- বইয়ের নামঃ একজন অতিমানবী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. আমার নাম কিরি
আমার নাম কিরি। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে যে আমার বাবা–মা আমাকে অনাথ আশ্রমে দেবার সময় এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চিত হবার কোনোই উপায় নেই, কারণ কোনো বাবা–মা যখন অনাথ আশ্রমে তাদের সন্তানকে দিয়ে আসেন তখন তার পূর্ববর্তী সমস্ত তথ্য নষ্ট করে দেওয়া হয়। এমনটিও হতে পারে যে আমার বাবা–মা আমাকে কোনো নাম ছাড়াই অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিলেন এবং অনাথ আশ্রমের মূল তথ্যকেন্দ্র র্যান্ডম ধ্বনি ব্যবহার করে আমার জন্য একটি নাম তৈরি করে নিয়েছে। সম্ভবত আমার বাবা ছিলেন না এবং আমার মার জীবনে একটা ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল তাই আমাকে গভীরভাবে ভালবাসা সত্ত্বেও কোনো উপায় না দেখে আমার মা আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গিয়েছিলেন। আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় আমি নিশ্চয়ই আকুল হয়ে কাঁদছিলাম এবং সম্ভবত আমার হাত দুটি তার দিকে প্রসারিত করে রেখেছিলাম, আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমার মায়ের বুক ভেঙে যাচ্ছিল কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। অনাথ আশ্রম থেকে বের হয়ে আমার মা সম্ভবত দুই হাতে মুখ ঢেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন এবং পথচারীরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিজের সন্তানকে ছেড়ে আসার গভীর দুঃখে সমস্ত পৃথিবী নিশ্চয়ই তার কাছে শূন্য এবং অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
কোম অবশ্য আমার কথা বিশ্বাস করে না। তার ধারণা আমার কোনো বাবা–মা ছিল না, আমাকে ল্যাবরেটরিতে একটা ক্লোন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। আমি অনাথ আশ্রমে কিছু রোবটের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছি বলে সামাজিক আচার–আচরণ পুরোপুরি শিখে উঠতে পারি নি। রূঢ়ভাবে কথা বলতে না চাইলেও আমার বেশিরভাগ কথাই রূঢ় শোনায়। আমার মাঝে মাঝে কোনো একজন প্রিয় মানুষকে কিছু একটা কোমল কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু এক ধরনের সংকোচের জন্য বলতে পারি নি। আমার পরিচিত মানুষজন খুব কম, বন্ধুর সংখ্যা আরো কম। কোম আমার মতো অসামাজিক এবং অমিশুক বলে তার সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে। আমরা যখন একসাথে থাকি বেশিরভাগ সময় চুপচাপ বসে বসে। আশপাশের অন্যান্য মানুষজনকে দেখে সময় কাটিয়ে দিই। যেদিন আমাদের হাতে খরচ করার মতো ইউনিট থাকে আমরা শহরতলির কোনো পানশালায় বসে নিফ্রাইট মেশানো কোনো হালকা পানীয় খেতে খেতে গল্প করি। নিফ্রাইটের জৈব রসায়ন মস্তিষ্কের নিউরন সেলের সিনালের মাঝে দিয়ে এক ধরনের আরামের অনুভূতি আনা–নেওয়া করতে থাকে, আমাদের সুখের স্মৃতি মনে হতে থাকে এবং আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে তরল গলায় কথা বলতে থাকি।
তৃতীয় গ্লাস পানীয় খেয়ে আজ কোম হঠাৎ করে অনর্গল কথা বলতে শুরু করল। আমার দিকে তাকিয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, কিরি, তুমি একটা গণ্ডমূর্খ ছাড়া আর কিছু নও। তাই তুমি বিশ্বাস কর যে তোমার জন্ম হয়েছে বাবা–মায়ের ভালবাসা থেকে।
আমার কথাবার্তা যেরকম প্রায় সব সময়েই রূঢ় শোনায় কোমের বেলায় ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। সে রূঢ় কোনো কথা বললেও সেটিকে কেমন জানি ছেলেমানুষি শোনায়। আমি আমার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আমি কী বিশ্বাস করতে চাই সেটা পুরোপুরি আমার ব্যাপার।
কিন্তু যুক্তিহীন বিশ্বাস অর্থহীন।
বিশ্বাসমাত্রই যুক্তিহীন। যদি সত্যিকারের যুক্তি দিয়ে একটা কিছু প্রমাণ করা যায় তা হলে সেটাকে বিশ্বাস করতে হয় না–সেটা তখন সবাই এমনিতেই মেনে নেয়। যার পিছনে কোনো যুক্তি নেই শুধুমাত্র সেটাকেই বিশ্বাস করতে হয়।
কোম ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কোথা থেকে এ রকম আজগুবি কথা শুনেছ?
এটা মোটেও আজগুবি কথা নয়। তুমি নিশ্চয়ই ইতিহাস পড় নি। ইতিহাস পড়লে জানতে প্রাচীনকালে মানুষ ধর্ম বলে একটা জিনিস বিশ্বাস করত। সেটার কোনো প্রমাণ ছিল না, ধর্মের পুরোটাই গড়ে উঠেছিল বিশ্বাস থেকে।
কোম অনাবশ্যকভাবে মুখের মাংসপেশি শক্ত করতে করতে বলল, সত্যি কথাটা স্বীকার করে নাও কিরি। সত্যিকারের কোনো বাবা–মা কখনোই তাদের সন্তানকে অনাথ আশ্রমে দেবে না। শুধুমাত্র একটা ক্লোনই অনাথ আশ্রমে বড় হতে পারে।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি জান মানুষের ক্লোন তৈরি করা গত শতাব্দীতে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।
তাতে কী হয়েছে? ভিচুরিয়াস মাদকও দুই শতাব্দী আগে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তুমি যদি চাও এখনই আমি এই ঘর থেকেই দশ মিলিগ্রাম আঁটি ভিচুরিয়াস কিনে দিতে পারব।
ভিচুরিয়াস মাদক আর মানুষের ক্লোন এক জিনিস হল? হাজার দশেক ইউনিট থাকলেই ভিচুরিয়াস তৈরি করার জন্য সিনথেসাইজার কেনা যাবে। ক্লোন তৈরি করার বায়োজ্যাকেট কি এত সহজে কিনতে পারবে?
কেন পারব না? কোম সরু চোখে বলল, ব্ল্যাক মার্কেটে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের মেগা ব্লাস্টার পাওয়া যায়, সে তুলনায় বায়োজ্যাকেট কিছুই না।
কিন্তু যখন আইন রক্ষাকারী রোবটগুলো পিছনে লেগে যাবে, জীবনের শান্তি কি বাকি থাকবে একফোঁটা? এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কারা মানুষের ক্লোন তৈরি করবে? কেন করবে?
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্য।
কার কাছে বিক্রি করার জন্য?
ক্রিমিনালদের কাছে। আন্তঃগ্রহ পরিবহনে দুর্ঘটনায় যেসব ক্রুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হয় তাদের কাছে
আমি আমার হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলি, এই দেখ, আমার হাত–পা, নাক, চোখ–মুখ সব আছে–কেউ কোথাও বিক্রি করে দেয় নি।
কোম এত সহজে তর্কে হার মানতে রাজি নয়, মাথা নেড়ে বলল, হয়তো তোমার শরীরের ভিতরে পুরো জিনিসপত্র নেই। লিভার রয়েছে একটুখানি, কিডনি অর্ধেকটা, হৃৎপিরে ভাভ হয়তো নেই।
আমি হেসে বললাম, আমি পুরোপুরি সুস্থ পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ। গত মাসে চেকআপে আমি তিরানব্বই পয়েন্ট পেয়েছি।
কত?
তিরানব্বই।
কোম শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, নিশ্চয়ই ভুল দেখেছ, সংখ্যাটি ছিল ঊনচল্লিশ, ভুল করে তুমি পড়েছ তিরানব্বই।
না ভুল দেখি নি। সংখ্যাটি ডেসিমেল এবং কোয়ার্টানারিতে ছিল, ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই।
কোম হাতের পানীয়টুকু গলায় ঢেলে চোখ মটকে বলল, হয়তো তোমার মস্তিকের নিউরন সংখ্যা কম। হয়তো তোমার সেরেব্রাল কর্টেক্স থেকে এক খাবলা তুলে নেওয়া হয়েছে, তোমার বুদ্ধিমত্তা হয়তো শিম্পাঞ্জির কাছাকাছি। তোমার রিফ্লেক্স হয়তো একটা সরীসৃপের সমান।
মস্তিষ্কে নিফ্রাইটের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে আমাদের আলোচনা কোন দিকে অগ্রসর হত বলা মুশকিল, কিন্তু ঠিক এই সময়ে পানশালাতে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। সশব্দে দরজা খুলে ভিতরে তিন জন মানুষ এসে ঢুকল, তাদের শরীরে কালো নিওপলিমারের আবরণ, মুখ ঢাকা এবং চোখে ইনফ্রারেড গগলস। তাদের সবার হাতেই এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সামনের মানুষটি, যাকে দেখে একজন মেয়েমানুষ বলে সন্দেহ হচ্ছিল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উপরের দিকে তাক করে একপসলা গুলি করে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে খসখসে গলায় বলল, এটা একটা লুণ্ঠন প্রক্রিয়া। আমরা ঠিক দুই মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডে এখান থেকে চলে যাব বলে ঠিক করেছি। কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলে এগিয়ে আস।
ঘরের উপস্থিত পুরুষ এবং মেয়েরা আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে টেবিল বা পরদার আড়ালে লুকিয়ে যেতে শুরু করে। মেয়েটি অস্ত্রটা উপরে তুলে বলল, যে যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমাদের কাজ শেষ করার আগে কেউ নড়তে পারবে না। আমরা এখানে এসেছি একটা ভালো হৃৎপিণ্ডের জন্য।
মেয়েটা উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে একনজরে তাকিয়ে ঘরের এক কোনায় বসে থাকা একজন কিশোরীর দিকে ইঙ্গিত করল, তুমি এগিয়ে এস।
মুহূর্তে কিশোরীটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে কোনোমতে দাঁড়িয়ে বলল, আমি?
হ্যাঁ, তুমি।
না–কিশোরীটি চিৎকার করে বলল, না!
হ্যা তুমি। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, তাড়াতাড়ি চলে এস।
কিশোরী মেয়েটি একটা টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত গলায় কাঁদতে শুরু করল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতের মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল, কী হচ্ছে?
কিশোরীটি তবুও দাঁড়িয়ে রইল দেখে মেয়েটি তার সাথের দুজন মানুষকে ইঙ্গিত করতেই তারা ছুটে গিয়ে দুজন দুপাশ থেকে কিশোরী মেয়েটিকে ধরে ফেলল। মেয়েটি। ভয়ার্ত গলায় একটা আর্তনাদ করে ওঠে।
আমি কী করছি নিজেও খুব ভালো করে জানি না–হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমি উঠে দাঁড়িয়ে উঁচুগলায় বলছি, দাঁড়াও।
মেয়েটা এবং তার সঙ্গী দুজন সাথে সাথে অস্ত্র হাতে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আমি খুব স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দুই পা হেঁটে গেলাম, কোনো একটি বিচিত্র কারণে আমার কাছে পুরো
ব্যাপারটিকে একটি ছেলেমানুষি কাজ বলে মনে হতে লাগল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বুকের দিকে তাক করে রাখলে যেরকম ভয় লাগার কথা আমার একেবারেই সেরকম ভয় লাগছিল না। মেয়েটি চিৎকার করে বলল, কী চাও তুমি?
আমি গত মাসে চেকআপ করিয়েছি। খুব শক্ত এবং তাজা একটা হৃৎপিণ্ড রয়েছে আমার বুকের ভিতরে। ঐ বাচ্চা মেয়েটাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে যাও।
মেয়েটির মুখ মুখোশে ঢাকা বলে তার মুখভঙ্গি দেখতে পেলাম না কিন্তু তার ক্রুদ্ধ গলার স্বর হিসহিস করে ওঠে, আমি কাকে নেব সেটা আমি ঠিক করব–নির্বোধ কোথাকার।
আমি আরো দুই পা এগিয়ে মেয়েটার কাছাকাছি চলে গিয়ে বললাম, তার জন্য একটু দেরি হয়ে গেছে।
কী বলতে চাইছ তুমি?
তুমি যতক্ষণে ঐ ট্রিগার টানবে তার আগে আমি তোমার পাজরের দুটি হাড় ভেঙে দিতে পারি।
মেয়েটি মনে হয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম, আমাকে গুলি করার জন্য একটু দূরে যেতে হবে, ঘুরতে শুরু করা মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে। পিছনে আরো দুজন আছে কিন্তু আমি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছি। মেয়েটিকে বাচিয়ে আমাকে গুলি করা কঠিন–জেনেশুনে কেউ সে ঝুঁকি নেবে না।
মেয়েটির শরীর নড়তে শুরু করা মাত্র আমি শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে পা দিয়ে তাকে আঘাত করলাম, বিকেলবেলা যখন কিছুই করার থাকে না উঁচু দেয়ালে চক দিয়ে ক্রসচিহ্ন এঁকে আমি এভাবে সেখানে পা দিয়ে আঘাত করে করে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলি। সত্যিকার কখনো এটা ব্যবহার করতে হবে ভাবি নি, কিন্তু যখন ব্যবহার করা হল ব্যাপারটি মোটেও কঠিন মনে হল না।
আমি যখন আবার নিচে নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েছি তখন মেয়েটি মেঝেতে মুখ থুবড়ে কাতরাচ্ছে, বলেছিলাম দুটি পাজরের হাড় ভেঙে দেব, মেয়েটিকে দেখে মনে হল সংখ্যা একটু বেশি হতে পারে। এখনো দুজন সশস্ত্র মানুষ রয়েছে তাদেরকে সামাল দেওয়ার একটি মাত্র উপায়। আমি শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বিদ্যুদ্বেগে নিচে পড়ে থাকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে নিলাম। এই যন্ত্রটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি না কিন্তু সেই কথাটি আর কারো জানার কথা নয়। আমি কপাল থেকে চুল সরিয়ে অত্যন্ত শান্তি গলায় বললাম, অস্ত্র ফেলে দুই হাত তুলে দাঁড়াও। অন্য কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা নিজের দায়িত্বে করবে। বুঝতেই পারছ উপায় থাকলে আমি শারীরিক আঘাত করে শুইয়ে দিতাম কিন্তু এত দূর থেকে সেটা করতে পারব না। মেরে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হল মানুষ দুজন শেষ চেষ্টা করবে কিন্তু আমার কঠিন শান্ত ভঙ্গি দেখে শেষ পর্যন্ত করল না। অস্ত্র ফেলে হাত উঁচু করে দাঁড়াল। কিশোরী মেয়েটি সাথে সাথে নিজেকে মুক্ত করে আমার কাছে ছুটে আসে, আমার বুকের কাপড় ধরে হাউমাউ করে। কাঁদতে থাকে। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির কোথাও বেকায়দা চাপ দিয়ে গুলি না করে ফেলি সেভাবে ধরে রেখে কিশোরী–মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, একটু সময় দাও আমাকে, নির্বোধ মানুষগুলোকে বেঁধে ফেলি।
আমার কথা শেষ হবার আগেই বেশ কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ দুজনকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে হাত পিছনে বেঁধে ফেলতে শুরু করল।
আমি যখন আমার টেবিলে কোমের কাছে ফিরে গেলাম তখন পানশালার বেশিরভাগ মানুষ আমাকে ঘিরে রেখেছে। তাদের প্রায় সবারই ধারণা আমি সম্ভবত বিশেষ সামরিক অস্ত্রাগারে তৈরি একটি প্রতিরক্ষা রোবট। আমি মাথা নেড়ে সেটা অস্বীকার করার পরেও তারা সেটা বিশ্বাস করতে রাজি হল না।
কোম দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, আমি সবসময় তোমার সাথে ঠাট্টা করে বলে এসেছি যে তুমি একটি ক্লোন। আজকে আমি নিশ্চিত হলাম।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন?
তুমি যে ক্ষিপ্রতায় খ্যাপা মেয়েটিকে আঘাত করেছ সেটি কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তুমি নিশ্চয়ই ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা একটা প্রাণী! তুমি নিশ্চয়ই ক্লোন।
ঠিক আছে কিন্তু আমি মানুষ সেটা তো স্বীকার করবে? নাকি তুমিও বিশ্বাস কর আমি একটা প্রতিরক্ষা রোবট?
কী জানি! কোম মাথা নেড়ে বলল, আমি আর কোনোকিছুই এখন বিশ্বাস করতে পারছি না।
.
আমি যখন পানশালা থেকে বের হলাম তখন মধ্যরাত্রি। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার নরম আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কোথায় জানি পড়েছিলাম রাতের বেলায় মাইলারের পরদা দিয়ে মহাকাশ থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলন করিয়ে কৃত্রিম জ্যোৎস্না তৈরি করা নিয়ে একসময় পৃথিবীতে বড় ধরনের বিতর্ক হয়েছিল। কৃত্রিম জ্যোৎস্না সৃষ্টি করার আগে কৃষ্ণপক্ষে অমাবস্যা নামক একটি ব্যাপার ঘটত, তখন নাকি আলো না জ্বালিয়ে রাখলে সারা পৃথিবী গভীর অন্ধকারে ঢেকে যেত। ব্যাপারটি কীরকম আমরা এখন ভালো করে কল্পনাও করতে পারি না।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা, কনকন করে শীতের বাতাস বইছে। নিও পলিমারের পোশাকের উত্তাপ বাড়িয়ে দিতে এক ধরনের আলসেমি লাগছিল, আমি জ্যাকেটের কলার দুটি উঁচু করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিলাম।
আমি কি তোমার সাথে খানিকক্ষণ হাঁটতে পারি? গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। আমার পাশে পাশে হাঁটছে সোনালি চুলের একটি মেয়ে। মেয়েটিকে আমি পানশালায় দেখেছি, আরো কয়েকজন মানুষের সাথে এসেছিল। কৃত্রিম জ্যোৎস্নায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মেয়েটির চোখ নীল, ত্বক কোমল এবং মসৃণ। মেয়েটি সম্ভবত সুন্দরী কিন্তু তবুও চেহারায় কোথায় জানি এক ধরনের কৃত্রিমতা রয়েছে–সেটি ঠিক ধরতে পারলাম না। আমি বললাম, অবশ্যই হাঁটতে পার। আগে থেকে বলে রাখছি হাঁটার সঙ্গী হিসেবে আমি কিন্তু একেবারে যাচ্ছেতাই।
তাতে কিছু আসে–যায় না। আজকে পানশালায় তুমি যেভাবে ঐ চরিত্রগুলোকে ধরেছ তার তুলনা নেই। আমি বাচ্চা মেয়ে হলে ডাইরিতে তোমার অটোগ্রাফ নিয়ে রাখতাম।
আমি হেসে বললাম, ওরকম পরিস্থিতিতে শরীরে এড্রিনেলিনের প্রবাহ বেড়ে যায় বলে অনেক কিছু করে ফেলা যায়।
মেয়েটা আমার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে কাজ করি, কোনটা এড্রিনেলিনের প্রবাহ দিয়ে করা যায়, কোনটা করার জন্য অমানুষিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়–আমি খুব ভালো করে জানি।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। মেয়েটি বলল, আমার নাম লানা। আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরে দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার।
আমি লানা নামের মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালাম। কমান্ডিং অফিসার কথাটি শুনলেই আমার চোখে উঁচু চোয়ালের ভাবলেশহীন একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। সোনালি চুল, নীল চোখ আর কোমল ও নরম ত্বকের একটি মেয়েকে কেন জানি মোটেই কমান্ডিং অফিসার বলে মনে হয় না।
লানা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী হল, পরিচয়টা বেশি পছন্দ হল না?
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, পছন্দ হবে না কেন? আমি তো আর গোপন ভিচুরিয়াস তৈরি করি না যে প্রতিরক্ষাবাহিনীর কমান্ডার শুনে আঁতকে উঠব!
