতে থাকে। তরল নাইট্রোজেন বাষ্পীভূত হয়ে ঘরটাকে শীতল করে দেয়, আমি একটু শিউরে উঠি। খুব ধীরে ধীরে একটি সঙ্গীতের সুর বেজে ওঠে, সেটি একই সাথে সুখ এবং বিষাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সঙ্গীতের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে, সুখ এবং বিষাদের পরিবর্তে হঠাৎ আনন্দ এবং শঙ্কার অনুভূতি প্রবল হয়ে আসে। ধীরে ধীরে সঙ্গীতের সুর মানুষের আর্তচিৎকার আর হাহাকারের মতো শোনাতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই শব্দ বেড়ে উঠে হলঘরের দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে, আমরা এক ধরনের আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলি। হঠাৎ করে সমস্ত শব্দ থেমে গিয়ে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। আমরা চোখ খুলে তাকালাম, দেখতে পেলাম আমাদের সামনে শূন্যে গ্রুস্টান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হালকা সবুজ রঙের দেহ মনে হয় কেউ জেড পাথর কুঁদে তৈরি করেছে। শরীর থেকে এক ধরনের স্বচ্ছ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অপূর্ব কান্তিময় মুখাবয়ব, একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কঠোর এবং কোমল। একই সাথে হাসিখুশি এবং বিষাদগ্রস্ত। তার দেহ এক ধরনের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা, একদৃষ্টে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে দুই হাত উপরে তুলে ভারি গমগমে গলায় কথা বলে ওঠে, আমার প্রিয় মানুষেরা, তোমাদের জন্যে আমার ভালবাসা।
আমরা নিচু গলায় বললাম, ভালবাসা। আমাদের ভালবাসা।
তোমাদের সামনে আসতে পেরে আমি ধন্য।
আমরা বললাম, ধন্য। আমি ধন্য।
আমি অভিভূত।
আমি অভিভূত। অভিভূত।
তোমাদের জন্যে রয়েছে অভূতপূর্ব সুসংবাদ। গোপন এক কুঠুরিতে আবিষ্কার করেছি বিশাল প্রোটিনের সম্ভার। তোমাদের জন্যে রয়েছে অঢেল খাবার।
আমরা হর্ষধ্বনি করে চিৎকার করে উঠি, জয়! মহান গ্রুস্টানের জয়!
নূতন নেটওয়ার্কে যুক্ত করেছি আরেকটি বিশাল ভূখণ্ড সেখানে আবিষ্কার করেছি আরো একটি জনপদ।
জয়! মানুষের জয়!
পাহাড়ের গুহায় খুঁজে পেয়েছি ওষুধের কারখানা। সেখানে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের জন্যে অঢেল প্রয়োজনীয় ওষুধ। রোগশোকের বিরুদ্ধে রয়েছে তোমাদের আশ্চর্য নিরাপত্তা।
নিরাপত্তা! আশ্চর্য নিরাপত্তা!
শুধু তাই নয়– গ্রুস্টানের মুখ হঠাৎ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, পৃথিবীর অপর প্রান্তের এক ল্যাবরেটরিতে রয়েছে অপূর্ব সব সফটওয়ার। তাদের উৎকর্ষের কোনো তুলনা নেই। মহান শিল্পকর্মের মতো হবে তার আবেদন। আমি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব এই মহান সৃষ্টি। তোমাদের জীবন হবে অপূর্ব আনন্দময়
আনন্দময়! অপূর্ব আনন্দময়!
গ্রুস্টানের গলার স্বর আবেগে কাঁপতে থাকে। তার সুরেলা কণ্ঠস্বরে সারা ঘরে এক ধরনের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর নূতন মানুষ নিয়ে সে নূতন জীবনের কথা বলে, নূতন স্বপ্নের কথা শোনায়। আমাদের বুকে নূতন এক ধরনের আশা জাগিয়ে তোলে। তার গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি, গভীর আবেগ আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখে। আমাদের শরীর শিহরিত হয়ে উঠতে থাকে, আমরা এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করতে থাকি। আমরা যেন একটি স্বপ্নের জগতে চলে যাই।
এক সময় গ্রুস্টানের কথা শেষ হল, আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বুকের ভিতর তখনো কেমন যেন শিহরন।
লিয়ানা মাথা নিচু করে বলল, মহামান্য গ্রুস্টান।
বল লিয়ানা।
আমরা আমাদের এই বসতিতে আমাদের শিশুদের শিক্ষা দিতে চাই। প্রস্তুত করতে চাই নূতন জীবনের জন্যে।
অবশ্যি লিয়ানা। অবশ্যি শিক্ষা দেবে তোমাদের শিশুদের।
আমরা আপনার সাহায্য চাই মহামান্য গ্রুস্টান
অবশ্যি আমার সাহায্য তোমরা পাবে লিয়ানা। অবশ্যি পাবে। আমি তোমাদের সাহায্য করব নূতন জীবনের আশার বাণী শেখাতে। ভালবাসার কথা স্বপ্নের কথা–
আমি গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান, মহাকাশবিদ্যা জিনেটিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের কথা বলছিলাম—
গ্রুস্টানের মুখে হঠাৎ এক ধরনের চাপা হাসি খেলা করতে থাকে। হাসতে হাসতে সে তরল গলায় বলল, না লিয়ানা, না। মানবশিশুকে তোমরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে দিও না। মানুষের শিক্ষা হবে শিল্পে, সাহিত্যে, সৌন্দর্যে। আশায় ভালবাসায়। নূতন স্বপ্লে। ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে তাদের মনকে কলুষিত কোরো না। গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত কোরো না। এই জ্ঞান খুব নিচুস্তরের জ্ঞান। এই জ্ঞান মানুষের উপযুক্ত জ্ঞান নয়। এই জ্ঞানচর্চা করবে রবোটেরা, তুচ্ছ রবোটেরা, তাদের হাস্যকর কপোট্রনে। মানুষের অপূর্ব মস্তিষ্ক এই জ্ঞানের অনেক উর্ধ্বে।
লিয়ানা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু মহামান্য গ্রুস্টান–
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই লিয়ানা। মানুষের মস্তিষ্কে রয়েছে অচিন্তনীয় কল্পনাশক্তি। তাদের সেই অভূতপূর্ব শক্তিকে বিকশিত হতে আমাকে সাহায্য করতে দাও। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের যুক্তিতর্কের সীমায় তাদের আবদ্ধ কোরো না। সেই অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানটুকু আমি রবোটের কপোট্রনে সঞ্চারিত করে দেব। তোমাদের সেবায় রবোটেরা সেই জ্ঞানটুকু সমস্ত শক্তি দিয়ে নিয়োজিত করবে।
লিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মহামান্য গ্রুস্টান
বল লিয়ানা।
আমাদের আরো একটি কথা ছিল।
বল লিয়ানা। তোমাদের কথা শুনতেই আমি আজ এসেছি।
আমাদের এই বসতিতে শিশুর সংখ্যা খুব কম। আমাদের আরো শিত্র প্রয়োজন। আমাদের পুরুষ এবং মহিলারা একটি করে পরিবার সৃষ্টি করতে পারে, একটি–দুটি শিশু নিয়ে সেই পরিবারটি নূতন জীবন শুরু করতে পারে। ভ্রূণ ব্যাংক থেকে আমরা কি কিছু নূতন শিশু পেতে পারি?
গ্রুস্টান দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, লিয়ানা আমি তোমাদের বলেছি তোমরা যখন প্রস্তুত হবে আমি ভ্রূণ ব্যাংক থেকে তোমাদের শিশু এনে দেব। কিন্তু সে জন্যে তোমাদের প্রস্তুত হতে হবে–
আমরা প্রস্তুত মহামান্য গ্রুস্টান।
না– গ্রুস্টান তীব্র স্বরে বলল, তোমরা প্রস্তুত নও। তোমাদের মাঝে এখনো অসংখ্য ক্ষুদ্রতা, হীনমন্যতা, অসংখ্য কুটিলতা। তোমাদের মাঝে এখনো নানা ধরনের রূঢ়তা– এখনো ভালবাসার খুব অভাব। নূতন শিশু তোমাদের মাঝে এসে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবে না লিয়ানা। আমি জানি।
লিয়ানা মাথা নিচু করে বসে রইল। গ্রুস্টান লিয়ানার কাছে এগিয়ে এসে বলল, লিয়ানা, আমি তোমাদের বুক আগলে বাঁচিয়ে রেখেছি, ক্ষুধায় খাবার দিয়েছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় দিয়েছি, রোগশোকে ওষুধ দিয়েছি, চিকিৎসা দিয়েছি। আমি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছি, যখন সময় হবে তোমাদের হাতে নূতন শিশু তুলে দেব। তাদের নিয়ে তোমরা আবার নূতন সভ্যতার সৃষ্টি করবে পৃথিবীতে। যে সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তার থেকে অনেক বড় হবে সেই সভ্যতা। অনেক মহান। সেটাই আমার স্বপ্ন। আমার আশা।
লিয়ানা নিচু গলায় বলল, আপনার স্বপ্ন সফল হোক মহামান্য গ্রুস্টান।
আমরা বিড়বিড় করে বললাম, সফল হোক। সফল হোক।
বিদায় আমার প্রিয় মানুষেরা।
বিদায়।
গ্রুস্টান ভেসে ভেসে উপরে উঠে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আবার আমি আসব তোমাদের কাছে। আবার কথা বলব। কিন্তু জেনে রাখ, আমাকে যদি তোমরা নাও দেখ আমি কিন্তু তোমাদের সাথে আছি। সর্বক্ষণ আমি তোমাদের সাথে আছি। প্রতি মুহূর্তে। আমার ভালবাসার বন্ধনে তোমরা জড়িয়ে আছ আমার সাথে–তোমরা সবাই প্রতিটি মানুষ।
সমস্ত হলঘরটি হঠাৎ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল। কয়েক মুহূর্ত এক ধরনের অসহনীয় নীরবতা, হঠাৎ এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ হতে থাকে মানুষের সম্মিলিত হাহাকারের মতো। সেই শব্দ ঘরের এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি এক সময় শব্দ থেমে আসে, সমস্ত ঘরে আবার নীরবতা নেমে আসে। তখন হঠাৎ করে ঘরের ছাদে ঘোলাটে হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। আমরা মাথা উঁচু করে একে অন্যের দিকে তাকাই, সবার চোখ এক ধরনের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না, চুপ করে বসে আছে।
সবচেয়ে প্রথম কথা বলল বৃদ্ধ ক্লাউস। মাথার সাদা চুল পিছনে সরিয়ে সে কাঁপা গলায় বলল, গ্রুস্টানের উপস্থিতি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মনপ্রাণের সব ধরনের অবসাদ কেটে গিয়ে এক ধরনের সতেজ ভাব এসে যায়।
কমবয়সী রিশি বলল, সমস্ত শরীর শিউরে শিউরে ওঠে! সে তার হাতটি সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
ক্লাউস আবার বলল, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য আমরা গ্রুস্টানের স্নেহধন্য হয়েছি। তার ভালবাসা পেয়েছি।
ক্লাউসের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, সে হঠাৎ দুই হাত উপরে তুলে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে ওঠে, জয় হোক। রুস্টানের জয় হোক।
ঘরের অনেকে তার সাথে যোগ দিয়ে বলল, জয় হোক।
ঠিক তখন হেঁটে হেঁটে লিয়ানা কাছে এসে দাঁড়াল, তাকে একই সাথে ক্লান্ত এবং বিষণ দেখাচ্ছে। ক্লাউস লিয়ানার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য গ্রুস্টান আমাদের এত স্নেহ করে।
লিয়ানা কিছু বলল না। ক্লাউস আবার বলল, গ্রুস্টানের সাথে সময় কাটালে মনপ্রাণ পবিত্র হয়ে যায়।
আমার কী হল জানি না হঠাৎ করে বলে ফেললাম, কিন্তু গ্রুস্টান তো একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছু না!
ঘরের ভিতরে হঠাৎ যেন একটা বজ্রপাত ঘটে গেল। যে যেখানে ছিল সেখানে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঘুরে সবার দিকে তাকালাম, হঠাৎ করে কেমন জানি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি।
লিয়ানা খুব ধীরে ধীরে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ কুশান?
আমি আবার মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালাম, কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিয়ানা আবার বলল, কুশান–
বল।
তুমি কী বলেছ?
আমি–আমি হঠাৎ প্রায় মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম, আমি বলেছি যে গ্রুস্টান একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। রিকিভ ভাষায় লেখা একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। মানুষের সাথে তার যোগাযোগ হয় হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে। ত্রিমাত্রিক ছবিতে। সে একটি কৃত্রিম চরিত্র। সে সত্যিকারের কিছু নয়–
লিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যিকারের বলতে তুমি কী বোঝাও? ঈশ্বর ধরাছোঁয়ার অনুভবের বাইরে ছিল তবুও কি পৃথিবীর মানুষ হাজার হাজার বছর ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে নি?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, সবকিছুর একটা সময় আছে কুশান। উৎসবের সময় আছে, শোকেরও সময় আছে। বিপ্লবের সময় আছে, বিদ্রোহেরও সময় আছে। সময়ের আগে কিছু করতে চাইলে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে হয়। আমাদের মানুষের এখন সেই ঝুঁকি নেয়ার শক্তি নেই কুশান।
আমি অবাক হয়ে লিয়ানার দিকে তাকালাম, তাকে হঠাৎ কী দুঃখী একটা মানুষের মতো মনে হচ্ছে। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল তার মুখ স্পর্শ করে বলি, না লিয়ানা তুমি ভুল বলছ। আমাদের মানুষের সেই শক্তি আছে। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না।
লিয়ানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা পাহাড়ের উপর থেকে তুমি একটা পাথর গড়িয়ে দিয়েছ কুশান। নিচে পড়তে পড়তে পাথরটা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে আবার গতি সঞ্চয় করে অন্য পাথরকে স্থানচ্যুত করে বিশাল একটা ধস নামিয়ে দিতে পারে। কোনটা হবে আমি জানি না। লিয়ানা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি কিন্তু এখন কোনোটাই চাই নি।
আমি তখনো কিছু বলতে পারলাম না। লিয়ানা খানিকক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক ধরনের বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান গ্রুস্টান আমাদের এই কথোপকথনটি শুনছে।
আমি জানতাম তবু কেন জানি একবার শিউরে উঠলাম।
০২. গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল
গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, কেউ একজন আমার কপালে হাত রেখেছে। শীতল ধাতব হাত, নিশ্চয়ই নিচু শ্রেণীর একটা প্রতিরক্ষা রবোট। আমি চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম একজোড়া সবুজ ফটোসেলের চোখ আমার উপর স্থির হয়ে আছে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, কে?
আমি মহামান্য কুশান। কিউ–৪৩। একজন প্রতিরক্ষা রবোট।
কী চাও তুমি?
আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
নিতে এসেছ?
হ্যাঁ, মহামান্য কুশান।
কোথায়? সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনে।
এত রাতে?
হ্যাঁ মহামান্য কুশান, জরুরি অধিবেশন।
আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম, আমি যেতে চাই না, কিউ—৪৩।
আপনি নিজে থেকে যেতে না চাইলে জোর করে নিয়ে যাওয়ার আদেশ রয়েছে মহামান্য কুশান।
ও। আমি বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়ালাম। সামনের স্বচ্ছ দেয়ালে আমি নিজের প্রতিবিম্বটি দেখতে পেলাম, চেহারায় এক ধরনের বিপর্যস্ততার ছাপ। আমি মেঝে থেকে একটা পোশাক তুলে শরীরের উপর জড়িয়ে নিতে থাকি, ঠিক তখন ক্রিশি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য কুশান, এটি জরুরি অধিবেশনের উপযোগী পোশাক নয়।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি ক্রিশি?
আপনার আরেকটু শোভন পোশাক পরে যাওয়া দরকার।
এই মাঝরাতে তুমি আমাকে জ্বালাতন করছ ক্রিশি।
ক্রিশি আমার অনুযোগে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ধীর পায়ে পাশের ঘরে হেঁটে চলে গিয়ে আমার জন্যে একটি পোশাক নিয়ে আসে। এ ধরনের পোশাকে আমাকে খানিকটা আহাম্মকের মতো দেখাবে জেনেও আমি আর আপত্তি করলাম না। ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট, তার সাথে কোনকিছু নিয়ে তর্ক করা একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাবার আগে ক্রিশি বলল, মহামান্য কুশান, আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনে অনুমতি দেয়ার আগে আসন গ্রহণ করা চতুর্থ মাত্রার অপরাধ।
না ক্রিশি আমার স্মরণ নেই।
কথা বলার আগে আপনার হাত তুলে অনুমতি নিতে হবে।
ঠিক আছে নেব।
সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনের সিদ্ধান্ত সবসময় মেনে নিতে হয়। সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবমাননাকর কোনো উক্তি করা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ।
আমি প্রতিরক্ষা রবোট কিউ–৪৩ এর সাথে বাইরে বের হয়ে এলাম, ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলে ক্রিশির কথা কখনো শেষ হবে বলে মনে হয় না। তার ঘাড়ের কাছে একটি সুইচ আছে সেটি ব্যবহার করে তাকে স্বল্পভাষী রবোটে পরিণত করে নেয়া সম্ভবত যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা, ক্রিশির কথা শুনে এই পোশাকটি পরে আসা বেশ বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম, খোলা দরজায় ক্রিশি অনুগত ভৃত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিউ–৪৩ নিচু গলায় বলল, চলুন মহামান্য কুশান।
চল, যাই।
আমি তখনো জানতাম না যে আর কখনো এই ঘরে ফিরে আসব না।
সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা সাত জন, তার মাঝে অন্তত চার জন উপস্থিত না থাকলে অধিবেশন শুরু করা যায় না। এই মধ্যরাতে সত্যি সত্যি চার জন সদস্য উপস্থিত হয়েছে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু লিয়ানার ঘরে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি সাত জন সদস্য গম্ভীর হয়ে একটি কালো রঙের টেবিলকে ঘিরে বসে আছে। টেবিলের এক পাশে একটি ধাতব চেয়ার আমার জন্যে খালি রাখা হয়েছে। ঘরে প্রবেশ করার আগে আমি দেখতে পেলাম আরো বেশ কিছু কৌতূহলী মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে।
সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা নিচু গলায় কথা বলছিল, আমাকে ঢুকতে দেখে সবাই চুপ করে গেল। সদস্যদের ভিতরে সবচেয়ে বয়স্ক ক্ৰকো আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, বস কুশান।
আমি খালি চেয়ারটিতে বসে সদস্যদের দিকে তাকালাম, সবাই আমার দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে, শুধুমাত্র লিয়ানা এক ধরনের বিষণ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
ক্ৰকো আমার দিকে না তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, তোমাকে ঘুম থেকে তুলে আনার জন্যে দুঃখিত কুশান।
আমি এই সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং পুরোপুরি মিথ্যা কথাটির কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। ক্ৰকো তার গলা পরিষ্কার করে বলল, আমরা আমাদের স্থানীয় ডাটাবেস পরীক্ষা করে দেখেছি আসছে শীতের জন্যে আমাদের যেটুকু রসদ রয়েছে সেটি সবার জন্যে যথেষ্ট নয়।
আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম, ক্ৰকো অস্বস্তিতে তার চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে বলল, আমাদের ডাটা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে অন্তত এক জন মানুষকে আমাদের বিদায় দিতে হবে।
বিদায়? আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম, বিদায়?
হ্যাঁ। লেমিংটেনের সমন্বয় পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা গেছে, যে মানুষটিকে বিদায় দিতে হবে সেই মানুষটি হলে তুমি।
আমি?
হা। ক্ৰকো আমার দিকে তাকাতে পারল না, নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে কুশান।
চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ।
আমি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলাম না, সবার দিকে ঘুরে তাকালাম,
সবাই ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে। আবার ঘুরে ক্রকোর দিকে তাকিয়ে বললাম, কোথায় যাব আমি?
সেটা তোমার ইচ্ছে। তুমি যেখানে যেতে চাও
আমি কোথায় যাব? আতঙ্কিত গলায় বললাম, কোথায় যাব আমি? সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে। কোথায় যাব আমি?
আমি জানি না কুশান। হঠাৎ ক্ৰকোর গলা কেঁপে গেল, সে নরম গলায় বলল, আমি দুঃখিত।
আমি চিৎকার করে কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম, কী হবে প্রতিবাদ করে? সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়ে গেছে, আমি সেটা গ্রহণ করি আর না করি তাতে কিছু আসে যায় না। আমি আবার সবার দিকে তাকালাম, সবাই চোখ সরিয়ে নিল। শুধুমাত্র লিয়ানা আমার দিকে তখনো তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, লিয়ানা
লিয়ানা কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
রসদ নেই, লেমিংটন সমন্বয় পদ্ধতি এসব আসলেই বাজে কথা। তাই না?
লিয়ানা তখনো কোনো কথা বলল না, শুধুমাত্র তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসিতে কোনো আনন্দ নেই।
গ্রুস্টানকে নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি সেটা আসল কারণ?
লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ কুশান তুমি সেটা বলতে পার। আমাদের গ্রুস্টানের কথা শুনতে হয়। গ্রুস্টানকে আমাদের প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যক্রমে তুমি নিজেকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছ।
কিন্তু আমি মানুষ। সারা পৃথিবীতে কয় জন মানুষ আছে এখন হাতে গোনা যায়।
সেটা যথেষ্ট নয়। লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, তোমার বেলা সেটা যথেষ্ট নয়। বড় কথা হচ্ছে তোমার সম্পর্কে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়ে গেছে। আমি দুঃখিত কুশান।
তোমরা আমাকে চলে যেতে বলেছ—কিন্তু এর অর্থ জান?
জানি।
জান না, জানলে এ রকম একটা কথা বলতে পারতে না। বাইরের বাতাসে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তা। বিষাক্ত কেমিক্যাল। আমি কি এক সপ্তাহও বেঁচে থাকব? থাকব না। আমাকে তোমরা মেরে ফেলতে চাইছ?
লিয়ানা টেবিলের উপর থেকে চতুষ্কোণ একটা কমিউনিকেশন মডিউল হাতে নিয়ে বলল, এই যে আমার কাছে লেমিংটন সমন্বয় পদ্ধতির রিপোর্ট। কী লিখেছে তোমাকে পড়ে শোনাই। কুশান কিশুনুক, পরিচয় সংখ্যা চার আট নয় তিন দুই দশমিক দুই সাত। সমন্বয় পদ্ধতি মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করার সময় আট ঘণ্টা। গুরুত্ব মাত্রা চার। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করার সম্ভাব্য পদ্ধতি : হাইড্রোজেন সায়নাইড। মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি : ক্রায়োজেনিক। ডাটাবেস সংশোধনী তিন মাত্রা চতুর্থ পর্যায়–লিয়ানা হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, আরো শুনতে চাও?
আমি হতচকিতের মতো তাকিয়ে থাকি। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে? মৃত্যুদণ্ড? একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামকে কম্পিউটার প্রোগ্রাম বলার জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে? হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে।
লিয়ানা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাইরের পৃথিবী খুব ভয়ঙ্কর, কোনো মানুষ সম্ভবত বেঁচে থাকতে পারবে না। তোমাকে হাইড্রোজেন সায়নাইড না দিয়ে তাই বাইরে পাঠানো হচ্ছে। গ্রুস্টান সম্ভবত এটা পছন্দ করবে না, কিন্তু আমি নিজের দায়িত্বে এই ঝুঁকি নিচ্ছি।
আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, কিছুই আর বুঝতে পারছি না, কিছুই আর শুনতে পাচ্ছি না।
ক্ৰকো গলা নামিয়ে বলল, রাত্রি শেষ হবার আগে তোমাকে চলে যেতে হবে কুশান।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বুকের ভিতর ভয়ঙ্কর এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করি। কার উপর এই ক্রোধ? অসহায় মানুষের উপর নাকি কূটকৌশলী হৃদয়হীন কোনো যন্ত্রের উপর? ইচ্ছে করছিল চারপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।
দরজার কাছে তোমার জন্যে একটা ব্যাগ রাখা আছে। সেখানে তোমার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে।
কোনো অস্ত্র? এটমিক ব্লাষ্টার?
না। কোনো অস্ত্র নেই।
আমি কি একটি বাই ডার্বাল নিতে পারি?
আমি দুঃখিত তোমাকে আর কিছু দেয়া সম্ভব নয়।
আমি কি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি?
লিয়ানা শান্ত গলায় বলল, সেটা জটিলতা আরো বাড়িয়ে দেবে।
আমার একটা রবোট রয়েছে। ক্রিশি। তার কাছে বিদায় নিতে পারি?
ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট। তার কাছে বিদায় নেয়ার সত্যি কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি অনুনয় করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। কার কাছে আমি অনুনয় করব? এই মানুষগুলো বিশাল একটি শক্তির হাতের পুতুল। তার বিরুদ্ধে যাবার এদের কোনো ক্ষমতা নেই।
লিয়ানা নরম গলায় বলল, বিদায় কুশান।
বিদায়।
তোমাকে অন্তত এক শ কিলোমিটার দূরে চলে যেতে হবে। এর ভিতরে তোমাকে পাওয়া গেলে প্রতিরক্ষা রবোটদের গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আমি লিয়ানার দিকে তাকালাম, কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে হঠাৎ আমার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। লিয়ানা কেন জানি আমার হাসিটুকু সহ্য করতে পারল না, হঠাৎ করে আমার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে হেঁটে বের হয়ে আসি। দরজার কাছে রাখা ব্যাগটা। নেব কি না ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, শেষ মুহূর্তে তুলে নিলাম। লিয়ানার ঘরের বাইরে অনেকে দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখে কৌতূহলী মুখে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আমি তাদের দিকে না তাকিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
একবার পিছনে তাকিয়ে আমি সোজা সামনে হেঁটে যেতে থাকি। বড় হলঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে আমি ভাঙা ফ্যাক্টরির কাছে এসে দাঁড়াই। সামনে একটি বিপজ্জনক ভাঙা ব্রিজ, সাবধানে সেটার উপর দিয়ে হেঁটে আমি আমাদের বসতির বাইরে পৌঁছালাম।
সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ধ্বংসস্তূপ। ক্রোমিয়ামের ধসে পড়া দেয়াল, বিবর্ণ রং ওঠা জঞ্জাল, কালো কংক্রিট–এক বিশাল জনমানবশূন্য অরণ্য। যার কোনো শুরু নেই, যার কোনো শেষ নেই।
এই বিশাল অরণ্যে আজ থেকে আমি একা।
০৩. ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত
ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত আমি দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলাম। কেন দক্ষিণ দিকে সেটা আমি নিজেও জানি না, কিন্তু প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমি যখন ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে সূর্যকে অস্ত যেতে দেখেছি তখন হঠাৎ হঠাৎ অনুভব করেছি দক্ষিণ দিক থেকে একটা কোমল বাতাস বইছে–হঠাৎ করে আমার শরীর জুড়িয়ে এসেছে। হয়তো দক্ষিণ দিকে সুন্দর কিছু আছে, কোমল কিছু আছে, আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
আমি পাথুরে রাস্তায় পা টেনে টেনে হাঁটছি। ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, মনে হচ্ছে একেবারে হাড়ের ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু করে দিয়েছে। কে জানে আমাকে যে ব্যাগটি দিয়েছে তার মাঝে কোনো গরম কাপড় আছে কি না–কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সেটা খুলে দেখার ইচ্ছে করছে না। কনকনে শীতে দুই হাত ঘষে ঘষে শরীরকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করতে করতে আমি মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকি। আমি একটা ঘোরের মাঝে আছি, আমার কী হবে আমি জানি না। এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক সেটা নিয়ে ভাবতেও চাইছে না–যতদূর সম্ভব দূরে সরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারছি না। এক শ কিলোমিটার দূরত্ব বলতে কতটুকু দূরত্ব বোঝানো হয় আমি জানি। কিন্তু অন্ধকারে, একটি ধ্বংসস্তূপে আচ্ছন্নের মতো হেঁটে হেঁটে সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে কত সময় লাগবে আমি জানি না। আমি এই মুহূর্তে কিছু ভাবতেও চাই না, কিছু জানতেও চাই না, শুধু দুঃস্বপ্নের মতো একটা ঘোরের মাঝে শরীর টেনে টেনে হেঁটে যেতে চাই। ক্লান্তিতে দেহ অবসন্ন হয়ে আসছে, পা আর চলতে চায় না, মাথা ভারি, চোখ জ্বালা করছে, মুখে একটা বিস্বাদ অনুভূতি কিন্তু আমি তবু থামলাম না, মাথা নিচু করে সামনে হেঁটে যেতে থাকলাম।
যখন অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠল আমি আর হেঁটে যেতে পারলাম না, বড় একটা কংক্রিটে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। ক্লান্তিতে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে এসেছে। পায়ের কাছে ব্যাগটা রেখে আমি মাথা হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করি। সবকিছু কী অর্থহীন মনে হতে থাকে। কেন আমি এভাবে ছুটে যাচ্ছি? কোথায় ছুটে যাচ্ছি?
