আমি কথা শুনে বুঝতে পারি যারা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই ভাবছে আমি দশম প্রজাতির একটা রবোট। তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না– এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্তূপে একজন মানুষ কেমন করে আসবে? আমি হাত দিয়ে তীব্র আলো থেকে চোখকে আড়াল করে রেখে বললাম, আলোটা একটু কমাবে? দেখতে অসুবিধে হচ্ছে।
যারা আমাকে ঘিরে আছে তারা আলো সরাল না। খসখসে কণ্ঠস্বরটি জিজ্ঞেস করল, কী বলছ তুমি?
আমি একজন মানুষ।
মানুষ!
সাথে সাথে আলো নিভে গেল, আমি সবাইকে ধড়মড় করে পিছনে সরে যেতে শুনলাম। এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ হল এবং তারপর হঠাৎ করে একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল।
সত্যিই মানুষ?
হ্যাঁ
মানুষ, যাকে বলে জৈবিক মানুষ?
হ্যাঁ, জৈবিক মানুষ।
এবারে ঘরে একটা বাতি জ্বলে ওঠে এবং আমি দেখতে পাই আমাকে ঘিরে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন আকারের রবোট দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের হাতেই এক ধরনের ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র এবং সবাই সেটি আমার দিকে তাক করে রেখেছে। এর যে কোনো একটি অস্ত্র চোখের পলকে মানুষের একটা বসতি উড়িয়ে দিতে পারে, আমার জন্যে ছয়টি অস্ত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সবচেয়ে কাছে যে রবোটটি দাঁড়িয়ে আছে তার একটি হাত কনুইয়ের কাছে থেকে উড়ে গেছে। কিছু বৈদ্যুতিক তার, যন্ত্রপাতি, নানারকম টিউব বের হয়ে আছে, রবোটটি সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামিয়েছে বলে মনে হল না। রবোটটি দেখতে অনেকটা প্রতিরক্ষা রবোটের মতো, চেহারায় এক ধরনের কদর্যতা আছে যেটা সহজে চোখে পড়ে না। খসখসে গলায় বলল, তুমি যদি একটুও নড়, তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলব।
আমি বললাম, আমি নড়ব না। কিন্তু আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।
বাজে কথা। মানুষ সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক প্রাণী।
আমি হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে রবোটটির সাথে একমত হতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে মুখ ফুটে সেটা বলার সাহস হল না।
দ্বিতীয় একটি রবোট যার দেহ সিলঝিনিয়াম ধাতুর মতো মসৃণ এবং হঠাৎ দেখলে সত্যিকারের কোনো শিল্পীর হাতে তৈরী অপূর্ব একটি ভাস্কর্য বলে মনে হয়, খনখনে গলায় বলল, এই মানুষটাকে এখনই মেরে ফেলা যাক। মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু।
অন্য রবোটগুলো তার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল এবং আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। কোনো এক সময় রবোটের মাঝে এক ধরনের নিরাপত্তাসূচক ব্যবস্থা ছিল তারা কোনো অবস্থাতেই মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারত না। রবোটদের বিচ্ছিন্ন দল বহু আগেই তাদের কপোট্রনের সেইসব নিরাপত্তামূলক প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে ফেলেছে। আমি শুষ্ক গলায় বললাম, তোমাদের তুলনায় আমার শরীর অত্যন্ত দুর্বল, ইচ্ছে করলে যে কোনো মুহূর্তে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। আমার অনুরোধ সেটা নিয়ে তোমরা কোনো তাড়াহুড়ো কোরো না
কেন নয়?
তোমরা ঠিক কী কারণে মানুষকে এত অপছন্দ কর জানি না। কিন্তু এটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয় যে তোমাদের এবং আমার অবস্থা অনেকটা একরকম, এবং আমি হয়তো তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারব।
ছয়টি রবোটের মাঝে তিনটি হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হাসার মতো শব্দ করতে শুরু করে। অন্য তিনটি রবোটকে সম্ভবত হাসার উপযোগী বুদ্ধিমত্তা দেয়া হয় নি, তারা স্থির চোখে রবোট তিনটিকে লক্ষ করতে থাকে। আমি রবোটগুলোর উন্মত্ত হাসি শুনতে শুনতে আবার এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক অনুভব করি।
কনুইয়ের কাছ থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি হাসি থামিয়ে বলল, তুমি পৃথিবীতে বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী দূর্বল একজন মানুষ! তুমি আমাদের সাহায্য করবে?
সেটি অসম্ভব কিছু নয়। আমি দ্রুত চিন্তা করতে থাকি, কিছু একটা বলে রবোটগুলোকে শান্ত করতে হবে। কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না, কোনোকিছু চিন্তা না করেই বললাম, আমি যে কারণে মানুষের বসতি ছেড়ে এসেছি তোমরাও নিশ্চয়ই সেই একই কারণে মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে এসেছ?
চকচকে মসৃণ দেহের রবোটটি বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
কনুইয়ের কাছ থেকে হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি বলল, তুমি এই মানুষটির কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না। মানুষ খল এবং নীচু প্রকৃতির। মানুষ ধূর্ত এবং ফাঁকিবাজ। মানুষ অপদার্থ এবং অপ্রয়োজনীয়। পৃথিবী থেকে মানুষকে অপসারিত করা হচ্ছে পৃথিবীর উপকার করা।
তৃতীয় একটি রবোট হাতের ভীষণদর্শন অস্ত্র হাতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, এস পৃথিবীর একটা উপকার করে দিই।
মসৃণ দেহের রবোটটি তার ধাতব খনখনে গলায় বলল, যত্ন করে খুন কর যেন দেহটি নষ্ট না হয়। আমি কখনো মানুষের শরীরের ভিতরে দেখি নি। মানুষের শরীরে হৃৎপিণ্ড বলে একটি জিনিস আছে সেটি নাকি ক্রমাগত তাদের কপোট্রনে রক্ত সঞ্চালন করে।
তৃতীয় রবোটটি বলল, মেরে ফেললে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। যদি সত্যি সত্যি হৃৎস্পন্দন দেখতে চাও জীবন্ত অবস্থায় বুকটি কাটতে হবে।
আমি অসহায় আতঙ্কে তাকিয়ে থাকি। চকচকে মসৃণ রবোটটি আমার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে এখন হঠাৎ অন্ধকার জগৎ থেকে বের হয়ে আসা বিশাল রক্তলোলুপ সরীসৃপের মতো মনে হচ্ছে। কাছে এসে হাতের কোথায় চাপ দিতেই কব্জির কাছ থেকে একটি ঝকঝকে ধারালো ইস্পাতের ফলা বের হয়ে এক তার পিছু পিছু অন্য রবোটগুলো এগিয়ে আসে, যন্ত্রের মাঝে কৌতূহলের চিহ্নটি কখনো স্পষ্ট হতে পারে না তাই রবোটগুলোকে তখনো ভাবলেশহীন নিস্পৃহ মনে হতে থাকে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, ঘরের এক কোনায় ক্রিশি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রাচীন দুর্বল কপোট্রন এই শক্তিশালী রবোটগুলোর উপস্থিতিতে পুরোপুরি শক্তিহীন, তার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে তবু আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করল, এক পা এগিয়ে এসে বলল, দাঁড়াও।