কী কর তুমি?
বিশেষ কিছু করি না। একটা মাঝারি আকারের হলোগ্রাফিক ডাটা সেন্টার দেখাশোনা করি।
লানা শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, কী বলছ তুমি! তোমার মতো একজন মানুষ ডাটা সেন্টার দেখাশোনা করে?
আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। যারা অনাথ আশ্রমে বড় হয় তাদের জীবনে বড় সুযোগগুলো কখনোই আসে না। মাঝারি এবং ছোট সুযোগগুলোও আমরা চোখে দেখি না। আমাদের পুরো জীবনটা কাটে বড় বড় বিপর্যয়কে পাশ কাটিয়ে।
লানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে ভালো করতে।
আমি অবাক হবার ভঙ্গি করে বললাম, কী বলছ তুমি? আমি জানতাম গায়ের জোর দিয়ে যুদ্ধ করত গুহা–মানবেরা! আজকাল মারপিট করা হয় যন্ত্র দিয়ে–রোবটেরা করে।
সেটা তুমি ঠিকই জান। কিন্তু একমূহূর্তের মাঝে অসম্ভব জটিল কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কাজ করার ব্যাপারটি এখনো মানুষ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। আর সেরকম মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
আমি সেরকম একজন?
হ্যাঁ। লানা কথা না বলে আমার পাশে পাশে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকে। আমি কী নিয়ে কথা বলব ঠিক বুঝতে না পেরে শহরের তাপমাত্রা নিয়ে একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন মেয়েটা বলল, তুমি কি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও?
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, কী বলব বুঝতে না পেরে হাসার ভঙ্গি করে বললাম, তোমার ধারণা আমি খুব সাহসী মানুষ, আমি আসলে ভীত এবং দুর্বল।
ভীতি, দুর্বলতা এসব হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের এক ধরনের ইলেকট্রো কেমিক্যাল বিক্রিয়া। ছোট একটা ক্যাপসুল দিয়ে সে সব কিছু দূর করে দেওয়া যায়।
আমি ওই মেয়েটির দিকে আবার তাকালাম, আমার হালকা কথাবার্তাকে মেয়েটা সহজভাবে না নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলতে শুরু করেছে। সত্যি সত্যি আমাকে নিশ্চয়ই প্রতিরক্ষাবাহিনীতে নিতে চায়। আমি মুখটা একটু গম্ভীর করে বললাম, দেখ, আজকে পানশালায় আমি যে কাজটা করেছি সেটা করেছি হঠাৎ করে একটা ঝোঁকের মাথায়। এ ধরনের ভায়োলেন্ট কাজ আমি শুধুমাত্র ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ করেই করতে পারব। ঠাণ্ডা মাথায় কখনো করতে পারব না।
কিন্তু
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমাকে শেষ করতে দাও। শুধু যে করতে পারব না তাই নয়, আমি করতেও চাই না।
লানা একটা আহত দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, কিন্তু কিছু বলল না। আমরা নিঃশব্দে আরো কয়েক পা হেঁটে গেলাম এবং লানা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে একটা চতুষ্কোণ কার্ড বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার কার্ড।
আমি কার্ডটি হাতে নিলাম। মধ্যবিত্ত মানুষের স্বল্পমূল্যের কার্ড নয় এটি, রীতিমতো হলোগ্রাফিক মালটিকমিউনিকেশান্স কার্ড। বিজ্ঞানবিষয়ক সাপ্তাহিকীতে এর উপরে লেখা দেখেছি, কখনো নিজের চোখে দেখি নি। ছোট লাল বোতামে স্পর্শ করলে সাথে সাথে মেয়েটির সাথে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে যোগাযোগ করা যাবে। লানা বলল, আমি জানি তুমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও না কিন্তু তবু যদি কোনো কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাও এই কার্ডটি ব্যবহার কোরো।
কী নিয়ে যোগাযোগ করব?
লানা মিষ্টি করে হেসে বলল, সেটি তোমার ইচ্ছা। একটু থেমে বলল, আমি তা হলে আসি। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।
ধন্যবাদ লানা।
লানা হেঁটে হেঁটে দূরে লেভিটেশান টার্মিনালে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
রাত আরো গম্ভীর হয়েছে। আমার এখন বাসায় গিয়ে ঘুমানোর কথা, কিন্তু যে কারণেই হোক আমার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না, আমি হেঁটে হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলতে চাই। মাঝে মাঝে আমার বুকের ভিতরে গভীর এক ধরনের নিঃসঙ্গতা এসে ভর করে। কী করে সেই নিঃসঙ্গতা দূর করা যায় আমি জানি না। আমি তখন একা একা শহরের আনাচে–কানাচে হাঁটতে থাকি।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একসময় আমি আবিষ্কার করলাম আমি শহরের নির্জন পার্কের কাছে চলে এসেছি। ভিচুরিয়াসের নতুন একটি কম্পাউন্ড বের হবার পর থেকে শহরে ছোটখাটো অপরাধ খুব বেড়ে গেছে। নির্জন এলাকায় একটু পরে পরে দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল বসানো হয়েছে, এতে অপরাধীদের ধরে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারটি খুব সহজ হয়ে গেছে সত্যি কিন্তু অপরাধের সংখ্যা এতটুকু কমে নি। আমি এই নির্জন এলাকায় খ্যাপা কিছু ভিচুরিয়াসসেবীর হাতে ধরা পড়তে চাই না। পার্ক থেকে বের হবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম একটু দূরে চার জন মানুষ এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃত্রিম জ্যোৎস্নার নরম আলোতে মানুষগুলোকে এক ধরনের প্রেতাত্মার মতো দেখাতে থাকে। আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্কের কাঁপুনি অনুভব করি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে?
মানুষগুলো কোনো উত্তর না দিয়ে এক পা এগিয়ে এল। আমি কাঁপা গলায় আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে? কী চাও?
চার জন মানুষের মাঝে অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষটি মাটিতে থুতু ফেলে বলল, রোবটের বাচ্চা রোবট।
পানশালায় যে মানুষগুলো এসেছিল এরা নিশ্চয়ই তাদের দলের লোক। নিশ্চয়ই এরা প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমি কষ্ট করে নিজের গলার স্বর শান্ত রেখে বললাম, আমাকে যেতে দাও।
খাটো মানুষটি হিসহিস শব্দ করে বলল, তোমাকে নরকে যেতে দেব।
কী চাও তোমরা?
তোমার মুণ্ডু দিয়ে বল খেলতে চাই। চামড়া দিয়ে টেবিলক্লথ বানাতে চাই। রক্ত দিয়ে গ্রাফিতি আঁকতে চাই।
আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি এবং হঠাৎ করে আমার সমস্ত আতঙ্ক উবে গিয়ে সেখানে বিচিত্র এক ধরনের শক্তি এসে ভর করে। মনে হতে থাকে চোখের পলকে আমি চার জন মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারব। আমি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, তোমরা কে আমি জানি না। আমার জানা প্রয়োজন নেই। ঠিক দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি এর মাঝে—-
চুপ কর বেটা পিত্তথলি। সিফিলিসের ব্যাক্টেরিয়া।
খাটো চেহারার মানুষটা কথা শেষ করার আগেই একসাথে দুজন মানুষ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি প্রস্তুত ছিলাম, তারা আমার নাগালে আসার আগেই আমি শূন্যে লাফিয়ে উঠে সমস্ত শরীর ঘুরিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে দুজনকে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। মানুষ দুজন নিচে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল, আমি তাদের দিকে নজর না দিয়ে বাকি দুজনের দিকে তাকালাম। শান্ত গলায় বললাম, দশ সেকেন্ড সময় দিয়েছিলাম, তার মাঝে দুই সেকেন্ড পার হয়ে গেছে আর আট সেকেন্ড
আমার কথা শেষ করার আগেই দুজনের মাঝে অপেক্ষাকৃত লম্বা মানুষটি পোশাকের ভিতর থেকে একটা জিরকনালাইটের ছোরা বের করে আনে, কোথায় একটা চাপ দিতেই ধারালো ফলাটা বের হয়ে আসে। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলোতেও আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম ছোরার ফলায় সাদা পাউডারের মতো নিহিলা বিষ চকচক করছে। পেশাদার অপরাধীরা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে মাঝে মাঝে নিহিলা বিষ মাখানো জিরকনালাইটের ছোরা ব্যবহার করে শুধুমাত্র অমানুষিক যন্ত্রণা দেবার জন্য।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি ঐ ছোরাটা ব্যবহার করতে পারবে না। তার অনেক আগেই আমি তোমাকে শেষ করে দেব।
মানুষটি আমার কথা বিশ্বাস করল না, ছোরা হাতে আমার দিকে লাফিয়ে এল, আমি সরে গিয়ে তার চোয়ালে একটা ঘুষি দিতে গিয়ে থেমে গেলাম। কারণ ঠিক তখন খাটো মানুষটি একটা প্রাচীন স্টান্টগান আমার দিকে তাক করে গুলি করার জন্য এগিয়ে এসেছে। আমি ঘুরে প্রায় তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে সরে এলাম, মানুষ দুজন একসাথে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে একজন আরেকজনকে জাপটে ধরল। আমি দেখতে পেলাম দীর্ঘকায় মানুষটি তার হাতে উদ্যত জিরকনালাইটের ছোরা উঁচু করে ধরেছে, পরমুহূর্তে অন্য মানুষটি অমানুষিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল–ভুল করে তার পাজরে ছোরা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
নিহিলা বিষের যন্ত্রণা যে এত মারাত্মক আমি জানতাম না। মানুষটি অমানুষিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আমার সামনেই কয়েকটা খিচুনি দিয়ে হঠাৎ নিথর হয়ে গেল। দীর্ঘকায় মানুষটি তখনো হতচকিতের মতো জিরকনালাইটের রক্তাক্ত ছোরাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, আমি কখনো ভাবি নি আমি একটা হত্যাকাণ্ড দেখব। আমার আত্মাকে তুমি আজকে দূষিত করে দিলে নির্বোধ মানুষ।
.
কালো গ্রানাইটের টেবিলের অন্য পাশে একটি প্রতিরক্ষা রোবট এবং দুজন আইনরক্ষাকারী অফিসার বসে আছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী অফিসারটি আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করল, কেন তুমি এই উচ্ছঙ্খল মদ্যপ মানুষটিকে হত্যা করলে?
আমি তৃতীয়বার শান্ত গলায় বললাম, আমি এই মানুষটিকে হত্যা করি নি।
মানুষটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি কেন এখনো অর্থহীন কথা বলছ? তুমি যেখানে মানুষটিকে হত্যা করেছ ঠিক তার কাছে একটা দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল রয়েছে। পুরো ঘটনাটি নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। আমরা পরিষ্কার দেখেছি–
আমি বিশ্বাস করি না।
দ্বিতীয় অফিসারটি একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি বিশ্বাস না করলে কিছু আসে–যায়। যেটি সত্যি সেটি সত্যিই থাকবে।
আমি দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউলের ছবিটি দেখতে চাই।
সময় হলেই তুমি দেখবে। রিগা কম্পিউটারের সামনে যখন আত্মপক্ষ সমর্থন করবে তখন তোমাদের পুরো ঘটনাটি দেখানো হবে।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, তোমরা ব্যাপারটি বুঝতে পারছ না। এখানে একটা বড় ভুল হয়েছে। ঘটনাটি যদি আমাকে দেখাও আমি তোমাদের বলে দিতে পারি কোথায় ভুলটি হয়েছে।
কমবয়সী অফিসারটি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে রোবটটির দিকে ইঙ্গিত করতেই ঘরের মাঝামাঝি ত্রিমাত্রিক একটা ছবি দেখা যেতে শুরু করল। ছবিতে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম, আমার সামনে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খাটো মানুষটি আমাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করছে এবং হঠাৎ করে দুই জন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি তার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে তাদের নিচে ফেলে দিয়েছি। এর পরের দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ আমার শরীর শীতল হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম আমি আমার পোশাকের ভিতর থেকে জিরকনালাইটের ধারালো ছোরা বের করে এনেছি। অসম্ভব ব্যাপার, এটি কী করে সম্ভব? আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই দেখতে পেলাম আমি ধারালো ছোরা দিয়ে খাটো মানুষটিকে আঘাত করেছি। মানুষটি প্রচণ্ড আর্তনাদ করে নিচে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।
হলোগ্রাফিক দৃশ্যটি যেরকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেরকম হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। কমবয়সী অফিসারটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল তোমার কী বলার আছে।
আমি একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমার কিছু বলার নেই।
কিছু বলার নেই? বলবে না কেন মানুষটিকে কোনো প্ররোচনা ছাড়া আঘাত করলে?
আমি মাথা নাড়লাম, আমি আঘাত করি নি। দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল যে ছবি তুলেছে সেটার পরিবর্তন করা হয়েছে।
পুলিশ অফিসারটি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ কাঠ কাঠ স্বরে হা হা করে হেসে উঠে বলল, তুমি কি সত্যিই আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করতে বল? রিগা কম্পিউটার একটা অপরাধ–দৃশ্যের পরিবর্তন করেছে? আমরা যদি রিগা কম্পিউটারকে অবিশ্বাস করি তা হলে বিশ্বাস করব কিসে?
আমি চুপ করে রইলাম। প্রাচীনকালে মানুষ যেভাবে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করত এখন সেভাবে রিগা কম্পিউটারকে বিশ্বাস করা হয়। ঈশ্বরকে অবমাননা করার জন্য প্রাচীনকালে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, রিগা কম্পিউটারকে অবিশ্বাস করার জন্যও কি আমাকে সেভাবে শাস্তি দেওয়া হবে?
তুমি কথা বলছ না কেন?
আমি সাধারণ মানুষের সাথে লড়তে পারি। কিন্তু রিগা কম্পিউটারের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়ব? আমার কী বলার থাকতে পারে?
পুলিশ অফিসারটি আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি বিশ্বাস কর যে তোমার তথ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে?
আমি শুধু বিশ্বাস করি না, আমি জানি। আমি হঠকারী হতে পারি, নির্বোধ হতে পারি, আমি উন্মাদ হতে পারি, খ্যাপা হতে পারি, কিন্তু আমি কখনোই হত্যাকারী হতে পারি না।
আমার সামনে বসে থাকা পুলিশ অফিসার দুজন আমার কোনো কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। রোবটটি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে বলল, ট্রাকিওশান লাগাতে হবে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কী বললে? ট্রাকিওশান? আমার মাথায়?
হ্যাঁ।
কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ভয় পেয়ে মাথা নেড়ে বললাম, আমি কথা দিচ্ছি আমি কোথাও যাব না।
আমরা জানি, তুমি কোথাও পালিয়ে যাবে না।
তা হলে?
বিচারে তুমি যতক্ষণ নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ না করছ–যেটা খুব সহজ হবে না, বলতে পার প্রায় অসম্ভব—ততক্ষণ তুমি একজন হত্যাকারী। সমাজের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে।
আমি ভালো করে তাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না, অস্পষ্ট গলায় বললাম, দায়িত্ব?
হ্যাঁ। তোমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। পুলিশ অফিসারটি বলল, আমি দুঃখিত কিরি।
কিন্তু আমি জানি সে দুঃখিত নয়। এতটুকু দুঃখিত নয়।
০২. গভীর ঘুমে অচেতন
কিরি। ঘুম থেকে ওঠ, কিরি।
আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়েছিলাম, ঘুম থেকে জেগে উঠতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু কণ্ঠস্বরটি আবার আমাকে ডাকল, ওঠ কিরি। জেগে ওঠ।
আমি কষ্ট করে নিজেকে জাগিয়ে তুলোম। কণ্ঠস্বরটি নরম গলায় বলল, চোখ খুলে তাকাও কিরি।
আমি চোখ খুলে তাকালাম। আমি ধবধবে সাদা একটা বিছানায় শুয়ে আছি। আমার মাথার কাছে কিছু মনিটর, পায়ের কাছে একটা নিচু টেবিলে কিছু যন্ত্রপাতি। শরীর থেকে কয়েক ধরনের টিউব বের হয়ে যন্ত্রপাতিতে গিয়েছে, সেখান থেকে নিচু শব্দ তরঙ্গের একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম, আশপাশে কেউ নেই। কে তা হলে আমাকে ডেকে তুলল? এক ধরনের ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছিল, আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
চোখ বন্ধ কোরো না কিরি। কণ্ঠস্বরটি নরম গলায় বলল, চোখ খুলে তাকাও।
আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম, কে?
আমি।
আমি কে? আমি চারদিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কোথায়?
আমাকে তুমি খুঁজে পাবে না কিরি।
আমার ভিতরে হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে, আমি পুরোপুরি জেগে উঠে ভয়–পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কেন তোমাকে খুঁজে পাব না?
কারণ, আমি তোমার ট্রাকিওশান।
ট্রাকিওশান! আমি ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলাম, পাজরের এক কোনায় হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা করে ওঠে। মাথার পিছনে একটা ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করি। অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটি হঠাৎ সুরেলা গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল, তোমার এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই কিরি। আমি তোমার বন্ধু।
বন্ধু!
হ্যাঁ। তোমার মস্তিষ্কে আমাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তোমার সকল ইন্দ্রিয়কে এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ইচ্ছে করলে তোমাকে আনন্দ দিতে পারি। ইচ্ছে করলে দুঃখ দিতে পারি, কষ্ট দিতে পারি। তোমার সাথে কথা বলতে পারি এখন যেরকম বলছি। তোমাকে
আমি অসহনীয় এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বললাম, চুপ কর! চুপ কর তুমি।
কেন?
আমি বলছি তাই।
কণ্ঠস্বরটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, কিন্তু আমাকে তো সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় নি।
তোমাকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে?
আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তুমি একজন হত্যাকারী। হত্যাকারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আমি তোমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখব কিরি।
আমি দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম। ইচ্ছে করল শক্ত দেয়ালে মাথা ইকে খুলি ভেঙে ভিতর থেকে সবকিছু বের করে ফেলি।
তুমি মিছেমিছি ব্যস্ত হচ্ছ কিরি।
চুপ কর। চুপ কর তুমি।
আমি দুঃখিত কিন্তু আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় নি। আমাকে নিয়েই তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। ব্যাপারটি তুমি যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করে নেবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল।
আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, আমাকে কী করতে হবে?
তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে।
শুনছি।
তোমাকে সবকিছু স্বীকার করতে হবে।
কী স্বীকার করতে হবে?
তুমি কেন বিনা প্ররোচনায় একটি মানুষকে হত্যা করেছ?
আমি কাউকে হত্যা করি নি।
করেছ।
আমি চিৎকার করে বললাম, করি নি। করি নি।
আমার মাথার মাঝে ট্রাকিওশান খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তুমি নেহায়েত নির্বোধ একজন মানুষ। আমি কখনো শুনি নি একজন তার মস্তিষ্কে গেঁথে রাখা ট্রাকিওশানের কথার অবাধ্য হয়। আমি তোমাকে এমন যন্ত্রণা দিতে পারি যে মনে হবে কেউ তোমার শরীরের চামড়া একটু একটু করে খুলে নিচ্ছে। মনে হবে কানের মাঝে গলিত সীসা ঢেলে দিচ্ছে। মনে হবে সঁড়াশি দিয়ে নখ উপড়ে নিচ্ছে। মনে হবে কপালের মাঝে ড্রিল দিয়ে–
আমি চিৎকার করে বললাম, চুপ কর–চুপ কর তুমি।
আমার কথার অবাধ্য হয়ো না কিরি।
আমাকে একটু সময় দাও। তোমার পায়ে পড়ি আমি। আমাকে একটু সময় দাও। একটু সময়
দেব। নিশ্চয়ই দেব। আমার মাথার মাঝে ট্রাকিওশান নরম গলায় বলল, এখন আমি হচ্ছি তুমি, আর তুমি হচ্ছ আমি। আমি তোমাকে নিশ্চয় সময় দেব। তার আগে তুমি। আমাকে বল কেন ঐ মানুষটিকে হত্যা করেছিলে?