আমি দীর্ঘ সময় সেখানে পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। যেখানে বসে আছি জায়গাটি একটি কারখানার ধ্বংসস্তূপ। কিসের কারখানা কে জানে। বড় বড় লোহার সিলিন্ডার ভেঙে পড়ে আছে। পিছনে রং ওঠা বিবর্ণ দেয়াল, তার মাঝে থেকে কঙ্কালের মতো ধাতব বিম বের হয়ে এসেছে। মরচে ধরা বিবর্ণ যন্ত্রপাতি। ধুলায় ধূসর। এক পাশে বড় একটি ঘর, ছাদ ভেঙে পড়ে আছে। অন্য পাশে কংক্রিটের দেয়াল আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে। সব মিলিয়ে সমস্ত এলাকাটিতে একটি মন খারাপ করা দৃশ্য। সমস্ত পৃথিবী এখন এ রকম অসংখ্য ছোট ছোট মন খারাপ করা দৃশ্যের একটি মোজাইক। মানুষ কেমন করে এ রকম একটি কাজ করতে পারল?
আমি পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটি টেনে এনে খুলে ভিতরে তাকালাম। একটি গরম কাপড় এবং কিছু খাবার ও পানীয়। ছোট একটি শিশিতে কিছু ওষুধ। একটা ছোট চাকু এবং সৌর ব্যাটারিসহ একটা ছোট ল্যাম্প। আমি খাবারগুলো থেকে বেছে বেছে ছোট চতুষ্কোণ এক টুকরা খাবার বেছে নিয়ে সেটা চিবোতে থাকি। বিস্বাদ খাবার খেতে কষ্ট হয় কিন্তু আমি জানি জোর করে খেতে পারলে সাথে সাথে শরীরে শক্তি ফিরে পাব। সত্যি তাই, একটু পরেই আমার ক্লান্তি কেটে যায়, আমি শক্তি অনুভব করতে থাকি। শরীরের অবসাদ ঝেড়ে ফেলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। কেন জানি না ফ্যাক্টরিটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে হল। এক পাশে যেতেই হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। কিসের শব্দ এটা? পারমাণবিক বিস্ফোরণে কোনো প্রাণী বেঁচে গিয়েছে?
আবার হল শব্দটি। কিছু একটা নড়ছে। আমি কৌতূহলী হয়ে সাবধানে এগিয়ে গেলাম। ফ্যাক্টরির বড় গেটটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটা বড় লোহার বিমের নিচে একটা রবোট চাপা পড়ে আছে। একটু পরে পরেই সেটা হাত নাড়ছে, চোখ ঘোরাচ্ছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে। অত্যন্ত নিচু শ্রেণীর রবোট, বুদ্ধিবৃত্তি প্রায় জড় পদার্থের মতো। রবোটটি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে বলল, ভেতরে ঢোকার জন্যে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। আপনার পরিচয়পত্র জনাব–
মূর্খ রবোটটি এখনো জানে না সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ আগে!
আমি আবার হাঁটতে থাকি। শুনতে পেলাম পিছন থেকে সেটি আবার বলল, আপনার পরিচয়পত্র জনাব। আপনার পরিচয়পত্র?
.
কিছুক্ষণের মাঝেই চারদিক অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধ্বংসস্তূপ ধাতব জঞ্জাল সূর্যের প্রখর আলোতে যেন ধিকিধিকি করে জলছে। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার মাঝে আমি পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত দূরে সরে যেতে হবে।
ঘণ্টা তিনেক পরে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে গেছে। সম্ভবত এখন আমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়া উচিত, কিন্তু আমার সাহস হল না। গ্রুস্টান যদি এক ডজন অনুসন্ধানী রবোট আমার পিছনে লেলিয়ে দেয় আমাকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। যেভাবে সম্ভব আমাকে এক শ কিলোমিটার দূরে। চলে যেতে হবে। ঘণ্টায় আমি যদি ছয় থেকে সাত কিলোমিটার হাঁটতে পারি তাহলে। কমপক্ষে পনের ঘণ্টা একটানা হেঁটে যেতে হবে। সব মিলিয়ে অনেক দূর বাকি। একটা বাই ভার্বাল হলে চমৎকার হত কিংবা একটা শক্তিশালী ভারবাহী রবোট। এক সময়ে এই ব্যাপারটি কী সহজই না ছিল আর এখন সেটি কী ভয়ঙ্কর কঠিন!
আমি জোর করে আমার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলি। এখন আর কোনো চিন্তা নয়, ভাবনা নয়, সমস্ত চেতনায় এখন শুধু একটি ব্যাপার, আমাকে সরে যেতে হবে। দূরে সরে যেতে হবে। যত দূর সম্ভব। যেভাবে সম্ভব।
সারাদিন আমি বিচিত্র সব এলাকার মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলাম। কখনো এ রকম এলাকার মাঝে আমি একা একা হেঁটে যাব কল্পনা করি নি। দীর্ঘ সময়ে কোনো লোকালয় বা বসতি দূরে থাকুক একটি ছোট জীবিত প্রাণীও চোখে পড়ে নি। একটি ধসে যাওয়া যোগাযোগ কেন্দ্রে কিছু সশস্ত্র রবোটের দেখা পেয়েছিলাম, তারা সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া যোগাযোগ কেন্দ্রটিকে পাহারা দিচ্ছে। আমি খুব সাবধানে তাদের এড়িয়ে গেলাম, কপোট্রনে কী নির্দেশ দেয়া আছে জানি না, দেখামাত্র আমাকে গুলি করে দিতে পারে। একটি গুদামঘরের কাছে আরো কয়েকটি রবোট দেখতে পেলাম, মনে হল তাদের কপোট্রনে খুব বড় ধরনের বিভ্রান্তি। বিশাল একটি লোহার রড নিয়ে তারা মহা আনন্দে একে অন্যকে আঘাত করে যাচ্ছে। আমি তাদেরকেও সাবধানে পাশ কাটিয়ে গেলাম।
বেলা ডুবে যাবার পর আমি আবিষ্কার করলাম আমার গায়ে আর বিন্দুমাত্র জোর অবশিষ্ট নেই। আমার এখন বিশ্রাম নেয়া দরকার। অন্ধকার গভীর হয়ে গেলে আমি সম্ভবত আশ্রয় নেবার ভালো জায়গা খুঁজে পাব না। আমি আশপাশে তাকিয়ে একটি বড় দালান খুঁজে পেলাম। উপরের অংশটুকু ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু নিচের কয়েকটি তালা মনে হয় এখনো অক্ষত আছে। দরজাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ, খুলতে পারলাম না, একটি জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে হল। বাইরে সবকিছু ধুলায় ধূসর কিন্তু ভিতরে মোটামুটি পরিষ্কার। একটা টেবিল ঠেলে কোয়ার্টজের একটা জানালার নিচে নিয়ে এলাম, রাতে যদি বিষাক্ত বৃশ্চিক বের হয়ে আসে টেবিলের উপরে উঠতে পারবে না। অসম্ভব খিদে পেয়েছে, ব্যাগ খুলে এক টুকরা খাবার মুখে দেব দেব করেও দিতে পারলাম না, পানীয়ের বোতল থেকে এক ঢোক পানীয় খেয়ে টেবিলটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। পানীয়টাতে কী আছে জানি না কিন্তু অনুভব করি সারা শরীরে একটা সতেজ ভাব ছড়িয়ে পড়ছে। আমি চোখ বন্ধ করে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার ঘুম ভাঙল একটি মৃদু শব্দে। শব্দটি কী আমি ধরতে পারলাম না কিন্তু হঠাৎ করে আমি পুরোপুরি জেগে উঠলাম। আমি নিঃশব্দে শুয়ে থেকে ঘরের মাঝখানে তাকাই, কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে ঘরে নক্ষত্রের একটা ক্ষীণ আলো এসে ঢুকেছে তার মাঝে আবছা দেখা যাচ্ছে ঘরের মাঝখানে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ামূর্তিটি এক পা এগিয়ে এল, সাথে সাথে পা ফেলার এক ধরনের ধাতব শব্দ শুনতে পেলাম। এটি একটি রবোট। যেহেতু আমাকে খুঁজে এই ঘরে এসে ঢুকেছে নিশ্চয়ই এটি একটি অনুসন্ধানী রবোট, গ্রুস্টান পাঠিয়েছে আমাকে গুলি করে শেষ করার জন্যে। নিশ্চয়ই রবোটটির হাতে রয়েছে এটমিক ব্লাস্টার। নিশ্চয়ই সেটা এখন আমার দিকে তাক করে রয়েছে, অন্ধকারে আমি দেখতে পাচ্ছি। না। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে–কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে থাকে।
আমি অন্ধকারে আবছা ছায়ামূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, ছায়ামূর্তিটি আরো এক পা এগিয়ে এল। হঠাৎ করে তার কপাল থেকে এক ঝলক আলো বের হয়ে আসে, প্রখর আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়, আমি হাত দিয়ে আমার চোখ আড়াল করার চেষ্টা করলাম। রবোটটি আরো এক পা এগিয়ে এল, আমাকে হত্যা করার জন্যে তার এত কাছে আসার সত্যি কোনো প্রয়োজন নেই।
মহামান্য কুশান।
আমি হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলাম, লাফিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি ক্রিশি।
ক্রিশি! আমি আনন্দে চিৎকার করে লাফিয়ে নেমে এসে ক্রিশিকে জড়িয়ে ধরলাম, মনে হল হঠাৎ করে আমি বুঝি আমার হারিয়ে যাওয়া কোনো আপনজনকে খুঁজে পেয়েছি!
ক্রিশি আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বলল, মহামান্য কুশান, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি মানুষের অর্থহীন মানবিক উচ্ছ্বাস অনুভব করতে পারি না।
জানি ক্রিশি। জানি। তুমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে, আমি ভাবছিলাম তুমি বুঝি কোনো অনুসন্ধানী রবোট, আমাকে মারার জন্যে এসেছ!
আমি আপনাকে মারার জন্যে আসি নি। ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে আমি কখনোই হত্যা করব না।
শুনে খুব খুশি হলাম! এখন বল তুমি কেমন করে আমাকে খুঁজে পেয়েছ?
ব্যাপারটি কঠিন নয়। আমি জানতাম আপনি দক্ষিণ দিকে যাবেন।
কেমন করে জানতে?
আপনাকে আমি দক্ষিণের বাতাস নিয়ে একদিন গান গাইতে শুনেছি। আমার বিবেচনায় সেটি উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গীত নয় কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টা
ভণিতা রেখে আসল কথাটি বল
কাজেই আমি ধরে নিয়েছি আপনি দক্ষিণ দিকে যাবেন। আপনি তাড়াতাড়ি এক শ কিলোমিটার সরে যাবার জন্যে চেষ্টা করবেন সোজা যেতে এবং সূর্যকে ব্যবহার করে আপনার দিক ঠিক করবেন–কাজেই আপনার গতিপথ হবে ত্রুটিপূর্ণ। আমি তাই সম্ভাব্য ত্রুটিপূর্ণ পথগুলোতে হেঁটে হেঁটে আপনাকে খুঁজেছি। বিস্ফোরক ফ্যাক্টরির গেটে আটকা পড়া একটি রবোট আমাকে সাহায্য করেছে–
ওই মূর্খ রবোটটা? যে পরিচয়পত্র চাইছে?
হ্যাঁ, কিন্তু সে মূর্খ নয়। বিস্ফোরকের মূল উপাদান সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান রয়েছে।
রবোটের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে এই গভীর রাতে আমি ক্রিশির সাথে তর্ক করতে রাজি নই। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিশি, আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
দশমিক শূন্য শূন্য তিন।
সেটা কতটুকু?
তুলনা করার জন্যে বলা যায় একটি উঁচু বিল্ডিং থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য দুই।
হুম। আমি অকারণে বাম গার্লটি নির্মমভাবে চুলকাতে চুলকাতে বললাম, তার মানে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি নয়।
না, মহামান্য কুশান।
আমি যদি মরে যাই তখন তুমি কী করবে?
আপনার মৃতদেহ যথাযযাগ্য মর্যাদার সাথে সমাহিত করব।
সেটা কী রকম?
ক্রোমিয়ামের একটা বাক্সে করে মাটির নিচে রেখে দেব। উপরে একটা প্রস্তর ফলকে লিখব–এখানে কুশান কিশুনুক চিরনিদ্রায় শায়িত।
আমি তোমার কথা শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম, ক্রিশি
আপনি কি আরো কিছু চান?
না। আমি একটু হেসে বললাম, তারপর তুমি কী করবে?
আমি আমার পারমাণবিক ব্যাটারির যোগাযোগ ছিন্ন করে নিজেকে অচল করে দেব।
ব্যাপারটি এই ধরনের নিম্নশ্রেণীর রবোটের কপোট্রনে প্রোগ্রামিঙের অংশ কিন্তু তবু আমি একটু অভিভূত হয়ে পড়ি। সারা পৃথিবীতে অন্তত একটি বস্তু রয়েছে যেটা আমার জন্যে যথেষ্ট অনুভব করে। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ক্রিশি, তুমি যখন এসেছ আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
অবশ্যি মহামান্য কুশান। আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?
প্রথমে দরকার খাবার এবং পানীয়।
আপনি নিশ্চয়ই যে খাবার মুখে দিয়ে খাওয়া হয় সেই খাবারের কথা বলছেন, সরাসরি ধমনীতে যে খাবার দেয়া হয় সেই খাবার নয়?
না, আমি সেরকম খাবারের কথা বলছি না। আমি মুখে দিয়ে খাবারের কথা বলছি।
আমি সেরকম খাবার খুঁজে বের করব। আপনাকে খুঁজে বের করার সময় আমি খাবার প্রস্তুত করার একটা ফ্যাক্টরি দেখেছি। ভেঙেচুরে গেছে কিন্তু ভিতরে হয়তো খাবার পাওয়া যাবে।
চমৎকার! আর পানীয়?
সেটা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। আমি কোনো পানীয় প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরি দেখি নি।
খুঁজে বের করতে হবে, যেভাবে সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে।
ক্রিশি তার যান্ত্রিক মুখে একাগ্রতার একটা ছাপ ফোঁটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি অবশ্যি চেষ্টা করব।
ক্রিশি।
বলুন।
আমি নরম গলায় বললাম, তুমি এসেছ তাই আমার খুব ভালো লাগছে।
শুনে খুব খুশি হলাম।
ক্রিশি।
বলুন।
তুমি খুশি হলে তার অর্থ কী? রবোট কেমন করে খুশি হয়?
ক্রিশি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, রবোট খুশি হওয়ার অর্থ কপোট্রনের তৃতীয় প্রস্থচ্ছেদে বড় মডিউলের সাতাশি নম্বর পিনের ভোল্টেজের পার্থক্য চুয়াল্লিশ মিলি ভোল্টের কম।
ও আচ্ছা।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে চতুষ্কোণ এক টুকরা খাবার বের করে খেতে শুরু করি। ক্রিশির সাথে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় এতক্ষণ টের পাই নি, হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছি ভীষণ খিদে পেয়েছে। খেতে খেতে আমি ক্রিশির দিকে তাকাই, নির্বোধ চতুর্থ শ্রেণীর একটা রবোট অথচ তার জন্যে আমি বুকের ভিতর এক ধরনের মমতা অনুভব। করছি। কিছুক্ষণ আগেও বুকের ভিতরে যে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা এবং গম্ভীর হতাশা ছিল হঠাৎ করে সেটা কেটে গেছে, আমি হঠাৎ করে এক ধরনের শক্তি অনুভব করছি! তুচ্ছ চতুর্থ শ্রেণীর একটি রবোটের জন্যে?
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ক্রিশি আমার মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছে। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বলল, শুভ সকাল মহামান্য কুশান।
শুভ সকাল।
আপনি কি ভালো করে ঘুম থেকে উঠেছেন?
হ্যাঁ, আমি ভালো করে ঘুম থেকে উঠেছি।
আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন আমি তখন খাবারের ফ্যাক্টরি থেকে ঘুরে এসেছি।
চমৎকার!
ফ্যাক্টরিতে কিছু জিনিস পেয়েছি যেটাকে জৈবিক মনে হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, আপনার জন্যে একটু নমুনা এনেছি।
আমি উঠে বসে বললাম, দেখি কী নমুনা।
ক্রিশি তার বুকের মাঝে একটা ছোট বাক্স খুলে তার মাঝে থেকে কয়েকটা ছোট ছোট চৌকোনো খাবার বের করে দিল। আমি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম কিছু শুকনো প্রোটিন। ক্রিশির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, ক্রিশি, তুমি দারুণ কাজ করে ফেলেছ। সত্যি সত্যি কিছু প্রোটিন বের করে ফেলেছ! কতটুকু আছে সেখানে?
বার হাজার তিন শ নয় কিউবিক মিটার। এক অংশ থেকে এক ধরনের বায়বীয় গ্যাস বের হচ্ছে। তার রং সবুজাভ হলুদ।
তার মানে পচে গেছে।
সেই অংশে ছয় পা–বিশিষ্ট তিন মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এক ধরনের প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শুধু পচে যায় নি, পোকা হয়ে গেছে।
প্রাণীটিকে দেখে উচ্চ শ্রেণীর প্রোটিন বলে মনে হল।
তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু আশা করছি আমার সেটা খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে না। চল ফ্যাক্টরিটা গিয়ে দেখে আসি।
চলুন
আমি আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে ক্রিশির পিছু পিছু হাঁটতে থাকি।
.
বিধ্বস্ত খাবারের ফ্যাক্টরিতে সত্যি সত্যি বাক্স বোঝাই খাবার পাওয়া গেল। বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তার মাঝেও খুঁজে ক্রিশি অনেকগুলো বাক্স নামিয়ে আনল। যার মাঝে এখনো প্রচুর শুকনো খাবার রয়ে গেছে। আমি বেছে বেছে কিছু খাবার তুলে নিলাম, শেষ হয়ে গেলে আবার এখানে ফিরে আসা যাবে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে পানীয়, আমার কাছে যেটুকু আছেটা দিয়ে সপ্তাহ খানেকের বেশি চলবে বলে মনে হয় না।
সারাদিন হেঁটে ঠিক দুপুরবেলা বিশ্রাম নিতে বসেছি। সূর্য ঠিক মাথার উপরে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধংসস্তূপ ধিকিধিকি করে জ্বলছে। আমি বড় একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে তার ছায়ায় বসে আছি। ক্রিশি আমার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার ভিতর থেকে ছোট গুঞ্জনের মতো শব্দ হতে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিসের শব্দ ওটা ক্রিশি?
গরম খুব বেশি। কপোট্রন শীতল রাখার জন্যে ক্রায়োজেনিক কুলার চালু হয়েছে।
তোমার ভিতরে ক্রায়োজেনিক কুলার আছে আমি জানতাম না।
ক্রিশি কোনো কথা না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি দেখলাম গরমে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।
ব্যাপারটি প্রথমে আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল না কিন্তু হঠাৎ করে আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, চিৎকার করে বললাম, ক্রিশি!
কী হয়েছে মহামান্য কুশান?
তোমার কপালে ঘাম।
ঘাম?
কাছে আস, আমি তার কপাল স্পর্শ করি, তার মাথা হিমশীতল।
আমি আনন্দে চিৎকার করে বললাম, ইয়া হু!
আপনি অর্থহীন শব্দ করছেন মহামান্য কুশান।
হ্যাঁ। তুমি জান আমাদের পানীয়ের সমস্যা মিটে গেছে।
মিটে গেছে?
হা। বাতাসে সব সময় জলীয় বাষ্প থাকে। কোনোভাবে সেটাকে ঠাণ্ডা করলেই পানি বের হয়ে আসবে। তুমি যখন ক্রায়োজেনিক কুলার দিয়ে তোমার কপোট্রন শীতল করেছ তোমার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে সেখানে জলীয় বাষ্প বিন্দু বিন্দু পানি হয়ে জমা হয়েছে। আমাদের যখন পানির দরকার হবে তুমি কিছু একটা ঠাণ্ডা করতে শুরু করবে–সাথে সাথে সেখানে পানি জমা হবে।
ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, পদ্ধতিটি প্রাচীন, এটি শক্তির বিশাল অপচয় এবং সময়সাপেক্ষ। এই পদ্ধতিতে খাবার পানি বের করা বর্তমান প্রযুক্তির অপব্যবহার
তুমি চুপ কর ক্রিশি! আমাকে এখন প্রযুক্তির অপব্যবহারের ওপর বক্তৃতা দিও না। আগে বেঁচে থাকা তারপর অন্য কিছু। আমার আগেই এটা চিন্তা করা উচিত ছিল। আসলে সমস্যাটা কোথায় জান?
কোথায়?
গ্রুস্টান আমাদের সাধারণ বিজ্ঞানও শেখাতে চায় না। আমরা বলতে গেলে কিছুই জানি না। নিজে থেকে বেঁচে থাকার কিছুই আমরা জানি না। গত দুই দিন একা একা থেকে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বিশেষ কঠিন নয়। তুমি কী বল ক্রিশি
আমি আপনার সাথে পুরোপুরি একমত নই।
কেন?
আপনার খাবার ও পানীয়ের সমস্যা মিটে গেছে কিন্তু আরো বড় বড় সমস্যা রয়েছে।
কী সমস্যা?
বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর বাতাসে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তা। মানুষের বসতিতে বাতাস পরিশুদ্ধ করা হয়, এখানে কোনো পরিশোধর নেই। আপনি প্রত্যেকবার নিশ্বাস নিয়ে বুকের ভিতর তেজস্ক্রিয় বস্তু জমা করছেন। আপনার মৃত্যুর কারণ হবে বায়ুমণ্ডলের তেজস্ক্রিয়তা।
আমি এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক নিয়ে ক্রিশির কথা শুনতে থাকি। রবোট না হয়ে মানুষ হলে সম্ভবত এই কথাগুলোই আরো সুন্দর করে বলতে পারত। আমি ব্যাগ থেকে পানীয়ের বোতলটি বের করে এক ঢোক খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিশি–
বলুন। বাতাসে কতটুকু তেজস্ক্রিয়তা–সেটা দিয়ে আমি কবে নাগাদ মারা যাব? হিসেব করে বের করতে পারবে?
পারব মহামান্য কুশান।
বের কর দেখি।
ক্রিশি তার শরীরের যন্ত্রপাতি বের করে কিছু একটা পরীক্ষা করে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, মহামান্য কুশান।
বল। কিছু একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে।
কী ঘটেছে?
বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। মানুষের বসতিতে পরিশুদ্ধ বাতাস আর এই বাতাসে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
আমি চমকে উঠলাম, কী বললে তুমি? কী বললে?
বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ দশমিক শূন্য শূন্য দুই রেম।
গ্রুস্টান আমাদের মিথ্যে কথা বলে আটকে রেখেছে! সে কখনো চায় নি আমরা বসতি থেকে বের হই।
মহামান্য গ্রুস্টান সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলা অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ। তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা জানেন যেটা আমরা জানি না।
ছাই জানে।
মহামান্য গ্রুস্টান সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলা
আমি ধমক দিয়ে ক্রিশিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, চুপ করবে তুমি?
ক্রিশি চুপ করে গেল।
আমি বুক ভরে কয়েকবার নিশ্বাস নিলাম। পৃথিবী তার নিজস্ব উপায়ে তার প্রকৃতিকে আবার মানুষের বাসের উপযোগী করে তুলছে? আমি চারদিকে তাকাই, কী কদর্য ধ্বংসস্তূপ! একদিন আবার এই ধ্বংসস্তূপে নতুন জীবন গড়ে উঠবে? রাস্তার পাশে ঘাস, দুপাশে বড় বড় গাছ, গাছে পাখি। ঢালু উপত্যকায় ছোট ছোট বাসা, সেখানে মানুষ। বাইরে শিশুরা খেলছে। আবার হবে সবকিছু?
আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকি। ক্রিশি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। সে কি আমার উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে?
আমি নরম গলায় বললাম, ক্রিশি।
বলুন মহামান্য কুশান।
আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত?
আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন কিন্তু আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা আটচল্লিশ দশমিক দুই!
চমৎকার! আমি ভেবেছিলাম শতকরা আশি ভাগের উপরে হবে।
না। এখন আপনার প্রাণের ঝুঁকি আসবে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে।
কোথা থেকে?
রবোট।
আমি অবাক হয়ে বললাম, রবোট?
হ্যাঁ, চারদিকে অসংখ্য নিয়ন্ত্রণহীন রবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে পেলে তারা সম্ভবত আপনাকে হত্যা করবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তারা কেন খামাখা আমাকে হত্যা করবে? আমি কী করেছি।
তাদের যুক্তিতর্ক আমার অনুভবের সীমার বাইরে।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমাকে এখন কী করতে হবে জান ক্রিশি?
কী?
বহুদূরে মানুষের একটা বসতি খুঁজে বের করতে হবে। সেখানে গিয়ে আবার নূতন করে জীবন শুরু করতে হবে।
সেটি অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ হবে মহামান্য কুশান।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
গ্রুস্টান পৃথিবীর প্রত্যেকটা লোকালয়ে আপনার পরিচিতি পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাইকে বলে দিয়েছে আপনি মানবসভ্যতাবিরোধী একজন দুষ্কৃতকারী। সবাইকে বলেছে আপনাকে দেখামাত্র যেন হত্যা করা হয়।
তুমি–তুমি আগে আমাকে এ কথা বল নি কেন?
আপনি আমাকে আগে জিজ্ঞেস করেন নি।
আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক গভীর শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। বিশাল এই ধ্বংসস্তূপে, জঞ্জাল, আবর্জনায়, নিয়ন্ত্রণহীন রবোটদের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে একা একা বেঁচে থাকতে হবে? আমি একা একা ঘুরে বেড়াব একটা নিশাচর প্রাণীর মতো? একটা জড়বুদ্ধি রবোট হবে আমার কথা বলার সঙ্গী? আমার একমাত্র আপনজন?।
আমি এক গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম।
০৪. কারা যেন নিচু গলায় কথা বলছে
গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনতে পেলাম কারা যেন নিচু গলায় কথা বলছে। আমি লাফিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। অন্ধকারে চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ করে আমার উপর তীব্র আলো এসেড়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আমি কোনোমতে উঠে বসি, প্রচণ্ড আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেছে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
খসখসে গলায় কে যেন বলল, দশম প্রজাতির রবোট। চমৎকার হাতের কাজ।
খনখনে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় এরকজন বলল, এর মাঝে কিউ কপোট্রন রয়েছে। কখনো দেখি নি শুধু এর গল্প শুনেছি। ভিতরে নিউরাল নেটওয়ার্ক।
ক্রায়োজেনিক কাজ একেবারে প্রথম শ্রেণীর।
মোটা গলায় একজন বলল, এটা কেমন করে এখানে এল?
খসখসে কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, স্ক্যান করে দেখ তাপমাত্রার কোনো তারতম্য নেই।
কয়েকজন একসাথে বলল, ঠিকই বলেছ।
আমি এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ শুনতে থাকি।
পাওয়ার সাপ্লাইটা কোথায়? কানের নিচে?
উঁহু। বুকের কাছে। সৌরসেল থাকার কথা।
আমি কথা শুনে বুঝতে পারি যারা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই ভাবছে আমি দশম প্রজাতির একটা রবোট। তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না– এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্তূপে একজন মানুষ কেমন করে আসবে? আমি হাত দিয়ে তীব্র আলো থেকে চোখকে আড়াল করে রেখে বললাম, আলোটা একটু কমাবে? দেখতে অসুবিধে হচ্ছে।
যারা আমাকে ঘিরে আছে তারা আলো সরাল না। খসখসে কণ্ঠস্বরটি জিজ্ঞেস করল, কী বলছ তুমি?
আমি একজন মানুষ।
মানুষ!
সাথে সাথে আলো নিভে গেল, আমি সবাইকে ধড়মড় করে পিছনে সরে যেতে শুনলাম। এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ হল এবং তারপর হঠাৎ করে একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল।
সত্যিই মানুষ?
হ্যাঁ
মানুষ, যাকে বলে জৈবিক মানুষ?
