তারপর সে প্রথমে তার ডান হাতটা নিজের বুকের উপর রাখে, তারপর দ্বিতীয় হাতটাও বুকের উপর নিয়ে আসে তারপর দুই হাত দিয়ে তার আম্মুকে দেখায়। আম্মু বললেন, “জানি না বাপু।”
তিষা বলল, “এর মানে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আম্মু বললেন, “তুই কাউকে ভালোবাসলে সোজাসজি মুখ ফুটে বলে ফেল। হাত পা নেড়ে এতো কায়দা করে বলতে হবে কেন?”
তিষা বলল, “এটা হচ্ছে সাইন ল্যাংগুয়েজ। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে এসেছে সে কানে শুনতে পায় না, ঠিক করে কথাও বলতে পারে না। সবকিছু সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলে। আমাদেরকে সে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাচ্ছে।”
আম্মু বললেন, “ব্যাপারটা খারাপ হয় না। তুই যতক্ষণ বাসায় আছিস সারাক্ষণ সাইন ল্যাংগুয়েজ কথা বললে বাসাটা একটু নিরিবিলি থাকবে!”
তিষা তার মাকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও আম্মু। তোমার সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা।”
টুইটি তিষাকে সমর্থন করে ভারী গলায় ডাকল। তাকে যখন প্রথম আনা হয়েছিল তারপর দুই বছর পার হয়ে গেছে এখন সে আর ছোট কুকুরটি নেই, রীতিমত বড় হয়ে গেছে। তেজী শরীর, মসৃণ অবয়ব, কৌতূহলী চোখ। যতক্ষণ তিষা স্কুলে কিংবা বাইরে থাকে টুইটি ততক্ষণ খুবই দায়িত্বশীল একটা কুকর। সে বাসায় আসা মাত্র তার দুষ্টুমি শুরু হয়ে যায়। সে লাফ ঝাঁপ দিতে থাকে, তিষাকে ঘিরে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। তার প্রিয় খেলা হচ্ছে তিষার একপাটি জুতো মুখে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যাওয়া। ঘরের ভেতরে না থেকে বাইরে ছোটাচ্চুটি করা টুইটির অনেক বেশী পছন্দ। যতদিন শীত না পড়েছে ততদিন সমস্যা ছিল না কিন্তু বরফ পড়তে শুরু করার পর তিষা বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে–টুইটি সেটা বুঝতে পারে না। সে যেরকম বরফে ছোটাচ্চুটি করতে পারে তার ধারণা সবাই বুঝি সে রকম পারে!
এই দুই বছরে তিষাও অনেক বড় হয়েছে। তার ক্লাশের আমেরিকান বান্ধবীরা অবশ্যি আর কিশোরী নেই সবাই তরুণী হয়ে গেছে। তিষা এখনো হালকা পাতলা, চোখে মুখে একটু বাড়তি বুদ্ধির ছাপ, চাল চলনে একটু বেশী আত্মবিশ্বাস তা না হলে হয়তো বোঝাই যেতো না তার বয়স এখন। পনেরো।
রাতে খাবার টেবিলে তিষা আবার তার ক্লাশের কানে না শোনা ছেলেটির কথা তুলল, বলল, “আব্বু, তুমি জান আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে এসেছে, ছেলেটা কানে শুনতে পায় না কিন্তু কম্পিউটারের জিনিয়াস।”
আব্বু বলল, “হতেই পারে। কানে না শুনলে একজন কী জিনিয়াস হতে পারে না? বিটোভেন কানে শুনতেন না–তাতেই কতো বড় শিল্পী কানে শুনলে না জানি কী হতো!”
তিষা বলল, “ছেলেটার নাম জন। জন উইটক্যাম্প। খুবই সুইট। একদিন বাসায় নিয়ে আসব দেখো।”
“নিয়ে আসিস।”
“আমাদেরকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাচ্ছে।”
“ইন্টারেস্টিং।” আব্বু বললেন, “আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন সাইন ল্যাংগুয়েজের কথা জানতাম না। যদি জানতাম তাহলে কী করতাম বল দেখি?”
“কী করতে?”
“পরীক্ষার হলে নকল করা খুব সোজা হতো। আমাদের ফার্স্ট বয় এক কোনায় বসে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলতো আর পুরো হলের আমরা সবাই লিখে ফেলতাম। একেবারে নিঃশব্দে।”
“আব্বু, আজকাল পরীক্ষায় নকল করার জন্যে সাইন ল্যাংগুয়েজ লাগে না। কতো রকম ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বের হয়েছে তুমি জান?”
“তা ঠিক।”
আম্মু বললেন, “এই যে ছেলেটা কানে শুনতে পায় না তার ক্লাশ করতে সমস্যা হয় না?
“মোটেও না। লিপ রিডিং করতে পারে। ঠোঁট নাড়া দেখে সব কথা বুঝতে পারে। একটু একটু বলতেও পারে, কষ্ট করে বুঝতে হয়।”
“ইন্টাররেস্টিং।” আব্বু বললেন, “আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না এরকম একজন আমাদের সাথে লেখাপড়া করবে।”
তিষা বলল, “জন তো মোটামুটি স্বাভাবিক। আমাদের স্কুলে একজন আছে অন্ধ। আরো দুইজন হুইল চেয়ারে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, যে মেয়েটি অন্ধ সে তার ক্লাশের মনিটর।”
“বাহ!”
“আমরা কেউ অবশ্যি অন্ধ বলি না, সবসময়েই বলি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।”
“তাইতো বলা উচিত।”
.
পরের কয়েকদিন প্রচুর তুষারপাত হল, চারদিক বরফে ঢেকে গেল। এর মাঝে তিষা একদিন খবর আনল কাছাকাছি সাসকুয়ান হ্রদটা বরফে ঢেকে গেছে, সবাই তার ওপরে স্কেটিং করছে।
আম্মু বললেন, “জানি না বাপু।হ্রদের উপর বরফ জমে গেছে সেখানে স্কেটিং করার সময় বরফ ভেঙ্গে যদি নিচে পড়ে যায়?”
তিষা বলল, “কী বল আম্মু? বরফ কতো শক্ত হয় জান? লেকের ওপর রীতিমত গাড়ী যেতে পারে!”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। চল একবার দেখে আসি।”
“তোর আব্বুকে বল, গিয়ে দেখে আসব। খোদার দুনিয়ায় কতো বিচিত্র জিনিষই না আছে!”
“আমি আমার স্কেট নিয়ে যাব।”
“ঠিক আছে।”
এই বয়সী মেয়েরা যা করে তিষাও সেগুলো করে। রোলার স্কেটিং করে আইস স্কেটিং করে, উইক এন্ডে দলবেধে মলে বেড়াতে যায়। সবাই মিলে সিনেমা দেখে। দেশের অনেক মানুষ এখানে এসে তাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করে, তিষার আব্বু আম্মু কখনো সেটা করেন নি।
.
দুই সপ্তাহ পর এক উইক এন্ডে তিষাকে নিয়ে তার আবু আম্মু জমে যাওয়া সাসকুয়ান লেক দেখতে গেল। আব্বু গাড়ী চালাচ্ছেন সামনে আম্মু। পিছনে তিষা আর টুইটি। টুইটির উত্তেজনা চোখে পড়ার মত, অনেকদিন পর ঘর থেকে বের হতে পেরে তার আনন্দের শেষ নেই।