আমি কাউকে হত্যা করি নি। রিগা কম্পিউটার আমার ছবি পাল্টে দিয়েছে।
ট্রাকিওশানটি হঠাৎ চুপ করে গেল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম, আমার স্নায়ু টানটান হয়ে রইল অভাবিত কিছু একটা ঘটার জন্য কিন্তু কিছু ঘটল না। আমি ভয়ে ভয়ে ট্রাকিওশানকে ডাকলাম, তুমি কোথায়?
আমি আছি। তোমার সাথেই আছি।
তুমি কেন চুপ করে আছ?
আমি রিগা কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করছি। তার সাথে কথা বলছি।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। ট্রাকিওশানটি রিগা কম্পিউটারের সাথে কথা বলছে, আমি কি কারো সাথে কথা বলতে পারি না? কেউ কি নেই এই পৃথিবীতে যে আমাকে সাহায্য করতে পারে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমার মতো অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মানুষ আসলেই বড় নিঃসঙ্গ। বড় অসহায়। বড় দুঃখী।
ঠিক এই সময়ে আমার লানার কথা মনে পড়ল। সোনালি চুল এবং নীল চোখের সেই মেয়েটি যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার। যে আমাকে প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা বলেছিল, চলে যাওয়ার সময় তার হলোগ্রাফিক মালটিকমিউনিকেশান্স কার্ডটি আমাকে দিয়েছিল। আমি পকেটে হাত দিতেই চতুষ্কোণ কার্ডটির শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। জোর করে আমাকে অচেতন করে আমার মাথায় অস্ত্রোপচার করার সময় এই কার্ডটি ইচ্ছে করলে ফেলে দিতে পারত, কিন্তু তারা ফেলে দেয় নি। আমি কার্ডটি বের করে লাল বোতামটি স্পর্শ করতেই কার্ডটিতে এক ধরনের ভোঁতা শব্দ হল, ছোট ছোট দুটি বাতি জ্বলে উঠল এবং হঠাৎ করে আমার সামনে ছোট একটি স্ক্রিনে লানার ত্রিমাত্রিক একটা ছবি ফুটে উঠল। লানা উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, কে? কে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে!
আমি। আমি কিরি।
কিরি! কী ব্যাপার? তোমার কী হয়েছে?
আমি–আমি খুব বড় বিপদে পড়েছি লানা।
কী বিপদ?
সেটি অনেক বড় ইতিহাস–তোমাকে কীভাবে বুঝিয়ে বলব জানি না।
চেষ্টা কর।
আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগানো হয়েছে।
ট্রাকিওশান! লানা আর্তনাদ করে উঠল, কেন?
আমি নাকি একজনকে খুন করেছি।
লানা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে অনিশ্চিতের মতো বলল, খুন?
কিন্তু আমি খুন করি নি। রিগা কম্পিউটার মিথ্যা বলছে।
লানা শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে নিচু গলায় বলল, তুমি সত্যি সত্যি খুব বড় বিপদে পড়েছ কিরি।
আমি জানি।
তোমাকে সাহায্য করা যাবে কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা করব।
লানা!
বল।
যদি খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করা না হয় তা হলে আমাকে আর কেউ কোনোদিন সাহায্য করতে পারবে না।
আমারও তাই মনে হয়।
.
প্রতিরক্ষা দপ্তরের কমান্ডিং অফিসারদের যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে বলে আমি ধারণা করেছিলাম দেখা গেল তাদের ক্ষমতা তার থেকেও বেশি। কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমাকে বিশাল একটা হলঘরে এনে হাজির করা হল। হলঘরটিতে আবছা অন্ধকার, দেয়াল প্রায় দেখা যায় না। অনেক উঁচু ছাদ; সেখান থেকে এক ধরনের স্বচ্ছ নরম আলো বের হচ্ছে। ঘরের মাঝখানে কুচকুচে কালো কৃত্রিম গ্রানাইটের টেবিল। টেবিলের একপাশে উঁচু আরামহীন একটা শক্ত চেয়ারে আমি সোজা হয়ে বসে আছি। আমার সামনে টেবিলের অন্যপাশে তিন জন মাঝবয়সী মানুষ। এক জন পুরুষ, এক জন মহিলা, তবে তৃতীয় জন নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। সে পুরুষ কিংবা মহিলা দুই–ই হতে পারে, আধুনিক কোনো রোবট হলেও অবাক হব না। পুরুষমানুষটি তার সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু একটা দেখছে, স্ক্রিনটা আমার দৃষ্টিসীমা থেকে আড়াল করে রাখা আছে বলে মানুষটা কী দেখছে আমি জানি না। তার। মুখভঙ্গি এবং মাঝে মাঝে সূক্ষ্ম এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকানোর ভঙ্গি দেখে। মনে হচ্ছিল সম্ভবত সেখানে আমার সম্পর্কে কোনো তথ্য রয়েছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ হল এভাবে বসে আছি, নিজে থেকে কথা শুরু করার কথা নয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে অধৈর্য হয়ে আছি বলে হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদিও গত কয়েক ঘণ্টা আমার মস্তিষ্কে বসানো ট্রাকিওশানটি আমাকে কোনোভাবে উত্ত্যক্ত করছে না কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছি, ট্রাকিওশানটি হঠাৎ করে চালু হয়ে গেলে আমি স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারব বলে মনে হয় না।
আমার সামনে বসে থাকা মহিলাটি হঠাৎ চোখ তুলে বলল, তুমি আমাদের কাছে কী চাও?
আমাকে অন্যায়ভাবে একটা খুনের—
অপ্রয়োজনীয় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। মহিলাটি অনাবশ্যক রূঢ়তা ব্যবহার করে আমাকে থামিয়ে দিল। আমি আগেও লক্ষ করেছি একজন মেয়ে যত সহজে কোমল ব্যবহার করতে পারে ঠিক তত সহজে রূঢ় ব্যবহার করতে পারে।
মহিলাটি গ্রানাইটের টেবিলে তার চমৎকার নখ দিয়ে শব্দ করে বলল, তুমি ঠিক কী চাও?
আমি একমুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, আমার মস্তিষ্কে যে ট্রাকিওশানটি বসানো হয়েছে সেটা সরাতে চাই।
মহিলাটি সহৃদয়ভাবে হাসল, বলল, এই তো চমৎকারভাবে ঠিক বিষয়ে কথা বলতে শিখে গেছ। তবে তোমার এই ইচ্ছাটি পূরণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। প্রতিরক্ষা দপ্তর বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তে নাক গলাতে পারে না।
পারে।
আমার কথা শুনে পুরুষ এবং মহিলা দুজনেই একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। তৃতীয় মানুষটির কোনো ভাবান্তর হল না, এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, পারে?
নিশ্চয়ই পারে।
তুমি কেন এ রকম কথা বলছ?
কারণ আমি নিশ্চিতভাবে জানি রিগা কম্পিউটার আমার সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবর্তন করেছে। এই ধরনের অন্যায় কাজ বিচ্ছিন্নভাবে হতে পারে না। আমি নিশ্চিত সেটা ইচ্ছাকৃত। যে পদ্ধতিতে একটি অন্যায় কাজ করা হয় সেখানে নিশ্চয়ই আরো অসংখ্য অন্যায় এবং অনিয়মিত কাজ করা হয়।
মহিলাটি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। পুরুষমানুষটি একটু ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলল, তোমার অস্বাভাবিক শারীরিক ক্ষিপ্রতা থাকলেও বুদ্ধিমত্তা নিম্নশ্রেণীর।
আমি এক ধরনের অসহায় অপমানবোধ অনুভব করি, অত্যন্ত রূঢ় কিছু একটা বলার ইচ্ছে খুব কষ্ট করে সংযত করতে হল। শান্ত গলায় বললাম, আমি খুব সাধারণ মানুষ, খুব সাধারণ কাজ করি। আমার নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা দিয়েই বেশ কাজ চলে যায়।
ঠিক চলে না। তা হলে এখানে এসে উপস্থিত হতে না।
হয়তো আমাকে এখানে উপস্থিত করা হয়েছে। হয়তো পুরো ব্যাপারটি পূর্বপরিকল্পিত।
পুরুষমানুষটি এবারে শিস দেওয়ার মতো একটি শব্দ করে হেসে ফেলল এবং হঠাৎ করে তাকে একজন সহৃদয় মানুষের মতো দেখাতে থাকে। মানুষটি তার সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে টোকা দিতে দিতে বলল, আমরা যদি তোমার ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা। মিটিয়ে দিই তুমি আমাদের কী দেবে?
তোমরা যদি ট্রাকিওশানটি বের করে দাও–
মানুষটি হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি ট্রাকিওশান বের করার কথা বলি নি।
আমি থতমত খেয়ে বললাম, তা হলে?
ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলেছি।
পার্থক্যটা কী?
তোমার মস্তিষ্কে যে ট্রাকিওশানটি রয়েছে, তার যে প্রোগ্রাম রয়েছে সেটা হচ্ছে একজন খুনিকে নিয়ন্ত্রণ করার ট্রাকিওশান। আমরা প্রোগ্রামটি পাল্টে দিতে পারি।
কী দিয়ে পাল্টে দেবে?
যদি দেখি তুমি আমাদের সত্যিকার কোনো কাজ করে দিতে পারছ তা হলে নিরীহ কোনো প্রোগ্রাম দিয়ে পাল্টে দিতে পারি। তোমাকে যন্ত্রণা না দিয়ে সেটি বরং তোমাকে সাহায্য করবে–
চাই না আমি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি চাই না আমার মস্তিষ্কের ভিতরে একটা ট্রাকিওশান বসে থাকুক
আমিও চাই না এ রকম চমৎকার একটা দিনে অন্ধকার একটা ঘরে বসে একজন নিম্নশ্রেণীর খুনির সাথে তর্ক করি। কিন্তু তবু আমাকে সেটা করতে হয়।
আমি আবার অসহায় অপমানবোধ অনুভব করতে থাকি। মানুষটা গলার স্বর একটু উঁচু করে বলল, তোমার কিছু করার নেই। যদি আমাদের জন্য ছোট একটা কাজ করে দাও তোমার ট্রাকিওশানের প্রোগ্রাম পাল্টে দিতে পারি। ব্যস, আর কিছু বলে লাভ নেই।
প্রোগ্রামটা—
মানুষটা অধৈর্যের মতো মাথা নেড়ে বলল, আমি আর কিছু নিয়ে কথা বলতে চাই না। যদি রাজি থাক তা হলে বল রাজি আছি, আমাদের তথ্যকেন্দ্রে সেটা গ্রহণ করে নিই। যদি রাজি না থাক তা হলে বল রাজি নই, তোমার নিয়ন্ত্রণটা ট্রাকিওশানের পুরোনো প্রোগ্রামে ফিরিয়ে দিই।
আমি প্রায় মরিয়া হয়ে বললাম, কাজটা কী?
আমি জানি না। যদি জানতামও তোমাকে বলতাম না।
তা হলে–
আমি আর কিছু শুনতে চাই না। মানুষটা হঠাৎ অনাবশ্যকভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তুমি রাজি থাকলে বল। আমি তোমাকে ঠিক দুই সেকেন্ড সময় দিচ্ছি।
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, প্রকৃতপক্ষে আমাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় নি। পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা বড় পরিকল্পনার অংশ, আমি কী বলি তাতে মনে হয় কিছু আসে–যায় না। আমাকে নিয়ে যেটা করার কথা সেটাই নিশ্চয়ই করা হবে। আমি ইচ্ছে করলে রাজি না হওয়ার ভান করতে পারি তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। যদি রাজি হওয়ার ভান করি হয়তো ব্যাপারটা বোঝার একটু সময় পাব।
দুই সেকেন্ড অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বললাম, আমি রাজি।
চমৎকার। মানুষটা না–পুরুষ না–রমণী চেহারার মানুষটিকে বলল, ক্লিও, তুমি তা হলে কাজ শুরু করে দাও।
ক্লিও খসখসে গলায় বলল, সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো?
প্রোফাইলটা আরেকবার দেখে নাও। সিস্টেম সাতাই দিয়ে কনফ্লিক্ট হতে পারে।
ঠিক আছে।
ছোট একটা ঘরে সাদা একটা বিছানায় শুইয়ে আমার মস্তিষ্কের প্রোফাইল নেওয়া হল। একটা বড় মনিটরে ঝুঁকে পড়ে ক্লিও কিছু একটা দেখছিল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ক্লিও।
কী হল?
তুমি কি মানুষ না রোবট?
ক্লিও বিরক্ত হয়ে বলল, কাজের সময় তুমি বড় বিরক্ত কর।
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, ক্লিও মানুষ নয়, রোবট।
.
প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে ফিরে আসার পর দুই দিন কেটে গেছে। এই দুই দিন নতুন কিছুই ঘটে নি। আমার মাথায় ট্রাকিওশানটি রয়ে গেছে এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে সেখানে নতুন একটি প্রোগ্রাম প্রবেশ করানো হয়েছে কিন্তু আমি এখনো তার কোনো সাড়া পাই নি। যেন কিছুই হয় নি সেরকম একটা ভান করে আমি কাজে গিয়েছি, গত দুই দিন কেন অনুপস্থিত ছিলাম সেটা নিয়ে আমাকে একটা ছোট কৈফিয়ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
তৃতীয় দিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগের মুহূর্তে আমার সাথে প্রথমবার যোগাযোগ করা হল। কমবয়সী একটা মেয়ের গলায় একজন আমাকে ফিসফিস করে ডাকল, কিরি।
কণ্ঠস্বরটি কার হতে পারে পুরোপুরি জানার পরও আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি। তোমার ট্রাকিওশান। তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে ইশি বলে ডাকতে পার।
ইশি?
হ্যাঁ। আমি কি তোমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?
তুমি বলতে চাইছ আমি যদি রাজি না হই তা হলে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না?
না, বলব না। আমি সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি। আমি পুরোপুরি তোমার নিয়ন্ত্রণে। তোমার না চাওয়া পর্যন্ত আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।
আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
ইশি নামক সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি প্রোগ্রামটি তরল কণ্ঠে হাসার মতো শব্দ করে বলল, পরীক্ষা করে দেখ। তুমি বল দূর হও হতভাগা আমি তোমার কথা শুনতে চাই–আমি তা হলে তোমাকে আর বিরক্তকরব না।
সত্যি করবে না? কখনোই করবে না?
সেটা অবশ্য আমি বলতে পারব না। ইশি গলার স্বরে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বলল, প্রতিরক্ষা দপ্তরকে তুমি কথা দিয়েছ তাদের একটা কাজ করে দেবে। সেটা নিয়ে যদি প্রতিরক্ষা দপ্তর কিছু বলতে চায় তা হলে সেটা তোমাকে জানাতে হবে। তুমি শুনতে না। চাইলেও তোমাকে জানাতে হবে।
ও।
তা হলে কী দাঁড়াল? ইশি বলল, তোমার সাথে কথা বলব নাকি বলব না?
এটা কি প্রতিরক্ষা দপ্তরের আদেশ?
অনেকটা সেরকম।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তা হলে শোনা যাক। ব্যাপারটা নিয়ে আমার নিজেরও একটু কৌতূহল হচ্ছে।
ইশি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমাকে ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমি গত দুই দিন তোমার চিন্তাভাবনাকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি দেখতে পেয়েছি তুমি মানুষটা খুব কোমল স্বভাবের। তোমাকে যে কাজটা করতে হবে সেটি তোমার স্বভাবের সাথে একেবারেই খাপ খায় না।
আমাকে কী করতে হবে?
একটা খুন করতে হবে।
খুন? কাকে?
কাকে নয় ‘কী’–কে।
আমি বুঝতে পারছি না। যে জিনিসটা খুন করতে হবে সেটা যদি মানুষ না হয়ে থাকে তা হলে তুমি খুন কথাটা ব্যবহার করছ কেন? একটা যন্ত্র আমরা খুন করি না। আমরা ধ্বংস করি।
আমি যে জিনিসটার কথা বলছি সেটা মানুষের এত অবিকল প্রতিচ্ছবি, মানুষের এত সফল অনুকরণ যে সেটাকে মানুষ বলায় কোনো ক্রটি নেই। তাই আমি খুন কথাটা ব্যবহার করছি। ইশি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তুমি যদি আপত্তিজনক মনে কর আমি এই শব্দটা ব্যবহার করব না।
আমি হাত নেড়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললাম, কী শব্দ ব্যবহার করা হল তাতে কিছু আসে–যায় না। কী কাজ করতে হবে সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
তা ঠিক।
আমাকে তা হলে একটা রোবট ধ্বংস করতে হবে?
জিনিসটি পুরোপুরি রোবট নয়। এর ভিতরে রয়েছে কিছু যন্ত্র কিছু জৈবিক জিনিস আবার কিছু জিনিস যেটা যান্ত্রিকও নয় জৈবিকও নয়।
এটা কী? কোথা থেকে এসেছে?
ইশি একটু ইতস্তত করে বলল, ঠিক করে কেউ জানে না।
তার মানে তুমি আমাকে বলবে না।
বলতে পার। আমি খুব বেশি জানি না, কিন্তু যেটুকু জানি সেটুকুতেই নিষেধ রয়েছে।
তা হলে তুমি কেমন করে আশা কর কিছু না জেনেশুনে আমি হঠাৎ করে কাউকে খুন করে ফেলব?
তোমাকে যেটা জানানো প্রয়োজন সেট আমরা জানাব। তা ছাড়া—
তা ছাড়া কী?
তোমাকে খুন করার জন্য আলাদা করে আমাদের কিছু করতে হবে না। তুমি নিজে তোমার সর্বশক্তি দিয়ে সেটিকে শেষ করার চেষ্টা করবে।
কেন এই কথা বলছ?
তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্র বা প্রাণীটি তোমাকে কোনো সুযোগ দেবে না। তুমি যদি তাকে হত্যা না কর সেটি তোমাকে চোখের পলকে হত্যা করে ফেলবে।
কেন?
এই খেলাতে সেটাই নিয়ম। আমরা খেলোয়াড় মাত্র। নিয়ম তো আমরা তৈরি করি নি।
ও!
.
আমার আরো দুদিন কেটে গেল কোনোরকম যন্ত্রণা ছাড়াই। একদিন বিকেলে পানশালাতে গেলাম নিফ্রাইট মেশানো পানীয় খেতে। কোমের সাথে দেখা হল সেখানে, দুই গ্লাস নিফ্রাইট খেয়ে তার মস্তিষ্কে সিনান্সের খেলা চলছে, আমার দিকে চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল, এই যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের রোবট!
আমি ভিতর ভিতরে একটু চমকে উঠলাম। আমার মাথার ভিতরে একটা ট্রাকিওশানে প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটা প্রোগ্রাম বসানো রয়েছে আমাকে মনে হয় সত্যি এখন রোবট ডাকা যায়। কোম অবশ্য তার কিছু জানে না, ব্যাপারটি গোপন রাখার কথা। গোপন না রাখলে কী হবে আমি জানি না, কিন্তু ব্যাপারটা আমার পরীক্ষা করার সাহস হল না। কোম নিফ্রাইট মেশানো পানীয়ের তৃতীয় গ্লাসটিতে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, তোমার চকচকে ভাবটি নেই, কেমন যেন ভুসভুসে হয়ে গেছ!
আমি কোমের সামনে খালি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, একসময় চকচকে ছিলাম তা হলে?
ছিলে। তোমার মন ভালো থাকলেই তোমাকে চকচকে দেখায়! তোমার নিশ্চয়ই মন খারাপ। কী হয়েছে বল?
আমি একটু অবাক হয়ে কোমের দিকে তাকালাম, সত্যি কি আমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমি খুব বড় দুঃসময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি! আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল, কোম, তুমি সত্যিই বুঝেছ। আমার খুব মন খারাপ। আমার মাথায় একটা ধুরন্ধর ট্রাকিওশান বসানো আছে, সেটি আমাকে দিয়ে একটি খুন করিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমি সেটা বললাম না, শব্দ করে হেসে বললাম, কোম, তুমি আর যা–ই কর কখনো মনোবিজ্ঞানীর চাকরি নিও না, না খেতে পেয়ে মারা যাবে।
কোম একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি আমার কাছে কিছু–একটা লুকাচ্ছ। বল কী হয়েছে?