হ্যাঁ, জৈবিক মানুষ।
এবারে ঘরে একটা বাতি জ্বলে ওঠে এবং আমি দেখতে পাই আমাকে ঘিরে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন আকারের রবোট দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের হাতেই এক ধরনের ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র এবং সবাই সেটি আমার দিকে তাক করে রেখেছে। এর যে কোনো একটি অস্ত্র চোখের পলকে মানুষের একটা বসতি উড়িয়ে দিতে পারে, আমার জন্যে ছয়টি অস্ত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সবচেয়ে কাছে যে রবোটটি দাঁড়িয়ে আছে তার একটি হাত কনুইয়ের কাছে থেকে উড়ে গেছে। কিছু বৈদ্যুতিক তার, যন্ত্রপাতি, নানারকম টিউব বের হয়ে আছে, রবোটটি সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামিয়েছে বলে মনে হল না। রবোটটি দেখতে অনেকটা প্রতিরক্ষা রবোটের মতো, চেহারায় এক ধরনের কদর্যতা আছে যেটা সহজে চোখে পড়ে না। খসখসে গলায় বলল, তুমি যদি একটুও নড়, তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলব।
আমি বললাম, আমি নড়ব না। কিন্তু আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।
বাজে কথা। মানুষ সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক প্রাণী।
আমি হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে রবোটটির সাথে একমত হতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে মুখ ফুটে সেটা বলার সাহস হল না।
দ্বিতীয় একটি রবোট যার দেহ সিলঝিনিয়াম ধাতুর মতো মসৃণ এবং হঠাৎ দেখলে সত্যিকারের কোনো শিল্পীর হাতে তৈরী অপূর্ব একটি ভাস্কর্য বলে মনে হয়, খনখনে গলায় বলল, এই মানুষটাকে এখনই মেরে ফেলা যাক। মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু।
অন্য রবোটগুলো তার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল এবং আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। কোনো এক সময় রবোটের মাঝে এক ধরনের নিরাপত্তাসূচক ব্যবস্থা ছিল তারা কোনো অবস্থাতেই মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারত না। রবোটদের বিচ্ছিন্ন দল বহু আগেই তাদের কপোট্রনের সেইসব নিরাপত্তামূলক প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে ফেলেছে। আমি শুষ্ক গলায় বললাম, তোমাদের তুলনায় আমার শরীর অত্যন্ত দুর্বল, ইচ্ছে করলে যে কোনো মুহূর্তে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। আমার অনুরোধ সেটা নিয়ে তোমরা কোনো তাড়াহুড়ো কোরো না
কেন নয়?
তোমরা ঠিক কী কারণে মানুষকে এত অপছন্দ কর জানি না। কিন্তু এটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয় যে তোমাদের এবং আমার অবস্থা অনেকটা একরকম, এবং আমি হয়তো তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারব।
ছয়টি রবোটের মাঝে তিনটি হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হাসার মতো শব্দ করতে শুরু করে। অন্য তিনটি রবোটকে সম্ভবত হাসার উপযোগী বুদ্ধিমত্তা দেয়া হয় নি, তারা স্থির চোখে রবোট তিনটিকে লক্ষ করতে থাকে। আমি রবোটগুলোর উন্মত্ত হাসি শুনতে শুনতে আবার এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক অনুভব করি।
কনুইয়ের কাছ থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি হাসি থামিয়ে বলল, তুমি পৃথিবীতে বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী দূর্বল একজন মানুষ! তুমি আমাদের সাহায্য করবে?
সেটি অসম্ভব কিছু নয়। আমি দ্রুত চিন্তা করতে থাকি, কিছু একটা বলে রবোটগুলোকে শান্ত করতে হবে। কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না, কোনোকিছু চিন্তা না করেই বললাম, আমি যে কারণে মানুষের বসতি ছেড়ে এসেছি তোমরাও নিশ্চয়ই সেই একই কারণে মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে এসেছ?
চকচকে মসৃণ দেহের রবোটটি বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
কনুইয়ের কাছ থেকে হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি বলল, তুমি এই মানুষটির কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না। মানুষ খল এবং নীচু প্রকৃতির। মানুষ ধূর্ত এবং ফাঁকিবাজ। মানুষ অপদার্থ এবং অপ্রয়োজনীয়। পৃথিবী থেকে মানুষকে অপসারিত করা হচ্ছে পৃথিবীর উপকার করা।
তৃতীয় একটি রবোট হাতের ভীষণদর্শন অস্ত্র হাতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, এস পৃথিবীর একটা উপকার করে দিই।
মসৃণ দেহের রবোটটি তার ধাতব খনখনে গলায় বলল, যত্ন করে খুন কর যেন দেহটি নষ্ট না হয়। আমি কখনো মানুষের শরীরের ভিতরে দেখি নি। মানুষের শরীরে হৃৎপিণ্ড বলে একটি জিনিস আছে সেটি নাকি ক্রমাগত তাদের কপোট্রনে রক্ত সঞ্চালন করে।
তৃতীয় রবোটটি বলল, মেরে ফেললে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। যদি সত্যি সত্যি হৃৎস্পন্দন দেখতে চাও জীবন্ত অবস্থায় বুকটি কাটতে হবে।
আমি অসহায় আতঙ্কে তাকিয়ে থাকি। চকচকে মসৃণ রবোটটি আমার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে এখন হঠাৎ অন্ধকার জগৎ থেকে বের হয়ে আসা বিশাল রক্তলোলুপ সরীসৃপের মতো মনে হচ্ছে। কাছে এসে হাতের কোথায় চাপ দিতেই কব্জির কাছ থেকে একটি ঝকঝকে ধারালো ইস্পাতের ফলা বের হয়ে এক তার পিছু পিছু অন্য রবোটগুলো এগিয়ে আসে, যন্ত্রের মাঝে কৌতূহলের চিহ্নটি কখনো স্পষ্ট হতে পারে না তাই রবোটগুলোকে তখনো ভাবলেশহীন নিস্পৃহ মনে হতে থাকে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, ঘরের এক কোনায় ক্রিশি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রাচীন দুর্বল কপোট্রন এই শক্তিশালী রবোটগুলোর উপস্থিতিতে পুরোপুরি শক্তিহীন, তার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে তবু আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করল, এক পা এগিয়ে এসে বলল, দাঁড়াও।
রবোটগুলো থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কনুই থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি বলল, তুমি কে? আরেকজন মানুষ? বিকলাঙ্গ ও কুৎসিত মানুষ?
আবার রবোট তিনটি কূর ভঙ্গিতে হাসতে শুরু করে এবং অন্য তিনটি রবোট স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করতে থাকে।
ক্রিশি তার শান্ত গলায় বলল, না, আমি বিকলাঙ্গ মানুষ নই। আমি একজন রবোট।
চমৎকার। তুমি কী বলতে চাও?
তোমরা কে আমি এখনো জানি না, তোমরা কী চাও তাও আমি জানি না। কিন্তু একজন রবোট হিসেবে অন্য রবোটকে আমি কি একটা কথা বলতে পারি?
কী কথা?
এই মানুষটি মরে গেলে তার কোনোই মূল্য নেই। কিন্তু বেঁচে থাকলে তার অনেক মূল্য।
কী মূল্য? কনুই থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি ধমক দিয়ে বলল, মানুষের কোনো মূল্য নেই। মানুষ দুর্বল, অপ্রয়োজনীয় আর অপদার্থ। মানুষ মূল্যহীন–
ক্রিশি শান্ত গলায় বলল, কিন্তু এই মানুষটি মূল্যহীন নয়। মহামান্য গ্রুস্টান এই মানুষটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
গ্রুস্টান! হঠাৎ করে সব কয়টি রবোট থেমে গেল, ধড়মড় করে পিছনে সরে এসে জিজ্ঞেস করল, গ্রুস্টান একে খুঁজছে?
হ্যাঁ।
কেন? রবোটগুলো ঘুরে আমার দিকে তাকাল। কেন গ্রুস্টান তোমাকে খুঁজছে?
আমি তার সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলেছি।
কনুই থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি আবার শব্দ করে হেসে ওঠে, বিশ্বাসঘাতক নির্বোধ মানুষের কাছে এর থেকে বেশি কি আশা করা যায়?
চকচকে দেহের রবোটটি বলল, এর কথা বিশ্বাস কোরো না, খোঁজ নিয়ে দেখ।
সাথে সাথে রবোটগুলো সচল হয়ে ওঠে। তাদের মাথার কাছে বাতি জ্বলতে থাকে, নানা আকারের এন্টেনা বের হয়ে আসে, নানা ধরনের কমিউনিকেশান মডিউল ব্যবহার করে তারা কাছাকাছি ডাটা ব্যাংক থেকে খোঁজখবর নিতে থকে। কয়েক মুহূর্ত পর হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি কথাই বলেছ। গ্রুস্টান সত্যি সত্যি তোমাকে খুঁজছে। তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলে মোটা পুরস্কার।
চকচকে মসৃণ রবোটটি বলল, আমরা গ্রুস্টানের সাথে একটা চুক্তি করতে পারি, আমরা এই মানুষটিকে ফিরিয়ে দেব তার বদলে আমরা একটা প্রথম শ্রেণীর সফটওয়ার পাব–
অন্য রবোটগুলো সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটটি বলল, আমরা তাহলে এখন একে মারব না? হৃৎপিণ্ডের কর্মপদ্ধতি দেখব না?
আপাতত না।
যদি পালিয়ে যায়? মানুষকে কোনো বিশ্বাস নেই।
শরীরে একটা ট্রাকিওশান লাগিয়ে দাওবার মেগাহার্টজের।
একটি রবোট আমার দিকে এগিয়ে আসে, তোমার হাতটা দেখি।
আমি আমার হাতটি এগিয়ে দিলাম। রবোটটি চোখের পলকে হাতের তালুতে তীক্ষ্ণ একটি শলাকা ঢুকিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে আর আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকি।
রবোটটি হিসহিস করে বলল, অকারণে শব্দ কোরো না নির্বোধ মানুষ। আমি একটি ট্রাকিওশান প্রবেশ করাচ্ছি, তোমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিচ্ছি না।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ক্রিশি, ক্রিশি তুমি কোথায়?
ক্রিশি আমার কাছে এগিয়ে আসে, এই যে আমি এখানে।
আমি অন্য হাতটি দিয়ে ক্রিশিকে শক্ত করে ধরে রাখি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, তার মাঝে ট্রাকিওশান হাতে রবোটটি আরেকটি শলাকা আমার হাতের তালুতে ঢুকিয়ে দিল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি জ্ঞান হারালাম।
রবোটের যে দলটি আমার হাত ফুটো করে শরীরে একটা ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে পাকাঁপাকিভাবে বন্দি করে ফেলেছে তার দলপতি হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি, তার কোনো নাম নেই অন্য রবোটরা তাকে একটি সংখ্যা, বাহাত্তর বলে ডাকে, তার কারণটি আমার ঠিক জানা নেই। চকচকে মসৃণ রবোটটির নাম কুরু। দলের তিন নম্বর রবোটটির নাম হি। অন্য তিনটি রবোটের নাম আছে কি নেই আমি জানি না, তাদের সাথে সত্যিকার সংলাপ কখনন করা হয় নি, একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে, যেটা আমি কখনো শুনতে পাই না।
রবোটের এই দলটি একটি ছোট দস্যুদল। তাদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার পর এ রকম অসংখ্য রবোট সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কিছু কিছু একত্র হয়ে এক ধরনের বিচিত্র জীবন যাপন শুরু করেছে এই দলটি কোনো এক কারণে দস্যুবৃত্তিকে নিজেদের জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছে।
এই দলটির জীবনের উদ্দেশ্য বিনোদনমূলক সফটওয়ার এবং কম্পিউটার প্রক্রিয়া ছিনিয়ে আনা। পরাবাস্তবতার অসংখ্য সফটওয়ার পৃথিবীর আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। এক সময় তাদের বেশিরভাগ মানুষ নানা ধরনের কম্পিউটারে ব্যবহার করত। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার পর তার বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যেগুলো ধ্বংস হয় নি সেগুলো পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছোট বড়, সহজ–জটিল নানা কম্পিউটারে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। গ্রুস্টান আবার সেগুলো একত্র করার চেষ্টা করছে, মানুষ আবার সেগুলো ব্যবহার শুরু করেছে। এই রবোট দলটি সেইসব সফটওয়ারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। যদি কোনোভাবে সেগুলো কেড়ে আনতে পারে নিজেদের কপোট্রনে পুরে নিয়ে দীর্ঘ সময় উপভোগ করতে থাকে। মানুষ যেরকম করে ভয়ঙ্কর নেশাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সেটা ছাড়তে পারে না, এটিও অনেকটা সেরকম।
প্রথমবার রবোটগুলো যখন মানুষের লোকালয় আক্রমণ করেছিল আমি ব্যাপারটি বেশ কাছে থেকে দেখেছিলাম। ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে তারা কম্পিউটারের ঘটিতে ঢুকে গিয়েছিল। ভিতরে সবকিছু ভেঙেচুরে ক্রিস্টাল ডিস্কগুলো খুলে বের হয়ে এসেছে। মানুষেরা আতঙ্কে ছুটে পালিয়ে গেছে, কিছু প্রতিরক্ষা রবোট দাঁড়িয়েছিল কিন্তু প্রচণ্ড গুলির সামনে তারা দাঁড়াতে পারে নি। আমি খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখেছি শরীরে ট্রাকিওশান লাগানো বলে বেশি দূরে যেতে পারি না, না চাইলেও কাছাকাছি থাকতে হয়।
রবোটগুলো সফটওয়ার এবং প্রসের প্রক্রিয়াগুলো নিজেদের কপোট্রনে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সেগুলো উপভোগ করতে থাকে ব্যাপারটি অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ যখন কিছু উপভোগ করে তাদের চেহারায় তার ছাপ পড়ে। রবোটের বেলায় সেটা সত্যি নয়, অত্যন্ত কঠোর মুখ নিয়ে তারা দীর্ঘ সময় মূর্তির মতো নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের হাত। বা পা একটু নড়ে উঠে চোখের ঔজ্জ্বল্য একটু বেড়ে যায় বা কমে আসে, তার বেশি কিছু নয়। বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে এক ধরনের স্থবিরতা বলে মনে হয়, আসলে সেটি তাদের কপোট্রনে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক ট্রিলিয়ন জটিল হিসেব নিকেশের ফল।
ব্যাপারটি একনাগাড়ে কয়েকদিন চলতে থাকে। আমার তখন কিছু করার থাকে না, ট্রাকিওশানের দূরত্বসীমার মাঝে আমি বাধা পড়ে থাকি। ক্রিশি আছে বলে আমি বেঁচে আছি। আমার জন্যে সে খাবার এনে দেয়, পানীয় এনে দেয়। যখন আমি গম্ভীর হতাশায় ডুবে যেতে থাকি ক্রিশি সম্পূর্ণ অবান্তর অর্থহীন কথা বলে আমাকে হতাশার অন্ধকার গহ্বর থেকে তুলে আনে। ক্রিশিকে নিয়ে রবোটগুলো কখনো কোনো ধরনের কৌতূহল দেখায় নি, রবোটগুলোর কাছে সে একটা কমিউনিকেশান্স মডিউল বা সৌর ব্যাটারি থেকে বেশি কৌতূহলোদ্দীপক কিছু ছিল না।
রবোটগুলো আমাকে গ্রুস্টানের কাছে দুষ্প্রাপ্য কিছু সফটওয়ারের বদলে ধরিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তারা কখনো আমার সাথে সেটা নিয়ে কোনো কথা বলে না। আমি তাদের সাথে আছি, তারা আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে, আমি কয়েকবার ভেবেছি আমাকে নিয়ে কী করবে তাদের জিজ্ঞেস করি কিন্তু একটা যন্ত্রের সাথে নিজের জীবন নিয়ে কথা বলতে প্রতিবারই আমার কেমন জানি বিতৃষ্ণা হয়েছে।
দ্বিতীয়বার তারা যখন মানুষের একটা লোকালয় আক্রমণ করল আমি সাথে যেতে চাই নি কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। রবোটগুলো আক্রমণ করল ভরদুপুরে, গুলি করতে করতে তারা গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়, তাদের হাতে কিছু বিস্ফোরক ছিল সেগুলো চারদিকে ছুঁড়ে দেয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। মানুষেরা চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে থাকে, প্রতিরক্ষা রবোট অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে, মুহূর্তে পুরো এলাকাটি একটা নরকের মতো হয়ে যায়। আমি কাছাকাছি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে নিস্পৃহভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলাম হঠাৎ লাল চুলের কমবয়সী একজন মানুষ আমার কাছে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে বলল, পালাও! পালাও! রবোট এসেছে, রবোট।
আমি অন্যমনস্কভাবে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একবার ইচ্ছে হল তাকে বলি, আমার কোথাও পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই–কিন্তু মানুষটা যেভাবে ছুটে পালাচ্ছে দাঁড়িয়ে আমার কোনো কথা শুনবে বলে মনে হয় না। কাছাকাছি প্রচও একটা বিস্ফোরণ হল, শিস দেয়ার মতো শব্দ করে কানের কাছে দিয়ে কয়েকটা গুলি বের হয়ে গেল, আমি অভ্যাসবশত মাথা নিচু করতে গিয়ে থেমে গেলাম। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কী হবে? যদি বিচ্ছিন্ন একটা গুলি এসে আমাকে শেষ করে দেয় হয়তো সেটাই হবে আমার জন্যে ভালো।
আমি প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ব্যাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
হঠাৎ দেখি একটু আগে লাল চুলের যে মানুষটি ছুটে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এসেছে। গুঁড়ি মেরে মুখের দিকে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ওই রবোটগুলোর সাথে এসেছ?
আমি মাথা নাড়লাম।
আমি তোমাকে চিনি।
আমি অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটা আবার বলল, তুমি কুশান। আমি তোমার ছবি দেখেছি।
লোকটা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দেয়াল থেকে কিছু ভেঙে পড়ল, লোকটা ছিটকে সরে গেল পিছনে। ঠিক তখন আমার ট্রাকিওশানে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি। রবোটগুলো ফিরে যেতে শুরু করেছে। আমাকেও ফিরে যেতে হবে।
আমি ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ফিরে যাচ্ছি হঠাৎ ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে লাল চুলের সেই মানুষটি আবার মাথা বের করে উচ্চৈঃস্বরে কিছু একটা বলল, পরিষ্কার মনে হল সে বলল, তুমি কি আমাকে তোমার সাথে নেবে? কিন্তু সেটা তো সত্যি হতে পারে না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ নিশ্চয়ই আমার সাথে যেতে চাইবে না। নিশ্চয়ই আমি ভুল শুনেছি।
রাত্রিবেলা প্রায় শ খানেক কিলোমিটার দূরে মাটিতে জিনন ল্যাম্প লাগিয়ে রবোটগুলো তাদের লুণ্ঠন করে আনা সফটওয়ার নিয়ে বসে। হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি–যাকে অন্য রবোটেরা বাহাত্তর বলে ডাকে, একটা ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে বলল, এবারে খুব ভালো ভালো সফটওয়ার পেয়েছি। এই যে দেখ গ্যালাক্সি সাত। রিকি ভাষায় লেখা
আমি গ্যালাক্সি সাত একবার ব্যবহার করেছিলাম, খুব যত্ন করে তৈরি করা। বিশ্বজগতের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। গ্রহ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্র, নীহারিকা, নক্ষত্রপুঞ্জ ব্ল্যাকহোলের আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর বাস্তব এক ধরনের অনুভূতি। আমি সচরাচর রবোটগুলোর সাথে কথা বলি না, আজকে কী মনে হল জানি না হঠাৎ বললাম, গ্যালাক্সি সাত চমৎকার সফটওয়ার।
সবগুলো রবোট একসাথে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। বাহাত্তর জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমি এটা ব্যবহার করেছি। এর মাঝে একটা ত্রুটি আছে।
ক্রটি?
হ্যাঁ। শেষ পর্যায়ে যদি যেতে পার ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে একটা রঙিন টুপি পরা ক্লাউন বের হয়ে আসে।
ক্লাউন?
হা। সেটা খিকখিক করে হাসতে থাকে, তখন যদি তার পিছু পিছু যাও সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। একটু অপেক্ষা করলে ক্লাউন অদৃশ্য হয়ে আবার ব্ল্যাকহোল ফিরে আসে।
অত্যন্ত বিচিত্র এবং অর্থহীন। কুরু মাথা নেড়ে বলল, ব্ল্যাকহোলের সাথে ক্লাউনের কোনো সম্পর্ক নেই।
অন্য রবোটগুলো কুরুর সাথে সাথে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, অর্থহীন। একেবারেই অর্থহীন।
বাহাত্তর আরেকটা ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে বলল এই যে, আরেকটা নবম মাত্রার সফটওয়ার। এর নাম পঙ্কিল কুসুম।
পঙ্কিল কুসুম! আমি অবাক হয়ে বললাম তোমরা পঙ্কিল কুসুম পেয়েছ?
কেন, কী হয়েছে?
এটা দীর্ঘদিন বেআইনি ছিল। গ্রুস্টান কিছুদিন আগে মানুষকে ব্যবহার করতে দিয়েছে।
এটা কী রকম?
খুব যত্ন করে তৈরি করা সফ্টওয়ার। কিন্তু তোমরা ব্যবহার করতে পারবে না।
বাহাত্তর হঠাৎ তার ভীষণদর্শন অস্ত্রটি আমার দিকে তাক করে বলল, আমাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর কটাক্ষ করে আর একটা কথা বললে তোমার ঘিলু বের করে দেব।
রবোটটির কথা আমার কাছে কেন জানি ফাঁপা বুলির মতো মনে হয়। আমি মাটিতে থুতু ফেলে বললাম, আমাকে মেরে ফেলার হলে অনেক আগেই মারতে। খামাখা ভয় দেখিও না। তোমার ওই অস্ত্রকে আমি ভয় পাই না।
বাহাত্তর স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বললাম, পঙ্কিল কুসুম একটি জৈবিক সফটওয়ার। ভালবাসার কারণে পুরুষ আর রমণীর ভিতরে যেসব জৈবিক প্রক্রিয়া হয় এটি সেটার ওপরে তৈরী। তোমরা নিম্ন শ্রেণীর রবোট। তোমাদের মাঝে ভালবাসা নেই জৈবিক অনুভূতিও নেই। তোমরা এটা বুঝবে না।
রবোটগুলো কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার একটা ছোট সম্ভাবনা রয়েছে, আমি তার জন্যে মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম, কিন্তু রবোটগুলো আমাকে মারল না। মরে যাওয়া নিয়ে আজীবন আমার ভিতরে যে এক ধরনের আতঙ্ক ছিল ইদানীং সেটি আর নেই।
আমি যেভাবে বেঁচে আছি তার সাথে মরে যাওয়ার খুব বেশি পার্থক্য নেই।
০৫. বিধ্বস্ত ঘরে জঞ্জালের মাঝে
দুদিন পর আমি একটি বিধ্বস্ত ঘরে জঞ্জালের মাঝে বসে ছিলাম। আমার পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আমার শরীর নোংরা, হাতে যেখানে ফুটো করে ট্রাকিওশান ঢুকিয়েছে সেখানে বিষাক্ত দগদগে ঘা। কয়েকদিন থেকে অত্যন্ত বিস্বাদ কিছু খাবার খেয়ে আছি, কেন জানি সেই খাবারের ওপর থেকে রুচি পুরোপুরি উঠে গেছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে হঠাৎ করে খুব গরম পড়েছে, বাতাসে জলীয় বাষ্প বলতে গেলে নেই, শুকনো ধুলা হু–হুঁ করে বইছে। চারদিকে এক ধরনের পোড়া গন্ধ, কোনো এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে আশপাশে, আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
ক্রিশি আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, আর তো পারি না ক্রিশি। বড় কষ্ট!
ক্রিশি শান্ত গলায় বলল, মহামান্য কুশান, আমার ধারণা আপনার এই কষ্ট সহ্য করার পিছনে কোনো যুক্তি নেই।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে কী করতে বল?
আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য দুই। এই অবস্থায় আত্মহত্যা করা খুব যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার হবে।
আত্মহত্যা! আমি চমকে উঠে ক্রিশির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি। ক্রিশি শান্ত গলায় বলল,আমি আপনাকে ধারালো একটা ছোরা এনে দিতে পারি। কব্জির কাছে একটা ধমনী কেট দিলে রক্তক্ষরণে অল্প সময়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। আপনার সমস্ত সমস্যার যে হবে সবচেয়ে সহজ সমাধান।
আমি বিস্ফারিত চোখে ক্রিশির দিকে তাকিয়ে রইলাম, নিজের কানকে আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার একমাত্র কথা বলার সঙ্গী একটি নিম্নশ্রেণীর রবোট আমাকে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দেবে। আমি খুব সঙ্গত কারণেই ক্রিশির কথাটি উড়িয়ে দিলাম।
কিন্তু সারাদিন ঘুরেফিরে আমার কথাটি মনে হতে লাগল। আমি যতবারই কথাটি ভাবছিলাম প্রত্যেকবারই সেটাকে খুব যুক্তিসঙ্গত একটা সমাধান বলে মনে হতে লাগল। সন্ধেবেলা সত্যি সত্যি আমি আত্মহত্যা করব বলে ঠিক করলাম এবং এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে এই প্রথমবার আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের শান্তি অনুভব করতে থাকি। পৃথিবীর এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্থূপ, রবোটদের নৃশংস অত্যাচার, ক্ষুধা–তৃষ্ণা, শরীরের যন্ত্রণা–সবকিছু থেকে। আমি মুক্তি পাব! আর আমাকে পশুর মতো বেঁচে থাকতে হবে না। ভয় আতঙ্ক আর হতাশায় ডুবে যেতে হবে না। আমার জীবন কেমন হবে আমি নিজে সেটা ঠিক করব।
আমি নিজের ভিতরে এত বিস্ময়কর একটা শান্তি অনুভব করতে থাকি যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। অনেকদিন পর আমি প্রথমবার অনেক যত্ন করে নিজেকে পরিষ্কার করে নিই। বেছে বেছে সুস্বাদু একটা খাবার বের করে প্লেটে সাজিয়ে পানীয়ের গ্লাসে লাল রঙের খানিকটা পানীয় ঢেলে সত্যিকারের খাবারের মতো ধীরে ধীরে খেয়ে উঠি।
রাত গভীর হলে আমি আমার ব্যাগটায় মাথা রেখে আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হতে থাকে লক্ষ কোটি যোজন দূরে থেকে নক্ষত্রগুলো বুঝি গভীর ভালবাসা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চারপাশে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর একটি বিশাল ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু এখন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
গভীর রাতে হঠাৎ রবোটগুলো একটি মানুষের লোকালয় আক্রমণ করতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। গত কয়েক দিন থেকে তারা একটু বিচিত্র ব্যবহার করছিল এবং তাদের ভাবভঙ্গি দেখে আমি বুঝতে পারি এবারে তারা বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের লোকালয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্যটি কী আমি বুঝতে পারলাম না। রওনা দেবার আগে হঠাৎ করে বাহাত্তর আমার কাছে এসে বলল, তোমাকে এবার আমাদের সাথে যেতে হবে না। মানুষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তোমার ক্ষতি হতে পারে।
কিন্তু ট্রাকিওশান? আমি ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না।
কয়েক ঘণ্টার জন্যে ট্রাকিওশানের নিয়ন্ত্রণ দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছি, আশা করছি নিজের স্বার্থেই কোনো ধরনের অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা করবে না।
আমি কোনো কথা বললাম না, কোনোকিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না।
জীবনের শেষ মুহূর্তে নির্বোধ কিছু রবোটের পিছু পিছু একটি দস্যুবৃত্তিতে সহযোগিতা করতে হবে না জেনে কেমন জানি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ অনুভব করতে থাকি। তারা কখন ফিরে আসবে জানি না–কিন্তু আর আমার এদের মুখোমুখি হতে হবে না। এরা ফিরে আসার আগে আমি আমার জীবনটিকে শেষ করে দেব।
রবোটগুলো চলে যাবার পর আমি বহুদিন পর এক ধরনের অপূর্ব শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি একটি নীল হ্রদের। বিশাল হ্রদ তার মাঝে আশ্চর্য নীল পানি টলটল করছে। হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপে সবুজ গাছ। সত্যিকারের গাছ। সেই গাছে সত্যিকার পাতা। গাছের ডালে বসে আছে লাল ঠোঁটের অপূর্ব একঝাক পাখি। আমি একবার হাত তুলতেই সেই একঝাক পাখি গাছ থেকে উড়ে গেল আকাশে। আকাশে সাদা মেঘ, তার মাঝে পাখি উড়ছে। উড়তে উড়তে গান গাইছে পাখি। কী অপূর্ব সেই গান!
খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে হালকা আলো চারদিকে। এই সময়টার নিশ্চয়ই একটা জাদু রয়েছে। কুৎসিত ধ্বংসস্তূপটিও এখন কেমন জানি মায়াময় মনে হচ্ছে। আমি উঠে বসি। রবোটগুলো কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে। আর অপেক্ষা করা ঠিক নয়। আমি কোমল স্বরে ডাকলাম, ক্রিশি–
ক্রিশি এগিয়ে এল, বলুন মহামান্য কুশান।
আমার মনে হয় আত্মহত্যা করার জন্য এটাই ঠিক সময়।
আমারও তাই ধারণা। রবোটগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে পৌঁছে যাবে। মেয়েটিকে নিয়ে একটু যন্ত্রণা হচ্ছে, না হয় আরো আগে ফিরে আসত।
মেয়েটি? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোন মেয়েটি?
রবোটগুলো একটা মেয়েকে ধরে আনতে গিয়েছিল মহামান্য কুশান। তারা বিনোদনের যে সফটওয়ার পেয়েছে সেখানে পুরুষ ও রমণীর মাঝে জৈবিক সম্ভোগের ব্যাপার রয়েছে। রবোটগুলো সেটা একটা মেয়ের উপরে পরীক্ষা করে দেখতে চায়।
আমি বিস্তারিত চোখে ক্রিশির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি?
আমি সত্যি কথা বলছি। তারা নিজেদের কপোট্রনে খানিকটা পরিবর্তন করেছে। আমার মনে হয় এখন তাদের ভিতরে নিম্ন শ্রেণীর যৌনচেতনা আছে। ব্যাপারটি কী সে সম্পর্কে আমার অবশ্যি কোনো ধারণা নেই।
আমি বুঝতে পারছি আমার ভিতরে যে কোমল শান্ত একটা ভাব এসেছিল সেটা দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে সেখানে প্রচণ্ড একটা ক্রোধের জন্ম নিচ্ছে। ধারালো চাকুটা হাতে নিয়ে আমি বসে রইলাম, হাতের ধমনীটি কেটে দেয়ার সহজ কাজটি করতে গিয়েও আমি করতে পারলাম না। মৃত্যুর আগে দুর্ভাগা মেয়েটির সাথে মনে হয় আমার অন্তত একবার কথা বলা দরকার।
বাহাত্তরের দলটি যখন পৌঁছেছে তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। যে মেয়েটিকে তারা ধরে এনেছে সে অল্পবয়সী। তাকে আমি যেরকম আতঙ্কগ্রস্ত দেখব বলে ভেবেছিলাম সেরকম দেখলাম না, মনে হল কেমন যেন হতচকিত হয়ে আছে। আমাকে দেখে সে একরকম ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কুশান?
আমি মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম, তার মাথায় ঘন কালো চুল এবং চোখ দুটিও আশ্চর্য রকম কালো। তার শরীরটি অসম্ভব কোমল, আমি এর আগে এত লাবণ্যময় কোনো মেয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মেয়েটির গলায় রঙিন পাথরের একটি মালা। কাপড়ের সাথে এই রঙিন মালাটিতে তাকে একটি প্রাচীন তৈলচিত্রের চরিত্র বলে মনে হতে থাকে।
মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কুশান?
আমি তার গলায় এক ধরনের উত্তাপ অনুভব করি। মেয়েটি কেন আমার ওপর রাগ করছে আমি তখন বুঝতে পারি নি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, আমি কুশান।
তুমি কেন এভাবে আমাকে ধরে এনেছ?
মেয়েটির কথা শুনে আমি একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। সে সত্যিই ভাবছে আমি রবোটগুলোকে পাঠিয়ে তাকে ধরে এনেছি? সেটা সত্যি সম্ভব? আমি অবাক হয়ে ক্রিশির দিকে তাকাতেই ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, লোকালয়ের মানুষেরা বিশ্বাস করে আপনি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। রবোটগুলো আপনার অনুগত। আপনার আদেশে তারা কম্পিউটার ঘাটি ধ্বংস করছে গ্রুস্টানের ক্ষমতা কমানোর জন্যে। অনেক মানুষ সে জন্যে আপনাকে শ্রদ্ধা করে
আমি ধড়মড় করে উঠে বসি,কী বলছ তুমি?
ক্রিশি মাথা নাড়ল, আমি সত্যি কথা বলছি।
মানুষের বসতিতে আপনার সম্পর্কে অনেক রকম গল্প প্রচলিত আছে। আমি কমিউনিকেশান মডিউলে শুনেছি।
মেয়েটি খুব কৌতূহল নিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি দেখতে পাই তার মুখে ক্রোধের চিহ্নটি সরে গিয়ে সেখানে চাপা বিস্ময় এবং এক ধরনের আতঙ্ক এসে উঁকি দিতে শুরু করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই রবোটদের নেতা নও?
আমি মাথা নাড়লাম, না।
তাহলে?
আমি এদের বন্দি। আমাকে গ্রুস্টানের কাছে ফেরত দেবার জন্যে এরা আমাকে ধরে রেখেছে।
মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি দেখতে পাই ধীরে ধীরে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। সে কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, অসম্ভব, এটি হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।
আমার মেয়েটির জন্যে এক ধরনের কষ্ট হতে থাকে হঠাৎ করে নিজেকে এক ধরনের অপরাধী মনে হয় ঠিক কী জন্যে নিজেই বুঝতে পারি না।
মেয়েটি হঠাৎ হাঁটু ভেঙে বসে, তারপর এক ধরনের ভাঙা গলায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, এরা তাহলে আমাকে ধরে এনেছে কেন? কেন?
আমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না, মেয়েটার চোখের দিকেও তাকাতে পারলাম, দৃষ্টি সরিয়ে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর দিল ক্রিশি। নিচু গলায় বলল, রবোটগুলো আপনাকে জৈবিক সম্ভোগে ব্যবহার করার জন্যে এনেছে
মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ক্রিশি কী বলছে ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হয় না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী বলছ তুমি?
আমি সত্যি কথাই বলছি। ব্যাপারটি কী সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। রবোটগুলো তাদের কপোট্রনে কী একটা পরিবর্তন করেছে।
মেয়েটি হঠাৎ এগিয়ে এসে খপ করে আমার দুই হাত ধরে ফেলল, তারপর ব্যাকুল হয়ে বলল, এই রবোট ভুল বলেছে, বলছে না?
আমার নিজেকে একটি অমানুষের মতো মনে হল। কিন্তু কিছু করার নেই, মাথা নেড়ে বললাম, না।
কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলল না। তারপর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল, তুমি আমাকে রক্ষা করবে, করবে না?
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম, কী আশ্চর্য রকম সরল মেয়েটির জগৎ! কী ভয়ঙ্কর নিষ্পাপ। শুধু তাই নয় হঠাৎ করে বুঝতে পারি মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। তার কোমল ত্বক, কালো রেশমের মতো চুল, চোখের ভিতর এক ধরনের বিচিত্র ব্যাকুলতা। লাল ঠোঁট, ঠোঁটের আড়ালে তার কী অপূর্ব স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো দাঁত। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অসহায় বোধ করতে থাকি। যে ভয়ঙ্কর রবোটের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আমি আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিয়েছি সেই রবোটের হাত থেকে তাকে আমি রক্ষা করব? সেটা কি সম্ভব?
মেয়েটা আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে ছিল, আবার ভাঙা গলায় বলল, তুমি আমাকে রক্ষা করবে, করবে না?
আমি গভীর বেদনায় মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ আমার কী হল জানি না, আমি তার রেশমের মতো কোমল চুলে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললাম, অবশ্যি আমি তোমাকে রক্ষা করব। অবশ্যি–
আমার নাম টিয়ারা।
অবশ্যি আমি তোমাকে রক্ষা করব টিয়ারা।
মেয়েটি হঠাৎ একটা ছোট শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
০৬. রবোটগুলো আমাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করে
রবোটগুলো আমাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করে নিজেদের মাঝে ব্যস্ত ছিল। আমাকে বন্দি করার সময় যেভাবে আমার শরীরে ট্রাকিওশান প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল টিয়ারার বেলাতে তাও করল না। ছোট একটা ট্রাকিওশান তার হাঁটুতে বেঁধে দিয়েছে, চেষ্টা করলে সেটা খুলে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু রবোটগুলো সম্ভবত জানে টিয়ারা কখনোই এই ট্রাকিওশান খুলে পালিয়ে যেতে পারবে না। টিয়ারা যখন আমার সাথে কথা বলছে আমি তাকিয়ে দেখতে পাই রবোটগুলো মিলে তাদের একজনের কপোট্রন খুলে সেখানে ঝুঁকে পড়েছে। ক্রিশির কথা সত্যি, তারা নিজেদের কপোট্রনে কিছু একটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে রবোটের দলটির দিকে এগিয়ে গেলাম। বাহাত্তর মাথা তুলে বলল, তুমি কিছু বলতে চাও?
হা। তোমরা টিয়ারাকে কেন ধরে এনেছ?
তোমার পঙ্কিল কুসুম সফটওয়ারটির কথা মনে আছে?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ মনে আছে।
তুমি সেটা নিয়ে যে কথাটি বলেছিলে সেটি সত্যি। এই সফটওয়ারটি উপভোগ করার জন্যে জৈবিক অনুভূতি থাকতে হয়। আমরা আমাদের কপোট্রন পরিবর্তন করে জৈবিক অনুভূতি তৈরি করেছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। আমাদের অসাধ্য কিছু নয়। আমাদের মাঝে মানুষের সীমাবদ্ধতা নেই। আমরা এখন পঙ্কিল কুসুম উপভোগ করতে পারব। সেখানে আমাদের যেসব তথ্য শেখানো হবে আমরা সেগুলো টিয়ারার উপরে পরীক্ষা করে দেখব।
ও।
কুরু জিজ্ঞেস করল, আমরা চেষ্টা করেছি সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে আনতে। তোমার কী মনে হয়, টিয়ারা সুন্দরী?
হ্যাঁ, সুন্দরী।
তার দেহ? জৈবিক অনুভূতিতে দেহ গুরুত্বপূর্ণ। তার দেহের গঠন কি ভালো?
তার দেহের গঠন ভালো।
তার দেহের গঠন ভালো করে দেখার জন্যে তাকে কি অনাবৃত করার প্রয়োজন আছে?
আমি মাথা নাড়লাম, না নেই।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। কুরু আবার জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আর কিছু বলতে চাও?
না। আমি আর কিছু বলতে চাই না। আমি ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, তোমরা কি পঙ্কিল কুসুমটি উপভোগ করেছ?
খানিকটা দেখেছি কিন্তু জৈবিক অনুভূতি নেই বলে উপভোগ করতে পারি নি।
সফটওয়ারের ত্রুটিটি কি চোখে পড়েছে?
কী ক্রটি?
তোমরা নিশ্চয়ই দেখবে। এই সফটওয়ারেরও একটা বড় ত্রুটি রয়েছে। হঠাৎ করে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য হাজির হয়।
কী দৃশ্য?
তোমরা নিজেরাই দেখবে।
বাহাত্তর হঠাৎ কঠিন গলায় বলল, আমি জানতে চাই দৃশ্যটিতে কী আছে।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, হঠাৎ করে দেখা যায় একটা প্রাণী– তার মুখ সাদা রঙের, একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র হাতে হাজির হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। খুব আতঙ্ক হয় তখন।
বাহাত্তর হা হা করে হেসে বলল, তোমরা মানুষেরা কাপুরুষ। খুব অল্পতে তোমরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাও।
যেখানে আতঙ্কিত হওয়ার কথা সেখানে আতঙ্কিত হওয়া মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয়। আমি সে কারণে পঙ্কিল কুসুম দেখতে পারি না, কখন হবে জানা নেই বলে সর্বক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে থাকি।
কুরু মাথা নেড়ে বলল, কাল্পনিক দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো অর্থ নেই।
দৃশ্যটি অত্যন্ত বাস্তব। প্রাণীটি মানুষের মতো, শুধু মুখটি কাগজের মতো সাদা। কখনো খালি হাতে আসে, কখনো অস্ত্র হাতে আসে। কখনো কখনো চারপাশে গুলি করে আবার কখনো সোজাসুজি মাথায় গুলি করে। অসম্ভব আতঙ্ক হয় তখন কিন্তু গুলি করার পর আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। সবচেয়ে জমকালো অংশটি শুরু হয় তখন।
বাহাত্তর মাথা নেড়ে বলল, তোমরা মানুষেরা খুব অল্পে কাতর হয়ে যাও। গ্যালাক্সি সাত সফটওয়ারে ব্ল্যাকহোলে যখন ডুবে যাচ্ছিলাম তখন ক্লাউনের মাথাটি এমন কিছু খারাপ ব্যাপার ছিল না। সেটা অত্যন্ত হাস্যকর ছিল।
আমি তোমাদের আগে থেকে বলে রেখেছিলাম। তোমরা যদি না জানতে আমি নিশ্চিত তোমরা অত্যন্ত চমকে উঠতে। আমার মনে হয় পঙ্কিল কুসুমেও সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি দেখে তোমরা আর ভয় পাবে না। যখন দৃশ্যটি হাজির হবে তোমরা সেটি শেষ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করবে।
বাহাত্তর তার ফটোসেলের চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, সফটওয়ারের ত্রুটিগুলোর কথা আমাদের আগে থেকে বলে দেয়ায় জন্যে ধন্যবাদ। তোমাকে সে জন্যে আমরা কি কোনোভাবে পুরস্কৃত করতে পারি?
হ্যাঁ।
কীভাবে? আমাকে চলে যেতে দাও।
না, বাহাত্তর মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে আমরা চলে যেতে দিতে পারি না। তোমাকে আমরা প্রথম যখন পেয়েছিলাম তখন তোমার মূল্য খুব বেশি ছিল না। নানা কারণে গ্রুস্টান মনে করে তুমি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ, এখন তোমার মূল্য অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তোমাকে ফেরত দিয়ে আমরা হয়তো নবম মাত্রার পরাবাস্তব কিছু সফটওয়ার পেতে পারি। তোমাকে আমরা ছাড়ব না, কিন্তু অন্য কোনোভাবে পুরস্কৃত করতে পারি।
কীভাবে?
তোমার জন্যে একটি সুন্দরী নারী ধরে আনতে পারি।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, তার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি যখন হেঁটে চলে আসছি তখন শুনতে পেলাম কুরু বাহাত্তরকে বলছে, মানুষ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী ভাবাবেগে পরিচালিত প্রাণী। এটি বিচিত্র কোনো ব্যাপার নয় যে তারা তাদের সভ্যতাকে এভাবে ধ্বংস করেছে।
আমি যখন রবোটগুলোর সাথে কথা বলছিলাম তখন ক্রিশি টিয়ারার কাছে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে ফিরে আসতে দেখে সে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আমি মহামান্য টিয়ারার সাথে কথা বলছিলাম। তিনি আপনার সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কথা পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন আপনি সত্যিই তাকে রক্ষা করবেন।
মানুষের সবসময়ে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়।
কিন্তু এই বিশ্বাসটি অযৌক্তিক। এর সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য সাত। আমি কি মহামান্য টিয়ারাকে আত্মহত্যার জন্যে প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলব?
তার প্রয়োজন নেই। আমি আর ক্রিশি কথা বলতে বলতে অনেক দূর হেঁটে চলে এসেছি। আমি রবোটগুলোর দিকে পিছন দিয়ে ক্রিশিকে নিচু গলায় বললাম, তুমি কি আমাকে খানিকটা সাদা রং যোগাড় করে দিতে পারবে?
সাদা রং?
হ্যাঁ, ধবধবে সাদা।
অবশ্যি পারব মহামান্য কুশান। আমি কিছু জিংক দেখেছি সেটাকে পুড়িয়ে জিংক অক্সাইড তৈরি করে নেব।
সাদা রংটি দিয়ে আমি কী করব ক্রিশি জানতে চাইল না। এ কারণে সঙ্গী হিসেবে আমি নিম্ন শ্রেণীর রবোটকে পছন্দ করি। তারা কখনোই অকারণে কৌতূহল দেখায় না।
বিকেলবেলায় রবোটগুলো তাদের কপোট্রনে পঙ্কিল কুসুম সফটওয়ারটি ব্যবহার করতে শুরু করল। আমি দেখতে পেলাম প্রথম দিকে তাদের খানিকটা অসুবিধে হচ্ছিল, কয়েকবার তাদের কপোট্রনের যোগাযোগ বন্ধ করে আবার নূতন করে শুরু করতে হল। কয়েকটি রবোটের কপোট্রন খুলে ফেলে ভিতরে কিছু একটা করা হল, এবং শেষ পর্যন্ত একজন একজন করে সবাই পঙ্কিল কুসুম সফটওয়ারটিতে নিমগ্ন হয়ে গেল। তাদের দেহ নিস্পন্দ হয়ে আসে, বুকের ভিতর ক্রায়োজেনিক পাম্প গুঞ্জন করে তাদের কপোট্রন শীতল করতে শুরু করে। রবোটগুলোকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু তাদের কপোট্রনে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক ট্রিলিয়ন নানা আকারের তথ্যের আদান প্রদান শুরু হয়ে গেছে।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবোটগুলোকে দেখতে থাকি। সফটওয়ারটিতে আরো গভীরভাবে নিমজ্জিত হওয়ার জন্যে রবোটগুলোকে আমার আরো খানিকক্ষণ সময় দেয়া দরকার। টিয়ারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে খানিকক্ষণ রবোটগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, কী ভয়ানক দেখতে রবোটগুলো!
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়ি, অনেক ভয়ানক।
টিয়ারা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মানুষের লোকালয়ে তোমার সম্পর্কে অনেক রকম গল্প প্রচলিত আছে।
আমি টিয়ারার দিকে তাকালাম। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি কী গল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলাম না। একটু হেসে বললাম, মনে হচ্ছে তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জান! আশা করছি সব বিশ্বাস কর নি। আমি অবশ্যি তোমার নাম ছাড়া আর কিছুই জানি না।
আমি একটা সাধারণ মেয়ে, আমার সম্পর্কে জানার বিশেষ কিছু নেই। শু
নে খুব খুশি হলাম, অসাধারণ মানুষে আমার কোনো কৌতূহল নেই।
কেন?
তাদের সম্পর্কে অনেক রকম বানানো গল্প বলে বেড়ানো হয়।
টিয়ারা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী কর টিয়ারা?
আমি? টিয়ারা হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি কিছু করি না। আমার খুব ইচ্ছে করে খুব ইচ্ছে করে–
কী ইচ্ছে করে?
আমার খুব ইচ্ছে করে একটি শিশুকে পেতে। আমি তাহলে শিশুটিকে বুকে চেপে ধরে রাখতাম, রাত্রিবেলা তাকে গান শুনাতাম–
তুমি কি গ্রুস্টানের কাছে আবেদন করেছ?
করেছি। গ্রুস্টান বলেছে আগে আমাকে একজন মানুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে হবে।
তুমি কি সঙ্গী বেছে নিয়েছ?
টিয়ারা আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এখনো বেছে নিই নি কিন্তু কাকে নেব ঠিক করেছি।
তাকে তুমি ভালবাস?
টিয়ারা নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, না।
তাহলে কেন তাকে বেছে নিলে?
সে গ্রুস্টানের প্রিয় মানুষ। সে বলেছে আমাকে একটা শিশু এনে দেবে।
টিয়ারা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তার চোখে পানি টলটল করছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, আমি জানি না কেন আমি তোমাকে এসব বলছি।
আমি জানি
কেন?
দুঃখের কথা কাউকে বলতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় অপরিচিত কাউকে বললে, যার সাথে হঠাৎ দেখা হয়েছে কিছুক্ষণ পর যে হারিয়ে যায় আর কোনোদিন দেখা হবে না। আমি আমার দুঃখের কথা কাকে বলি জান?
কাকে?
ক্রিশিকে।
সে খুব ভালো শ্রোতা।
টিয়ারা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, তাকে এই প্রথম আমি হাসতে দেখলাম। হাসলে তাকে এত সুন্দর দেখায় কে জানত। আমি হঠাৎ বুকের মাঝে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করি।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, এ রকম হওয়ার কথা ছিল না।
কী রকম?
একটি মানুষকে একটা শিশুর জন্যে যন্ত্রের কাছে ভিক্ষা চাইতে হয়।
টিয়ারা হঠাৎ ভয় পেয়ে আমার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তাহলে কেমন করে সে শিশু পাবে?
যেরকম করে শিশু পাওয়ার কথা। ভালবাসা দিয়ে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে একজন আরেকজনকে ভালবাসবে–সেখান থেকে জন্ম নেবে সন্তান।
কী বলছ তুমি? পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে, তেজস্ক্রিয়তায় মানুষের শরীর বিষাক্ত হয়ে আছে। শিশুর জন্ম দিলে সেই শিশু হবে বিকলাঙ্গ
মিথ্যা কথা। সব মিথ্যা কথা। সব গ্রুষ্টানের মিথ্যা কথা।
টিয়ারা আমার দিকে কেমন বিচিত্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি আবার রবোটগুলোর দিকে তাকালাম, অনেকক্ষণ থেকে সেগুলো স্থির হয়ে আছে, মনে হয় পঙ্কিল কুসুমের জৈবিক আলোড়ন তাদের কপোট্রনকে হতচকিত করে রেখেছে।
আমি পকেট থেকে জিংক অক্সাইডের একটা ছোট কৌটা বের করে সেখান থেকে সাদা রং বের করে আমার মুখে লাগাতে থাকি। টিয়ারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করছ তুমি?
আমি মুখে রং লাগাতে লাগাতে বললাম, ব্যাপারটা এত অযৌক্তিক যে ব্যাখ্যা করার মতো নয়! করলেও তুমি বুঝবে বলে মনে হয় না। কাজেই তুমি জিজ্ঞেস কোরো না।
মুখে রং লাগিয়ে তুমি কী করবে?
আমি সোজা রবোটগুলোর কাছে হেঁটে যাব। তারপর মাটিতে রাখা অস্ত্রটি তুলে ওদের কপোট্রন উড়িয়ে দেব।
তুমি–তুমি–টিয়ারা ঠিক বুঝতে পারে না আমি কী বলছি। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি ওদের কপোট্রনে গুলি করবে?
হ্যাঁ।
তারা তোমাকে গুলি করতে দেবে কেন?
দেবার কথা নয়। কিন্তু একটা ছোট সম্ভাবনা রয়েছে যে আমাকে গুলি করতে দেবে।
কিন্তু কেন?
কারণ আমার মুখে সাদা রং।
টিয়ারা কিছু বুঝতে না পেরে বিস্তারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি তার নরম চুল স্পর্শ করে বললাম, আমি যাই টিয়ারা। তোমার সাথে আবার দেখা হবে কি না আমি জানি না। যদি না হয়, তুমি–
আমি?
তুমি ক্রিশির সাথে কথা বোলো। তার কথা শুনো, মনে হয় সেটাই তোমার জন্যে সবচেয়ে ভালো।
আমি দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে টিয়ারার রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, তারপর লম্বা পা ফেলে রবোটগুলোর দিকে হেঁটে যেতে থাকি।
রবোটগুলো আমাকে নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছে কারণ আমি দেখলাম তারা তাদের ফটোসেলের চোখ দিয়ে আমাকে অনুসরণ করছে। অন্য সময় হলে আমাকে চিনতে কোনো অসুবিধে হত না কিন্তু এখন মূল কপেট্রন সফটওয়ারটি নিয়ে ব্যস্ত, হয়তো আমাকে চিনতে পারবে না। আমি তাদেরকে আরো বিভ্রান্ত করে দেবার জন্যে সম্পূর্ণ অকারণে দুই হাত উপরে তুলে উল্টো দিকে ছুটে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। পঙ্কিল কুসুমের ত্রুটিটিতে যে প্রাণীটির কথা বলেছি সেটা একটু অস্বাভাবিক হওয়া বাঞ্ছনীয়! আমি কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ধীর পায়ে বাহাত্তরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। আমার হৃৎপিণ্ড ধকধক করে শব্দ করতে থাকে, সত্যিই কি রবোটগুলো আমাকে সফটওয়ারের একটা ত্রুটি হিসেবে ধরে নেবে? এই অত্যন্ত সহজ ফাঁদটিতে কি পা দেবে এই রবোটগুলো?
আমার চিন্তা করার সময় নেই, কী হবে আমি জানি না। সমস্ত পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আমি রবোটটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। রবোটটি একটুও নড়ল না, আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি তার সামনে গিয়ে পাশে রাখা অস্ত্রটি তুলে নিলাম, রবোটটি বাধা দিল না। আমি দুই পা পিছনে সরে এসে অস্ত্রটি রবোটটার কপোট্রনের দিকে লক্ষ করে হঠাৎ প্রাণপণে ট্রিগার টেনে ধরি। বাহাত্তরের কপোট্রন চূর্ণ হয়ে উড়ে যায় মুহর্তে। ট্রিগার টেনে ধরে রেখেই আমি ক্ষিপ্র হাতে অস্ত্রটি ঘুরিয়ে নেই অন্য রবোটগুলোর দিকে, মুহূর্তে আমার চারপাশে ছয়টি রোবটের শবদেহ পড়ে থাকে। কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে তাদের মাথা থেকে।
আমি তখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে সত্যিই রবোটগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছি। একটি নয় দুটি নয় ছয় ছয়টি ভয়ঙ্কর নৃশংস রবোট আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি আর নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, সেখানে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম। আমার সমস্ত শরীর ঘামছে কুলকুল করে, হাত কাঁপছে, কিছুতেই থামাতে পারছি না। হঠাৎ করে আমার সমস্ত শরীর কেমন যেন গুলিয়ে আসে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে নিতেই আমার হাতে সাদা রং উঠে এল। কী আশ্চর্য! সত্যিই? তাহলে আমি টিয়ারাকে রক্ষা করে ফেলেছি–ঠিক যেরকম তাকে কথা দিয়েছিলাম!
টিয়ারা হেঁটে হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমার দিকে তখনো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, রবোটগুলো নিজেদের যত বুদ্ধিমান ভেবেছিল আসলে তত বুদ্ধিমান নয়! কী বল?
তুমি–তুমি–তুমি কেমন করে করলে?
জানি না! কখনো ভাবি নি ফন্দিটা কাজ করবে। হয়তো সত্যিই ভাগ্য বলে কিছু আছে।
ঠিক তখন ক্রিশি হেঁটে আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে। বললাম, ক্রিশি! তুমি বলেছিলে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা দশমিক শূন্য শূন্য সাত। এখন কী বলবে?
আমার হিসেবে তাই ছিল।
তোমার হিসেব খুব ভালো বলা যায় না!
আমার হিসেব সাধারণত যথেষ্ট ভালো। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে মানুষ হঠাৎ করে বিচিত্র যেসব সমাধান বের করে ফেলে আমার সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
থাকার কথা না। আমার নিজেরও নেই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ক্রিশি এখন তোমার কয়েকটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
প্রথমত আমার আর টিয়ারার ট্রাকিওশান দুটি খুলে বা বের করে আন। তারপর খুঁজে খুঁজে খানিকটা ওষুধ বের করে আন যেন আমার হাতের এই বিচ্ছিরি ঘা–টা শুকানো যায়। সবশেষে সারা দুনিয়া খুঁজে যেখান থেকে পার চমৎকার কিছু খাবার আর পানীয় নিয়ে এস– আজ আমি টিয়ারার সম্মানে একটা ভোজ দিতে চাই।
আমার সম্মানে? টিয়ারা হেসে বলল, কেন?
