- বইয়ের নামঃ একজন অতিমানবী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. আমার নাম কিরি
আমার নাম কিরি। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে যে আমার বাবা–মা আমাকে অনাথ আশ্রমে দেবার সময় এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চিত হবার কোনোই উপায় নেই, কারণ কোনো বাবা–মা যখন অনাথ আশ্রমে তাদের সন্তানকে দিয়ে আসেন তখন তার পূর্ববর্তী সমস্ত তথ্য নষ্ট করে দেওয়া হয়। এমনটিও হতে পারে যে আমার বাবা–মা আমাকে কোনো নাম ছাড়াই অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিলেন এবং অনাথ আশ্রমের মূল তথ্যকেন্দ্র র্যান্ডম ধ্বনি ব্যবহার করে আমার জন্য একটি নাম তৈরি করে নিয়েছে। সম্ভবত আমার বাবা ছিলেন না এবং আমার মার জীবনে একটা ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল তাই আমাকে গভীরভাবে ভালবাসা সত্ত্বেও কোনো উপায় না দেখে আমার মা আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গিয়েছিলেন। আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় আমি নিশ্চয়ই আকুল হয়ে কাঁদছিলাম এবং সম্ভবত আমার হাত দুটি তার দিকে প্রসারিত করে রেখেছিলাম, আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমার মায়ের বুক ভেঙে যাচ্ছিল কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। অনাথ আশ্রম থেকে বের হয়ে আমার মা সম্ভবত দুই হাতে মুখ ঢেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন এবং পথচারীরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিজের সন্তানকে ছেড়ে আসার গভীর দুঃখে সমস্ত পৃথিবী নিশ্চয়ই তার কাছে শূন্য এবং অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
কোম অবশ্য আমার কথা বিশ্বাস করে না। তার ধারণা আমার কোনো বাবা–মা ছিল না, আমাকে ল্যাবরেটরিতে একটা ক্লোন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। আমি অনাথ আশ্রমে কিছু রোবটের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছি বলে সামাজিক আচার–আচরণ পুরোপুরি শিখে উঠতে পারি নি। রূঢ়ভাবে কথা বলতে না চাইলেও আমার বেশিরভাগ কথাই রূঢ় শোনায়। আমার মাঝে মাঝে কোনো একজন প্রিয় মানুষকে কিছু একটা কোমল কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু এক ধরনের সংকোচের জন্য বলতে পারি নি। আমার পরিচিত মানুষজন খুব কম, বন্ধুর সংখ্যা আরো কম। কোম আমার মতো অসামাজিক এবং অমিশুক বলে তার সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে। আমরা যখন একসাথে থাকি বেশিরভাগ সময় চুপচাপ বসে বসে। আশপাশের অন্যান্য মানুষজনকে দেখে সময় কাটিয়ে দিই। যেদিন আমাদের হাতে খরচ করার মতো ইউনিট থাকে আমরা শহরতলির কোনো পানশালায় বসে নিফ্রাইট মেশানো কোনো হালকা পানীয় খেতে খেতে গল্প করি। নিফ্রাইটের জৈব রসায়ন মস্তিষ্কের নিউরন সেলের সিনালের মাঝে দিয়ে এক ধরনের আরামের অনুভূতি আনা–নেওয়া করতে থাকে, আমাদের সুখের স্মৃতি মনে হতে থাকে এবং আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে তরল গলায় কথা বলতে থাকি।
তৃতীয় গ্লাস পানীয় খেয়ে আজ কোম হঠাৎ করে অনর্গল কথা বলতে শুরু করল। আমার দিকে তাকিয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, কিরি, তুমি একটা গণ্ডমূর্খ ছাড়া আর কিছু নও। তাই তুমি বিশ্বাস কর যে তোমার জন্ম হয়েছে বাবা–মায়ের ভালবাসা থেকে।
আমার কথাবার্তা যেরকম প্রায় সব সময়েই রূঢ় শোনায় কোমের বেলায় ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। সে রূঢ় কোনো কথা বললেও সেটিকে কেমন জানি ছেলেমানুষি শোনায়। আমি আমার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আমি কী বিশ্বাস করতে চাই সেটা পুরোপুরি আমার ব্যাপার।
কিন্তু যুক্তিহীন বিশ্বাস অর্থহীন।
বিশ্বাসমাত্রই যুক্তিহীন। যদি সত্যিকারের যুক্তি দিয়ে একটা কিছু প্রমাণ করা যায় তা হলে সেটাকে বিশ্বাস করতে হয় না–সেটা তখন সবাই এমনিতেই মেনে নেয়। যার পিছনে কোনো যুক্তি নেই শুধুমাত্র সেটাকেই বিশ্বাস করতে হয়।
কোম ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কোথা থেকে এ রকম আজগুবি কথা শুনেছ?
এটা মোটেও আজগুবি কথা নয়। তুমি নিশ্চয়ই ইতিহাস পড় নি। ইতিহাস পড়লে জানতে প্রাচীনকালে মানুষ ধর্ম বলে একটা জিনিস বিশ্বাস করত। সেটার কোনো প্রমাণ ছিল না, ধর্মের পুরোটাই গড়ে উঠেছিল বিশ্বাস থেকে।
কোম অনাবশ্যকভাবে মুখের মাংসপেশি শক্ত করতে করতে বলল, সত্যি কথাটা স্বীকার করে নাও কিরি। সত্যিকারের কোনো বাবা–মা কখনোই তাদের সন্তানকে অনাথ আশ্রমে দেবে না। শুধুমাত্র একটা ক্লোনই অনাথ আশ্রমে বড় হতে পারে।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি জান মানুষের ক্লোন তৈরি করা গত শতাব্দীতে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।
তাতে কী হয়েছে? ভিচুরিয়াস মাদকও দুই শতাব্দী আগে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তুমি যদি চাও এখনই আমি এই ঘর থেকেই দশ মিলিগ্রাম আঁটি ভিচুরিয়াস কিনে দিতে পারব।
ভিচুরিয়াস মাদক আর মানুষের ক্লোন এক জিনিস হল? হাজার দশেক ইউনিট থাকলেই ভিচুরিয়াস তৈরি করার জন্য সিনথেসাইজার কেনা যাবে। ক্লোন তৈরি করার বায়োজ্যাকেট কি এত সহজে কিনতে পারবে?
কেন পারব না? কোম সরু চোখে বলল, ব্ল্যাক মার্কেটে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের মেগা ব্লাস্টার পাওয়া যায়, সে তুলনায় বায়োজ্যাকেট কিছুই না।
কিন্তু যখন আইন রক্ষাকারী রোবটগুলো পিছনে লেগে যাবে, জীবনের শান্তি কি বাকি থাকবে একফোঁটা? এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কারা মানুষের ক্লোন তৈরি করবে? কেন করবে?
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্য।