আমি কোমের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে বললাম, আমার কিছু হয় নি।
তার মানে তুমি আমাকে বলবে না।
আমি কোনো কথা না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আকাশে চমৎকার মেঘ করেছে। দূরে বনাঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে, গাছের পাতা নড়ছে বাতাসের ঝাপটায়। কী চমৎকার লাগছে দেখতে! জানালার এই দৃশ্যটি কৃত্রিম তবু সেটিকে সত্যি বলে ভাবতে ভালো লাগে।
চতুর্থ দিন ভোরবেলা আমি কাজে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আমার মস্তিষ্কের ভিতর থেকে ইশি বলল, কিরি, তোমার আজকে কাজে যাবার প্রয়োজন নেই।
কেন?
তোমাকে আজ প্রতিরক্ষা দপ্তরে যেতে হবে।
প্রতিরক্ষা দপ্তরে?
হ্যাঁ। তোমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র চালনা শেখানো হবে। কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।
আমি যদি যেতে না চাই?
কেন চাইবে না? ইশি হাসির মতো একটা শব্দ করে বলল, তোমার জন্য পুরো ব্যাপারটি হবে আশ্চর্য রকম সহজ।
আমি কোনো কথা না বলে একটা নিশ্বাস ফেললাম।
.
প্রতিরক্ষা দপ্তরের অফিসটিকে বাইরে থেকে চেনার কোনো উপায় নেই। ইশি আমাকে না বলে দিলে আমি কোনোদিন সেখানে প্রবেশ করতাম না। বড় কালো দরজার পিছনেই কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছিল, একজন এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বলল, আমার নাম বর্কেন। এটা অবশ্য আমার সত্যিকারের নাম নয়। আজকের জন্য আমার নাম বকেন।
আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার সত্যিকারের নাম বললে ক্ষতি কী?
নিষেধ রয়েছে। এখানে এটা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ।
ও।
আমার সাথে আছে দুই জন, কুন্না এবং ত্রালুস।
এগুলোও কি বানানো নাম?
হ্যাঁ।
তোমরা কি সবাই রোবট?
মানুষটা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল আমি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি রোবট কি না তাতে কিছু আসে–যায় না। আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান আছে সেটা আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমারও নিজেকে রোবট বলে মনে হয়। পুরোপুরি রোবট হয়ে গেলে খারাপ হয় না।
বৰ্কেন নামের মানুষটা মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, বেশ ভালোই হল তা হলে। আমাদের কাজ শেষ হলে তুমি মোটামুটিভাবে পুরোপুরি রোবটই হয়ে যাবে।
আমি চমকে উঠে মানুষটার দিকে তাকালাম, তার চোখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই।
.
ইশি যখন আমাকে বলেছিল প্রতিরক্ষা দপ্তরে আমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র চালানো শেখানো হবে আমার ধারণা ছিল সেগুলো হবে সনাতনধর্মী অস্ত্র, লেজার রশ্মিচালিত বিস্ফোরক বা এই ধরনের কিছু। কিন্তু প্রতিরক্ষা দপ্তরের মানুষেরা তার ধারেকাছে দিয়ে গেল না। তারা আমার ডান হাতের তর্জনী কেটে সেখানে ছোট একটি টিউব বসিয়ে দিল, তার পিছনে প্রক্ষেপণের জন্য যে যান্ত্রিক অংশটুকু রয়েছে সেটিকে আঙুলের নার্ভের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তর্জনী টানটান করে সেই যান্ত্রিক অংশটুকু চালু করতে পারি। সাথে সাথে ভয়াবহ টিউবের ভিতর দিয়ে ছুটে যাবে শক্তিশালী বিস্ফোরক। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত একটি শত্রু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে একমুহূর্তে।
আমার মুখের ভিতরে, জিভের নিচে বসানো হল দ্বিতীয় অস্ত্রটি, দাঁতের সাথে শক্ত করে আটকানো হয়েছে সেটি। ফুঁ দেওয়ার ভঙ্গিতে সেটাকে চালু করে তার যান্ত্রিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মুহূর্তে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরক।
সবশেষে অবশ্য আমাকে কিছু পরিচিত অস্ত্রও দেওয়া হল। তার ব্যবহারও শেখানো হল। দুই কিলোমিটার দূর থেকে আমি নিখুঁত নিশানায় ধ্বংস করে দিতে শিখে গেলাম যে কোনো জিনিস। ট্রাকিওশানে অনুপ্রবেশ করানো হল প্রোগ্রাম, উপগ্রহের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হল তার। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে চোখের পলকে যোগাযোগ করা যাবে আমার সাথে। কপালে ফুটো করে সেখানে লাগানো হল ইনফ্রারেড সেল, অন্ধকারে দেখার জন্য চোখের পাতায় সার্জারি করে লাগানো হল মাইক্রোচিপ। আমার রক্তে মেশানো হল বিশেষ হরমোন, নিশ্বাসে দেওয়া হল বিশুদ্ধ অক্সিজেন। আমার চামড়ার নিচে বসানো হল বায়োকেমিক্যাল সেল, শরীরের বিশেষ উত্তেজক ড্রাগ দিয়ে আমার সমস্ত স্নায়ুকে সতর্ক করে রাখা হল সর্বক্ষণের জন্য।
হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত করে প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বিশেষ একটি হলঘরে, সেখানে আমার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল আরো চার জন মানুষ। তাদের দুই জন মধ্যবয়সী, অন্য দুই জন প্রায় তরুণ। তারা স্বল্পভাষী এবং মুখভঙ্গি কঠোর। আমাকে দেখামাত্র তারা শীতল গলায় কথা বলতে শুরু করল। মধ্যবয়স্ক একজন বলল, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শত্রুকে চেনা। আমি খুব দুঃখিত যে এই যুদ্ধে তোমার সেই সৌভাগ্য হবে না।
আমার মুখের মাঝে লাগানো বিচিত্র অস্ত্রটিতে আমি এখনো অভ্যস্ত হতে পারি নি, সেটির কারণে আমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল, এক ধরনের জড়িয়ে যাওয়া উচ্চারণে বললাম, কেন এ কথা বলছ?
তোমার শত্রুকে চেনা প্রায় দুঃসাধ্য। সে অবলীলায় তার রূপ পরিবর্তন করতে পারে। তার যান্ত্রিক কাঠামোর ওপরে আধা জৈব এক ধরনের টিস্যু রয়েছে, সেটি অবিকল মানুষের ত্বকের মতো। সে ইচ্ছে করলে হুবহু মানুষের রূপ নিতে পারে।
তরুণ মানুষটি কোনো একটি সুইচ স্পর্শ করা মাত্র ঘরের মাঝামাঝি একটি হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে এল। আধা যন্ত্র আধা জৈবিক অত্যন্ত কদাকার একটি রূপ। মুখমণ্ডল আকৃতিহীন, চোখের জায়গায় দুটি গভীর গর্ত যার ভিতর থেকে দুটি লাল বর্ণের ফটোসেল জ্বলছে। তরুণটি উত্তাপহীন গলায় বলল, এটি সম্ভবত এই যন্ত্রটির প্রকৃত রূপ। কিন্তু তুমি তাকে এই রূপে দেখবে না। তুমি সম্ভবত তাকে এই রূপে দেখবে–
তরুণটি সুইচের কোনো এক জায়গায় স্পর্শ করামাত্র কদাকার যন্ত্রটি অনিন্দ্যসুন্দর একজন কিশোরের রূপ নিয়ে নিল।
কিংবা এই রূপে– কিশোরটি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হল, উঁচু চোয়াল, গভীর বিষণ্ণ নীল চোখ এবং একমাথা কোঁকড়ানো চুল।
আমাদের শেষ তথ্য অনুযায়ী যন্ত্রটি ইদানীং একটি মেয়ে রূপ গ্রহণ করছে। তার চেহারা সম্ভবত এ রকম।
হলোগ্রাফিক ছবিটি একটি স্বল্পবসনা রূপবতী মেয়ের রূপ গ্রহণ করে। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি তার প্রাণহীন একঘেয়ে গলায় আবার কথা বলতে শুরু করে, এই যন্ত্রটি বাইরে যে রূপ নিয়েই থাকুক না কেন, তার ভিতরে রয়েছে অসম্ভব জটিল কিছু যান্ত্রিক কলকব্জা। দেশের একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংস্থা কিছু নীতিহীন বিজ্ঞানীদের দিয়ে এই আধা যান্ত্রিক জৈবিক রোবটটিকে তৈরি করেছে। তার কপোট্রনের মেমোরি প্রায় মানুষের কাছাকাছি, চিন্তা করার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তার শারীরিক ক্ষমতা মানুষ থেকে অনেকগুণ বেশি। সাধারণ রোবট কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হয়, এই আধা জৈবিক রোবটটি প্রায় সব বিষয়ে পারদর্শী। তার প্রধান শক্তি হচ্ছে অমানুষিক নিষ্ঠুরতা। মানুষের প্রতি এক বিচিত্র ঘৃণা তার ভিতরে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। সেই ঘৃণা যে কী ভয়ঙ্কর আমরা এখনই তার একটা প্রমাণ দেখাব।
ঘরের মাঝামাঝি হলোগ্রাফিক ছবিটি পাল্টে গিয়ে সেখানে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর কিছু দৃশ্য দেখানো শুরু হয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের এজেন্টদের শরীরে লাগানো ক্যামেরা থেকে তোলা কিছু ছবির পুনর্গঠন। ছবিগুলো স্পষ্ট কিংবা পূর্ণাঙ্গ নয়, ঘটনার বীভৎসতা সে কারণে মনে হয় আরো ঠিকভাবে ধরা পড়েছে। যে দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছে সেগুলো সত্যি ঘটেছে চিন্তা করে আমার সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, এই অস্বাভাবিক আধা জৈবিক বরাবটের সাথে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করা খুব সহজ নয়। আমাদের চার জন এজেন্ট ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। সম্ভবত তুমিও প্রাণ হারাবে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করেই যেতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, তার ওপর ভিত্তি করে তোমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আধা জৈবিক রোবটটির কাছাকাছি তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন হয় সে তোমাকে হত্যা করবে, না হয় তুমি তাকে হত্যা করবে।
আমি চুপচাপ বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এই ধরনের ভয়ঙ্কর একটা জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কে জানত?
০৩. প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে সশস্ত্র হয়ে
প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে সশস্ত্র হয়ে ফিরে আসার পর আমার জীবনধারা অনেকখানি পাল্টে গেল। আমি একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারলাম না যে, আমার শরীরের নানা জায়গায় ভয়ঙ্কর কিছু অস্ত্র জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অঙ্গুলি হেলনে আমি বিশাল অট্টালিকা ধুলো করে দিতে পারি, এক ছুঁয়ে আক্ষরিক অর্থে আমি একটা ছোট জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারি। আমাকে ব্যবহার করার জন্য যে এটমিক ব্লাস্টার দেওয়া হয়েছে সেটা ব্যবহার করে আমি অবলীলায় এক মিটার পুরু সীসার পাতে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের গর্ত করে ফেলতে পারি। আমার এই অমানবিক ক্ষমতা আমার মাঝে এতটুকু আনন্দ নিয়ে এল না, নিজেকে সবসময় এক ধরনের হিংস্র দানব মনে হতে লাগল। যে ভয়ঙ্কর আধা জৈবিক রোবটটির মুখোমুখি হবার জন্য আমাকে এই হিংস্র দানবে পরিণত করা হয়েছে সেই রোবটটির প্রতি আমার ভিতরে এক বিজাতীয় ঘৃণার জন্ম হতে থাকে। এই রোবট বা প্রাণীটিকে দেখামাত্রই আমি যে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারব আমার ভিতরে সেটা নিয়ে এতটুকু সন্দেহ ছিল না। এই ধরনের অনুভূতির সাথে আমি পরিচিত নই, বুকের ভিতরে ভয়ঙ্কর জিঘাংসা নিয়ে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই আধা জৈবিক রোবটটির মুখোমুখি হবার। জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই সম্মুখ সংঘর্ষে আমি রোবটটিকে হত্যা করব নাকি রোবটটা আমাকে হত্যা করবে আমি জানি না, কিন্তু এখন তাতে কিছুই আসে–যায় না। পুরো ব্যাপারটির অবসান ঘটানো ছাড়া এই মুহূর্তে আমি আর অন্য কিছুই চিন্তা করতে পারছি না।
কাজেই একদিন মধ্যরাতে যখন ইশি আমাকে ডেকে তুলে বলল, কিরি প্রস্তুত হও তখন আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের অসুস্থ্ উল্লাস অনুভব করতে শুরু করলাম। আমি নিও পলিমারের আবরণে নিজেকে ঢেকে নিলাম, ছোট একটি ব্যাগে এটমিক ব্লাস্টারটি ভরে নিয়ে শরীরের নানা যন্ত্রাংশকে চালু করতে শুরু করলাম। সিরিঞ্জ দিয়ে চামড়ার নিচে একটি ছোট উত্তেজক ড্রাগ প্রবেশ করিয়ে দিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
মধ্যরাতে ইশি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে বহু দূরে একটি পরিত্যক্ত জ্বালানি পরিশোধনাগারে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। এলাকাটি নির্জন এবং অন্ধকার। আমাকে ইনফ্রারেড চশমা ব্যবহার করে অন্ধকারে হেঁটে যেতে হল। আমার হাতে শক্তিশালী এটমিক ব্লাস্টার, আমার শরীরে একাধিক ভয়ঙ্কর অস্ত্র, আমার রক্তে বিচিত্র কিছু হরমোন আমাকে বাড়াবাড়ি সাহসী করে রেখেছে কিন্তু তবুও আমার বুকের ভিতরে কোনো এক জায়গায় একটি বিচিত্র ধরনের আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। আমি ইনফ্রারেড চশমায় অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে থাকা আধা জৈবিক ভয়ঙ্কর রোবটটি খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যেতে থাকি। রোবটটির তাপমাত্রা কত হবে আমি জানি না, কপোট্রনে নিশ্চিতভাবে কিছু বেশি উত্তাপ থাকার কথা, আমার এই ইনফ্রারেড চশমায় নিশ্চয়ই আমি তাকে দেখতে পাব। সংবেদনশীল শব্দ প্রসেসরটিও চালু করেছি, সোজাসুজি সেটি শোনার কোনো উপায়। নেই, বিল্ডিঙের অন্য প্রান্তে ছোট মাকড়সার দেয়াল বেয়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দটি পর্যন্ত শুনতে পাওয়া যায়, তার মাঝে কোনটি সন্দেহজনক শব্দ এবং সেটি কোনদিক দিয়ে আসছে বোঝা কঠিন। শব্দ প্রসেসরের শক্তিশালী কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামটি সেটি প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক শব্দগুলোর অস্তিত্ব আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। পরিত্যক্ত এই জ্বালানি পরিশোধনাগারে ঢোকার আগে পর্যন্ত ইশি আমার সাথে কথা বলছিল, কিন্তু তারপর হঠাৎ করে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। আমার পরিপূর্ণ মনোযোগে সে এতটুকু বিচ্যুতি ঘটাতে চায় না।
আমি অন্ধকার কালো দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকি, ইনফ্রারেড চশমায় সমস্ত এলাকাটাকে একটা কাল্পনিক ভুতুড়ে দৃশ্যের মতো মনে হয়। ঘরের দেয়াল, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি থেকে বিচিত্র তাপমাত্রা বিকিরণ করছে, তার মাঝে আমি একটি নিষ্ঠুর আধা জৈবিক যন্ত্র খুঁজতে থাকি।
আমি ছোট একটি ধসে যাওয়া ঘর থেকে বড় একটা হলঘরে এসে হাজির হলাম। শোধনাগারের বড় বড় পাইপ, উঁচু ডিস্টিলেশান কলাম, ধ্বংস হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি এবং জঞ্জালের মাঝে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ আমার সামনে দিয়ে দ্রুত কিছু একটা ছুটে গেল। আমি সাথে সাথে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বড় একটি ট্যাংকের সাথে পিঠ লাগিয়ে আমি নিঃশব্দে হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি তুলে নিই। যে প্রাণী বা যন্ত্রটি আমার সামনে দিয়ে ছুটে গেছে তার আকার মানুষের মতো, মাথার অংশটি ইনফ্রারেড চশমায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, যার অর্থ সেটি উত্তপ্ত, একটি রোবটের যেরকম থাকার কথা। যে গতিতে ছুটে গেছে সেটি একজন মানুষের মতোই, নিশ্চিতভাবে কোনো এক জায়গায় সেটি লুকিয়ে গেছে, আমি তাকে দেখে যেটুকু সতর্ক হয়েছি, সেটিও নিশ্চয়ই আমাকে দেখে ততটুকু সতর্ক হয়েছে।
শব্দ প্রসেসরে আমি হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ শুনতে পেলাম, তার কয়েক মুহূর্ত পরে আরেকটি। এই যন্ত্র বা প্রাণীটি গুড়ি মেরে আমার দিকে গিয়ে আসছে। আমি নিঃশব্দে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, নড়ামাত্রই মনে হয় সেটি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি প্রাণীটিকে আমার আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতে দিলাম তারপর বিদ্যুদ্বেগে ঘুরে গিয়ে প্রায় শূন্যে লাফিয়ে উঠে প্রাণীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রাণীটি আমার এ রকম আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, আমার পায়ের ধাতব জুতোর আঘাতে কিছু–একটা ঝনঝন করে ভেঙে গেল। এবং আমি কয়েকটা বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ছুটে যেতে দেখলাম।
আমি যখন আবার নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছি তখন আমার দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখা এটমিক ব্লাস্টারটি প্রাণীটির কণ্ঠনালীতে ধরে রাখা, প্রাণীটিকে আমি ঠেলে দিয়েছি সামনের দিকে, ভরকেন্দ্র সরে গিয়েছে সামনে, আর একটু ধাক্কা দিলেই সে তাল হারিয়ে নিচে পড়বে। আমি হিংস্র গলায় চিৎকার করে বললাম, খবরদার, একটু নড়লেই তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দেব।
রোবট বা প্রাণীটি নড়ার চেষ্টা করল না, ট্রিগারে হাত রেখে বললাম, তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?
রোবটটি উত্তর দেবার আগেই ইশি ফিসফিস করে বলল, ছেড়ে দাও ওকে।
ছেড়ে দেব?
হ্যাঁ, এই মাত্র প্রতিরক্ষা দপ্তর খবর পাঠিয়েছে পুরো ব্যাপারটি একটি রিহার্সাল। এটা একটা সাজানো ঘটনা।
সাজানো?
আমার কথা শেষ হবার আগেই উজ্জ্বল আলোতে চারদিক প্লাবিত হয়ে গেল। অন্ধকারে এতক্ষণ রেটিনার রডগুলো কাজ করছিল হঠাৎ করে উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেল। চোখে আরো সয়ে যেতেই দেখলাম যে–ঘরটিকে পরিত্যক্ত জ্বালানি শোধনাগার ভেবেছিলাম সেটি অনেক যত্ন করে তৈরি করা একটি থিয়েটারের স্টেজের মতো। অসংখ্য ক্যামেরা আমার দিকে তাক করে আছে। আমার হঠাৎ নিজেকে নির্বোধের মতো মনে হতে থাকে।
আমি রোবটটিকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলাম। সেটি কয়েক পা ছুটে তাল সামলে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ক্রুদ্ধ গলায় বললাম এর অর্থ কী?
ইশি অপরাধীর মতো বলল, আমিও জানতাম না। প্রতিরক্ষা দপ্তর দেখতে চাইছিল সত্যিকারের পরিস্থিতিতে তুমি কী রকম ব্যবহার কর।
দেখেছে?