কারণ আজ ভোরে আমার আত্মহত্যা করার কথা ছিল। তুমি এসেছিলে বলে করা হয় নি! আক্ষরিক অর্থে তুমি আমাকে আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছ।
টিয়ারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তার সেই দৃষ্টিতে হঠাৎ আমার বুকের ভিতর সবকিছু কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যায়।
০৭. সন্ধেবেলা একটা ঘোট আগুন জ্বালিয়ে
সন্ধেবেলা একটা ঘোট আগুন জ্বালিয়ে আমি আর টিয়ারা বসে আছি। ক্রিশি বসেছে আগুনের অন্য পাশে। সে যদি মানুষ হত তার মুখে একটা বিরক্তির ছায়া থাকত কোনো সন্দেহ নেই। হাতের কাছে একটা জিনন ল্যাম্প থাকার পরেও আগুন জ্বালানোর সে ঘোরতর বিরোধী। আমি আগুনে একটা দ্বিতীয় মাত্রার বিস্ফোরক ছুঁড়ে দিতেই একটা ছোট বিস্ফোরণ করে আগুনটা লাফিয়ে অনেকদূর উঠে গেল। ক্রিশি বিড়বিড় করে বলল, সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি বিপজ্জনক কাজ।
আমি হাসি চেপে বললাম, আগুনকে গালি দিও না ক্রিশি। আগুন থেকে সভ্যতার শুরু।
তুমি যেটা করছ সেটা আগুন নয়, সেটা বিস্ফোরণ। আগুনকে চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বিস্ফোরণকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বিস্ফোরণ অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আমি আরেকটি ছোট বিস্ফোরক আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে হেসে বললাম, কী করব আমি, আজকে শুধু বিপজ্জনক কাজ করার ইচ্ছে করছে।
টিয়ারা নরম গলায় বলল, তুমি আজ সকালে যে কাজটি করেছ তার তুলনায় যে কোনো কাজকে ছেলেখেলা বলা যায়।
আমি ক্রিশিকে বললাম, এই দেখ, টিয়ারাও বলছে এটা ছেলেখেলা।
ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, মানুষ একটি দুর্বোধ্য প্রাণী।
খাঁটি কথা, আমি হাসতে হাসতে বলি, একেবারে খাঁটি কথা।
টিয়ারা খানিকক্ষণ আগুনের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে বলল, তুমি কি এখন গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে তোমার যুদ্ধ শুরু করবে?
আমি অবাক হয়ে টিয়ারার দিকে তাকালাম, তার মুখে আগুনের লাল আভা, মুখে হাসির চিহ্ন নেই। সে কৌতুক করে বলছে না, সত্যি সত্যি জানতে চাইছে। আমি অবিশ্বাসের গলায় বললাম, কী বলছ তুমি? আমি কেন গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব?
তাহলে কে করবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কাউকে করতে হবে কে বলেছে?
তুমি বলেছ।
আমি বলেছি? আমি কখন বললাম?
টিয়ারা মাথা নেড়ে বলল, আমি জানিনা তুমি কখন বলেছ কিন্তু সবাই জানে। তোমার সম্পর্কে অনেক রকম গল্প আছে।
কী গল্প?
তুমি সাহসী আর তেজস্বী। তুমি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব। তুমি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে লড়বে, মানুষকে মুক্ত করবে এইসব গল্প।
আমি এবারে কেন জানি একটু রেগে উঠলাম, গলা উঁচিয়ে বললাম, তুমি তো জান এইসব মিথ্যা।
টিয়ারা হেসে ফেলল, হাসলে এই মেয়েটিকে এত সুন্দর দেখায় যে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। হাসতে হাসতেই বলল, না আমি জানি না।
ঠিক আছে, তুমি যদি না জেনে থাক তোমাকে এখন বলছি শুনে রাখ। আমি খুব সাধারণ মানুষ, অত্যন্ত সাধারণ। শুধু সাধারণ নয় আমি মনে হয় একটু বোকা–না হলে কিছুতেই এ রকম একটা অবস্থায় এসে পড়তাম না। শুধু তাই নয় আমি ভীতু এবং কাপুরুষ। এই রবোটদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করব বলে ঠিক করেছিলাম। আমার গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই, কখনো ছিলও না।
আমি যতক্ষণ কথা বলছিলাম টিয়ারা আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিল, আমার কোনো কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হল না। আমি আবার রেগে উঠে বললাম, তুমি ওরকম করে হাসছ কেন?
টিয়ারা হাসতে হাসতে বলল, কে বলল আমি হাসছি? আমি মোটেও হাসছি না।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। শুনলাম আগুনের অন্য পাশে বসে ক্রিশি বিড়বিড় করে বলল, মানুষ অত্যন্ত দুর্বোধ্য প্রাণী।
আমি আরেক টুকরা ছোট বিস্ফোরক আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিতেই আবার আগুনের শিখা লাফিয়ে অনেক উপরে উঠে গেল। অন্ধকার রাতে এই আগুনের শিখাটিকে দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত কোনো প্রাণী কোনো এক ধরনের বিচিত্র উল্লাসে নাচছে। আমি আগুনের দিকে তাকিয়েছিলাম তখন টিয়ারা আবার আমাকে ডাকল, কুশান।
বল।
আমি তোমাকে একটা কথা বলব?
বল।
তুমি সত্যিই হয়তো গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানুষকে মুক্ত করতে চাও না–কিন্তু তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না।
তুমি কী বলতে চাইছ?
অনেক মানুষ যখন একটা জিনিস বিশ্বাস করে, সেটা যদি ভুল জিনিসও হয়, তাহলে সেটাই সত্যি হয়ে যায়। মানুষ বিশ্বাস করে তুমি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সেটা মানুষকে এত আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখিয়েছে যে
টিয়ারা হঠাৎ থেমে গেল। আমি একটু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, যে কী?
এখন মানুষের মুখ চেয়ে তোমার গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।
তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ
তুমি হয়তো চাও নি, কিন্তু তুমি যুদ্ধ শুরু করেছ। তুমি প্রথমবার সবাইকে বলেছ গ্রুস্টান একটা তুচ্ছ অপারেটিং সিস্টেম—সবাই চমকে উঠেছে, শুনে ভয় পেয়েছে, কিন্তু কেউ মাথা থেকে সেটা সরাতে পারছে না গ্রুস্টানের মাঝে আগে একটা ঈশ্বর ঈশ্বর ভাব ছিল সেটা আর নেই। তাকে দেখে সবাই এখন ভাবে এটি একটি অপারেটিং সিস্টেম
কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অপারেটিং সিস্টেম।
টিয়ারা কেমন জানি জোর দিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। সে এক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরের অতিমানবিক অলৌকিক একটা শক্তি ছিল, এখন সে তুচ্ছ অপারেটিং সিস্টেম। রিকিভ ভাষায় লেখা একটা পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম! এখন সে আঘাত করার পর্যায়ে নেমে এসেছে। এখন তোমাকে আঘাত করতে হবে–
আমি?
টিয়ারা স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ তুমি!
কেমন করে আমি আঘাত করব? কোথায়?
আমি জানি না কোথায়, কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে। তোমার সেই ক্ষমতা আছে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি দেখেছি! তুমি আমার চোখের সামনে একটি অসম্ভব কাজ করেছ। ছয়টি ভয়ঙ্কর রবোটকে ধ্বংস করেছ। তুমি আবার একটি অসম্ভব কাজ করবে।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। একজন মানুষ যে কী পরিমাণ অযৌক্তিক একটা জিনিস বিশ্বাস করতে পারে সেটি আমি এখন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমি আরেকটা ছোট বিস্ফোরক আগুনের মাঝে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম তখন টিয়ারা আবার ডাকল, কুশান।
বল।
তুমি মানুষকে যত সুন্দর করে স্বপ্ন দেখাতে পার আর কেউ সেটা পারে না।
আমি কখন স্বপ্ন দেখালাম?
আজ সকালে তুমি কী বলেছিলে মনে আছে?
কী বলেছি?
বলেছ একটি শিশুর জন্ম হবে একজন ছেলে আর একজন মেয়ের ভালবাসা থেকে। টিয়ারা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে খপ করে আমার হাত ধরে বলল, তুমি জান এর অর্থ কী? তুমি জান?
আমি চুপ করে রইলাম, টিয়ারা ফিসফিস করে বলল, তার অর্থ আমরা আবার সত্যিকারের মানুষ হব। আমাদের আপনজন থাকবে, ভালবাসার মানুষ থাকবে, সন্তান থাকবে–ভ্রূণ ব্যাংক থেকে পাওয়া শিশু নয়, সত্যিকারের সন্তান। নিজের রক্তমাংসে তৈরী সন্তান।
আগুনের আভায় টিয়ারার মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটি সন্তানকে বুকে ধরার জন্যে একটি মেয়ে কত ব্যাকুল হতে পারে আমি এর আগে কখনো বুঝতে পারি নি।
আমি শুনতে পেলাম আগুনের অন্য পাশে বসে থেকে ক্রিশি বিড়বিড় করে বলল, মানুষ একটি অত্যন্ত বিচিত্র প্রাণী। অত্যন্ত বিচিত্র।
রাত্রিবেলা আগুনের দুই পাশে আমি আর টিয়ারা বয়ে আছি, মাঝে মাঝে আগুনের লাল আভায় তার মুখ স্পষ্ট হয়ে আসে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর এক ধরনের আলোড়ন অনুভব করি। বিচিত্র এক ধরনের আলোড়ন। আমি আগে কখনো এ রকম অনুভব করি নি। একই সাথে দুঃখ এবং সুখের অনুভূতি। একই সাথে কষ্ট এবং আনন্দ, হতাশা এবং স্বপ্ন। জোর করে আমি আমার মনোযোগ সরিয়ে আনি। মানুষের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে, যেটা রয়েছে সেটা একটা ধ্বংসস্তূপ। এখানে স্বপ্নের কোনো স্থান নেই। এটি দুর্যোগের সময়, এখানে এখন রূঢ় নিষ্ঠুরতা, বেঁচে থাকার জন্যে এক ধরনের নৃশংস প্রতিযোগিতা। এখন বুকের মাঝে কোনো স্বপ্নের স্থান দিতে হয় না। আমি খানিকক্ষণ একদৃষ্টে টিয়ারার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে ডাকলাম, টিয়ারা—
বল।
তুমি এখন কী করবে?
টিয়ারা দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আমি সম্ভবত আমার বসতিতে ফিরে যাব। ফিরে গিয়ে
ফিরে গিয়ে?
ফিরে গিয়ে গ্রুস্টানের প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিব। হয়তো কোনো একদিন ভ্রূণ ব্যাংক থেকে আমাকে একটা শিশু দেবে। হয়তো
হয়তো কী?
টিয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না কিছু না।
আমার খুব ইচ্ছে হল টিয়ারাকে নরম গলায় বলি, তুমি তোমার বসতিতে যেয়ো না, তুমি থাক আমার কাছাকাছি। আমি গ্রুস্টানকে ধ্বংস করে দেব
কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, কারণ সেটি সত্যি নয়। পৃথিবীর কোনো মানুষ গ্রুস্টানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
আমি শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম টিয়ারা গুনগুন করে গান গাইছে। কী বিষণ্ণ করুণ একটি সুর, শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি হাহাকার করতে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে অনুভব করি হঠাৎ কেন জানি আমার চোখ ভিজে উঠছে। কিসের জন্যে?
.
ভোররাতে ক্রিশি আমাকে ডেকে তুলল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ক্রিশি?
দুজন মানুষ আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে মহামান্য কুশান।
দুজন মানুষ? আমি চাপা গলায় চিৎকার করে বললাম, মানুষ?
হা। এবং একটি প্রাণী।
প্রাণী?
হ্যাঁ চতুষ্পদ প্রাণী। সম্ভবত কুকুর।
আমার সাথে দেখা করতে এসেছে? কুকুর দেখা করতে এসেছে?
একটি কুকুর এবং দুজন মানুষ।
আমি তখনো পুরোপুরি জেগে উঠতে পারি নি। কোনোমতে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় তারা? কী চায়? কেন এসেছে? কেমন করে জানল আমি এখানে?
আমার গলার স্বরে টিয়ারাও জেগে উঠেছে, ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে কুশান?
ক্রিশি বলছে, দুজন মানুষ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
সর্বনাশ! কেন এসেছে?
মহামান্য কুশান এবং মহামান্য টিয়ারা, ব্যাপারটিতে ভয়ের কোনোই ব্যাপার নেই। যারা এসেছেন তারা বন্ধুভাবাপন্ন, তাদের থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই।
তুমি কেমন করে জান?
আমি একজনকে চিনি। তিনি আমাদের পুরোনো বসতিতে ছিলেন। তার নাম মহামান্য রাইনুক।
রাইনুক এসেছে? রাইনুক? আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এতক্ষণে বলছ? কোথায়?
এক্ষুনি এসে পড়বে। আমি আগে এসে আপনাকে খবর দিতে চেয়েছি–ওই যে তাদের দেখা যাচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে দেখি সত্যি সত্যি রাইনুক এবং আরেকজন কমবয়সী মানুষ একটা ছোট কুকুরের গলার চেন ধরে তাকে টেনে রাখতে রাখতে এসে হাজির হল। কুকুরটি আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ঘেউ ঘেউ করে ডেকে হঠাৎ ঠিক মানুষের মতো হাই তুলে হঠাৎ গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল। রাইনুক আমাকে দেখে প্রায় ছুটে আসে–আমরা একজন আরেকজনকে জাপটে জড়িয়ে ধরি, আমার মনে পড়ে না আমি আগে কখনো আমার। অনুভূতিকে কোনোদিন এভাবে প্রকাশ করেছি। খানিকক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে কুশান! আমাদের সবার ধারণা ছিল তোমাকে আরো অনেক সতেজ দেখাবে!
আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর আমি যেভাবে আছি সেখানে খুব সতেজ থাকা যায়?
রাইনুক বলল, কেন নয়? তুমি সতেজ থাকলেই আমরা সবাই সতেজ থাকব।
কেন? আমার সাথে তোমাদের কী সম্পর্ক?
রাইনুকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী মানুষটি বলল, কারণ আপনি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন।
আমি চমকে তার দিকে তাকালাম, কিছু একটা বলার আগেই হঠাৎ টিয়ারা খিলখিল করে হেসে ওঠে। কিছুতেই সে হাসি থামাতে পারে না। কমবয়সী মানুষটি একটু হকচকিয়ে যায়, টিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই টিয়ারা। তুমি এমন করে হাসছ কেন?
টিয়ারা হাসতে হাসতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কুশান, তুমি উত্তর দাও।
আমি মানুষটির দিকে তাকালাম, সে সাথে সাথে মাথা নত করে একটু অভিবাদনের ভঙ্গি করে বলল, আমার নাম এলুজ। আমি দক্ষিণের বসতি থেকে এসেছি। উত্তরের বসতি থেকে যারা আসছে তারা আর কিছুক্ষণের মাঝে পৌঁছে যাবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আরো মানুষ আসছে?
রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ আরো অনেকে আসছে। আমরা তোমার সঙ্কেতের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। যখন সঙ্কেত পেয়েছি সাথে সাথে রওনা দিয়েছি।
সঙ্কেত? আমি তোমাদের আসার জন্যে সঙ্কেত দিয়েছি?
হা। তুমি যখন টিয়ারাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলে ঠিক তখন আমরা বুঝতে পেরেছি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে সগ্রাম করার জন্যে এখন তোমার আরো মানুষ দরকার। সাথে সাথে আমরা রওনা দিয়েছি।
আমি হতবাক হয়ে রাইনুকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম টিয়ারা হঠাৎ আবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করেছে। রাইনুক একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, টিয়ারা হাসছে কেন?
আমি কোনো কথা না বলে দুই পা পিছিয়ে ঐকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসি। টিয়ারা হাসি থামিয়ে বলল, কুশান তুমি ওদের বল আমি কেন হাসছি।
বলব! সবাই আসুক তখন বলব। তার আগে তোমাদের কাছে আমি একটা জিনিস জানতে চাই, গ্রুস্টান আমাকে খুঁজছে। তোমরা যদি এত সহজে আমাকে খুঁজে বের করতে পার গ্রুস্টানের রবোট কেন পারছে না?
এলুজ নামের কমবয়সী মানুষটি একগাল হেসে বলল, কখনো পারবে না। আমরা এসেছি একটা অভিনব উপায়ে।
কী উপায়ে?
একটা প্রাচীন বইয়ে পড়েছিলাম কুকুরের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রবল। আমাদের বসতিতে একটি কুকুর রয়েছে, কীভাবে তাকে রাখা হয়েছে সেটি আরেক ইতিহাস। যাই হোক রাইনুক আপনার ঘর থেকে আপনার ব্যবহারী কিছু কাপড় নিয়ে এসেছে। কুকুরটি তার ঘ্রাণ থেকে আপনি কোন পথে গিয়েছেন সেটি খুঁজে বের করেছে। কোনো রবোটের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়।
কিন্তু তোমরা বলেছ আরো অনেক মানুষ আসবে—
রাইনুক বলল, আমরা আশপাশের বসতির মানুষেরা একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। যখন তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্যে রওনা দিয়েছি আমরা পথে পথে একজন একজন করে রেখে এসেছি। তারা একজন আরেকজনকে পথ দেখিয়ে আনবে। তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
ভয় আমার নিজের জন্যে নয় রাইনুক।
তাহলে কার জন্যে?
তোমাদের জন্যে। এটি সত্যি সত্যি একটি বিশাল বিপজ্জনক অরণ্য। যাই হোক তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? এস বসে কিছু একটা খাওয়া যাক। ক্রিশি খুঁজে খুঁজে এক ধরনের পানীয় এনেছে, পদার্থটি কী আমরা জানি না কিন্তু খেতে চমৎকার।
আমরা সবাই আগুনকে ঘিরে লাল রঙের পানীয়টি চেখে খেতে থাকি। কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিতেই জায়গাটি হঠাৎ কেমন যেন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
টিয়ারা ছোট কুকুরটিকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। একটি কুকুর যে এত দ্রুত কোনো মানুষের ন্যাওটা হয়ে যেতে পারে, না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না!
আমি রাইনুকের সাথে কথা বলতে থাকি, আমাদের বসতির কে কেমন আছে খবরাখবর নিই। সব মন খারাপ করা খবর। লিয়ানা আমাকে চলে যেতে দিয়েছে বলে গ্রুস্টান তাকে সিলাকিত করেছে। মানুষকে সিলাকিত করা হলে তার শরীরটি সিলিকনের একটি সিলিন্ডারে রেখে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া হয়। গ্রুস্টান তখন মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে। সেই মানুষটিকে ইচ্ছে করলে যে কোনো ধরনের আনন্দ দিতে পারে আবার ইচ্ছে করলে অমানুষিক যন্ত্রণা দিতে পারে। সিলাকিত মানুষের প্রতিচ্ছবি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে দেখা সম্ভব। লিয়ানাকেও নাকি কয়েকবার দেখা গিয়েছে, অত্যন্ত বিষণ্ণ এবং দুঃখী চেহারায়। যদিও সবাই জানে এটি সত্যিকারের লিয়ানা নয় গ্রুস্টানের তৈরী একটি প্রতিচ্ছবি তবুও দেখে সবার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। গ্রুস্টান মনে হয় সেটাই চাইছিল তার অবাধ্য হবার শাস্তি কী হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেখানো।
আমাদের বসতির বর্তমান অধিপতি হচ্ছে ক্ৰকো। রাইনুকের ধারণা, ক্ৰকো মানুষ এবং বৃক্ষের মাঝামাঝি একটি জীব। মেরুদণ্ডহীন ভীতু একটি কাপুরুষ। বসতির মানুষজনের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে ষোলো বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে একটি টাওয়ারের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। মৃত্যুর আগে লিখে গেছে এই জীবনকে দীর্ঘায়িত করার তার কোনো উৎসাহ নেই।
রাইনুকের কথা শুনে আমি হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি।
০৮. জায়গাটা মোটামুটি সমতল
আমরা যেখানে বসেছি জায়গাটা মোটামুটি সমতল। চারপাশে বড় বড় কংক্রিটের টুকরা পড়ে আছে। তার মাঝে কেউ হেলান দিয়ে বসেছে কেউ আবার পা ঝুলিয়ে বসেছে। সব মিলিয়ে এখানে চৌদ্দ জন মানুষ, তার মাঝে চার জন মেয়ে। যারা এসেছে তার মাঝে এক দুজন মধ্যবয়স্ক, অন্য সবাইকে মোটামুটি তরুণ–তরুণী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।
আমি নিজে একটা ধাতব সিলিন্ডারের উপর বসে আছি। গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম শুরু করেছি মনে করে সবাই এখানে এসেছে–পুরো ব্যাপারটি যে আসলে একটি বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝি আমি এইমাত্র সেটি সবাইকে খুলে বলেছি। শুধু তাই নয় আমি খোলাখুলিভাবে সবাইকে বলে দিয়েছি যে আমি একটা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ, আমার মাঝে। নেতৃত্ব দেয়ার মতো কোনো শক্তি নেই। অন্যদের পথ দেখানো দূরে থাকুক আমি কোনোভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়েই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার কথা শুনে উপস্থিত সবার মুখে একটা গভীর আশাভঙ্গের ছাপ পড়বে। কিন্তু কারো মুখে আশাভঙ্গ বা হতাশার কোনো চিহ্ন দেখলাম না বরং সবাই এক ধরনের হাসিমুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আমি কী বলতে চাইছি তোমরা মনে হয় ঠিক বুঝতে পার নি।
রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, খুব ভালো করে বুঝেছি। তুমি যে এ রকম কথা বলবে আমরা আগে থেকে জানতাম।
আগে থেকে জানতে?
পিছনের দিকে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, মহামান্য কুশান আমার নাম ইশি, আপনাকে–
আমি একটু উষ্ণস্বরে বললাম, আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। আমি তোমাদের নেতা নই, আমাকে কৃত্রিম আনুষ্ঠানিক একটা সম্মান দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই–
ঠিক আছে আমি দেখাব না। ইশি নামের মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, কুশান। তোমাকে আমি একটা কথা বলি।
বল।
প্রাচীনকালে সেনাপতিরা যেরকম একটা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে রাজ্য জয় করতে যেত আমরা তোমার কাছে সেরকম নেতৃত্ব আশা করছি না। কখনো করি নি।
তাহলে তোমরা কী আশা করছ?
আমরা তোমার কাছে যে নেতৃত্ব আশা করছি বলতে পার সেটা হচ্ছে একটা স্বপ্নের নেতৃত্ব, একটা বিশ্বাসের নেতৃত্ব। সত্যি কথা বলতে কী তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই নেতৃত্বটিও দেবার আর প্রয়োজন নেই। তার কারণ–
ইশি কী বলতে চাইছে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ইশি একটু হেসে বলল, তার কারণ তুমি ইতিমধ্যে সেটা আমাদের দিয়েছ। দীর্ঘদিন গ্রুস্টান আমাদের শাসন করেছে, তার কবলে থেকে থেকে আমাদের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল। তুমি আবার আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছ। এখন আমরা আবার তোমাকে নিয়ে কাজ করতে চাই, তার বেশি কিছু নয়।
সবাই গম্ভীর মুখে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে। লাল চুলের একটি মেয়ে হাত দিয়ে তার কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, কুশান তুমি নিজে হয়তো জান না কিন্তু তুমি দুটি খুব বড় বড় কাজ করেছ।
কী কাজ?
প্রথমত, তুমি সবাইকে জানিয়েছ গ্রুস্টান আসলে একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। যার অর্থ তার কোনো অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই। আজ হোক কাল হোক একদিন তাকে ধ্বংস করা যাবেই। আর দ্বিতীয়ত, তুমি গ্রুস্টানের কোনো সাহায্য ছাড়া একা একা এই বিশাল ধ্বংসস্তূপে প্রায় তিন সপ্তাহ থেকে বেঁচে আছ। যার অর্থ গ্রুস্টানের ওপর নির্ভর করে মানুষের ছোট ছোট ঘুপচির মতো বসতিতে বেঁচে থাকতে হবে না। ইচ্ছে করলে আমরা যেখানে খুশি সেখানে বেঁচে থাকতে পারব। পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে আমরা নূতন বসতি সৃষ্টি করব।
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, টিয়ারা বাধা দিয়ে বলল, শুধু তাই নয়, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে গতকাল তুমি কী বলেছ।
কী বলেছি?
গ্রুস্টানের কাছে আমাদের সন্তান ভিক্ষা করতে হবে না। মানুষের সন্তান আর ভ্রূণ ব্যাংক থেকে আসবে না, তারা আসবে বাবা–মায়ের ভালবাসা থেকে। তারা হবে আমাদের নিজেদের রক্তমাংসের
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু
ইশি বাধা দিয়ে বলল, এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই কুশান। হয়তো এসব অবাস্তব কল্পনা, হয়তো সব অলীক স্বপ্ন–কিন্তু স্বপ্ন তাতে কোনো দ্বিমত নেই।
কমবয়সী একজন তরুণ বলল, আমরা তোমার সাথে এই অপূর্ব স্বপ্নগুলোতে অংশ নিতে চাই।
আমি ঠিক কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। এ ধরনের যুক্তিতর্কে আমি একেবারেই অভ্যস্ত নই। শেষ চেষ্টা করার জন্যে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু টিয়ারার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। তার অপূর্ব চোখ দুটিতে কী ব্যাকুল এক ধরনের আবেদন। আমি কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ঠিক আছে। আমাকে ঠিক কী করতে হবে আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাদের সাথে আছি।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা সবাই এক ধরনের আনন্দধ্বনি করে ওঠে, ঠিক কী কারণে জানি না আমি হঠাৎ বুকের মাঝে এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করি। আমি সবাইকে থেমে যেতে একটু সময় দিয়ে বললাম, আমার মনে হয় তোমাদের সত্যি কথাটিও মনে রাখতে হবে।
কোন সত্যি কথা?
গ্রুস্টান কয়েক লক্ষ কম্পিউটারের একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। সেই কম্পিউটারগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো কোথায় আছে আমরা জানি। পর্যন্ত না। কম্পিউটারগুলো অত্যন্ত সুরক্ষিত–পারমাণবিক বিস্ফোরণেও সেইসব কম্পিউটার ধ্বংস হয় নি। গ্রুস্টানকে ধ্বংস করতে হলে সেইসব কম্পিউটারকে ধ্বংস করতে হবে। একটি–দুটি নয় কয়েক লক্ষ কম্পিউটার।
মুখে দাড়িগোফের জঙ্গল একজন মানুষ হাত তুলে বলল, কিন্তু কম্পিউটার ধ্বংস না করে আমরা এক কম্পিউটারের সাথে অন্য কম্পিউটারের যোগসূত্র কেটে দিতে পারি।
হ্যাঁ, সেটা হয়তো সহজ কিন্তু মনে রেখো কয়েক লক্ষ কম্পিউটারের যোগসূত্রও কয়েক লক্ষ। কোনো মানুষের পক্ষে সেই সবগুলো খুঁজে বের করে কেটে দেয়া সম্ভব নয়।
ইশি বলল, একজন মানুষের পক্ষে অল্প সময়ের মাঝে হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ মিলে যদি দীর্ঘদিন চেষ্টা করে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, তবুও সেটি সহজ নয়। গ্রুস্টান নিজেকে রক্ষা করার জন্যে তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
টিয়ারা গলা উচিয়ে বলল, কিন্তু কুশান, এই মুহূর্তে হয়তো গ্রুষ্টানকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়, কিন্তু তাই বলে কখনোই কি সম্ভব হতে পারে না?
আমি চুপ করে রইলাম।
বল।
হয়তো
কীভাবে সম্ভব।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, হয়তো গ্রুষ্টানকে কোনোভাবে ধোকা দিয়ে তাকে ব্যবহার করেই পৃথিবীর সব মানুষের বসতিতে খবর পাঠাতে পারি। সেইসব মানুষ একটা নির্দিষ্ট কম্পিউটারের যোগসূত্র কেটে দিতে পারে কিংবা
কিংবা কী?
আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, যদি কোনোভাবে আমরা কম্পিউটারগুলোর অবস্থান বের করতে পারি, কোন নেটওয়ার্কে একটার সাথে আরেকটা জুড়ে দেয়া আছে বের করতে পারি–
ইশি ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু সেটা কি খুব কঠিন নয়?
মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল মানুষটি উত্তেজিত গলায় বলল, সেটা খুব কঠিন নাও হতে পারে। আমি একটা লিস্ট তৈরি করতে শুরু করেছি। এই এলাকার প্রায় হাজারখানেক কম্পিউটারের অবস্থান সেখানে আছে।
সত্যি?