নিশ্চয়ই দেখেছে।
এটমিক ব্লাস্টার দিয়ে গুলি করে কিছু–একটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, এ রকম আর কতবার রিহার্সাল হবে?
আর হবে না।
তুমি নিশ্চিত?
আমি নিশ্চিত। তোমার আর রিহার্সালের প্রয়োজন নেই।
.
এক সপ্তাহ পরে মধ্যরাতে ইশি আবার আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল, বলল, কিরি প্রস্তুত হও।
আমি মুহর্তে পুরোপুরি জেগে উঠলাম, বললাম, পাওয়া গেছে?
হ্যাঁ। উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে একটা পরিত্যক্ত খনিতে লুকিয়ে আছে সে। আগেই খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, একটু আগে নিঃসন্দেহ হগেছে। তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও।
কত দূর এখান থেকে?
কমপক্ষে তিন শ কিলোমিটার। প্রক্রিক্ষাবাহিনীর বিশেষ জেট বিমানে যাবে তুমি। বেশি সময় লাগার কথা নয়।
আমি আবার নিজেকে নিও পলিমারের আস্তরণে ঢেকে নিলাম, ছোট একটা ব্যাগে এটমিক ব্লাস্টারটি ভরে নিয়ে আবার সারা শরীরের নানা যন্ত্রাংশকে চালু করতে শুরু করলাম। রক্তে বিচিত্র সব হরমোন মিশিয়ে দেবার জন্য চামড়ার নিচে সিরিঞ্জ দিয়ে উত্তেজক ড্রাগগুলো প্রবেশ করিয়ে দিলাম। ইনফ্রারেড চশমার নিয়ন্ত্রণটুকু পরীক্ষা করে নিয়ে বললাম, চল ইশি যাই।
ঘরের বাইরে অন্ধকারে আমার জন্য ছোট একটি ভাসমান যান অপেক্ষা করছিল। আমাকে নিয়ে সেটি কিছুক্ষণের মাঝেই শহরের কেন্দ্রস্থলের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিল। সেখানে ছোট একটি জেট বিমানে করে আমাকে রাতের অন্ধকারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। পাহাড়ি অঞ্চলের নির্জন পরিত্যক্ত একটি খনির উপরে আমাকে ছোট গ্লাইডারে নামিয়ে দেওয়া হল। তিন কিলোমিটার উঁচু থেকে সেই স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রিত গ্লাইডার নিঃশব্দে নিচে নেমে এল।
গ্লাইডারের দরজা খুলে আমি বের হয়ে এলাম, চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুইচ টিপে ইনফ্রারেড চশমাটি চালু করে দিতেই মনে হল চারদিকে এক ধরনের অশরীরী আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত এই খনিটির কোথায় সেই আধা জৈবিক রোবটটি লুকিয়ে আছে আমি জানি না। আমি সেটিকে খুঁজে পাব, নাকি সেটিই আমাকে খুঁজে বের করে, সে কথাটিই–বা কে বলতে পারে!
খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে নাও কিরি। ইশির কথা শুনে আমার খাবারের প্যাকেটটির কথা মনে পড়ল, এই নির্জন এলাকায় আমাকে কতদিন একাকী থাকতে হবে কে জানে, যে খাবারের প্যাকেটটি দেওয়া হয়েছে সেটি দেখে মনে হচ্ছে এক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে আমি হাঁটতে থাকি। খানিকদূর হেঁটে যেতেই খনির গভীরে নেমে যাওয়া সুড়ঙ্গটি চোখে পড়ল। প্রাচীনকালে আকরিক খনিজ তোলার জন্য অত্যন্ত অবিবেচকের মতো পৃথিবীর নিচে অনেক গহ্বর খোঁড়া হয়েছিল, তার বিশাল এলাকা এখন। বিপজ্জনক বলে পরিত্যক্ত হয়েছে। এটি সম্ভবত সেরকম একটি এলাকা। আমি সুড়ঙ্গের মুখে এসে দাঁড়াতেই ইশি ফিসফিস করে বলল, তোমার এদিক দিয়ে নামতে হবে।
আমি সুড়ঙ্গের গভীরে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেললাম, এর ভিতরে আমার জন্য কী লুকিয়ে আছে কে জানে! আমি ব্যাগ খুলে একটা পলিলন কর্ড বের করে সুড়ঙ্গে নামার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। কর্ডটা একটা আংটা দিয়ে উপরে আটকে নিয়ে নিচে তাকালাম, ইনফ্রারেড চশমায় অত্যন্ত বিচিত্র দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে পরাবাস্তব একটি জগৎ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি যেটুকু সম্ভব নিঃশব্দে নিচে নেমে আসতে থাকি। আধা জৈবিক রোবটটি গোপনে কোনো সুড়ঙ্গ থেকে আমাকে ধ্বংস করে দিলে এই মুহূর্তে আমার কিছু করার নেই।
নিঃশব্দে নেমে আসার চেষ্টা করেছি বলে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। পায়ের নিচে শক্ত মাটি অনুভব করার পর আমি বুক থেকে একটি নিশ্বাস বের করে সাবধানে শক্ত পাথরের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পিছন থেকে আচমকা কেউ আর আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না।
আমি নিঃশব্দে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে জায়গাটা সম্পর্কে একটা ধারণা করার চেষ্টা করতে থাকি। একটি গভীর সুড়ঙ্গ ডান দিকে নেমে গেছে। কোথাও আলোর কোনো চিহ্ন নেই, নিকষ কালো অন্ধকার–ইনফ্রারেড চশমায় সেটিকে একটি অলৌকিক জগতের মতো দেখাতে থাকে।
ইশি ফিসফিস করে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। তুমি এগিয়ে যাও।
আমি ডান হাতে অস্ত্রটি ধরে রেখে সাবধানে এগুতে থাকি। আজ থেকে হাজারখানেক বছর আগে পৃথিবীর মানুষ এই খনির ভিতর থেকে লোহার আকরিক তুলে নিয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে সুড়ঙ্গের মুখ জায়গায় জায়গায় বুজে গিয়েছে। আমি কোথাও হেঁটে হেঁটে, কোথাও গুঁড়ি মেরে, কোথাও প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। চামড়ার নিচে সিরিঞ্জ দিয়ে যে বায়োকেমিক্যালটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি আমার রক্তের মাঝে বিচিত্র সব হরমোন মিশিয়ে দিচ্ছে। আমার চোখে তাই কোনো ঘুম নেই, আমি এখন হিংস্র শ্বাপদের মতো সজাগ, আমার দেহ চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র, আমার স্নায়ু ধনুকের ছিলার মতো টানটান। আমার সমস্ত মনোযোগ এখন এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, কোনো একটি চলন্ত ছায়া, জীবনের কোনো একটি স্পন্দন দেখামাত্রই তাকে ধ্বংস করে দিতে হবে। যদি তা না করা হয় সেই ভয়ঙ্কর আধা জৈবিক প্রাণী আমাকে ধ্বংস করে দেবে।
.
এভাবে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন পরিত্যক্ত একটি খনির সুড়ঙ্গে ঘুরে বেড়াতে থাকি। কতদিন পার হয়েছে কে জানে। প্রথমে ক্ষুধার সময় প্যাকেট খুলে কিছু খেয়েছিলাম। খাবারের মাঝে কী ছিল আমি জানি না, এখন আর আমার মাঝে ক্ষুধা–তৃষ্ণা নেই। আমার চোখে ঘুম নেই, দেহে ক্লান্তি নেই। আমার বুকের ভিতরে এখন কোনো অনুভূতি নেই, নিজেকে বোধশক্তিহীন একটা যন্ত্রের মতো মনে হয়। যে অদৃশ্য আধা জৈবিক রোবটটিকে আমার ধ্বংস করতে হবে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো ক্রোধ বা জিঘাংসা নেই কিন্তু তবু আমি জানি তাকে আমার ধ্বংস করতে হবে।
আমার ভিতরে ধীরে ধীরে এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম হতে থাকে, নিকষ কালো অন্ধকারে ইনফ্রারেড চশমার বিচিত্র আধিভৌতিক এক জগতে হেঁটে হেঁটে নিজেকে একটি পরাবাস্তব জগতের অধিবাসী বলে মনে হয়। পুরো ব্যাপারটিকে মনে হয় ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত বিকারগ্রস্ত কোনো মানুষের দুঃস্বপ্ন। আমি ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকি আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। যে নৃশংস কাজের জন্য আমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে সেটি শেষ করার জন্য নিজের ভিতরে এক ধরনের অতিমানবিক তাগিদ অনুভব করতে থাকি। যখন এই অস্থিরতা এই অতিমানবিক তাড়না অসহ্য হয়ে উঠল ঠিক তখন আমি সুড়ঙ্গের গভীরে বহুদূরে একটা শীর্ণ আলোকরশ্মি দেখতে পেলাম। আমি স্পেকট্রাম এনালাইজারে পরীক্ষা করে দেখলাম, সত্যিই সেটা আলোকরশ্মি, তরঙ্গদৈর্ঘ্য মানুষের ঠিক দৃষ্টিসীমার ভিতরে।
ইশি আমার মস্তিষ্কের ভিতরে ফিসফিস করে বলল, সাবধান কিরি।
আমি সাবধান আছি।
মনে রেখো তুমি কিন্তু দ্বিতীয় সুযোগ পাবে না।
মনে রাখব।
আমি পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছি কিরি। তোমার একাগ্রতায় যেন এতটুকু ক্রটি না হয় সে জন্য আমি এতটুকু শব্দ করব না।
বেশ।
যদি তুমি বেঁচে থাক তোমাকে অভিনন্দন জানাব। যদি বেঁচে না থাক তা হলে বিদায় নিয়ে নিচ্ছি।
ঠিক আছে।
যদি কিছু অন্যায় করে থাকি, না বুঝে তোমার মনে কোনোরকম আঘাত দিয়ে থাকি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা চাইবার কোনো প্রয়োজন নেই।
ইশি হঠাৎ করে পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। সুড়ঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটা গুহার মতো জায়গা, একপাশে খোলা অংশটুকু দরজার মতো, মনে হয় ভিতরে একটা ঘর। সেই ঘরে কী আছে আমি জানি না, রোবটটিকে যদি বের হতে হয় এই দরজা দিয়ে বের হতে হবে। আমি দুই হাতে শক্ত করে এটমিক রাস্তারটা ধরে হাত উঁচু করে রেখে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকি, যত কাছে যেতে পারব লক্ষ্যভেদের সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। আমি বুঝতে পারি আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে, আমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ খুট করে অস্পষ্ট একটা শব্দ হল সাথে সাথে সামনে দরজার মতো খোলা জায়গায় যেন অদৃশ্য থেকে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল। আমি এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলাম, ছায়ামূর্তিটি হুবহু মানুষের ছায়ামূর্তি। আলোটা পিছন থেকে আসছে বলে আমি চেহারা, দেহের অবয়ব দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু মনে হল এটি একটি নারী। প্রতিরক্ষা দপ্তর আমাকে বলেছিল এটি একটি নারীদেহ ধারণ করে আছে। আমি নিশ্বাস আটকে রেখে এটমিক ব্লাস্টারের ট্রিগার টেনে ধরলাম, তীব্র একটা আলোর ঝলকানির সাথে সাথে তীক্ষ্ণ একটি শব্দ হল। সাথে সাথে ছায়ামূর্তিটিসহ গুহার বিশাল অংশটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধসে পড়ল। ধুলোয় ঢেকে গেল চারদিক। আমি তার মাঝে জোর করে এটমিক ব্লাস্টার হাতে চোখ খোলা রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণের মাঝেই বিস্ফোরণের ঝাঁপটা কমে আসে, গড়িয়ে পাড়া পাথর ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে স্থির হয়ে আসে, ধুলোর আস্তরণ সরে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকি, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছায়ামূর্তিটিকে নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে হবে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দরজার মুখটা প্রায় বুজে গিয়েছে, সাবধানে গুঁড়ি মেরে ভিতরে ঢুকলাম, বিস্ফোরকের একটা ঝাঁজালো গন্ধ ভিতরে। বড় বড় কয়েকটা পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি খোলা মতন একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, তীব্র একটা আলো জ্বলছে মাথার উপরে, এই কর্কশ আলোতে পুরো এলাকাটাকে কী ভয়ানক শ্রীহীন, কী নিদারুণ বিষাদময় দেখায়! আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেলাম। ঠিক আমার। পিছনে, শোনা যায় না এ রকম একটা মৃদু শব্দ হয়েছে, আমার পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমার মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার জন্য একমুহর্ত অপেক্ষা করলাম কিন্তু কিছু হল না। মেয়ের গলায় কেউ খুব মৃদু স্বরে বলল, যেভাবে দাঁড়িয়ে আছ ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে থাক। একটু নড়লেই তোমাকে আমি হত্যা করব নিশ্চিত জেনো।
আমি সাবধানে বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিলাম। আধা জৈবিক যে প্রাণীটি মেয়ের অবয়ব নিয়ে আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেটি আমাকে সাথে সাথে হত্যা করে একটি খুব বড় ভুল করেছে। আমি বেঁচে থাকব কি না জানি না, কিন্তু এই প্রাণীটি নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হবে আজ।
মেয়ের গলায় আধা জৈবিক প্রাণীটি আবার কথা বলল, আমি আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তুমি এতটুকু নড়বে না। কথা বলবে না।
আমি নড়লাম না, কথা বললাম না, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়ের গলায় আবার প্রাণীটি কথা বলল, তোমার হাতের অস্ত্রটি নিচে ফেলে দাও।
আমি এটমিক ব্লাস্টারটি নিচে ফেলে দিলাম।
এবারে এক পা সামনে এগিয়ে যাও।
আমি ছোট একটি পদক্ষেপ ফেলে অল্প একটু সামনে এগিয়ে গেলাম। প্রাণীটিকে আমি নিরস্ত্র দেখছিলাম, সে সম্ভবত এই অস্ত্রটি তুলে নেবে। অস্ত্রটি তোলার জন্য তাকে নিচু হতে হবে। মানুষ রোবট বা আধা জৈবিক যে কোনো প্রাণীই নিচু হওয়ামাত্রই খানিকটা অসহায় হয়ে যায়। তখন তাকে আক্রমণ করতে হবে।
আরো এক পা এগিয়ে যাও।
আমি আবার তুলনামূলকভাবে ছোট একটি পদক্ষেপ ফেলে অল্প একটু এগিয়ে গেলাম। আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটির গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করতে থাকি। অস্পষ্ট একটা শব্দ পোশাকের খসখসে একটা কম্পন শুনেই আমি হঠাৎ বিদ্যুদ্বেগে শূন্যে লাফিয়ে উঠে ঘুরে গেলাম। পায়ের শক্ত আঘাতে পিছনের প্রাণীটি তাল হারিয়ে ফেলল। নিচে নামার আগেই আমি আমার সমস্ত শরীর দিয়ে প্রাণীটিকে দ্বিতীয়বার আঘাত করলাম। কাতর একটা ধ্বনি করে প্রাণীটি শক্ত পাথরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
আমি দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে প্রায় একটা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো প্রাণীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাতটি তার দেহ থেকে একটু সামনে স্থির রেখে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরকটি দিয়ে আঘাত করতে গিয়ে থেমে গেলাম। প্রাণীটি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটি আধা জৈবিক কোনো প্রাণী নয়, এটি কুশলী কোনো রোবট নয়, এটি অনিন্দ্যসুন্দরী একটি তরুণী। তরুণীটির মুখে কোনো ভয় নেই, কোনো আতঙ্ক বা হতাশা নেই, এক গভীর বিষাদে সেটি ঢেকে আছে।
আমি আমার হাতের মাঝে লুকিয়ে রাখা ভয়ঙ্কর অস্ত্রটি তার মাথার কাছে ধরে রেখে বললাম, তুমি কে?
তরুণীটি কোনো কথা বলল না। বিচিত্র এক ধরনের বিষাদমাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমার মস্তিষ্কের মাঝে ইশি ফিসফিস করে বলল, হত্যা কর কিরি। হত্যা কর। এই চেহারা এই বিষাদমাখা চোখ সব বিভ্রম।
আমি ফিসফিস করে বললাম, বিভ্রম?
হ্যাঁ, বিভ্রম। ওর কোমল ত্বকের নিচে আছে টাইটেনিয়ামের দেহ। চোখের পিছনে সিলঝিনিয়াম ফটোসেল। বুকের ভিতরে নিউক্লিয়ার সেল।
সত্যি?
সত্যি। তুমি দেখলে না তোমার ভয়ঙ্কর আঘাতেও তার কিছু হয় নি? দেখছ না সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো মানুষ কি পারবে দাঁড়িয়ে থাকতে? পারবে?
না।
তা হলে হত্যা কর। সময় চলে যাচ্ছে কিরি।
অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটি তার বিষাদমাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ। হত্যা কর আমাকে। শুধু একটি কথা–
কী কথা?
আমাকে কথা দাও আমার মৃতদেহটি তুমি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। এর প্রতিটি কোষকে। আমাকে কথা দাও।
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আমি দেখতে পেলাম তার চোখের কোনায় চিকচিক করছে পানি।
হত্যা কর কিরি। ইশি ফিসফিস করে বলল, হত্যা কর।
হ্যাঁ। হত্যা কর আমাকে। তরুণীটি বলল ফিসফিস করে।
না। আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম, তার পর দুই পা পিছিয়ে এসে একটা পাথরের ওপর বসলাম। হঠাৎ করে আমার ক্লান্তি লাগতে থাকে। অমানবিক এক ধরনের ক্লান্তি, মৃত্যুর কাছাকাছি এক ধরনের ক্লান্তি।
মেয়েটি চোখ খুলে তাকাল। খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ?
আমি জোর করে চোখ খুলে রেখে মেয়েটির দিকে তাকালাম, কাঁপা কাঁপা ক্লান্ত গলায়। বললাম, তার আগে বল, তুমি কে? তুমি এখানে কেন এসেছ?
সেটা তো তুমি জান।
না, জানি না।
তা হলে কেন আমাকে হত্যা করতে চাইছ?
আমি চাইছি না। যারা আমাকে ব্যবহার করছে, তারা চাইছে।
মেয়েটি হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসে, উৎকণ্ঠিত গলায় বলে, তুমি অসুস্থ। কী হয়েছে তোমার?
আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান। শরীরে ক্ষেপণাস্ত্র। মুখের মাঝে বিস্ফোরক। আমার শরীরে উত্তেজক ড্রাগ। আমি কিছু খাই নি বহুদিন। আমি ঘুমাই নি বহুকাল।
মেয়েটি আমার কাছে এগিয়ে আসে, দুই হাতে আমাকে ধরে সাবধানে শুইয়ে দেয় নিচে। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে, বিশ্রাম নিতে হবে তোমার না–হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হবে একটা আর্টারি ছিঁড়ে। যারা তোমাকে ব্যবহার করছে তোমার জন্য তাদের এতটুকু করুণা নেই।
আমি জানি।
তুমি ঘুমাও। আমি তোমাকে দেখে রাখব।
আমাকে দেখে রাখবে? আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করতে এসেছিলাম।
কিছু আসে–যায় না তাতে। আমিও চাই একজন আমাকে হত্যা করুক। পূর্ণাঙ্গভাবে। হত্যা করুক। যেন
যেন কী?
মেয়েটা বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, কিছু না। তুমি এখন ঘুমাও। ঘুমাও।
সত্যি সত্যি আমার চোখে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘুম নেমে আসে। আমি অনেক কষ্ট করে চোখ খোলার চেষ্টা করে বললাম, তুমি কে?
মেয়েটা আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
জান না?