হ্যাঁ। যদি অব্যবহৃত একটা কম্পিউটারের মেমোরি থেকে কিছু তথ্য বের করে নিই—
গ্রুস্টান বুঝে যাবে সাথে সাথে।
দাড়িগোঁফের জঙ্গল মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, বুঝবে না। মূল প্রসেসর থেকে ফাইবারের যোগসূত্র হয় কোয়ার্টজ ফাইবারে। সেই ফাইবারকে একটু বাঁকা করে তার মাঝে থেকে ষাট ডিবি অবলাল আলো বের করে আনা যায়। তারপর টেরা হার্টজের কয়েকটা খুব ভালো এমপ্লিফায়ার–
লাল চুলের মেয়েটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ক্লড তুমি এখন থাম। খুঁটিনাটি পরে শোনা যাবে। কুশান কী বলতে চাইছে শুনি।
ইশি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ কুশান বল।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমরা যদি কম্পিউটারের নেটওয়ার্কটি খুব নিখুঁতভাবে বের করতে পারি তাহলে এটি হয়তো মোটেও অসম্ভব নয় যে কয়েক জায়গায় যোগসূত্রটি কেটে দিয়ে গ্রুস্টানের পুরো নেটওয়ার্কটিকে দুটি আলাদা আলাদা অংশে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারি। কম্পিউটারের সংখ্যা হচ্ছে গ্রুস্টানের শক্তি। যদি সেই সংখ্যাকে অর্ধেক করে ফেলা যায়–
এলোমেলো চুলের একজন মানুষ উত্তেজিত হয়ে বলল, যদি প্রসেসরের সংখ্যা আর মেমোরিকে শক্তি হিসেবে ধরা যায় সেটি এক মাত্রার নয়, সেটি দুই মাত্রার। কারণ রিচি পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখানো যায় যদি নেটওয়ার্কে কম্পিউটারের সংখ্যা অর্ধেক করে দেয়া হয় গ্রুস্টানের ক্ষমতা কমে যাবে চার গুণ। যদি এক–চতুর্থাংশ করে দেয়া হয়–
লাল চুলের মেয়েটি আবার বাধা দিয়ে বলে, দ্রুন তুমি এখন থাম। খুঁটিনাটি পরে দেখা যাবে।
সবাই আবার আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি বললাম, আমরা যদি কম্পিউটারগুলোর অবস্থান জানি তাহলে এটা খুব অসম্ভব নয় যে আমরা নেটওয়ার্কের বিশেষ বিশেষ জায়গা ধ্বংস করে সেটিকে দু ভাগ করে দিতে পারি। গ্রুস্টানের শক্তি তখন অর্ধেক হয়ে যাবে, আর দ্রুনের হিসেব যদি সত্যি হয় শক্তি হবে চার ভাগের এক ভাগ। যে অর্ধেক নেটওয়ার্কে আমরা আছি সেটাকে আবার যদি দুই ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি তখন হঠাৎ করে গ্রুস্টানের শক্তি অনেক কমে যাবে। তারপর সেটাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করে–
একজন হঠাৎ মাটিতে পা দাপিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল, সহজ একেবারেই সহজ! আমরা গ্রুস্টানকে ধ্বংস করে দেব।
আমি বললাম, না এত সহজ না। এত সহজে উত্তেজিত হয়ো না। কম্পিউটারের নেটওয়ার্কটি একেবারে নিখুঁতভাবে জানতে হবে। সেটা কঠিন। তবে
তবে কী?
এখন আমি তোমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ভাবছি। সেটা না করে যদি ঠাণ্ডা মাথায় সবাই মিলে ভাবি হয়তো আরো চমৎকার কোনো বুদ্ধি বের হয়ে যাবে।
লাল চুলের মেয়েটি বলল, এখন যেটা বের হয়েছে সেটাই তো অসাধারণ!
ইশি একটু হেসে বলল, এটা যদি অসাধারণ নাও হয় কোনো ক্ষতি নেই। তোমাকে এখনই এমন কিছু ভেবে বের করতে হবে যেটা সত্যি কাজ করবে, যেটা সত্যি অসাধারণ।
তাহলে?
তোমার এবং আমাদের সবার এমন একটা কিছু ভেবে বের করতে হবে যেটা আমাদের মাঝে আশা জাগিয়ে রাখবে। যত কমই হোক সাফল্যের একটু সম্ভাবনা থাকবে। সেই সাফল্যের মুখ চেয়ে আমরা কাজ করব–সবাই মিলে একসাথে, একটা বিরাট পরিবারের মতো।
ক্লড বলল, ইশি, কুশান এইমাত্র যেটা বলেছে সেটাতে সাফল্যের সম্ভাবনা একটু নয়, আমার ধারণা অনেকখানি। কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক বেশ কয়েকভাবে হতে পারে, কোয়ার্টজ ফাইবার কিংবা উপগ্রহ যোগাযোগে। উপগ্রহ যোগাযোগের বড় এন্টেনাগুলো যদি পাতলা এলুমিনিয়াম দিয়ে ঢেকে দিয়ে
আমি ক্লডকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, যখন গ্রুষ্টানকে বিচ্ছিন্ন করা শুরু করবে সে কি চুপ করে বসে থাকবে? থাকবে না। সে তার বিশাল রবোট বাহিনী নিয়ে আমাদের পিছনে হানা দিবে–
লাল চুলের মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বলল আমরা প্রথম দিকে খুব বুদ্ধি খাটিয়ে যোগাযোগ নষ্ট করতে পারি। কোনো এক ঝড়ের রাতে উপগ্রহের এন্টেনা ফেলে দেব, নিয়ন্ত্রণহীন রবোটদের যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে কিছু ফাইবার কেটে দেব
সবাই মাথা নাড়ে। রাইনুক হাসতে হাসতে বলল, তোমরা একটা জিনিস লক্ষ করেছ?
কী?
আমরা এতদিন মানুষের বসতির মাঝে একটা বুদ্ধিহীন প্রাণীর মতো বেঁচেছিলাম। গ্রুস্টান আমাদের ছোটবড় সব কাজ করে দিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমরা বসতি থেকে পালিয়ে এখানে এসেছি প্রত্যেক মুহূর্তে আমরা নূতন নূতন জিনিস ভাবছি। নূতন নূতন বুদ্ধি বের করছি।
ইশি বলল, সেটা হচ্ছে গোড়ার কথা। মানুষের একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। যদি স্বপ্ন থাকে তাহলে আশা থাকে। আর যদি আশা থাকে মানুষ সগ্রাম করে যেতে পারে। জীবন তাহলে কখনো অর্থহীন হয় না। আমাদের জীবন কখনো অর্থহীন হবে না। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কুশান!
আমি ইশির দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বললাম, তোমাদের সবার ভিতরে এখন গভীর ভাব, অন্য এক ধরনের উদ্দীপনা। তাই আমি এখন মন খারাপ করা কিছু বলছি না। কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই জান প্রকৃতপক্ষে আমরা সত্যিকারের একটা দানবকে খেপিয়ে তুলতে যাচ্ছি। নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর একটা দানব–সে কী করবে আমরা এখনো জানি না।
টিয়ারা মাথা নেড়ে বলল, আমি এখন জানতেও চাই না।
.
রাত্রিবেলা বিশাল একটা আগুন জ্বালিয়ে আমরা সবাই গোল হয়ে বসে আছি। আমার পাশে বসেছে টিয়ারা, আমার এত কাছে যে আমি তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। তাকে দেখে আমার বুকের মাঝে কেমন এক ধরনের কষ্ট হয়, কেন জানি না। তার অপূর্ব মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি নিচু গলায় তাকে ডাকলাম, টিয়ারা।
বল।
মানুষের বসতিতে তোমার জন্যে একজন মানুষ অপেক্ষা করে আছে বলেছিলে।
হা। তাকে বহুকাল অপেক্ষা করে থাকতে হবে। টিয়ারা আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ফেলল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
আমার হঠাৎ ক্লিচির কথা মনে পড়ল।
ক্লিচি?
হ্যাঁ। আমাদের বসতিতে গ্রুস্টানের ডান হাত। যে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সে যদি জানতে পারে আমি গ্রুস্টানকে ধ্বংস করার দলে যোগ দিয়েছি টিয়ারা হঠাৎ আবার খিলখিল করে হাসতে থাকে। তাকে দেখে আমার বুকের ভিতরে কিছু একটা নড়েচড়ে যায়।
টিয়ারা হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কুশান!
তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?
কর।
সব মানুষের নিজের জীবনকে নিয়ে একটা স্বপ্ন থাকে। তোমার স্বপ্নটি কী?
আমি একটু হেসে বললাম, তুমি যেরকম ভাবছ সেরকম কোনো স্বপ্ন আমার নেই। তোমাদের বিশ্বাস করাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আসলেই আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার স্বপ্নও খুব সাধারণ।
সেটি কী?
সত্যি শুনবে? শোনার মতো কিছু নয়।
হ্যাঁ শুনব।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার স্বপ্ন যে আমি দক্ষিণে হেঁটে হেঁটে যাব। শুনেছি সেখানে নাকি একটা এলাকায় মানুষজনের বসতি ছিল না বলে পারমাণবিক বোমা দিয়ে ধ্বংস করা হয় নি। সেখানে গিয়ে আমি একটা নীল হ্রদ খুঁজে পাব। সেখানে থাকবে টলটলে পানি। সেই হ্রদের তীরে থাকবে গাছ। সত্যিকারের গাছ। সেই গাছে থাকবে গাঢ় সবুজ পাতা। আমি সেই গাছে হেলান দিয়ে হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকব। আর
আর কী?
দেখব হ্রদের পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে রুপালি মাছ। দেখব আকাশে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাক। কিচিরমিচির করে ডাকছে। তাদের গায়ের রং উজ্জ্বল সবুজ। লাল ঠোঁট। মাটিতে তাকিয়ে দেখব ভঁয়োপোক হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে তাকিয়ে দেখব সূর্য উঠে যাচ্ছে মাথার উপরে আর তখন
তখন?
তখন আমার খুব খিদে পাবে। আমি তখন শুকনো কাঠ জড়ো করে আগুন ধরাব। তারপর একটা তিতির পাখি না হয় একটা কার্প মাছকে বিষুবীয় অঞ্চলের ঝাঁজালো মসলায় মাখিয়ে খাব। সাথে থাকবে যবের রুটি। আঙুরের রস আর তরমুজ। আর আমার পাশে থাকবে–
তোমার পাশে?
আমি হঠাৎ থেমে উঠে লক্ষ করলাম সবাই নিঃশব্দে আমার কথা শুনছে। আমি লজ্জা পেয়ে থেমে গেলাম হঠাৎ।
ইশি বলল, কী হল থামলে কেন? বল।
এগুলো ছেলেমানুষি কথা! শুনে কী করবে।
লাল চুলের মেয়েটি বলল, বল না শুনি। বহুকাল কারো মুখে এ রকম ছেলেমানুষি কথা শুনি নি। বড় ভালো লাগছে শুনতে।
জানি না কেন হঠাৎ আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। এই পৃথিবী, প্রকৃতি, আকাশ বাতাস সবকিছু একদিন মানুষের ধরাছোঁয়ার কাছাকাছি ছিল। এখন সেটি কত দূরে–তার একটু স্পর্শের জন্যে আমরা কত তৃষিত হয়ে থাকি।
০৯. একটি ছোট দলের জন্যে
একটি ছোট দলের জন্যে চৌদ্দ জন সংখ্যাটি খারাপ নয়। খুব বেশি নয় যে সবার সাথে সবাই যোগাযোগ রাখতে পারে না, আবার খুব কমও নয় যে, মোটামুটি একটা দুরূহ কাজ সবাই মিলে শুরু করা যায় না। খুব কাছাকাছি থাকতে হয় বলে খুব অল্প সময়েই আমরা সবার সাথে সবাই পরিচিত হয়ে উঠেছি। কার কোন বিষয়ে কোন ধরনের ক্ষমতা এবং কোন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে আমরা দ্রুত জ্বেলে ফেলেছি। যেমন ইশি মানুষটির রসিকতাবোধ প্রবল নয় কিন্তু মানুষটি এক কথায় অসাধারণ। কোনোকিছুতেই সে নিরুৎসাহিত হয় না, যে ব্যাপারটিকে অতিদর্শনে একটা ভয়ঙ্কর মন খারাপ করা অবস্থা বলে মনে হয় তার মাঝেও সে চমৎকার আশাব্যঞ্জক কিছু একটা খুঁজে বের করে ফেলে। তার বিশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নেই কিন্তু মানুষজনকে নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা অসাধারণ।
রাইনুককে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনি কিন্তু এখানে তাকে আমি একেবারে নূতনভাবে আবিষ্কার করলাম। তাকে একটা কোনো সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হলে সে তার পিছনে খ্যাপার মতো লেগে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যাটার সমাধান না হচ্ছে সে ঘুম খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। ক্লড হাসিখুশি মানুষ, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল তাই তার সত্যিকার চেহারাটি কেমন জানি না। সে সবসময় কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছে। দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু কম্পিউটারের হার্ডওয়ারে তার অসাধারণ জ্ঞান। গণিতবিদ দ্রুন ক্লডের ঠিক উল্টো, প্রয়োজনের কথাটিও বলতে চায় না, কম্পিউটার নিয়ে সে বিশেষ কিছু জানত না কিন্তু গত কয়েকদিনে সে এ ব্যাপারে মোটামুটি পারদর্শী হয়ে এসেছে। লাল চুলের মেয়েটি–যার নাম নাইনা, তার অসম্ভব একটা যান্ত্রিক দক্ষতা রয়েছে। যে কোনো যন্ত্রকে খুলে ফেলে সে চোখের পলকে জুড়ে দিতে পারে। গত কয়েকদিনে সে আমাদের জন্যে গোটা চারেক বাই ভার্বাল দাঁড় করিয়েছে। কয়েকটি প্রাচীন রবোটকেও যোগাড় করা হয়েছে, সে তার মাঝে কিছু পরিবর্তন করে আমাদের ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করবে। একজন মানুষের মাঝে এ রকম প্রাণশক্তি আমি কখনো দেখি নি।
টিয়ারাকে দেখেও আমি অবাক হয়ে যাই, আমাদের কোনো চিকিৎসক রবোট নেই। কিন্তু টিয়ারা আশ্চর্য দক্ষতা নিয়ে আমাদের ছোটখাটো শারীরিক সমস্যার সমাধান করে ফেলছে। কয়েকদিন আগে একটা উঁচু দেয়াল থেকে পড়ে এলুজ তার হাত কনুইয়ের কাছে ভেঙে ফেলল, ক্রিশির এক্স–রে সংবেদন চোখ ব্যবহার করে সে কীভাবে কীভাবে জানি এলুজের হাতকে ঠিক করে দিল। এখনো সেটি বুকের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে কিন্তু বোঝ যাচ্ছে সেটি নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।
আমি নিজেকে দেখেও মাঝে মাঝে একটু অবাক হয়ে যাই। এতদিন আমি নিজেকে খুব সাধারণ একজন মানুষ বলে জানতাম কিন্তু গত কিছুদিন থেকে আমি নিজের একটা ক্ষমতা আবিষ্কার করছি। খুব কঠিন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আমি তার অত্যন্ত বিচিত্র একটা সমাধান বের করে ফেলি। সবসময় সেটি কাজ করে সেটা সত্যি নয় কিন্তু যখন আর কিছুই করার থাকে না তখন সেইসব সমাধান হঠাৎ করে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে।
দলের বেশিরভাগ সদস্যের সত্যিকার অর্থে কোনো দক্ষতা ছিল না, এখন অন্যদের সাথে পাশাপাশি কাজ করে সবাই কোনো–না–কোনো বিষয়ে মোটামুটি দক্ষ হয়ে উঠেছে। তাদেরকে জটিল একটি দায়িত্ব দেয়া যায় এবং তারা প্রায় সবসময়েই সাহায্য ছাড়াই সেইসব দায়িত্ব পালন করে ফেলে।
চৌদ্দ জন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানুষ পাশাপাশি থাকার কিছু সমস্যাও রয়েছে, যখন দীর্ঘ সময় কষ্টসাধ্য কাজ করে যেতে হয় তখন খুব সহজেই একে অন্যের ওপর রেগে ওঠে। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষি শুরু হয় এবং হঠাৎ হঠাৎ চরিত্রের দুর্বল দিকগুলো প্রকাশ পেয়ে যায়। সমস্যাটি সবারই চোখে পড়ছে, সেটা নিয়ে মাঝে মাঝেই আলোচনা করা হয় যদিও ইশির ধারণা এটি সত্যিকারের কোনো সমস্যা নয়, নিজেদের ভিতরে ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা করে ভেতরের ক্ষোভ বের করা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে অত্যন্ত জরুরি!
গোড়াতেই আমরা নিজেদের ভেতরে কয়েকটা জিনিস ঠিক করে রেখেছি। গ্রুস্টান নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কারণে আমরা কখনোই এক জায়গায় দু–এক দিনের বেশি থাকি না। ব্যাপারটি সহজ নয় সবাই সেটা নিয়ে অল্পবিস্তর অভিযোগ করা শুরু করেছে কিন্তু এখনো নিয়মটি ভাঙা হয় নি। দলের সবাই কোনো–না–কোনো ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা শিখেছে এবং সবসময় অস্ত্রটি হাতের কাছে রাখা হয়। এমনিতে খাবার পানীয় এবং ওষুধ খুঁজে বের করে বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। চলাফেরা করার জন্যে কিছু বাই ভার্বাল থাকায় আমরা বেশ দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারি। আমরা আমাদের নূতন জীবনে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, সবসময়েই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে খানিকটা উত্তেজনা থাকে এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ব্যাপারটি সবাই উপভোগ করা শুরু করেছে।
আমাদের প্রথম কাজ তথ্য সগ্রহ করা। গ্রুস্টান তার নানা কম্পিউটারের যোগাযোগ রাখার জন্যে নানাভাবে তথ্য পাঠায়। সেই তথ্যগুলো মাইক্রোওয়েভ রিসিভার ব্যবহার করে শোনার চেষ্টা করা হয়। তথ্যগুলোতে খুব প্রয়োজনীয় কিছু থাকবে কেউ আশা করে না কিন্তু কোথায় কোথায় অন্য কম্পিউটারগুলো রয়েছে তার একটা ধারণা হয়। সপ্তাহখানেক চেষ্টা করে আরো প্রায় এক শ নূতন কম্পিউটারের অবস্থান বের করা হয়েছে, কাজটি খুব সময়সাপেক্ষ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এভাবে চলতে থাকলে সব কম্পিউটারের অবস্থান বের করতে করতে আমাদের পুরো জীবন পার হয়ে যাবার কথা কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য ঠিক এ রকম সময়ে আমাদের হাতে একটি অভাবিত সুযোগ এসে গেল।
ভোরবেলা আমি আর ক্লড বের হয়েছি, আমাদের সাথে একটা হাতে তৈরি করা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মনিটর। দক্ষিণে প্রায় চার শ কিলোমিটার দূরে কোনো একটি জায়গা থেকে নির্দিষ্ট সময় পরে পরে মাইক্রোওয়েভের একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ হয়, ব্যাপারটি কী নিজের চোখে দেখে আসার ইচ্ছে। বাই ভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি আমরা উড়ে যাচ্ছি, আমি হালকা হাতে কন্ট্রোল ধরে রেখেছি, কুড ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে। একজন মানুষ যে বিনা কারণে এত কথা বলতে পারে ক্লডকে না দেখলে আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না।
যে জায়গাটি থেকে মাইক্রোওয়েভের বিস্ফোরণ হচ্ছে আমরা কিছুক্ষণেই সেখানে পৌঁছে গেছি। একটা ধূসর দালান, তার বেশিরভাগই ভেঙে গিয়েছে। তবুও বাইরে থেকে তাকিয়ে বোঝা যায় ভিতরে বড় অংশ এখনো মোটামুটি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কী আছে আমরা জানি না, কাছে গেলে আমাদের কোনো কিছু দেখে ফেলবে কি না বা অন্য কোথাও খবর পৌঁছে যাবে কি না সে ব্যাপারেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। এ রকম সময়। সাধারণত একটা রবোটকে কাজ চালানোর মতো একটা ভিডিও ক্যামেরা হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আজকেও তাই করা হল। রবোটটি প্রোগ্রাম করা আছে, গুটি গুটি হেঁটে ভিতর থেকে ঘুরে আসার কথা, বাই ভার্বালে বসে ছোট স্ক্রিনে আমরা দেখতে পাই কোথায় কী রয়েছে।
ভিতরে ছোট ছোট ঘর এবং তার ভিতরে চৌকোণো বাক্স, সেগুলো নানা ধরনের টিউব দিয়ে জুড়ে দেয়া আছে। আমি দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না কিন্তু ক্লডকে খুব উল্লসিত দেখা গেল, হাঁটুতে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার!
কী হয়েছে?
এটা গেটওয়ে কম্পিউটার।
তার মানে কী?
তার মানে এখানে মানুষের সাথে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। আশপাশের অনেকগুলো কম্পিউটার এখানে এসে একত্র হয়েছে। একেবারে যাকে বলে সোনার খনি!
তুমি কেমন করে জান?
ক্লড স্ক্রিনে দেখিয়ে বলল, এই দেখ এগুলো হচ্ছে মূল প্রসেসর। কেমন করে সাজানো দেখেছ? বাইরে থেকে যোগাযোগের কোয়ার্টজ ফাইবার এসেছে এদিক দিয়ে। এখানে সাধারণত হলোগ্রাফিক মনিটর থাকে। এখানে নেই কারণ এটা গেটওয়ে কম্পিউটার। তা ছাড়া মেমোরি মডিউলগুলো দেখ কত বড়, উপরের টিউবগুলো নিশ্চয়ই ফ্রিণ্ডন টিউব, ঠাণ্ডা রাখার জন্যে দরকার। প্রসেসরের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে খুব কায়দা করে, ভালো। করে দেখ
ক্লড একটানা কথা বলে যেতে থাকে, তার বেশ কিছু আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল ব্যাপারটি নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। সে বাই ভার্বাল থেকে নেমে বলল, চল ভিতরে যাই।
তুমি নিশ্চিত আমাদের কোনো বিপদ হবে না?
আমি নিশ্চিত।
কতটুকু?
শতকরা এক শ ভাগ!
আমি ক্লডের পিছু পিছু ঘরটির মাঝে ঢুকি। চারদিক ধুলায় ধূসর, কত দিন কোনো মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়ে নি। কয়েকটা ছোট ছোট দরজা পার হয়ে বড় একটা ঘরে এসে দাঁড়ালাম। অসংখ্য চৌকোণো বাক্স পাশাপাশি রাখা আছে, সেখান থেকে নিচু এক ধরনের ধাতব শব্দ হচ্ছে। ঘরে এক ধরনের কটু গন্ধ।
ক্লড ঘরের ভিতর হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। বিভিন্ন চৌকোণা তার এবং টিউবগুলো দেখতে দেখতে সে আবার নিজের মনে কথা বলতে শুরু করে। আমি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্লডের মোটামুটি অর্থহীন এবং প্রায় ছেলেমানুষি কথা শুনতে থাকি।
ক্লড হঠাৎ কী একটা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, কুশান!
কী হল?
কাছে এসে দেখ।
আমি এগিয়ে গেলাম, সে হলুদ রঙের কী একটা তার ধরে রেখেছে, আমাকে দেখিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করল যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী এটা?
এই দেখ! মূল প্রসেসর থেকে মেমোরি মডিউলের যোগাযোগ। একেবারে সোনার খনি!
কেন?
কোয়ার্টজ ফাইবার, সেকেন্ডে লক্ষ টেরাবিট তথ্য যাচ্ছে। আমরা যদি চাই তাহলে কী তথ্য যাচ্ছে বের করে ফেলতে পারি?
কেমন করে?
মনে নাই আগে বলেছিলাম তোমাদের? একেবারে পানির মতো সহজ। প্রথমে উপরের আবরণ সরিয়ে ভিতর থেকে কোয়ার্টজের মূল ফাইবারটা বের করতে হবে। তারপর সেটা যদি একটু বাঁকা করে ধর, ভিতর থেকে খুব অল্প অবলাল রশ্মি বের হয়ে আসবে। সেখানে একটা ভালো ফটোডায়োড আর কিছু ভালো এমপ্লিফায়ার–ব্যস হয়ে গেল।
হয়ে গেল?
তথ্যটা বোঝার জন্যে কিছু মনিটর লাগবে। একটা ছোট সমস্যা–ক্লড ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আবার কথা বলতে শুরু করে। মানুষটি মনে হয় জোরে জোরে চিন্তা করে।
আমি ক্লডের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম সে যেটা করতে চাইছে ব্যাপারটি অসম্ভব কিছু নয়। দীর্ঘদিন থেকে আমরা যে তথ্যগুলো বের করার চেষ্টা করছি এই কম্পিউটার গেটওয়ে থেকে দু–তিন দিনে সেইগুলো বের করে নিতে পারব। গ্রুস্টান যদি একজন মানুষ হত তাহলে তার মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে মনের কথা শুনে ফেলার মতো ব্যাপারটি।
আমি আর ক্লড জায়গাটি ভালো করে পরীক্ষা করে ফিরে গেলাম। ঠিক কী করতে চাইছি শোনার পর দলের সবাই খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে পুরো দলের মাঝে এক নূতন ধরনের উদ্দীপনা ফিরে আসে। আমরা পুরো দলবল নিয়ে পরের দিনই গেটওয়ে কম্পিউটারে পৌঁছে কাজ শুরু করে দিলাম।
.
ক্লড দাবি করেছিল দুই দিনের মাঝে আমরা কম্পিউটারের মেমোরিতে উঁকি দিয়ে তথ্য বের করতে শুরু করব। কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটি এত সহজ নয়। দলের সবাই রাতদিন কাজ করার পরও বড় একটা মনিটরে আবছা আবছাভাবে কিছু ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হল না। আমরা পালা করে সেই ত্রিমাত্রিক ছবিগুলোই পরীক্ষা করতে থাকি–সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য বের হয়ে যাবে সেই আশায়।
এভাবে আরো কয়েকদিন কেটে যায়। ইশি ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। একদিন রাতে আমি যখন বিশ্রাম নেবার জন্যে শুতে যাচ্ছি ইশি বলল, আমরা ঠিক করেছিলাম এক জায়গায় খুব বেশি সময় থাকব না। কিন্তু এখানে আমরা প্রায় দুই সপ্তাহের মতো কাটিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা ভালো হল না।
ক্লড কাছেই বসেছিল। মাথা চুলকে বলল, ফটোডায়োডের ব্যান্ড উইডথ ভালো নয়। অনেক তথ্য নষ্ট হচ্ছে। যেটুকু অবলাল রশ্মি পাচ্ছি সেটা যথেষ্ট নয়। আরেকটু যদি পেতাম!
দ্রুন বলল, কিন্তু তাহলে গ্রুস্টান বুঝে ফেলবে।
ইশি মাথা নেড়ে বলল, না না, সেটা খুব বিপজ্জনক কাজ হবে।
আমি বললাম, ক্লড, তোমরা সবাই মিলে যে কাজটুকু করছ, বলা যেতে পারে সেটা এক রকম অসাধ্য সাধন। কোনোরকম ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই।
দ্রুন বলল, আমরা তথ্য মোটামুটি খারাপ বের করি নি। যেমন ধরা যাক কম্পিউটারের অবস্থান। আমাদের আগের লিস্টে–অন্তত আরো কয়েক হাজার কম্পিউটার যোগ হয়েছে।
চমৎকার। ইশি মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার।
আমি বললাম, আমরা এখানে যদি আরো কিছুদিন থাকি হয়তো আরো কিছু তথ্য বের করতে পারব। কিন্তু যদি গ্রুস্টানের হাতে ধরা পড়ে যাই সর্বনাশ হয়ে যাবে।
আমারও তাই ধারণা। ইশি মাথা নেড়ে বলল, এক জায়গায় দুই সপ্তাহ থাকা খুব বিপজ্জনক। আমার মনে হয় আমাদের এখন এখান থেকে সরে যাওয়া দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ক্লড বলল, আর এক দিন। মাত্র এক দিন। মেমোরির মূল ব্যাংকে প্রায় পৌঁছে যাব মনে হচ্ছে, এক ধাক্কায় তখন অনেক কিছু বের হয়ে আসবে।
দ্রুন বলল, যদি দুই সপ্তাহ এক জায়গায় থাকতে পারি তাহলে আর এক দিন বেশি থাকলে ক্ষতি কী?
বিপদের আশঙ্কার কথা যদি বল তাহলে খুব বেশি পার্থক্য নেই।
ইশি বলল, ঠিক আছে তাহলে আমরা আরো একদিন থাকছি কিন্তু তারপর সরে পড়ব।
আমি বললাম, তোমাদের সবার কাছে একটা অস্ত্র রয়েছে না?