না। আমি কী আমি জানি কিন্তু আমি কে আমি জানি না।
গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাওয়ার আগে আমি শুনতে পেলাম ইশি ফিসফিস করে বলছে, হত্যা কর ওকে। হত্যা কর। মুখ থেকে ছুঁড়ে দাও বিস্ফোরক। ছুঁড়ে দাও।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না ইশি, আমি পারব না। আমি দানবকে ধ্বংস করতে পারি কিন্তু মানুষকে হত্যা করতে পারি না।
০৪. আমি ঠিক কত দিন
আমি ঠিক কত দিন বা কতক্ষণ গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে ছিলাম জানি না। ঘুমের মাঝে বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো আমি অর্থহীন স্বপ্ন দেখতে থাকি। মনে হতে থাকে আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবন্ত প্রাণীর মতো কিলবিল করে নড়ছে, আমি গড়িয়ে গড়িয়ে একটি অন্ধকার অতল গহ্বরে পড়ে যাচ্ছি। সেই অতল গহ্বরে মহাজাগতিক বীভৎস কিছু প্রাণী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার দেহকে তারা চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে খেতে এগিয়ে আসছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে আর অমানুষিক যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করতে থাকি আর তার মাঝে কোনো এক নারীকণ্ঠ আমাকে কোমল গলায় ডাকতে থাকে।
আমি ঘুম ভেঙে একসময় জেগে উঠি, দেখি সত্যি সত্যি অপূর্ব রূপবতী একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে। আমার মনে হতে থাকে এটি বুঝি পৃথিবীর কোনো মানবী নয়, যেন স্বর্গ থেকে কেউ ভুল করে নেমে এসেছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ সব কথা মনে পড়ে গেল, আমি এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটিকে হত্যা করতে এসেছিলাম।
মেয়েটি কোমল গলায় বলল, তুমি ঘুমের মাঝে কোনো একটি দুঃস্বপ্ন দেখছিলে।
হ্যাঁ। স্বপ্ন দেখছিলাম বীভৎস কোনো প্রাণী আমাকে খেয়ে ফেলছে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
জানি। দুঃস্বপ্ন খুব ভয়ঙ্কর হয়। আমি জেগে জেগেও দুঃস্বপ্ন দেখি।
আমি মেয়েটার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালাম, জিজ্ঞেস করলাম, কী বললে?
মেয়েটি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, না। কিছু না।
আমি উঠে বসে বললাম, তোমার সাথে আমার এখনো পরিচয় হয় নি। আমার নাম কিরি।
তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম কিরি।
তোমার নাম?
আমার কোনো নাম নেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, নাম নেই? কী বলছ?
ষোল বিটের একটা কোড দিয়ে আমার হিসাব রাখা হয়। হাতের চামড়ার নিচে একটা পালসার ছিল, খুলে ফেলেছি।
কী বলছ তুমি? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
মেয়েটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পারবে না। মাঝে মাঝে আমি নিজেও বুঝতে পারি না। তুমি যদি চাও আমাকে কোনো একটা নাম দিয়ে ডাকতে পার।
একজন মানুষ নাম ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে?
আমি মানুষ নই।
তুমি কী?
মনে হয় একটা দানবী। একটা পিশাচী
ইশি ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, কিরি। এটি একটি দানবী। একটি পিশাচী। তুমি একে হত্যা কর।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তুমি আমাকে হত্যা কর।
আমি চমকে উঠে বললাম, তুমি কীভাবে আমার ট্রাকিওশানের কথা শুনতে পাও? সে বলছে সরাসরি মস্তিষ্কে কোনো শব্দ না করে।
পিশাচীরা মনের কথা শুনতে পারে।
তুমি নিশ্চয়ই একটা রোবট। কাছাকাছি বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় রেডিয়েশান ধরতে পার।
মেয়েটি কোনো কথা বলল না, আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইশি ফিসফিস করে বলল, হত্যা কর। হত্যা কর। হত্যা–
আমি একটু অধৈর্য হয়ে আমার মস্তিস্কে বসানো ট্রাকিওশানকে বললাম, আমি যখন চাইব তখন করব। তুমি চুপ কর ইশি।
তুমি বুঝতে পারছ না। তোমার জীবনের ওপর প্রচণ্ড ঝুঁকি
তুমি চুপ কর।
তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই দায়িত্বের অবহেলা করতে পার না তুমি।
তুমি সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি, আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তুমি। আমি যখন তোমার সাহায্য চাইব তুমি সাহায্য করবে। না–হয় তুমি আমার সাথে কথা বলবে
মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল, তার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে আমাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে। তার মুখে ধীরে ধীরে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে ওঠে, হঠাৎ করে প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠল, আমি কখনো অন্য কারো ভালবাসা পাই নি। কারো স্নেহ–মমতা পাই নি। তুমি জান আমাকে কেউ কখনো কোনো দয়া কথা বলে নি।
আমি মেয়েটির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম, মেয়েটির দৃষ্টিতে হঠাৎ একটা কৌতুকের চিহ্ন ফুটে উঠল, বলল, তাই আমি ঠিক করেছি যে–কারো ভালবাসা পেলে শুধু তাকেই আমি ভালবাসব।
ইশি হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার করে বলল, না।
আমি চমকে ওকে বললাম, কী হল ইশি?
ইশি উত্তর দেবার আগেই মেয়েটা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, কিরি! কী মনে হয় তোমার? আমি কি নিজেকে ভালবাসি?
না–না–না–ইশি আমার মস্তিষ্কে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে ইশি? কী হয়েছে তোমার?
আমার মস্তিষ্কে ইশি কোনো উত্তর দিল না, চাপা কান্নার মতো এক ধরনের শব্দ করতে লাগল। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম, কী হয়েছে এখনো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি খুব দুর্বল সিস্টেম। সহজ প্রশ্নটাতেই তোমার ট্রাকিওশান কেমন জট পাকিয়ে গেল দেখেছ?
কী প্রশ্ন করেছ তুমি?
ছেলেমানুষি একটা প্রশ্ন। একটা প্যারাডক্স। আনুষের কাছে এই প্রশ্নের কোনো সমস্যা নেই–যন্ত্রের কাছে সমস্যা। সে কখনো তার উত্তর খুঁজে পাবে না। একটু সময় দাও, টেরা ওয়ার্ড মেমোরি শেষ হবার সাথে সাথে ওর সিস্টেম ধসে যাবে। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।
আর আমাকে বিরক্ত করবে না?
না। এই খনিটা মাটির অনেক নিচে, তামার আকরিকে বোঝাই। এখানে বাইরের পৃথিবীর কোনো সিগনাল আসে না। তোমার ট্রাকিওশানকে বাইরে থেকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সে নিজে থেকে যদি দাঁড়াতে পারে তোমার অনুগত একটি ট্রাকিওশান হয়ে দাঁড়াবে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমাকে যখন প্রথমবার হত্যা করা হয় তখন আমার মাথায় এ রকম ট্রাকিওশান ছিল।
আমি একটু শিউরে উঠে মেয়েটার দিকে তাকলাম, কী বলছে এই মেয়েটি? প্রথমবার হত্যা করার অর্থ কী?
একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। একজন মানুষকে কি বারবার হত্যা করা যায়?
আমি মানুষ নই।
তুমি কী?
মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটি গোপন প্রজেক্ট ছিল, তার নাম প্রজেক্ট অতিমানবী। সেই প্রজেক্টে অনেক শিশু তৈরি করা হয়েছিল।
তৈরি করা হয়েছিল!
হ্যাঁ। ওরা কোনো মা–বাবার ভালবাসায় জন্ম নেয় নি। ওদেরকে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছিল। সবাই ক্লোন। একটি কোষকে নিয়ে তার ডি. এন. এ.–কে একটু একটু করে পরিবর্তন করে নিখুঁত মানুষ তৈরি করার প্রজেক্ট ছিল সেটি। একসাথে তৈরি করা হত বিশ জন–পঁচিশ জন শিশু, প্রত্যেকটি শিশু ছিল এক জন আরেক জনের অবিকল প্রতিরূপ। একসাথে তাদের বড় করা হত একটি ইউনিট হিসেবে, তাদের আলাদা নাম দেওয়া হত না, আলাদা পরিচয় থাকত না। তারা সবাই মিলে একটি প্রাণী হিসেবে বড় হত। মানুষের শরীরে প্রত্যেকটি কোষ যেরকম আলাদা আলাদাভাবে জীবন্ত কিন্তু সবগুলো কোষ মিলে তৈরি হয় : মানুষ, অনেকটা সেরকম। প্রত্যেকটি শিশু আলাদা আলাদাভাবে জীবন্ত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবাই মিলে সত্যিকার একটা প্রাণী। একটা অতিমানব।
কোথায় সেইসব শিশুরা?
প্রতিরক্ষা দপ্তরের এই প্রজেক্ট ছিল পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট। তাই এই শিশুদের জিনগুলোর মাঝে একটা বিধ্বংসী জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তাদের বয়স যখন হত পাঁচ বছর, বিধ্বংসী জিনটি তার কাজ শুরু করত। রক্তের লোহিত কণিকা তৈরি হত ভিন্নভাবে, অক্সিজেন নিতে পারত না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে একে একে মারা যেত প্রতিটি শিশু হত্যা করার অনেক উপায় থাকা সত্ত্বেও এই নিষ্ঠুর উপায়টি বেছে নেওয়া হয়েছিল ইচ্ছে করে।
কেন?
সবাই মিলে ওরা একটা সত্তা ওদের যেকোনো একজন মারা গেলে ওদের সবারই মৃত্যুর অনুভূতি হত। এমনিতে সাধারণ কোনো মানুষ একবারের বেশি মৃত্যুর অনুভূতি অনুভব করতে পারে না–কিন্তু এই অতিমানবেরা বারবার সেই অনুভূতি অনুভব করত। বিজ্ঞানীরা মানুষের সেই অনুভূতি নিয়ে গবেষণা করতেন।
কিন্তু এটি তো নিষ্ঠুরতা।
নিষ্ঠুরতা কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। যে কাজ পশুর বেলায় করা হলে সেটি নিষ্ঠুরতা নয়, মানুষের বেলায় সেটি নিষ্ঠুরতা। পশুকে কেটেকুটে রান্না করে খাওয়া হয়, মানুষের বেলায় সেটা চিন্তাও করা যায় না। প্রচলিত অর্থে এইসব শিশুকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হত না। তাই তাদেরকে নিয়ে যেসব কাজ করা হত সেগুলো হত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সেগুলোকে কেউ নিষ্ঠুরতা মনে করত না।
আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি কি এই অতিমানব প্রজেক্টের এক জন?
মেয়েটি কথা না বলে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তা হলে বেঁচে আছ কেমন করে?
মেয়েটি বিচিত্র একটি ভঙ্গিতে হেসে বলল, বলতে পার প্রকৃতির এক ধরনের খেয়াল। ঠিক যে জিনটি আমাদের পাঁচ বছর পর হত্যা করত, মিউটেশানে তার পরিবর্তন হয়ে গেছে। ধ্বংসকারী সেই জিনের মাত্র একটা বেস পেয়ারের পরিবর্তন হয়েছে, যেটা হওয়ার কথা ছিল সি–এ–জি সেটা হয়েছে ইউ–এ–জি। যেখানে এমিনো এসিড গ্লুটামাইন তৈরি হওয়ার কথা সেখানে প্রোটিন সিনথেসিস বন্ধ হয়ে গেছে।
পাঁচ বছর পার হওয়ার পর যখন অক্সিজেনের অভাবে আমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবার কথা, আমরা কেউ মারা গেলাম না। আমাদের ডি. এন. এ. পরীক্ষা করে প্রজেক্ট অতিমানবীর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করল আমরা নিজে থেকে মারা যাব না। আমাদের একজন একজন করে হত্যা করতে হবে। কর্মকর্তারা কীভাবে মারা হবে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলল, আমরা আরো একটু বড় হয়ে গেলাম।
ট্রাকিওশান লাগিয়ে যখন আমাদেরকে প্রথমবার আত্মহত্যা করানো হল তার আঘাত হল ভয়ানক। দ্বিতীয়বার যখন আমাদের হত্যা করা হল আমাদের পক্ষে সেটি গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। মৃত্যুর পর কেউ ফিরে আসে না তাই পৃথিবীর কেউ মৃত্যুর অনুভূতি জানে না। আমরা জানি। আমাদের একজন যখন মারা যায় তখন আমরা সবাই সেই ভয়ঙ্কর কষ্ট অনুভব করি, ভয়ঙ্কর হতাশা আর এক অকল্পনীয় শূন্যতা অনুভব করি। তোমরা সেই অনুভূতির কথা কল্পনাও করতে পারবে না।
মেয়েটির মুখে একটি গাঢ় বিষাদের ছায়া এসে পড়ল। সে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা সেই কষ্ট আর সহ্য করতে পারলাম না, একদিন তাই ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে গেলাম।
পালিয়ে গেলে! আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমরা পাঁচ–ছয় বছরের শিশু কেমন করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের এত বড় ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে গেলে?
মেয়েটা একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমরা তখন ঠিক পাঁচ–ছয় বছরের শিশু নই, আরো একটু বড় হয়েছি। তা ছাড়া আমরা ছিলাম অতিমানবী, আমরা বড় হই অনেক দ্রুত। আমাদের ক্ষমতাও অনেক বেশি, আমরা মানুষের মনের মাঝে ঢুকে যেতে পারি। ভাবনা চিন্তা বুঝে ফেলতে পারি। মানুষের মস্তিষ্ককে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমরা যদি পালিয়ে যেতে চাই আমাদের আটকে রাখা খুব কঠিন।
পালিয়ে তোমরা কোথায় গেলে?
মেয়েটা বিষণ্ণ গলায় বলল, প্রথমে আমরা সবাই একসাথে ছিলাম। তখন প্রতিরক্ষা দপ্তরের ঘাতকদল এক জন এক জন করে আমাদের হত্যা করতে শুরু করল। নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমরা তখন ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেলাম।
মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যখন আমরা আলাদা আলাদা হয়ে গেলাম তখন প্রথমবার আমাদের সত্যিকারের সমস্যাটির কথা জানতে পারলাম।
সেটি কী?
আমরা ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ। আমাদের অতিমানবিক মস্তিষ্কের সঙ্গী হতে পারে শুধুমাত্র আমাদের মতো আরেকজন। তাদেরকে ছেড়ে আমরা যখন আলাদা হয়ে গেলাম মনে হতে লাগল আমাদের বুঝি একটি নিঃসঙ্গ এহে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এই জীবনের কোনো মূল্য নেই।
তা হলে তোমরা কী করবে?
এই অতিমানবী প্রজেক্ট একটি অত্যন্ত অমানবিক অত্যন্ত হৃদয়হীন প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টে আমাদের মতো কিছু অতিমানবী তৈরি হয় কিন্তু তারা আবিষ্কার করে এই পৃথিবী তাদের জন্য নয়। তুমি জান আমাদের কিছু অনুভূতি আছে যেগুলো কী ধরনের তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কী রকম সেই অনুভূতি?
আমি কেমন করে তোমাকে বোঝাব! যেমন মনে কর শব্দ। তুমি তো শব্দ শোন, তুমি কি জান প্রতিটি শব্দের একটা আকার আছে, একটা রং আছে?
শব্দের রং? আকার?
হ্যাঁ, তুমি সেটা চিন্তাও করতে পার না। কিন্তু আমরা সেটা দেখি। তোমাদের দুঃখের অনুভূতি আছে এবং সুখের অনুভূতি আছে কিন্তু তুমি কি জান যে তীব্র এক ধরনের সুখের অনুভূতি আছে, সেটি এত তীব্র যে সেটা যন্ত্রণার মতো?
আমি মাথা নাড়লাম, না, জানি না।
তোমাদের জানার কথাও নয়। তোমরা সৌভাগ্যবান, যেসব অনুভূতি তোমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তোমাদের শুধু সেই অনুভূতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের বেলায় সেটা সত্যি নয়, আমাদের করার কিছু নেই কিন্তু সেই অনুভূতি আমাদের বহন করে যেতে। হয়।
তোমরা এখন তা হলে কী করবে?
আমরা নিজেদেরকে ধ্বংস করে ফেলব।
ধ্বংস করে ফেলবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে আত্মহত্যা করবে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
মেয়েটি কোমল ভঙ্গিতে হেসে বলল, আমাকে কিছুই করতে হবে না। আমি শুধু সিদ্ধান্ত নেব যে আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। তখন আমার মস্তিষ্ক শরীরকে শীতল করে নেবে, হৃৎপিণ্ড রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেবে, আমার মেটাবলিজম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি বাচতে চাই কি না চাই সেটা আমার ইচ্ছা।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যখন অস্ত্র হাতে আমাকে হত্যা করতে এলে আমি ভেবেছিলাম আমি তোমাকে হত্যা করতে দেব, ঠিক তখন তোমার মস্তিষ্কের মাঝে আমি শুনতে পেলাম একটি কোমল কথা–তখন আর পারলাম না, সরে গেলাম।
আমি তোমার কাছে সে জন্য কৃতজ্–আমাকে একজন হত্যাকারী হতে হল না। শুধু তাই না–তোমার সাথে আমার পরিচয় হল– আমি এক মুহূর্ত থেমে বললাম, তোমার কোনো নাম নেই বলে আমার কথা বলতে খুব অসুবিধে হচ্ছে।
আমি তো বলেছি, একটা নাম দিয়ে দাও।
সত্যি?
সত্যি।
ঠিক আছে, এখন থেকে তোমার নাম লাইনা।
বেশ, আমার নাম লাইনা!
আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, তোমার সাথে পরিচয় হয়ে খুব খুশি হলাম লাইনা।
লাইনা আমার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি সত্যিই খুশি হয়েছ দেখে আমারও খুব। ভালো লাগছে কিরি।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি অতিমানবী! তুমি মস্তিষ্কের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পার–আমি সত্যি বলছি না মিথ্যা বলছি!
ঠিক তখন আমার মস্তিষ্কের মাঝে কে যেন ফিসফিস করে বলল, আমি কোথায়?
আমি গলার স্বরে চিনতে পারলাম, এটি আমার মস্তিষ্কে বসানো ট্রাকিওশান ইশি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, তুমি আমার মস্তিষ্কের ভিতরে।
মস্তিষ্ক কী?
তুমি যদি না জান মস্তিষ্ক কী, তোমাকে সেটা বোঝানো খুব কঠিন।
আমি কে?
তোমার নাম ইশি।
আমি কেন?
আমাকে সাহায্য করার জন্য।
আমি কীভাবে তোমাকে সাহায্য করব?
সময় হলেই আমি তোমাকে বলব। এখন আমরা আছি একটা খনির ভিতর, মাটির অনেক নিচে। তাই বাইরে থেকে কোনো সঙ্কেত আসতে পারছে না। কিন্তু আমরা যখন বাইরে যাব সাথে সাথে প্রতিরক্ষা দপ্তর তোমার সাথে যোগাযোগ করবে। তখন তুমি তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না।
ঠিক আছে আমি জবাব দেব না।
চমৎকার। তোমার আলাদাভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তোমার অস্তিত্ব আমার সাথে। আমার অস্তিত্ব রক্ষা করলেই তোমার অস্তিত্ব বেঁচে থাকবে। তাই তুমি সবসময় আমার নির্দেশ মেনে চলবে।
মেনে চলব।
তা হলে তুমি অপেক্ষা কর, যখন প্রয়োজন হবে, আমি তোমায় ডাকব।
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
ইশি মস্তিষ্কে নিঃশব্দ হয়ে যাবার পর আমি ঘুরে লাইনার দিকে তাকালাম, বললাম, আমি তোমার মতো অতিমানবী নই, আমি সাধারণ মানুষ, সেজন্যই মনে হয় আমি এই জিনিসটা বুঝতে পারছি না। যে আত্মহত্যা করতে চাইছে তাকে কেন হত্যা করতে হবে?
প্রতিরক্ষা দপ্তর জানে না আমরা এখন আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত হয়েছি। তারা জানে যে আমরা আর নিজেদেরকে বহন করতে পারছি না।
তা হলে কেন আমরা প্রতিরক্ষা দপ্তরকে সেটা জানিয়ে দিই না? এই নৃশংসতা কেন বন্ধ কর না?
করে কী হবে?
হয়তো তোমাদেরকে প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরিতে নেওয়া যাবে, হয়তো তোমাদের অতিমানবিক জিনিস পরিবর্তন করে তোমাদের সাধারণ মানুষে পরিবর্তন করা যাবে। হয়তো তোমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবে।
তোমরা? তুমি তোমরা কথাটি ব্যবহার করছ কেন?
কারণ তুমি নিজেই বলেছ তোমার একার অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গ নয়। সবাই মিলে তোমার অস্তিত্ব।
লাইনা ঝট করে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যিই আমাদের সবাইকে একত্র করতে পারবে!
আমি জানি না লাইনা। আমি নিচু গলায় বললাম, কিন্তু আমার মনে হয় সবকিছু জানতে পারলে প্রতিরক্ষা দপ্তর নিশ্চয়ই তোমাদের সবাইকে হত্যা না করে ল্যাবরেটরিতে ফিরিয়ে নেবে।
তোমার তাই মনে হয়?
আমার তাই মনে হয়। তুমি যদি রাজি থাক আমি চেষ্টা করতে পারি।
লাইনা কয়েক মুহূর্ত চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখ। আমি আমার সমস্ত অস্তিত্বগুলো একনজর দেখার জন্য সমস্ত বিশ্ব দিয়ে দিতে পারি। মৃত্যুর পূর্বে সবাই মিলে যদি একবারও পূর্ণাঙ্গ একটি অতিমানবী হতে পারি, আমার কোনো ক্ষোভ থাকবে না।
বেশ। আমি চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে আমাকে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।
কী ধরনের প্রস্তুতি?
আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরকে বিশ্বাস করি না। প্রয়োজনে যেন তাদেরকে ভয় দেখাতে পারি সেই প্রস্তুতি।
০৫. পরিত্যক্ত খনি থেকে
পরিত্যক্ত খনি থেকে বের হওয়ামাত্রই ইশি আমার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে বলল, আমাকে কেউ একজন ডাকছে।
প্রতিরক্ষা দপ্তর। উত্তর দেবার কিছু প্রয়োজন নেই।
কেন উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন নেই?
আমি কোথায় সেটা জানতে দিতে চাই না। তুমি উত্তর দেওয়ামাত্র আমার অবস্থান জেনে যাবে।
তোমার অবস্থান জানলে ক্ষতি কী?
আসলে কোনো ক্ষতি নেই। আমার অবস্থান আগে হোক পরে হোক জেনে যাবেই। কিন্তু আমি একটু সময় চাইছি।
আমি পরিত্যক্ত খনি থেকে অনেক কষ্টে শহরে ফিরে এলাম। নিজের বাসায় একদিন শুয়ে–বসে কাটিয়ে দিলাম। পরদিন শহরতলিতে পানশালায় গেলাম নিফ্রাইট মেশানো পানীয় খেতে। সেখানে কোমের সঙ্গে দেখা হল–আমার সাথে যে বেশ কয়েকদিন দেখা হয় নি সেটা নিয়ে কোম কিছু সন্দেহ করল না। আমরা পানীয়তে চুমুক দিয়ে শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি এই ধরনের বড় বড় ব্যাপার নিয়ে কথা বললাম। উঠে আসার সময় কোমকে জিজ্ঞেস করলাম, হিম নগরীতে যাবার সহজ রাস্তা কি জান?
কোম অবাক হয়ে বলল, হিম নগরী! সেখানে কেন যাবে?
আমি রহস্যময়ভাবে হেসে বললাম, একটু কাজ আছে!
হিম নগরীর রাস্তা কোম জানে না, আমি জানতাম সে জানবে না। কয়দিন পর যখন প্রতিরক্ষা দপ্তর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সে নিশ্চয়ই এই কথাটা বলবে, এই জন্যই তাকে জিজ্ঞেস করা।
আমি শহরের বড় বড় ব্যাঙ্ক ভন্টে কয়দিন ঘোরাঘুরি করলাম, আন্তঃভূমণ্ডল পরিবহন কেন্দ্রে কেনাকাটা করলাম, কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কে একদিন বসে বসে পৃথিবীর বড় বড় ডাটা সেন্টারে তথ্য বিনিময় করলাম। পৃথিবীর বড় কিছু গবেষণাগারে অর্থহীন বিষয় নিয়ে। আলোচনা করলাম। অবশেষে শহরের বড় একটি লেভিটেশান টার্মিনালে অসংখ্য মানুষের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে ইশিকে বললাম প্রতিরক্ষা দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে।
আমাকে খুঁজে বের করতে কতক্ষণ লাগবে সেটা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল ছিল, দেখতে পেলাম ঘণ্টাখানেকের মাঝেই আমাকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাছাকাছি একটা অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। লেভিটেশান টাওয়ারের ভিড় থেকে আমাকে তুলে আনা হয়েছে বলে অসংখ্য দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউলে সেটি সংরক্ষিত থাকার কথা, রিগা কম্পিউটার ইচ্ছে করলেই তার পরিবর্তন করতে পারবে কিন্তু এই বিশাল মানুষের ভিড়ের দৃশ্যে সেটি সহজ নাও হতে পারে।
প্রতিরক্ষা দপ্তরে আমার সাথে যে কথা বলতে এল সে সম্ভবত খুব উচ্চপদস্থ কর্মচারী, তার সাথে এসেছে দুজন আইনরক্ষাকারী অফিসার এবং একটি প্রতিরক্ষা রোবট। উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি মধ্যবয়স্ক, জীবনের একটি বড় সময় ভুরু কুঁচকে থাকার কারণে তার কপাল পাকাপাকিভাবে কুঞ্চিত হয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরে বলল, আধা জৈবিক প্রাণীটি ধ্বংস করে তোমার সাথে আমার যোগাযোগ করার কথা ছিল।
আমি একটু অবাক হবার দুর্বল অভিনয় করে বললাম, ছিল নাকি? আমি ভেবেছিলাম সে জন্য তোমরা আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগিয়েছ।
মানুষটি মুখ কালো করে বলল, ট্রাকিওশানটি আমাদের আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করছে।
তাই নাকি! আমি গলায় বিদ্রূপটুকু লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বললাম, কী অন্যায়! কী ঘোরতর অন্যায়?
প্রতিরক্ষা রোবটটি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইল, কিন্তু আমার কথায় সাথের আইনরক্ষাকারী অফিসার দুজন বিশেষরকম বিচলিত হয়ে উঠল বলে মনে হল।
উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আধা জৈবিক প্রাণীটিকে ধ্বংস করার একটি পূর্ণ বিপোর্ট দরকার। তুমি কি সেটি দেবার জন্য প্রস্তুত?
না।
কর্মচারীটি অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রাখল। আইনরক্ষাকারী অফিসারদের একজন বলল, কেন নয়?
সেটি সম্ভব নয় বলে।
কেন সেটি সম্ভব নয়?
কারণ আমি সেই প্রাণীটিকে হত্যা করি নি।
অসম্ভব। সেই প্রাণীটিকে হত্যা না করলে তুমি জীবন্ত বের হতে পারতে না। আমাদের সিসমি রেকর্ডে তোমার এটমিক ব্লাস্টারের বিস্ফোরণের সংকেত ধরা পড়েছে।
তোমরা যদি সেটি জান তা হলে কেন আমাকে প্রশ্ন করছ?
আমরা ঘুঁটিনাটি জানতে চাই। আধা জৈবিক প্রাণীটির ধ্বংসাবশেষ আনতে চাই।
আমি হঠাৎ করে সামনে ঝুঁকে গলার স্বর পরিবর্তন করে বললাম, আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আছে, কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমি দিতে পারি ঠিক সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষকে।
উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে হতে পারে?
তুমি তাকে চিনবে না। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যদি সেই মানুষের কথা তোমাকে বলি, তোমার বিপদ হতে পারে। তুমি কি সত্যিই শুনতে চাও?
আমি এই প্রথমবার মানুষটির মুখে এক ধরনের ভীতির ছাপ দেখতে পেলাম। সে ইতস্তত করে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তুমি তোমাদের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ মানুষ কিংবা যন্ত্রকে নিয়ে এস। যদি সেটা নিয়ে সমস্যা থাকে আমাকে একটি গোপন চ্যানেল দাও আমি ইশিকে ব্যবহার করে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কিংবা যন্ত্রের সাথে যোগাযোগ করি।
আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।
আমি কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে বললাম, তুমি জান আমি এক ছুঁয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দিতে পারি? তোমরা নিজেরা আমার মুখে ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরক লাগিয়ে দিয়েছিলে? সেটি এখনো ব্যবহার করি নি। তুমি জান?
আমার এই কথায় হঠাৎ ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সামনে যারা উপস্থিত ছিল তারা হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল এবং আমাকে একা বসিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি কালো একটি গ্রানাইট টেবিলের সামনে একাকী বসে রইলাম।
দীর্ঘ সময় পরে আমার সামনে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একজন বয়স্ক মানুষের ছবি দেখতে পেলাম। মানুষটি শুষ্ক গলায় বলল, তুমি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে চাইছ?
হ্যাঁ। শুধুমাত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছে।
বয়স্ক মানুষটি হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
সেটি সত্যি কি না আমি এক্ষুনি বুঝতে পারব। আমি একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বললাম, তুমি কি প্রজেক্ট অতিমানবীর কথা শুনেছ?
বয়স্ক মানুষটি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি–তুমি কী বললে?
প্রজেক্ট অতিমানবী।
তুমি কেমন করে প্রজেক্ট অতিমানবীর কথা জেনেছ?
তোমরা আমাকে যে অতিমানবীকে হত্যা করতে পাঠিয়েছিলে, আমি তাকে হত্যা করি নি। আমার তার সাথে পরিচয় হয়েছে
অসম্ভব।
তার কোন ক্রোমোজমের কোন জিনটির কোন বেস পেয়ারবটির মিউটেশানের কারণে তাদের মৃত্যু ঘটে নি সেটি বললে কি তুমি বিশ্বাস করবে?
বয়স্ক মানুষটি দীর্ঘসময় আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কেমন জানি ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি কী চাও?
আমি প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালকের সাথে কথা বলতে চাই।
বৃদ্ধ মানুষটি বিচিত্র এক ধরনের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে হঠাৎ কেমন জানি ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাতে থাকে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি কেন এটা করতে চাইছ?
অতিমানবীদের নিয়ে যে নৃশংসতা শুরু হয়েছে আমি সেটা বন্ধ করতে চাই।
তুমি?
হ্যা আমি।
তুমি কীভাবে সেটা করবে?
আমি সেটা প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালককে বলব।
বৃদ্ধ মানুষটি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালক সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান?
আমি কিছু জানি না।
আমারও তাই ধারণা, তাই তুমি তার সাথে দেখা করতে চাইছ।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কেন? তার সাথে দেখা করতে অসুবিধা কী?
আমার জানামতে কোনো মানুষ তার সাথে দেখা করে নি।
কেন?
এই প্রজেক্টটি পুরোপুরি পরিচালিত হয় আধা জৈবিক কিছু প্রাণী, কিছু রোবট, কিছু পরামানব–মানবী এবং কিছু যন্ত্র দিয়ে। সেখানে কোনো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই।
আমার শরীর কেন জানি শিউরে উঠল, আমি বৃদ্ধ মানুষটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, আমি তবু সেখানে যেতে চাই।
হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে বৃদ্ধ মানুষটি দীর্ঘসময় আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, আমি যদি তোমাকে এই মুহূর্তে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে অতিমানবীদের একে একে ধ্বংস করার প্রক্রিয়াটি চালু রাখি?
তুমি সেটা করবে না।
কেন?
তোমরা যে অতিমানবীকে হত্যা করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলে, সেই লাইনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তার শরীর থেকে রক্ত নিয়েছি, টিস্যু নিয়েছি। সেই রক্ত, টিস্যু, জীবন্ত কোষ বায়োজ্জ্যাকেটে করে হিম নগরীতে পাঠিয়েছি, পৃথিবীর নানা প্রান্তে জমা রেখেছি।
না– বৃদ্ধ মানুষটি চিৎকার করে বলল, না!
হ্যাঁ। তথ্যকেন্দ্রে আমি সেই তথ্যও জমা রেখেছি– বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিতে পার। আমার মৃত্যু হলে সেই তথ্য প্রকাশিত হবে। পৃথিবীর অর্থলোলুপ ব্যবসায়ীরা সেই টিস্যু, সেই জীবন্ত কোষ থেকে ৪৬টি ক্রোমোজম নিয়ে অতিমানবীর ক্লোন তৈরি করবে। কয়েকটি অতিমানবীর জায়গায় পৃথিবীতে থাকবে কয়েক সহস্র অতিমানবী। সেখান থেকে কয়েক লক্ষ। তোমরা কত জনকে হত্যা করবে?
না। না না। তুমি জান না তুমি কী ভয়ঙ্কর খেলায় হাত দিয়েছ। বৃদ্ধ মানুষটি চিৎকার করে বলল, তুমি উন্মাদ। তুমি বদ্ধ উন্মাদ।
সম্ভবত। কিন্তু একটা জিনিস জান?
কী?
আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলাম। তোমরা আমাকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলেছ। আর মজা কী জান? বদ্ধ উন্মাদ হয়ে আমার কিন্তু ভালো লাগছে।
বৃদ্ধ মানুষটি শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আমার কাছে কী চাও?
আমি একটি নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কি আমাকে প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালকের সাথে দেখা করিয়ে দেবে?
বৃদ্ধ মানুষটি খানিকক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল, তার পর অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব।
.
ভাসমান যানটি আমাকে চত্বরের শক্ত কংক্রিটে নামিয়ে দিয়ে এইমাত্র আবার আকাশে উঠে গেছে। আমি যতক্ষণ সম্ভব ভাসমান যানটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। লাল আলো জ্বলতে জ্বলতে এবং নিভতে নিভতে ভাসমান যানটি দূরে মিলিয়ে গেল। আমি সামনে তাকালাম, আমাকে বলে দেওয়া না হলে কখনোই বিশ্বাস করতাম না যে এই প্রায় বিধ্বস্ত দালানটি প্রজেক্ট অতিমানবীর মূল ল্যাবরেটরি। দূরে শক্ত পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা, উপরে নিশ্চয়ই শক্তিশালী ইনফ্রারেড আলোর অদৃশ্য প্রহরা। ভিতরে অবিন্যস্ত গাছপালা এবং ঝোঁপঝাড়, কংক্রিটের চত্বর থেকে ল্যাবরেটরি পর্যন্ত নুড়ি পাথর ছড়ানো রাস্তা। আমি হেঁটে হেঁটে ল্যাবরেটরির সামনে দাঁড়ালাম। কোথায় দরজা হতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম ঠিক তখন হঠাৎ ঘরঘর শব্দ করে চতুষ্কোণ একটা দরজা খুলে গেল, মনে হচ্ছে আমার জন্য কেউ একজন সেখানে অপেক্ষা করে আছে। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে ভিতরে পা দিলাম, নিজের অজান্তেই বুকের ভিতরে হঠাৎ আতঙ্কের একটা শিহরন বয়ে গেল।
দরজার পাশে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মানুষটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম, তার চারটি হাত। দুই হাতে সে শক্ত করে একটি বীভৎস অস্ত্র ধরে আছে, অন্য দুই হাতে আমাকে জাপটে ধরে আমি কিছু বোঝার আগেই আমার দুই হাতে একটা হাতকড়া লাগিয়ে দিল।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকালাম, সে খসখসে গলায় বলল, নিরাপত্তার খাতিরে তোমার হাতে হাতকড়া লাগাচ্ছি, তার বেশি কিছু নয়।
আমি মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, একজন মানুষের চারটি হাত দেখে নিজের অজান্তেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু যে জিনিসটি আমাকে বিস্মিত করল তার সাথে এই মানুষটির বিচিত্র দেহ–গঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মুখে এবং হাতের মাংসপেশিতে ভয়াবহ বিস্ফোরক লাগানো রয়েছে, ইচ্ছে করলেই আমি কঠোর নিরাপত্তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে এখানে ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে পারি। প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির এই প্রহরী সেই কথা জানে না প্রতিরক্ষা দপ্তর এই তথ্যটি জানার পরেও এদেরকে সে বিষয়ে সতর্ক করে দেয় নি ইচ্ছে করেই দেয় নি যার অর্থ এই ভয়ঙ্কর প্রজেক্টের জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরের কারো মনে এতটুকু সহানুভূতি নেই। কেন নেই?
চার হাতের মানুষটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে নিতে নিতে বলল, তোমার জন্য মহামান্য গ্রুটাস অপেক্ষা করছেন।
গ্রুটাস?
আমাদের এই ল্যাবরেটরির মহাপরিচালক।
আমি কোনো কথা না বলে হেঁটে যেতে যেতে কিছু বিচিত্র জিনিস দেখতে পেলাম। ঘরের মেঝেতে একটি হাত গড়াগড়ি খাচ্ছে, দেখে মনে হয় কেউ বুঝি কারো একটা হাত কেটে ফেলে রেখেছে; একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায় সেটি সত্যি নয় হাতের অন্যপাশে একটা ছোট কয়েক আঙুল লম্বা বিচিত্র অপুষ্ট দেহাবশেষ ঝুলছে। দেখে আমার শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। আমি একাধিক মানুষ দেখতে পেলাম যাদের মুখের জায়গায় একটি বীভৎস গর্ত। চোখের জায়গায় কান বের হয়ে এসেছে সেরকম কিছু বিচিত্র মানুষকেও ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। যে জিনিসটি দেখে আমি অমানুষিক আতঙ্কে প্রায় ছুটে যেতে চাইলাম সেটি মাথাহীন কিছু দেহ, যেগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পা নাড়ছে।
আমি একাধিক করিডোর ধরে হেঁটে, অনেক ধরনের বিচিত্র মানুষকে পাশ কাটিয়ে একটি বড় হলঘরের মতো জায়গায় হাজির হলাম। চার হাতের মানুষটি আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল।
বিশাল হলঘরের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একজন মানুষ ঝুলছে, মানুষটি স্বাভাবিক নয়, নিচের ঠোঁটটি একটু বেরিয়ে এসেছে। মানুষটির মুখের চামড়া কুঞ্চিত, চোখে অসুস্থ হলুদ রং। মানুষটির মুণ্ডিত মাথা দেহের তুলনায় অস্বাভাবিক বড়, তার ভিতরে কিছু–একটা নড়ছে, সেটা কী বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। মানুষটার বিশাল মাথার ভিতর থেকে নানা ধরনের টিউব বের হয়ে গেছে, তাদের ভিতর দিয়ে নানা রঙের তরল প্রবাহিত হচ্ছে। একাধিক টিউব নমনীয় ধাতবের, সম্ভবত বৈদ্যুতিক সঙ্কেত আদান–প্রদানের জন্য। পিছনের দেয়ালে জটিল কিছু যন্ত্রপাতি, আমি বিজ্ঞানী নই বলে সেগুলো কী ধরনের যন্ত্র। বুঝতে পারলাম না। মানুষটি কীভাবে শূন্যে ভেসে আছে দেখে বোঝা যাচ্ছে না, সম্ভবত সূক্ষ্ম কোনো তার দিয়ে ছাদ থেকে ঝোলানো রয়েছে।
বীভৎস এই মানুষটি আমাকে দেখে হঠাৎ সবৃসর করে নিচে নেমে আমার দিকে এগিয়ে। এল, যে সূক্ষ্ম ধাতব ফাইবারগুলো তাকে উপর থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে আমি এবারে সেগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মানুষটি আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই তার দেহ থেকে একটা দূর্গন্ধ ভেসে এল, পচা মাংসের মতো এক ধরনের উৎকট দুর্গন্ধ। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে তার মস্তিষ্ক অনেক বড়, সেখানে যান্ত্রিক কিছুও রয়েছে। নানা ধরনের টিউব দিয়ে সেই যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এই অসম্ভব কুদর্শন কদাকার মানুষটির গলা থেকে আমি এক ধরনের উৎকট কণ্ঠস্বরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু এই মানুষটির কণ্ঠস্বর অপূর্ব। সে গমগমে গলায় বলল, আমার নাম গ্রুটাস। তুমি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছ?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ।
গ্রুটাস নামের মানুষটি হা হা করে হেসে আবার সরসর করে উপরে ডানদিকে সরে গেল, সেখান থেকেই বলল, আশা করছি কারণটি জরুরি। আমি সাধারণত কারো সাথে দেখা করি না।
আমার মনে হয়েছিল কারণটা জরুরী। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিন্তু তোমার ল্যাবরেটরিতে হেঁটে আসতে আসতে আমি যা যা দেখেছি এখন আর নিশ্চিত নই।
গ্রুটাস সরসর করে নিচে নেমে আসতে আসতে বলল, তুমি কেন এ কথা বলছ?