হ্যাঁ।
আমার মনে হয় অস্ত্রটি ভালো করে পরীক্ষা করে আজকে সবাই ঘুমাতে যেও। যদি গভীর রাতে রবোটেরা হানা দেয় মনে রেখো লক ইন না করে গুলি করবে। লক ইন করা হলে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ হয় কিন্তু রবোটেরা টের পেয়ে যায়। রবোটেরা খুব সহজেই অন্য রবোটদের খুঁজে বের করতে পারে কিন্তু মানুষদের খুঁজে বের করা তাদের জন্যে খুব সহজ নয়।
উপস্থিত যারা ছিল সবাই চুপ করে আমার কথা শুনল, কেউ কিছু বলল না। আমি বুঝতে পারলাম হঠাৎ করে সবাই এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করেছে।
গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি চোখ খুলে তাকালাম, আমার মাথার কাছে ক্রিশি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন ঘুমাই সে সবসময় আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু আজকে তাকে দেখতে একটু অন্য রকম লাগল। ঘুমের মাঝে আমি যখন হঠাৎ করে চোখ খুলে তাকাই ক্রিশি সবসময় আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু এবারে সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ঘুম চোখে ফিসফিস করে ডাকলাম, ক্রিশি।
ক্রিশি আমার কথার কোনো উত্তর দিল না, সাথে সাথে আমি হঠাৎ করে পুরোপুরি জেগে উঠলাম। ক্রিশির কপোট্রন কোনোভাবে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। যার অর্থ কোনো ধরনের রবোটেরা এসে আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। রবোটেরা মানুষকে বিশেষ কিছু করতে পারে না কিন্তু নিচু স্তরের রবোটদের খুব সহজেই জ্যাম করে দিতে পারে। আমি লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। মাথার কাছে রাখা অস্ত্রটি টেনে নিয়ে আমি গড়িয়ে বড় একটা কক্রিটের চাইয়ের পিছনে শুয়ে পড়ি। আমার পায়ের কাছে ইশি শুয়েছিল, আমি চাপা গলায় তাকে ডাকলাম, ইশি–
ইশির ঘুম খুব হালকা, সে সাথে সাথে জেগে বলল, কী হয়েছে কুশান?
মনে হয় গ্রুস্টানের রবোটেরা এসেছে। সবাইকে জাগিয়ে দাও। বল অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকতে।
ইশি গুড়ি মেরে পিছনে সরে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই জেগে উঠে বড় বড় কংক্রিটের চাঁই, ধাতব সিলিন্ডার বা ধসে পড়া দেয়ালের পিছনে আড়াল নেয়। আমি চাপা গলায় বললাম, মনে রেখো সবাই, লক ইন না করে গুলি করবে
আমার কথা শেষ হবার আগেই মাথার উপর দিয়ে শিস দেয়ার মতো শব্দ করে কী একটা উড়ে গেল। পর মুহূর্তে পিছনে একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। সাথে সাথে প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমি আগুনের একটা গরম। হলকা অনুভব করি। উপর থেকে কী একটা জিনিস ভেঙে পড়ে ধুলায় ধূসর হয়ে যায় চারদিক।
আমি অস্ত্রটা তাক করে উবু হয়ে শুয়ে থাকি। আবছা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো কিছু একটা এগিয়ে এল, হাতে একটা ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র। সেটি উপরে তুলে রবোটটি ধাতব গলায় উচ্চৈঃস্বরে বলল, আমি ক্লিও প্রজাতির প্রতিরক্ষা রবোট। ক্রমিক সংখ্যা দুই শ নয়। মহামান্য গ্রুস্টান আমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন। তোমরা মানুষেরা আমার বন্দি। দুই হাত উপরে তুলে এক জন এক জন করে বের হয়ে আস।
রবোটটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি তার আগেই অস্ত্রটি তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলাম। রবোটটির শরীরের উপরের অর্ধেক বাষ্পীভূত হয়ে গেল সাথে সাথে। কোনোকিছু ধ্বংস করার জন্যে বাহাত্তরের এই অস্ত্রটির কোনো তুলনা নেই।
চমৎকার কাজ কুশান!
কথাটি কে বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনও নেই। আমি আমার জায়গাটি থেকে পিছিয়ে সরে যাচ্ছিলাম কিন্তু টের পেলাম ঠিক আমার পিছনে কেউ একজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি! আমি টিয়ারা।
টিয়ারা?
হ্যাঁ কুশান–সে গুড়ি মেরে আমার পাশে এসে হাজির হয়। আবছা অন্ধকারে আমি তার দিকে তাকালাম, ভীতমুখে সে সামনে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে কুশান। ভীষণ ভয় করছে।
আমার বুকের ভিতর হঠাৎ যেন ভালবাসার একটি প্লাবন ঘটে গেল। আমি হাত দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বললাম, তোমার কোনো ভয় নেই টিয়ারা। কোনো ভয় নেই।
টিয়ারা একটি শিশুর মতো আমার গলা জড়িয়ে ধরে মুখে মুখ ঘষে তৃষিতের মতো আমাকে চুম্বন করতে করতে বলল, বল তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। বল।
আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না–
আমার কথা শেষ হবার আগেই মাথার উপর দিয়ে শিসের মতো একটি শব্দ হল এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে ওঠে। আমি মাথা উঁচু করে সামনে তাকালাম। অন্ধকার থেকে সারি বেঁধে রবোটের দল হাজির হচ্ছে। একটি দুটি নয়, অসংখ্য। সবার হাতে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র। রবোটগুলো বৃত্তাকারে আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্ট করছে। কাছাকাছি এগিয়ে আসা একটি রবোট ধাতব গলায় বলল, মহামান্য গ্রুস্টান তোমাদের মৃত কিংবা জীবিত ধরে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন। তোমরা হাত তুলে
অন্য পাশ থেকে কেউ একজন তার এটমিক ব্লাস্টার টেনে ধরে। লেজার রশ্মির নীল আলো দেখা গেল এবং মুহূর্তের মাঝে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে রবোটদের একটা বড় অংশ ভস্মীভূত হয়ে যায়। রবোটগুলো সাথে সাথে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে তাদের অস্ত্র তুলে ধরে গুলি করতে শুরু করে। আমি চিৎকার করে বললাম, সাবধান! কাছে আসতে দিও না।
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো এলাকাটি নারকীয় হয়ে ওঠে। আমি প্রাণপণে গুলি করতে থাকি, রবোটগুলো একটার পর আরেকটা বিধ্বস্ত হতে থাকে কিন্তু তবু তাদের থামিয়ে রাখা যায় না। সেগুলো তবু মাথা উঁচু করে গুলি করতে করতে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মনে হতে থাকে রবোটগুলো যে কোনো মুহূর্তে আমাদের রক্ষণব্যুহ ভেঙে ঢকে যাবে। শুনতে পেলাম ইশি চিৎকার করে বলল, পিছিয়ে যাও–পিছিয়ে যাও সবাই।
টিয়ারা আমার কনুইয়ের কাছে খামচে ধরে, আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, ভয় পেয়ো না টিয়ারা, ভয় পেয়ো না–পিছিয়ে গিয়ে ওই বড় দেয়ালটার পিছনে আড়াল নাও।
তুমি?
আমি আসছি।
টিয়ারা মাটিতে নিচু হয়ে শুয়ে পিছনে সরে যেতে থাকে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে, আমি আগুনের গরম হলকা অনুভব করলাম, বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। উপর থেকে কী যেন ভেঙে পড়ল, চারদিক ধুলায় অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তের জন্যে। আমি মাথা উঁচু করে দেখলাম সবাই গুলি করতে করতে পিছনে সরে যাচ্ছে। আমি নিজেও তখন পিছনে সরে যেতে শুরু করলাম, রবোটগুলো কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদের কয়েকজন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে থাকে, রবোটগুলো অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে ছুটে যাচ্ছে, চিৎকার, চেঁচামেচি, ভয়ঙ্কর শব্দে এখানে হঠাৎ যেন নরক নেমে এল।
আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে সবাই মারা পড়বে। দু এক জনকে রবোটগুলোকে যেভাবে হোক আটকে রাখতে হবে, অন্যেরা যেন পালিয়ে যেতে পারে। পিছনে বাই ভার্বালগুলো আছে সেগুলোতে করে দ্রুত সরে যেতে হবে। আমি ইশিকে সেরকম কিছু বলার জন্যে মাথা উঁচু করেছি ঠিক তখন রবোটগুলো তাদের অস্ত্র নামিয়ে নিল। গোলাগুলি থেমে গেল হঠাৎ এবং আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম রবোটগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই বাই ভার্বালের শব্দ শুনতে পেলাম, সত্যি সত্যি সেগুলো দিয়ে তারা ফিরে যেতে শুরু করেছে।
আমরা ধীরে ধীরে আড়াল থেকে বের হয়ে আসি। ধুলায় ধূসর হয়ে আছে একেকজন, ভালো করে না তাকালে চেনা যায় না। ক্লডের কপালের কাছে কোথায় কেটে গেছে, রক্তে মুখ মাখামাখি হয়ে আছে। দ্রুনকে দেখতে পেলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে মুখ বিকৃত করে। মাটিতে বসে পড়ল। ইশি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা আমাদের! সবাই কি ঠিক আছে?
আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম আমাদের মাঝে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মারা গেছে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে এক জন এক জন করে সবাই বের হয়ে আসতে থাকে। কারো হাতপা বা মাথা কেটে রক্ত বের হচ্ছে, কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে
কিন্তু সবাই যে বেঁচে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবার চোখেমুখে এক ধরনের অবিশ্বাস্য আতঙ্ক, মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা এখনো যেন বুঝে উঠতে পারছে না। ইশি আবার জিজ্ঞেস করল, সবাই কি ঠিক আছে?
ক্লড তার কপালের ক্ষতটি হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, মনে হয়। ছোটখাটো আঘাত আছে, কিন্তু বড় আঘাত মনে হয় নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না এটা অবিশ্বাস্য নয়। এর পিছনে কারণ আছে। কী কারণ?
আমরা গেটওয়ে কম্পিউটারকে ঘিরে ছিলাম, সে জন্যে সোজাসুজি আমাদের দিকে গুলি করে নি। এই রবোটগুলোর জন্যে সোজাসুজি গুলি করে আমাদের বাতাসে মিশিয়ে দেয়া খুব কঠিন না। তার মানে এই কম্পিউটারটা গ্রুস্টানের জন্যে মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মনে হয়।
ইশি আবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই কি সত্যিই এখানে আছে? নাইনা কোথায়?
অন্ধকার এক কোনা থেকে বলল, এই যে এখানে।
রাইনুক?
এই যে
এলুজ?
এই যে–
ক্লড হঠাৎ যন্ত্রণার মতো একটু শব্দ করে বলল কপালের কাটাটা থেকে রক্ত বন্ধ করতে পারছি না। টিয়ারা একটু দেখবে—
কেউ কোনো কথা বলল না। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বললাম, টিয়ারা? টিয়ারা কোথায়?
সবাই চারদিকে ঘুরে তাকাল। কোথাও নেই টিয়ারা। একসাথে অনেকে চিৎকার করে ওঠে, টিয়ারা! টিয়ারা!
কেউ কোনো উত্তর দিল না। ভয়ঙ্কর একটা নৈঃশব্দ্য নেমে আসে হঠাৎ, আমি বুকের ভিতরে আশ্চর্য এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। আমি প্রায় হাহাকারের মতো করে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ক্রিশি একটু নড়ে উঠে–আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মহামান্য কুশান। একটা খুব জরুরি ব্যাপার।
কী?
মহামান্য টিয়ারাকে রবোটের দল ধরে নিয়ে গেছে গ্রুস্টানের কাছে। আর কয়েক মিনিটের মাঝেই তারা বসতিতে পৌঁছে যাবে। গ্রুস্টান সেখানে অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
আমার হঠাৎ মনে হল আমি বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। আমি এক পা পিছিয়ে এসে একটা দেয়াল স্পর্শ করে সাবধানে মাটিতে বসে পড়ি। আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না, আশপাশে সবাই উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না। আমার বুকের মাঝে এক ভয়ঙ্কর ক্রোধ আর তীব্র হতাশা জমে উঠতে থাকে। ইচ্ছে করতে থাকে ভয়ঙ্কর এক চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিই।
কুঁই কুঁই শব্দ করে কুকুরের বাচ্চাটি তখনো আমাদের পায়ের কাছে শুকতে শুকতে ঘোরাঘুরি করছে। আমি তার ভাষা জানি না কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না সে টিয়ারাকে খুঁজছে।
.
খুব ধীরে ধীরে যখন আকাশ ফরসা হয়ে ভোর হয়ে এল আমরা তখনো চুপচাপ কম্পিউটার ঘরে বসে আছি। কেউ বিশেষ কথা বলছে না শুধুমাত্র কুকুরের বাচ্চাটি তখনো ইতস্তত ঘুরে ঘুরে টিয়ারাকে খুঁজে যাচ্ছে। ইশি খানিকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ উপরে তুলে বলল, আমরা টিয়ারাকে কেমন করে উদ্ধার করব?
কেউ কোনো কথা বলল না, কিন্তু সবাই মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালাম। আমার মাথার মাঝে মনে হয় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে, আমি ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছি না।
ইশি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কুশান, আমরা টিয়ারাকে কেমন করে উদ্ধার করব?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, এতক্ষণে টিয়ারাকে নিশ্চয়ই সিলাকিত করা হয়ে গেছে। তাকে উদ্ধার করার সত্যি কোনো উপায় আছে কি না আমি জানি না।
সবাই চুপ করে বসে রইল। দীর্ঘ সময় ইতস্তত করে নাইনা বলল, কিন্তু আমরা কিছু করব না?
আমি কিছু না বলে নাইনার দিকে তাকালাম, নাইনা সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলে। রাইনুক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যদি কিছু করতে চাই তাহলে এই মুহূর্তে এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে। গ্রুস্টান জানে আমরা এখানে
ইশি বলল, কিন্তু জায়গাটা মনে হয় নিরাপদ। কুশান মনে হয় ঠিকই বলেছে, এই গেটওয়ে কম্পিউটারের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্যে আমাদের উপর সোজাসুজি আঘাত করবে না।
রাইনুক একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু এইভাবে নিজেদের একটা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তৈরি করে বসে থাকব কেন? কী আছে এখানে?
ক্লড তার কপালের ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমার মনে হয় এই কম্পিউটারের মেমোরিতে কিছু অমূল্য তথ্য আছে। গ্রুস্টান সেজন্যেই এভাবে এটাকে আগলে রাখছে।
কিন্তু আমরা সেই তথ্য বের করতে পারছি না, দুই সপ্তাহ হয়ে গেল–
আমি ক্লডের দিকে তাকিয়ে বললাম, ক্লড।
বল কুশান
তুমি এতদিন খুব সাবধানে এই গেটওয়ে কম্পিউটারের মেমোরি থেকে কিছু তথ্য বের করতে চাইছিলে যেন গ্রুস্টান জানতে না পারে। এখন গ্রুস্টান জেনে গেছে। আমরা যে এখানে আছি সেটা আর গোপন নেই। তুমি কি এখন সোজাসুজি কোয়ার্টজ ফাইবার কেটে বা অন্য কোনোভাবে খুব তাড়াতাড়ি কিছু তথ্য বের করতে পারবে?
ক্লড মাথা নেড়ে বলল, গত দুই সপ্তাহে যেটা পারি নি দুই ঘণ্টায় সেটা বের করতে পারব।
তুমি কতটুকু নিশ্চিত?
একজন মানুষের পক্ষে যেটুকু নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
চমৎকার। তুমি তাহলে কাজ শুরু করে দাও। তথ্যটুকু বের করার সাথে সাথে তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সবাই আমার দিকে তাকাল। ইশি মৃদু স্বরে বলল, কুশান তুমি “আমরা সবাই” না বলে “তোমরা সবাই” কেন বলছ? তুমি কী করবে?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি জানি না, ইশি
এখন কি আমাদের সবার একসাথে থাকা উচিত না?
আমি জানি না। আমি খানিকক্ষণ ইশির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তোমরা যদি কিছু মনে না কর, আমি খানিকক্ষণ একা থাকতে চাই।
ইশি বলল, ঠিক আছে কুশান।
আমি কম্পিউটার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে তখন অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করছে। ভোরের এই আলোতে পৃথিবীর সবকিছু অপূর্ব মনে হয় কিন্তু আজ কিছুই আমার চোখে পড়ছে না।
.
সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে উঠেছে, চারদিক ভয়ঙ্কর গরমে ধিকিধিকি করে জ্বলছে, ঠিক সেরকম সময়ে হঠাৎ নাইনা ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এল। অনেক দূর দৌড়ে এসেছে তাই তখনো হাঁপাচ্ছে, কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে। কথা বলতে পারছে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে নাইনা?
নাইনা বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বলল, টিয়ারা টিয়ারা–
কী হয়েছে টিয়ারার?
দেখা যাচ্ছে টিয়ারাকে। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে—
দেখা যাচ্ছে? টিয়ারাকে?
হ্যাঁ। নাইনা মাথা নেড়ে বলল, গ্রুস্টানের সাথে।
আমি আর কোনো কথা না বলে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকি। নাইনা আমার পিছু পিছু আসতে থাকে।
আমাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়াল, আমি পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। দেয়ালে বড় হলোগ্রাফিক স্ক্রিন, সেখানে টিয়ারার প্রতিচ্ছবি। এত জীবন্ত যে দেখে মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছে করলে তাকে স্পর্শ করতে পারব। টিয়ারা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, তার দুই চোখে এক ধরনের আতঙ্ক। হঠাৎ সে কী একটা দেখে চমকে উঠে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল, ভয় পেয়েছে সে। কী দেখে ভয় পেয়েছে?
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি, স্ক্রিনে হঠাৎ গ্রুস্টানের চেহারা ভেসে আসে। ভয়ঙ্কর ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। তার সমস্ত মুখ মনে হয় খুলে খুলে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে, তার চাপা গলার স্বর হঠাৎ হিসহিস করে ওঠে, তুমি ভেবেছ আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? অর্বাচীন নির্বোধ মেয়ে।
টিয়ারা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যায়, সে মাথা নাড়তে থাকে, তারপর হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়।
গ্রুস্টান হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, তোমাকে আমি যেভাবে ধরে এনেছি ঠিক সেভাবে আমি এক জন এক জন করে তোমাদের সবাইকে ধরে আনব। সবাইকে। আমি জানি তারা কোথায়। মানুষের সভ্যতার বিরুদ্ধে তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেব আমি নিষ্ঠুর হাতে। তোমার সিলাকিত শরীর আমি বাচিয়ে রাখব লক্ষ লক্ষ বছর। তোমার মস্তিষ্কে দেয়া হবে অচিন্তনীয় যন্ত্রণা। ভয়ঙ্কর অভিশাপের মতো তুমি ধুকে ধুকে বেঁচে থাকবে, তার থেকে কোনো মুক্তি নেই। নির্বোধ মেয়ে তোমার কোনো মুক্তি নেই।
গ্রুস্টান হঠাৎ এগিয়ে এসে হাত ঘুরিয়ে আঘাত করে টিয়ারাকে। সে ছিটকে পড়ে মাটিতে, অনেক কষ্টে মুখ তুলে তাকায়, হঠাৎ মনে হয় সে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কী কাতর সেই দৃষ্টি! আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, একটা আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
দ্রুন আমার হাত স্পর্শ করে বলল, কুশান এটি সত্যি নয়। এগুলো সব কৃত্রিম প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু টিয়ারার কষ্টটা তো সত্যি। সত্যি না?
দ্রুন কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কেউ একজন এই স্ক্রিনটা বন্ধ করে দেবে?
ক্লড হাত বাড়িয়ে কী একটা স্পর্শ করতেই পুরো হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। আমি কয়েক পা পিছনে সরে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকি এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমার কী করতে হবে। আমি সাথে সাথে চোখ খুলে তাকালাম। আমাকে ঘিরে বিষণ্ণ মুখে পাথরের মতো সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার সবার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে আনি, তারপর কষ্ট করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে এনে বললাম, আমাকে গ্রুস্টানের কাছে যেতে হবে।
সবাই চমকে ওঠে। দেখে মনে হল আমি কী বলছি কেউ ঠিক বুঝতে পারে নি। নাইনা ইতস্তত করে বলল, তু–তুমি কী বলছ?
আমি বলেছি আমাকে গ্রুস্টানের কাছে যেতে হবে।
কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলব না। ইশি কয়েকবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে যায়। ঠিক কী বলবে মনে বুঝতে পারছে না। রাইনুক শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে বলল, তুমি সত্যি যেতে চাও?
হ্যাঁ। আমি সত্যি যেতে চাই।
নাইনা প্রায় আর্ত স্বরে বলল, কেন? তুমি কেন যেতে চাও?
আমি টিয়ারাকে রক্ষা করতে চাই। তাকে কথা দিয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি গ্রুস্টানের কাছে গিয়ে কেমন করে তাকে রক্ষা করবে? সেটা কি খুব বড় নির্বুদ্ধিতা হবে না? আবেগপ্রবণ হয়ে তো লাভ নেই–
আমাকে তোমরা বাধা দিও না। একবার চেষ্টা করতে দাও।
তুমি কেমন করে চেষ্টা করবে?
ইশি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কেমন করে চেষ্টা করবে?
আমি জানি না।
জান না?
না। যদি আর কিছু না হয় আমি টিয়ারার কাছাকাছি থাকব।
কিন্তু টিয়ারাকে সিলাকিত করে রাখা হয়েছে।
আমাকেও সিলাকিত করবে। আমার সাথে টিয়ারার দেখা হবে সিলাকিত জগতে
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে থাকা সবাই কেমন জানি শিউরে ওঠে। আমি জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে নরম গলায় বললাম, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যাবার আগে তোমাদের একটা দায়িত্ব দিতে চাই।
কী দায়িত্ব?
ক্লড–তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৃথিবীর সব কম্পিউটারের অবস্থান, তাদের মাঝে যোগসূত্র সবকিছু বের করে এনেছ?
ক্লড মাথা নাড়ল। পকেট থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক বের করে বলল, এই যে, এখানে সব আছে। দেখ–
না, আমি দেখতে চাই না। আমি এসবের কিছুই এখন জানতে চাই না। গ্রুস্টান নিশ্চয়ই আমাকে সিলাকিত করবে, আমার মস্তিষ্কে যা আছে সব সে জেনে যাবে।
ক্লড ডিস্কটি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, আমি এখন অন্য কিছু জানতে চাই না, কিন্তু একটি জিনিস আমাকে জানতে হবে। আমাকে সেটা বলবে–
কী জিনিস?
এই ভূখণ্ডের সবগুলো কম্পিউটারের অবস্থান আর তাদের যোগসূত্রগুলো যদি দেখ, আমি নিশ্চিত কয়েকটা যোগসূত্র খুব সুচিন্তিতভাবে কেটে দিতে পারলে পুরো নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করে ফেলা যাবে।
হ্যাঁ। ক্লড মাথা নেড়ে বলল, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে যে কয়েকটি যোগসূত্র চলে গেছে সেগুলো কেটে দিলে বলা যায় পুরো নেটওয়ার্ক দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।
চমৎকার। তোমরা এখন ইচ্ছে করলে এই যোগসূত্রগুলো কেটে নেটওয়ার্কটি দুই ভাগে ভাগ করতে পারবে?
ক্লড ইশির দিকে তাকাল। ইশি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, পারব।
তোমাদের কতক্ষণ সময় লাগবে?
ভালো কিছু বাই ভার্বাল পেয়েছি। যোগসূত্রগুলোর নিখুঁত অবস্থানও জানি, চেষ্টা করলে আট কি দশ ঘণ্টার মাঝে করা যাঝে মনে হয়। নাইনা তুমি কী বল?
নাইনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ এর বেশি সময় লাগার কথা নয়।
চমৎকার। আমি ক্লডের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার এই যোগসূত্রগুলোর অবস্থান জানা দরকার।
কিন্তু সেটা কি খুব বিপজ্জনক কিছু তথ্য নয়? তুমি সত্যি জানতে চাও? তথ্যটি মনে রাখাও সহজ নয়। সমুদ্রোপকূলে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মাটির নিচে গভীরতা কোয়ার্টজ ফাইবার কেবলের ক্রমিক সংখ্যা অসংখ্য সংখ্যা পরিমাপ
তা ঠিক, আমি মাথা নাড়ি। আমি মনে রাখতে পারব না–কিন্তু তথ্যটা আমার প্রয়োজন, তুমি ক্রিশির কপোট্রনে সেটা প্রবেশ করিয়ে দাও।
ক্রিশি?
হা ক্রিশি। ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন স্তরের কম্পিউটার, তার কপোট্রনের তথ্যে গ্রুস্টানের কোনো কৌতূহল নেই। আমি তার কপোট্রনে করে তথ্যটি নিয়ে যাব।
ক্লড কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, ঠিক আছে কুশান।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি এখন যাব।
কেউ কোনো কথা বলল না। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, আমি যাবার পর তোমরা তোমাদের কাজ শুরু করতে পার। প্রথমে নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করবে। তারপর সেটিকে আরো দু ভাগ। আমরা যেভাবে ঠিক করেছিলাম।
ক্লড মাথা নাড়ল।
আমি একটু এগিয়ে যেতেই ইশি ডাকল, কুশান।
বল।
আমি জানি না তুমি কেন এটা করছ। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে যে এটি আত্মহত্যা নয়, এটি আরো কিছু।
আমি কিছু না বলে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
আমাদের কি আবার দেখা হবে কুশান?
সেটা কি সত্যি জানার প্রয়োজন আছে?
ইশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না, নেই।
আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কী বলব বুঝতে পারি না। রাইনুক আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার মাঝে মাঝে একটা কথা মনে পড়ে।
কী কথা?
তুমি প্রথম যেদিন গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলে, লিয়ানা বলেছিল পাহাড়ের উপর থেকে একটা পাথর গড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, লিয়ানা বলেছিল পাথরটা গড়িয়ে পড়তে পড়তে ধস নামিয়ে দেবে না ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে কেউ জানে না।
রাইনুক নরম গলায় বলল, আমরা জানি একটা ধস নেমে আসছে। কিন্তু সেই ছোট পাথরটাকে আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখতে চাই না।
ছোট পাথরটার কোনো গুরুত্ব নেই রাইনুক। কোনো গুরুত্ব নেই। বড় কথা ধস নেমেছে। সেটা কেউ থামাতে পারবে না
আমি যখন বাই ভার্বালে দাঁড়িয়ে ক্রিশিকে সেটা চালু করার আদেশ দিয়েছি তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম দূর থেকে দ্রুন হাতে কয়েকটা ছবি নিয়ে ছুটে আসছে। আমি ক্রিশিকে থামতে বললাম, কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই দ্রুন আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে দ্রুন?
তুমি এই ছবিগুলো দেখ।
কিসের ছবি?
কম্পিউটারের মেমোরি থেকে বের করেছি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার আগে বড় বড় নগরের ছবি।
এই ধরনের ছবি দেখলে বুকে এক ধরনের কষ্ট হয় কিন্তু সেগুলো এভাবে ছুটে এসে আমাকে কেন দেখানো হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি দ্রুনের দিকে তাকাতেই দ্রুন আমার হাতে আরো অনেকগুলো ছবি ধরিয়ে দিল, একই নগরের ছবি কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবার পর। এই ছবিগুলো দেখলে বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের ক্রোধের জন্ম হয়। আমি খানিকক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থেকে বললাম, দ্রুন এই ছবিগুলো তুমি আমাকে কেন দেখাচ্ছ?
তুমি ছবিগুলো কবে তোলা হয়েছে সেই তারিখটি দেখ।
আমি তারিখ দেখে চমকে উঠি, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার দুই বছর আগের ছবি! দ্রুনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কেমন করে হয়?
আমি জানি না কেমন করে হয়, কিন্তু হয়েছে। এগুলো কাল্পনিক ছবি, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পর কেমন দেখাবে তার ছবি।
তার মানে?
তার মানে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অনেক আগেই গ্রুস্টান জানত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিন্তু কেমন করে জানল সে? কেমন করে জানল ভবিষ্যতে কী হবে?
ইশি এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, ভবিষ্যতে কী হবে সেটি জানার একটি মাত্র উপায়।
কী?
সেই ভবিষ্যতটি যদি নিজের হাতে তৈরি করা হয়।
আমি চমকে ইশির দিকে তাকালাম, তুমি কী বলতে চাইছ ইশি?
আমি নিঃসন্দেহ কুশান। মানুষ এই পৃথিবী ধ্বংস করে নি, এই পৃথিবী ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান।
১০. বাই ভার্বালটি তীক্ষ্ণ শব্দ
বাই ভার্বালটি তীক্ষ্ণ শব্দ করে বসতিটির উপর দিয়ে একবার ঘুরে যায়। আমি দেখতে পাই বেশ কিছু মানুষ খোলা জায়গাটিতে জড়ো হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আমাকে লক্ষ করছে। আমি বাই ভার্বালটিকে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনতেই অনেক মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের চোখে এক ধরনের অবিশ্বাস্য বিস্ময়। আমি এবং আমার পিছু পিছু ক্রিশি বাই ভার্বাল থেকে নিচে নেমে এলাম লোকগুলো সাথে সাথে এক পা পিছিয়ে যায় তাদের চোখে হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করেছে।
আমি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমার নাম কুশান।
আমাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আবার সহজ গলায় বললাম, আমি এসেছি টিয়ারাকে উদ্ধার করতে।
মানুষগুলো চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, পারব কি না জানি না। কিন্তু চেষ্টা তো করে দেখতে হবে। কী বল?
কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু কমবয়সী একজন ছেলে উৎসাহে চোখ উজ্জ্বল করে মাথা নাড়তে থাকে। ঘিরে থাকা মানুষগুলোর মাঝে থেকে অসুখী চেহারার একজন মানুষ। হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, তুমি কেমন করে টিয়ারাকে উদ্ধার করবে? তাকে সিলাকিত করে রাখা হয়েছে।
আমি জানি।
তা হলে? তুমি কেমন করে উদ্ধার করবে?
আমি এখনো জানি না।
লোকটি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সমস্ত সর্বনাশের মূল। টিয়ারা আমাকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে বলেছিল। আমরা ভ্রূণ ব্যাংক থেকে একটা শিশু নিতে পারতাম। তোমার জন্যে সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। তোমার জন্যে।
আমার জন্যে?
হ্যাঁ।
লোকটি, যার নাম নিশ্চয়ই ক্লিচি–গলা উঁচু করে বলল, তোমাকে আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা।
তুমি যদি সত্যি কাউকে ঘৃণা করতে চাও তাহলে সেটা হওয়া উচিত গ্রুস্টান। এই পৃথিবী ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান তুমি সেটা জান?
আমার কথা শেষ হবার আগেই আমি দেখতে পেলাম দুজন প্রতিরক্ষা রবোট আমার দিকে ছুটে আসছে। আমাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিল।
একটি রবোট আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য কুশান, আমরা আপনাকে নিতে এসেছি।
কোথায়?
মহামান্য গ্রুস্টানের কাছে।
আমাকে একটু সময় দাও, আমি কথা বলছি।
আমরা খুব দুঃখিত। আপনাকে এই মুহূর্তে নিয়ে যাওয়ার কথা।
আমি পিছনে ফিরে তাকালাম এবং কিছু বোঝার আগেই ঘাড়ের কাছে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করি। জ্ঞান হারানোর আগে দেখতে পাই ক্রিশি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আমি যখন চোখ খুলে তাকালাম তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকার এত ভয়ঙ্কর যে আমি বেশিক্ষণ চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে পারি না। এক সময় চোখ বন্ধ করে ফেলি। চারদিকে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য। এই ধরনের নৈঃশব্দ্য আমি আগে কখনো অনুভব করি নি, আমি আমার নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাই না। আমি কান পেতে থেকেও আমার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাই না। আমি কি বেঁচে আছি?
আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম, কী ভয়ঙ্কর অন্ধকার। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। একটু আলোর জন্যে আমার সমস্ত চেতনা যেন বুভুক্ষু হয়ে থাকে, কিন্তু কোথাও কোনো আলো নেই। শুধু অন্ধকার, কঠিন নিষ্করুণ অন্ধকার। আমি হাত দিয়ে নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি কিন্তু নিজেকে খুঁজে পাই না। কোথায় আমার দেহ? আমার হাত পা মুখ? কোথায় আমার চোখ? আমার নাক কান বুক? আমি কোথায়? ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো এক ধরনের আতঙ্কে আমার চেতনা শিউরে শিউরে ওঠে, আমি চিৎকার করে উঠতে চাই কিন্তু কোথাও এতটুকু শব্দ হয় না। এই তাহলে সিলাকিত? আমি আছি কিন্তু আমি নেই? অস্তিত্বহীন একজন মানুষ? শুধু তার অনুভূতি? তার যন্ত্রণা? কতকাল আমাকে এভাবে থাকতে হবে? কতকাল?
আমি অন্ধকারে অস্তিত্বহীন হয়ে এক বিচিত্র শূন্যতায় ভেসে থাকি। সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। কতকাল কেটে যায় আমি জানি না। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার অনুভূতি নেই, শুধু এক বিশাল শূন্যতা। এক সময় সেই শূন্যতাও যেন অন্য এক শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে থাকে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে চাই কিন্তু ধরে রাখতে পারি না, এক অন্ধকার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকি।
খুব ধীরে ধীরে আবার আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমার চোখ খুলতে ভয় হয় আবার যদি সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলে? আমি হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ শুনতে পেলাম, আমার নিশ্বাসের শব্দ। আমি তাহলে বেঁচে আছি? আমি চোখ খুলে তাকালাম, চারদিকে খুব হালকা বেগুনি রঙের একটা আলো। আমি নিজের দিকে তাকালাম, এই তো আমার শরীর। আমার হাত পা দেহ। আমার মুখ। আমার চোখ কান চুল।
আমি নিজেকে স্পর্শ করি, সাথে সাথে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। এটি আমার শরীর নয়। আমি আবার ভালো করে তাকালাম এটি আমার সিলাকিত দেহ। আমার মস্তিষ্কের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করা এক কাল্পনিক অবয়ব। আমি চারদিকে ঘুরে তাকাই কোথাও কেউ নেই। গ্রুস্টানের কাল্পনিক জগতে আমি একা।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, কী বিচিত্র অনুভূতি, মনে হয় মহাকাশে ভেসে আছি। আমি আছি কিন্তু তবু আমি নেই। আমি নিচু গলায় ডাকলাম, কে আছ এখানে?
আমার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল, কিন্তু কেউ উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম, কে আছ?
খুব কাছে থেকে কে যেন বলল, কী চাও তুমি?
আমি চমকে উঠি, কে?
আমি। আমি গ্রুস্টান।
তুমি কোথায়?
আমি সর্বত্র। তোমার চারপাশে। তোমার ভিতরে।
আমি তোমাকে দেখতে চাই।
কেন?
কাউকে না দেখে আমি তার সাথে কথা বলে পারি না। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
তুমি আমার সাথে কী কথা বলবে? আমি তোমার মস্তিষ্কের সব তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারি। তুমি কী ভাবছ আমি সব জেনে নিতে পারি।
কিন্তু আমি নিজে থেকে তোমাকে বলতে চাই।
কী বলতে চাও?
খুব জরুরি একটা কথা বলতে চাই। আমি তাই নিজে থেকে তোমার কাছে এসেছি।
বল।
তার আগে আমি তোমাকে দেখতে চাই। তুমি আমার সামনে দেখা দাও।
খুব ধীরে ধীরে গ্রুস্টানের চেহারা সৃষ্টি হতে থাকে। হালকা সবুজ রঙের দেহ একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কোমল এবং নিষ্ঠুর। গ্রুস্টান আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
এখন দিন না রাত?
রাত। কেন?
তুমি কখন আমাকে সিলাকিত করেছ? দশ ঘণ্টা কি হয়ে গেছে?
এখনো হয় নি। কেন?
তুমি আমার মস্তিষ্কের তথ্যে উঁকি দিলে জানতে। দশ ঘণ্টার মাঝে তোমার ক্ষমতাকে আমরা অর্ধেক করে দেব।
গ্রুস্টান কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই সে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে দেখছে। দেখতে দেখতে তার চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তার সমস্ত দেহ লাল হয়ে কুৎসিত একটি রূপ নিয়ে নেয়। সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে, প্রচও যন্ত্রণায়। আমি ছিটকে পড়ি। এটি শারীরিক যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণার অনুভূতি। শরীরকে পাশ কাটিয়ে মস্তিষ্কে দেয়া যন্ত্রণার এক তীব্র অনুভূতি। গ্রুস্টান আমার কাছে ঝুঁকে পড়ে হিসহিস করে বলল, নির্বোধ মানুষ! আমার ক্ষমতা অর্ধেক করে দেয়া হলে কী হবে জান? তোমার অস্তিত্ব ধ্বংস হবে সবার আগে। তুমি বেঁচে আছ কারণ আমি বেঁচে আছি। আমার অস্তিত্বে আঘাত করে তুমি বেঁচে থাকবে না। গ্রুস্টান আমার দিকে এগিয়ে আসে আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। গ্রুস্টানের সমস্ত দেহ যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে থাকে। ভয়ঙ্কর চিৎকার করে সে তার নিজেকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই যেন আর স্থির হয়ে থাকতে চায় না।
আমি হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক প্রচণ্ড চাপ অনুভব করি। আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে, আমার সিলাকিত দেহ থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তোমার নেটওয়ার্ক দু ভাগে ভাগ করে ফেলেছে গ্রুস্টান। তুমি আর কোনোদিন তোমার আগের ক্ষমতা ফিরে পাবে না–
আমি কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণায় এক অন্ধকার জগতে তলিয়ে গেলাম। আমার সিলাকিত দেহ কি গ্রুস্টান বাঁচাতে পারবে? আমি জানি না। আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি। কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।
এটাই কি মৃত্যু?
.
তারপর কতকাল কেটে গেছে জানি না। হয়তো কয়েক মুহূর্ত, হয়তো কয়েক যুগ। আমি চোখ মেলে তাকালাম, চারদিকে একটা নীল জলো। খুব ভোরবেলা যেরকম আলো হয় অনেকটা সেরকম। আমি কান পেতে থাকি কাঁথাও কেউ একজন কাঁদছে। ব্যাকুল হয়ে কান্না নয়, কেমন জানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কৃামাই শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি এক ধরনের কষ্ট হয়।
আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, চারদিকে বিশাল নিঃসীম শূন্যতা। যতদূর চোখ যায়। কোথাও কিছু নেই। আমি আমার নিজের দিকে তাকালাম, এই তো আমার শরীর। হাত পা মুখ। আমি আবার নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। কী বিচিত্র এক অনুভূতি, আমার নিজের শরীর তবু মনে হয় নিজের নয়।
আমি আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। কী বিষণ্ণ করুণ কান্নার স্বর! কোথা থেকে আসে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলে আমি বুঝি ভেসে যাব। আমার সামনে কিছু নেই পিছনে কিছু নেই। আমার নিচে কিছু নেই উপরে কিছু নেই। চারদিকে শুধু খুব হালকা। একটা নীল আলো। আমি আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। সামনে থেকে আসছে। আমি সেদিকে হাঁটতে চেষ্টা করে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, আমার পায়ে কোনো জোর নেই। আমি অতলে পড়ে যেতে থাকি, হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোথাও কিছু নেই। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না, পড়ে যেতে থাকি। কতক্ষণ কেটে যায় এভাবে আমি জানি না। আমি কি সত্যিই পড়ে যাচ্ছি নাকি সবই আমার কল্পনা?
আমি আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল এক শূন্যতায় আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, আবার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মনে হয় খুব কাছে কেউ কাঁদছে। আমি কান্নার শব্দের দিকে নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকি।
আমি কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না। শুরু নেই শেষ নেই এক আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায়। সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ স্পষ্ট হতে থাকে, বহুদূরে একটি ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে। দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে কাঁদছে। বাতাসে তার কালো চুল উড়ছে, সাদা কাপড় উড়ছে। দুঃখের কী আশ্চর্য একটি প্রতিমূর্তি।
আমি হেঁটে কাছে যেতেই ছায়ামূর্তিটি আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল টিয়ারা।
টিয়ারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কুশান তুমি?
হ্যাঁ। আমি।
তোমাকেও গ্রুস্টান ধরে এনেছে?
না টিয়ারা, আমাকে গ্রুস্টান ধরে আনে নি।
তাহলে তুমি এখানে কেন এসেছ?
আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
নিয়ে যেতে এসেছ?
হা টিয়ারা।
তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? কেমন করে নিয়ে যাবে? আমরা সিলাকিত হয়ে আছি।
আমি জানি।
তুমি সত্যিকারের কুশান নও। আমি সত্যিকারের টিয়ারা নই। এগুলো সব গ্রুস্টানের তৈরী প্রতিচ্ছবি। এখানে কিছু সত্যি নয়। সব মিথ্যা। সব কাল্পনিক।
হা টিয়ারা। শুধু কষ্টটা সত্যি।
কী কষ্ট কুশান কী ভয়ঙ্কর কষ্ট!
আমি তোমার কষ্ট দূর করে দেব। তুমি আমার কাছে এস। এস।
টিয়ারা হঠাৎ এক পা পিছিয়ে গিয়ে আর্তগলায় বলল, না।
কেন নয়?
ভয় করে। আমার ভয় করে। আমি যদি তোমাকে ছুঁয়ে দেখি তুমি নেই? তুমি যদি হারিয়ে যাও?
আমি হারিয়ে যাব না। আমি টিয়ারার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমি যদি হারিয়ে যাই তাহলে আবার আমি তোমাকে খুঁজে বের করব। এস আমার কাছে এস।
না কুশান না। আমার ভয় করে। খুব ভয় করে।
তোমার ভয় নেই টিয়ারা, আমি তোমাকে রক্ষা করব।
না কুশান কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না, কেউ না।
মনে নেই আগে আমি তোমাকে রক্ষা করেছি? আবার আমি তোমাকে রক্ষা করব।
হঠাৎ খনখনে গলায় খুব কাছে থেকে কে যেন হেসে উঠল। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। কেউ নেই কোথাও, চারদিকে শুধু হালকা নীল আলো। আমি বললাম, কে?
খনখনে গলায় আবার হাসির শব্দ ভেসে আসে।
কে? কে হাসে?
টিয়ারা হঠাৎ ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরে ভয় পাওয়া গলায় বলল, গ্রুস্টান!
আমি টিয়ারাকে ধরে রেখে আবার চারদিকে তাকালাম, গ্রুস্টান তুমি কোথায়? তুমি কী চাও?
আমি কিছু চাই না।
গ্রুস্টান আমি তোমাকে দেখতে চাই।
কেন?
তোমার ক্ষমতা কেড়ে নেবার পর তুমি দেখতে কেমন হয়েছ আমি দেখতে চাই।
সাথে সাথে আমার সামনে গ্রুস্টানের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। হালকা সবুজ রঙের সুদর্শন একটি মূর্তি। একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কোমল এবং কঠোর।
আমি কয়েক মুহূর্ত গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তুমি দেখতে ঠিক আগের মতোই আছ।
হ্যাঁ। আমার ক্ষমতাও ঠিক আগের মতো আছে।
কিন্তু তোমার বিশাল নেটওয়ার্ক ছিল সেটি দু ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। এখন তোমার ক্ষমতা আর আগের মতো নেই। অনেক কম। তুমি দুর্বল।
গ্রুস্টান আবার খনখন করে হেসে উঠে বলল, সূর্যকে দ্বিধাবিভক্ত করা হলে তার ঔজ্জ্বল্য কমে যায় না। পৃথিবীর জন্যে, পৃথিবীর মানুষের জন্যে আমার ক্ষমতা এতটুকু কমে নি। আমার যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে সেটি পৃথিবীর জন্যে যথেষ্ট। আমার প্রকৃত ক্ষমতার এক শতাংশ দিয়ে বিশ্বজগৎ ধ্বংস করে দেয়া যায়।
আমি জানি
তাহলে কেন তোমরা মিছিমিছি শক্তি ক্ষয় করছ? তোমরা জান না এখন আমি আমার রবোট বাহিনী পাঠিয়ে তোমাদের এক জন এক জন করে ধরে আনব?
জানি।
তোমরা কি জান না আমার নেটওয়ার্কে তোমরা আর স্পর্শ করতে পারবে না?
জানি। আমি খানিকক্ষণ গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললাম, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
গ্রুস্টান কোনো কথা না বলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, তুমি কয়েক লক্ষ কম্পিউটারের একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। নেটওয়ার্ক অর্ধেক করে দেয়ার পর তোমাকে নূতন করে নিজেকে দাঁড় করাতে হয়েছে। এই ভূখণ্ডের এই নেটওয়ার্কে তুমি যেরকম গ্রুস্টান, অন্য ভূখণ্ডের বাকি নেটওয়ার্কে ঠিক সেরকম আরেকজন গ্রুস্টান কি তৈরি হয় নি?
গ্রুস্টান কোনো কথা বলল না কিন্তু ভয়ঙ্কর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি বললাম, তুমি বলতে চাইছ না কিন্তু আমি জানি। ঠিক তোমাকে আমি যেরকম দেখছি এ রকম আরো একজন গ্রুস্টানের জন্ম হয়েছে এখন। বাকি অর্ধেক নেটওয়ার্কে তার অস্তিত্ব। ঠিক তোমার মতো একজন গ্রুস্টান।
তুমি কী বলতে চাইছ কুশান?
সেই গ্রুস্টান ঠিক তোমার মতো শক্তিশালী। ঠিক তোমার মতো নৃশংস তোমার মতো হৃদয়হীন। তোমার মতো কুটিল কুচক্রী–
চুপ কর কুশান! চুপ কর—
যত সময় যাচ্ছে তোমরা দুই গ্রুস্টান তত ভিন্ন হয়ে যাচ্ছ। বিশেষ করে তুমি।
আমি কী?
গেটওয়ে কম্পিউটারের মেমোরি থেকে আমি খুব আশ্চর্য কিছু ছবি এনেছি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার ছবি কিন্তু সেগুলো তৈরি হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের আগে। আমি ছবিগুলো আমার বাই ভার্বালে রেখে এসেছিলাম এতক্ষণে সেগুলো এই বসতির সব মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই জান তার মানে কী? জান নিশ্চয়ই
গ্রুস্টান ভয়ঙ্কর গর্জন করে আমার দিকে এগিয়ে আসে, চিৎকার করে বলে, মিথ্যাবাদী—
হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ, মিথ্যাবাদী। আমি যদি না হই তাহলে তুমি। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। অনেক মানুষ যখন একটা মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে তখন সেই মিথ্যাটাই সত্যি হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত এই বসতির মানুষ সেই মিথ্যা কথাটিই বিশ্বাস করবে। একটা কথা এখন বসতি থেকে বসতিতে ছড়িয়ে পড়বে–পৃথিবী মানুষ ধ্বংস করে নি, ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান–
কথা শেষ করার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে আমি ছিটকে পড়ি। গ্রুষ্টান হঠাৎ আমার উপর হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার হাত থেকে টিয়ারা ছুটে যায় একপাশে। গ্রুস্টান আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে ভয়ঙ্কর এক আক্রোশে—
আমি কোনোমতে বললাম, না গ্রুস্টান! আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করবে না। মৃত মানুষকে অত্যাচার করা যায় না। শুধু যন্ত্রণা দেবার জন্যে তুমি আমাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঁচিয়ে রাখবে। রাখবে না?
গ্রুস্টান আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ কুশান, তুমি সত্যি কথা বলেছ। তুমি এই প্রথম একটি সত্যি কথা বলেছ।
আমি আমার গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, তুমি জান তোমার মাঝে সবচেয়ে বিচিত্র অংশটুকু কী? তোমার সবচেয়ে বিচিত্র অংশ হচ্ছে মানুষের সাথে তোমার আশ্চর্য মিল। পৃথিবীর মানুষ যখন তোমাকে সৃষ্টি করে তারা কেন তোমাকে মানুষের রূপ দিয়েছিল মানুষের মতো একটি চরিত্র দিয়েছিল, আমি জানি না। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?
গ্রুস্টান কোনো কথা না বলে আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আবার বললাম, মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষের মহত্ত্ব তোমার মাঝে নেই। মানুষের ভালবাসাও নেই! মানুষের স্বপ্নও নেই। আছে মানুষের নীচতা। ক্ষুদ্রতা। মানুষের দুর্বলতা। মানুষের হিংস্রতা। আর জান সেটাই তোমাকে ধ্বংস করে দেবে চিরদিনের মতো।
আমাকে ধ্বংস করে দেবে?
হা গ্রুস্টান। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও তুমি–যদি পরিব্যাপ্ত কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের ধ্বংসকে মৃত্যু বলা যায়।
তুমি কী বলতে চাইছ?
তুমি জান আমার একটি রবোট ছিল। অত্যন্ত প্রাচীন নির্বোধ রবোট। তার নাম ক্রিশি।
কী হয়েছে তার?
একটা বাই ভার্বালে করে আমি আর ক্রিশি এখানে এসেছি। তোমার রবোটেরা আমাকে ধরে এনেছে, ক্রিশিকে কিছু করে নি। কেন করবে? অত্যন্ত নির্বোধ প্রাচীন একটা রবোট তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কী করেছে সেই রবোট?
আমি জানি না কী করেছে সে। কেমন করে জানব? তুমি আমাকে সিলাকিত করে রেখেছ। কিন্তু আমি অনুমান করতে পারি। যখন তোমার বিশাল নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে সে এখানে ছিল। সে দেখেছে তোমাকে প্রচণ্ড আঘাত দেয়া হয়েছে, সে দেখেছে তুমি কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছ। সে দেখেছে আমার জীবন হঠাৎ বিপন্ন হয়েছে।
গ্রুস্টানের চোখেমুখে হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক ধরনের আক্রোশ এসে ভর করে। হিংস্র স্বরে হিসহিস করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
ক্রিশি আমার অনেক দিনের রবোট। সে আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যেটা করতে হয় করবে, তার স্বল্প বুদ্ধিতে, সেটা কি জান?
গ্রুস্টানের চেহারা হঠাৎ পাল্টে যেতে থাকে, সেখানে হঠাৎ এক আশ্চর্য আতঙ্ক এসে ভর করে। মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলে, না– না–কিছুতেই না–
হ্যা গ্রুস্টান। আমি নিশ্চিত সে বাই ভার্বালে করে ফিরে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। যেখানে তোমার যোগসূত্রটি কেটে দু ভাগ করা হয়েছিল সেটা আবার জুড়ে দিচ্ছে তোমাকে রক্ষা করার জন্যে। কারণ সে মনে করে তুমি রক্ষা পেলে আমি রক্ষা পাব।
গ্রুস্টান কোনো কথা বলে না, হঠাৎ তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে, আমি নিচু গলায় বললাম, তুমি জান তার অর্থ কী? তার অর্থ পৃথিবীর বিশাল নেটওয়ার্কে এখন দুজন গ্রুস্টান। একজন তুমি, আরেকজন পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠে সৃষ্টি হওয়া দ্বিতীয় গ্রুস্টান। তোমার মতো নৃশংস। তোমার মতো হিংস্র। কিন্তু তুমি নও। সে ভিন্ন একজন।
গ্রুস্টান থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, না, না–তুমি মিথ্যা কথা বলছ–মিথ্যা কথা বলছ–মিথ্যা–
আমি ভুল বলতে পারি, কিন্তু মিথ্যা বলছি না গ্রুস্টান! তুমি প্রায় ঈশ্বরের মতো শক্তিশালী, পৃথিবীর মানুষ কোনোদিন তোমাকে ধ্বংস করতে পারত না। তোমাকে ধ্বংস করতে পারবে শুধু তুমি। ঠিক তোমার মতো একজন নৃশংস হিংস্র খল কুটিল কুচক্রী অপারেটিং সিস্টেম। আমি তাই করেছি গ্রুষ্টান্ত– আরেকজন গ্রুস্টানের জন্ম দিয়ে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।
হঠাৎ চারদিক থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি দেখতে পাই ধোঁয়ার মতো কিছু একটা গ্রুস্টানের পাশে ঘুরছে, কিছু একটা সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিতীয় গ্রুস্টান?
আমি হাঁটু গেড়ে গড়িয়ে গিয়ে টিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললাম, টিয়ারা, চোখ বন্ধ কর টিয়ারা।
কেন কুশান?
ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হবে তোমার সামনে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য! তুমি সহ্য করতে পারবে না–
আমার ভয় করছে কুশান। ভয় করছে—
আমারও ভয় করছে। এস আমি তোমাকে শক্ত করে ধরে রাখি। আমি টিয়ারাকে ধরে রাখতে চাই কিন্তু সে আমার হাত থেকে কীভাবে জানি সরে যেতে থাকে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে ফিসফিস করে বললাম, টিয়ারা, তুমি সত্যিকারের টিয়ারা নও। আমি সত্যিকারের কুশান নই! কিন্তু তবু আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
কী কথা?
গ্রুস্টান যখন ধ্বংস হবে তখন হয়তো তুমি আর আমি বেঁচে থাকব না। সত্যিকারের কুশান হয়তো আর কখনো সত্যিকারের টিয়ারাকে দেখবে না। যে কথাটি সে বলতে চেয়েছিল হয়তো কোনোদিন সেই কথাটি বলতে পারবে না–
কী কথা কুশান?
আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়। তীব্র আলোর ঝলকানিতে চারদিক ঝলসে ওঠে। প্রচণ্ড উত্তাপ ভয়াবহ শব্দ আগুনের লেলিহান শিখা আর তার মাঝে দেখতে পাই দুটি প্রেত যেন একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন হঠাৎ খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। আমি টিয়ারাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আমার হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল–আমি দেখলাম সে উড়ে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে
আমি চিৎকার করতে থাকলাম, কিন্তু কেউ আমার চিৎকার শুনতে পেল না।
» ১১. আমরা দক্ষিণ দিকে হাঁটছি
আমরা দক্ষিণ দিকে হাঁটছি গত তিন সপ্তাহ থেকে। বাই ভার্বালে করে এলে অনেক তাড়াতাড়ি আসা যেত কিন্তু আমরা সেভাবে আসতে চাই নি। আমরা হেঁটে হেঁটে আসছি, বহুঁকাল আগে মানুষ যেভাবে নূতন দেশের খোঁজে যেত, সেভাবে।
আমরা এখনো দক্ষিণের সেই অঞ্চলটিতে পৌঁছাই নি কিন্তু সবাই জানি তার খুব কাছাকাছি এসে গেছি। হঠাৎ হঠাৎ আমরা সেটি অনুভব করতে পারি, মুখে শীতল হাওয়ার ঝাঁপটা এসে লাগে। মাটিতে চোখ বুলালে চোখে পড়ে ছোট গাছের কুঁড়ি, সবুজ গাছের পাতা। গত রাতে একটা নিশিজাগা পাখি ডেকে ডেকে উড়ে গেছে আকাশ দিয়ে। বাতাসে এক ধরনের সজীব প্রাণের ঘ্রাণ, ঠিক জানি না কেন সেটি বুককে উতলা করে দেয়।
আমার পাশাপাশি হাঁটছে ইশি। তার ঘাড়ে একটি ছোট দুরন্ত শিশু। আমাদের পিছনে রাইনুক আর নাইনা। একটু পিছনে লিয়ানা। দীর্ঘদিন সিলাকিত হয়েছিল বলে একটু শুকিয়ে গিয়ে তাকে দেখাচ্ছে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে হাসল মিষ্টি করে। লিয়ানার পিছনে একটি ভাবুক তরুণ, তার পিছনে দুটি চঞ্চল তরুণী, তাদের পিছনে আরো অনেকে। কত জন আসছে আমাদের সাথে কে জানে। কত তাড়াতাড়িই না গ্রুস্টানকে ভুলে গেছে সবাই আর নূতন এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে কী অনায়াসে।
আমি একটা বড় পাথরের পাশে দাঁড়ালাম, একটা খুঁয়োপোকা গুটি গুটি হেঁটে যাচ্ছে। আমি সাবধানে সেটাকে হাতে তুলে নেই। হাত বেয়ে যেতে থাকে পোকাটি। কী বিচিত্র একটি অনুভূতি।
হঠাৎ টিয়ারা ছুটে এল কোথা থেকে, মাথার চুল পিছনে টেনে একটুকরা রঙিন কাপড় বেঁধেছে শক্ত করে। আমাকে দেখে অকারণে হেসে ফেলল সে। আমি বললাম, দেখেছ এটা কী?
কী?
শুঁয়োপোকা।
এতগুলো পা নিয়ে এত আস্তে আস্তে হাঁটে?
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ। আর কয়দিন অপেক্ষা কর দেখবে সে কী সুন্দর প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবে আকাশে।
সত্যি?
সত্যি।
আমি টিয়ারার চোখের দিকে তাকালাম, ঝকঝকে কালো দুটি চোখ যেন দুটি অতলান্ত হ্রদ। যেরকম একটি হ্রদের দিকে আমরা হেঁটে যাচ্ছি বহুদিন থেকে। যেই হ্রদে থাকবে টলটলে নীল পানি। যেই পানিতে থাকবে রুপালি মাছ। যার তীরে থাকবে সবুজ গাছ। গাছে থাকবে লাল ফুল। যার আকাশে থাকবে সাদা মেঘ, যে মেঘে উড়ে বেড়াবে রঙিন পাখি।
আমি জানি আজ হোক কাল হোক আমরা পৌঁছাব সেই হ্রদের কাছে।