তোমার এখানে মানুষকে নিয়ে গবেষণা হয়। যারা মানুষের দেহ–মনকে যেভাবে খুশি বিকৃত করতে পারে তাদেরকে আমি বুঝতে পারি না।
মানুষটি সরসর করে উপরে উঠে যেতে যেতে বলল, মানুষ কথাটির একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে।
সেটি কী?
তাদের ৪৬টি ক্রোমোজমের দুই লক্ষাধিক জিনকে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দেওয়া আছে। সেই জিনকে পরিবর্তন করা হলে তারা আর মানুষ থাকে না। তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করা যায়। পৃথিবীর আইন আমাকে সেই অধিকার দিয়েছে।
আমি আসতে আসতে যাদের দেখেছি তারা মানুষ নয়?
প্রচলিত সংজ্ঞায় মানুষ নয়। তাদের অত্যন্ত সীমিত আয়ু দিয়ে কৃত্রিমভাবে দ্রুত বড় করা হয়েছে। মানুষের শরীরের একেক জায়গার কোষ একেকভাবে বিকশিত হয় কারণ তার জন্য নির্ধারিত জিন যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করে, অন্যগুলো সুপ্ত থাকে। আমরা ইচ্ছেমতো তাদের বিকশিত করতে পারি, সুপ্ত রেখে দিতে পারি, প্রয়োজন থেকে বেশি জুড়ে দিতে পারি। যেখানে চোখ থাকার কথা সেখানে কান তৈরি হয়, একটা হাতের জায়গায় দুটি হাত বের হয়ে আসে। এই গবেষণার প্রয়োজন আছে। মানুষকে রক্ষা করার জন্য এইসব অসম্পূর্ণ। প্রাণী তৈরি করার প্রয়োজন আছে।
এই ল্যাবরেটরিতে সবাই অসম্পূর্ণ প্রাণী?
হ্যাঁ। সবাই অসম্পূর্ণ প্রাণী। আমি একমাত্র মানুষ।
আমি মানুষ নামের এই বিচিত্র প্রাণীটির দিকে এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে সরসর করে আবার সরে গিয়ে বলল, তুমি কেন এসেছ? কী চাও?
এটি প্রজেক্ট অতিমানবী ল্যাবরেটরি। তোমাদের তৈরি অতিমানবী বিষয়ে আমি একটি তথ্য নিয়ে এসেছি।
গ্রুটাস সরসর করে আমার এত কাছে সরে এল যে তার শরীরের দুর্গন্ধ আমার জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল। সে তার হলুদ চোখে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কী তথ্য?
তারা তোমার এই ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে গেছে।
আমি জানি।
ইচ্ছে করলে তারা তাদের ক্লোন দিয়ে সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলতে পারে, পৃথিবীর মানুষ এই ক্লোনদের দিয়ে অপসারিত হতে পারে।
গ্রুটাসের মুখ শক্ত হয়ে আসে, সে ক্রুদ্ধ গলায় বলে, প্রতিরক্ষা দপ্তর তাদেরকে একজন একজন করে হত্যা করার দায়িত্ব নিয়েছে।
একজন অতিমানবীকে হত্যা করা এত সহজ নয় গ্রুটাস। আমি জানি তারা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
তুমি কেমন করে জান?
কারণ আমি সেই হত্যাকারীদের এক জন। আমি তাদের হত্যা করতে পারি নি।
গ্রুটাস সরসর করে ছিটকে আমার কাছ থেকে সরে গেল, একবার উপরে উঠে গেল, নিচে নেমে এল, তারপর ঘরের মাঝামাঝি স্থির হয়ে বলল, কেন তুমি হত্যা করতে পার নি?
তাদেরকে হত্যা করার প্রয়োজন নেই বলে।
কেন প্রয়োজন নেই?
কারণ তারা স্বেচ্ছায় এখানে ফিরে আসবে।
গ্রুটাস সরসর করে নিচে নেমে এল। শক্ত মূখে জিজ্ঞেস করল, কেন ফিরে আসবে?
কারণ তাদের সম্পর্কে যেটা ভাবো সেটা সত্যি নয়–তারা ভয়ঙ্কর নৃশংস প্রাণী নয় তারা প্রকৃত অর্থে একজন মানুষ। শুধু একটি ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিলেই তারা ফিরে আসবে।
কোন ব্যাপারে?
তারা অতিমানবী হতে চায় না। সাধারণ মানুষ হতে চায়। তাদেরকে সাধারণ মানুষে পাল্টে দিতে হবে।
গ্রুটাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে হলুদ চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, জিনের যে পরিবর্তনটুকুর কারণে তারা অতিমানবী রয়েছে, ধরে নাও সেটি একটি ক্রটি। সেই টিটুকু সারিয়ে দাও। সেই কত শত বছর আগে রিকম্বিনেন্ট ডি, এন, এ. টেকনিক দিয়ে ক্রটিপূর্ণ জিনকে ভালো জিন দিয়ে সারিয়ে দেওয়া হত। তোমরা এখন সেটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করতে পার।
গ্রুটাস মাথা নাড়ল, পারি।
তা হলে তাদেরকে সারিয়ে দাও, অতিমানবিকতাকে একটি জিনেটিক ক্রটি হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের চিকিৎসা করে সারিয়ে তোল। তাদের সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দাও।
গ্রুটাস কোনো কথা বলল না, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, যদি না দিই?
তুমি দেবে। কারণ তোমার কোনো উপায় নেই। তোমার ল্যাবরেটরিতে তৈরি একজন অতিমানবীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তার দেহকোষ নিয়ে সারা পৃথিবীর অসংখ্য গোপন জায়গায় সঞ্চিত রেখেছি। অতিমানবীদের সাধারণ মানুষে পাল্টে না দেওয়া পর্যন্ত আমি সেই দেহকোষ ফিরিয়ে দেব না।
উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গ্রুটাস আমার কাছে ছুটে এল, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ। আমি হাতকড়া দিয়ে লাগানো আমার দুই হাত উপরে তুলে বললাম, তুমিও আমাকে ভয় দেখাচ্ছ এই দেখ আমাকে হাতকড়া পরিয়েছ।
গ্রুটাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি শান্ত গলায় বললাম, তুমি কি আমার প্রস্তাবে রাজি?
গ্রুটাস সরসর করে পিছনে সরে গিয়ে বলল, কিন্তু আমি কীভাবে নিশ্চিত হব যে তুমি অতিমানবীদের কোনো দেহকোষ লুকিয়ে রাখবে না?
আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে। আমি একমুহূর্ত থেমে শান্ত গলায় বললাম, মানুষকে মানুষের বিশ্বাস করতে হয়।
গ্রুটাস তীব্র স্বরে বলল, আমি মানুষ, তাই আমি মানুষকে বিশ্বাস করি না।
আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, সেটি তোমার সমস্যা। তুমি যদি চাও আমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করেও দেখতে পার।
তাই দেখব।
বেশ। এখন তুমি কি অনুমতি দেবে? আমি কি অতিমানবীদের নিয়ে আসব?
গ্রুটাস আবার একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, যাও। নিয়ে এসো।
তোমাকে ধন্যবাদ গ্রুটাস। আমি চলে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, গ্রুটাস!
বল।
তোমাকে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
কী প্রশ্ন?
তুমি নিজেকে মানুষ বলে দাবি কর, কিন্তু বেঁচে আছ যন্ত্রের মতো। তোমার মস্তিষ্ক থেকে টিউব বের হয়ে আসছে, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মস্তিষ্কের ভিতরে কোনো একটা যন্ত্র নড়ছে, টিউবে করে তরল যাচ্ছে, সূক্ষ্ম ধাতব ফাইবার দিয়ে তুমি শূন্য থেকে ঝুলে আছ, কারণটা কী?
আমি মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা জানি। তাই চেষ্টা করছি যন্ত্রের কাছাকাছি যেতে। মানুষের জিন নিয়ে আমি কাজ করি, গুরুত্বপূর্ণ জিনের বেস পেয়ারের তালিকা আমাকে জানতে হয়, তাই বিশাল তথ্যকেন্দ্রের সাথে আমার মস্তিষ্ককে জুড়ে দিয়েছি। আমি সরাসরি তথ্য নিতে পারি। মস্তিষ্ককে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য আমার মস্তিস্কে জীবাণু–নিরোধক তরল পাঠাতে হয়, মস্তিষ্ককে সতেজ রাখার জন্য উত্তেজক ওষুধ পাঠাতে হয় সে জন্য খুলির ভিতরে ক্রায়োজেনিক পাম্প বসিয়েছি।
আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, গ্রুটাসের বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ইচ্ছে করে এই জীবনপদ্ধতি বেছে নিয়েছ?
গ্রুটাস হঠাৎ ছটফট করে সরসর করে ছিটকে গিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি সীমানা অতিক্রম করছ নির্বোধ মানুষ। আমি ইচ্ছে করে এই জীবনপদ্ধতি বেছে নিয়েছি নাকি বাধ্য হয়ে নিয়েছি তাতে তোমার কিছুই আসে–যায় না।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিকই বলেছ। আমার কিছুই আসে–যায় না।
০৬. পলিলন কর্ডটি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম
পরিত্যক্ত খনিটিতে আমি যে পলিলন কর্ডটি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম সেটি এখনো ঝুলছে। আমি সেটা ধরে নিচে নামতে থাকি, আগেরবার যখন এই কর্ড বেয়ে নেমে এসেছিলাম তখন নানা ধরনের উত্তেজক বায়োকেমিক্যাল দিয়ে আমাকে একটি হিংস্র শ্বাপদের মতো সজাগ করে রাখা হয়েছিল। এবারে আমার মাঝে কোনো উত্তেজনা নেই। খনির নিচে আমি একা নেমে এসেছি সত্যি কিন্তু উপরে আমার জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরের বিশাল বাহিনী একাধিক ভাসমান যান নিয়ে অপেক্ষা করছে।
খনির নিচে অন্ধকার সুড়ঙ্গের বাতি জ্বালিয়ে আমি নির্দিষ্ট পথে যেতে থাকি, বড় বড় দুটি গুহার মতো অংশ পার হয়ে একটি সরু সুড়ঙ্গের পরেই আমি ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখতে পেলাম। ফাঁকা জায়গাটাতে পৌঁছে আমি ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোথায়?
আমার কথার কেউ উত্তর দিল না। হঠাৎ আমার বুকের ভিতর একটা আশঙ্কা উঁকি দিয়ে গেল, ভয় পাওয়া গলায় আবার ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোথায়?
ঠিক তখন আমি লাইনাকে দেখতে পেলাম, শক্ত পাথরের মেঝেতে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। আমি ছুটে গিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়লাম, আবার ডাকলাম, লাইনা।
লাইনা খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল, তার দৃষ্টি দেখে আমি হঠাৎ শিউরে উঠলাম, কী ভয়ঙ্কর শূন্যতা সেখানে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, কী হয়েছে তোমার?
লাইনা ফিসফিস করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল আমি ঠিক শুনতে পেলাম না। আমি তার হাত ধরে তার আরো কাছে ঝুঁকে পড়লাম, হাতটি বরফের মতো শীতল। লাইনা ফিসফিস করে বলল, বিদায়।
আমি প্রায় আর্তনাদ করে কাতর গলায় বললাম, কী হয়েছে তোমার লাইনা?
লাইনা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করল। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সে আত্মহত্যা করতে শুরু করেছে। আমাকে বলেছিল যখন সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেবে তার দেহ নিজে থেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে–স্বেচ্ছামৃত্যু! সত্যিই কি সেটা হতে চলেছে?
আমি পাগলের মতো লাইনাকে জাপটে ধরে ঝাঁকুনি দিতে থাকি, চিৎকার করে ডাকতে থাকি, লাইনা লাইনা, তুমি যেও না, যেও না।
লাইনা অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকিয়ে শোনা যায় না এ রকম স্বরে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না।
এই তো এসেছি। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
দেরি হয়ে গেছে কিরি। লাইনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বিদায়।
না। আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এটা করতে পার না। তুমি যেতে পারবে।
লাইনার নিশ্বাস আর স্পন্দন আরো বিলম্বিত হতে থাকে। শরীর শীতল হয়ে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে শুরু করেছে। আমি লাইনাকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, তুমি যেতে পারবে না লাইনা। যেতে পারবে না। আমি তোমার জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরে গিয়েছি, গ্রুটাসের মুখোমুখি হয়েছি, আমি নিজের জীবন পণ করেছি শুধু তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। তুমি এভাবে যেতে পারবে না। পারবে না।
লাইনার শরীর আরো নির্জীব হয়ে ওঠে। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখাবয়বে কেমন জানি এক ধরনের শীতলতার ছাপ এসে পড়েছে। মাথায় এলোমেলো ঘন কালো চুলের মাঝে নিখুঁত মুখাবয়ব ফুটে রয়েছে। ভরাট টুকটুকে লাল দুটি ঠোঁট অল্প ফাঁক করে রেখেছে, মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে সেই ফাঁক দিয়ে। বড় বড় বিস্ময়কর চোখ দুটি বুজে আছে। আমার মনে হতে থাকে এই চোখ দুটি খুলে আমার দিকে আরো একবার না তাকালে আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না। এক সম্পূর্ণ অপরিচিত অনুভূতি আমার বুককে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। আমার সমস্ত হৃদয় এক ভয়াবহ শূন্যতায় ঢেকে যেতে থাকে। আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। লাইনাকে টেনে তুলে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো হু হু করে কেঁদে উঠলাম। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভাঙা গলায় বললাম, না লাইনা, তুমি এটা করতে পারবে না। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না। পারবে না। আমি তা হলে কাকে নিয়ে থাকব?
আমি কতক্ষণ এভাবে লাইনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম জানি না। তার মাথায় মুখ ঘষে আমি অপ্রকৃতিস্থের মতো কাঁদছি ঠিক তখন আমার মস্তিষ্কে একজন ডাকল, কিরি।
আমি চমকে উঠলাম, কে কথা বলছে? এটা কি আমার ট্রাকিওশান ইশি?
না, কিরি। আমি লাইনা।
লাইনা! আমি চমকে উঠলাম, কেমন করে সে আমার মস্তিষ্কে কথা বলছে?
আমি পারি কিরি। আমি অতিমানবী। আমি চলে যেতে যেতে ফিরে এসেছি কিরি। আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি। আমি বড় দুঃখী। আমি বড় একাকী, বড় নিঃসঙ্গ। আমি বড় ভালবাসার কাঙাল। বল, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। বল। কথা দাও।
আমি লাইনার শীতল দেহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, তার চুলে মুখ ডুবিয়ে কাতর গলায় বললাম, কথা দিচ্ছি লাইনা। কথা দিচ্ছি। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব না। কখনো যাব না। তুমি ফিরে এস আমার কাছে।
আমি হঠাৎ অনুভব করতে পারি লাইনার দেহে আবার উষ্ণতা ফিরে আসছে। জীবনের উষ্ণতা। প্রাণের উষ্ণতা। আমার সমস্ত দেহ–মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে ওঠে, একেই কি ভালবাসা বলে?
.
ভাসমান যানে লাইনাকে নিয়ে পাশের শহরে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়ালাম। বিল্ডিঙের দু শ এগার তলার বিধ্বস্ত একটি ঘরের সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে একটি মেয়ে বের হয়ে এল। মনে হল মেয়েটি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেয়েটি দেখতে হুবহু লাইনার মতো, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতাম ঘরের ভিতর থেকে লাইনাই বের হয়ে এসেছে। মেয়েটি এসে লাইনার সামনে দাঁড়াল, একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে চোখে চোখে তাকিয়ে রইল, তাদের মুখে অনুভূতির কোনো চিহ্ন ফুটে উঠল না, শুধু মনে হল অসম্ভব একাগ্রতায় কিছু একটা বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। মানুষের চোখ আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ, চোখে চোখে তাকিয়ে আমরা তাই অনেক কিছু বুঝে ফেলতে পারি। লাইনা এবং তার এই সত্তাটি অতিমানবী, তারা নিশ্চয়ই চোখে চোখে তাকিয়ে তাদের এই দীর্ঘ সময়ের সব না–বলা কথা বলে নিচ্ছে, অবরুদ্ধ আবেগের বিনিময় করছে। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা একজন আরেকজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং আমি প্রথমবার বুঝতে পারি লাইনা ঠিকই বলেছে আলাদাভাবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, সবাইকে নিয়েই তাদের পরিপূর্ণ জীবন।
লাইনার দ্বিতীয় সত্তাকে সাথে নিয়ে আমরা শহরের বাইরের একটি নির্জন পাহাড় থেকে তৃতীয় সত্তাকে তুলে নিলাম। আমরা যখন তাকে তুলতে গিয়েছি সে তখন প্রস্তুত হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এবারেও ঠিক আগের মতো একজন আরেকজনকে ধরে একাগ্র দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে বুঝে নিতে শুরু করল।
এভাবে এক জন এক জন করে নয় জনকে ভাসমান যানে তুলে নিলাম। তারা সবাই একই ধরনের ক্লোন, তাদের চেহারা হুবহু একই রকম, শুধু তাই নয়, তারা সবাই একই পোশাক পরে আছে। তারা দীর্ঘসময় আলাদা হয়ে ছিল, দেখা হবার পর নিজেরা নিজেদের সাথে কথাবার্তা বলবে বলে আমার যে ধারণা ছিল সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কারণ আমি জানতাম না লাইনারা নিজেদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কথা বলতে হয় না, বিচিত্র একটি উপায়ে তারা মস্তিষ্কের ভিতরে কথা বলতে থাকে। লাইনাকে তার মৃত্যুর সীমানা থেকে টেনে আনার সময় সে আমার সাথে একবার কথা বলেছিল। ব্যাপারটি কীভাবে করে কে জানে, সুযোগ পেলে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি ভাসমান যানে বসে দেখতে পাচ্ছি নয় জন লাইনা পাশাপাশি বসে আছে, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে নেই কিন্তু তাদের মুখভঙ্গি একই রকম, সবারই একসাথে হাসিমুখ হয়ে আবার একই সাথে গাঢ় বিষাদে ঢেকে যাচ্ছে, সবাই একই সাথে একই জিনিস ভাবছে তারা আলাদা মানুষ হয়েও তাদের মস্তিষ্ক একটি। না জানি এই মস্তিষ্কের মাঝে কী ভয়ানক ক্ষমতা লুকিয়ে আছে।
ভাসমান যানটি আমাদেরকে প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির ভিতরে নামিয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেল। ভাসমান যানটির লাল বাতিটি পুরোপুরি অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা এখন এই দেয়ালে ঘেরা ল্যাবরেটরিতে পুরোপুরি প্রতিরক্ষাহীন। বলা যেতে পারে পুরোপুরি গ্রুটাসের অনুকম্পার ওপরে নির্ভর করে আছি। আমি বুকের ভিতর এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি, বাইরে সেটা প্রকাশ না করে আমি নিচু গলায় বললাম, চল ভিতরে যাওয়া যাক।
আমার মস্তিষ্কের মাঝে কেউ একজন মৃদু স্বরে বলল, তুমি ভয় পেয়ো না কিরি। ভয়ের কিছু নেই।
আমি চমকে উঠে নয় জন লাইনার দিকে তাকালাম, তাদের মাঝে কে কথাটি বলেছে বুঝতে পারলাম না। আমার মনেই ছিল না এই নয় জন অতিমানবী, আমার মস্তিষ্কের মাঝে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারে।
ল্যাবরেটরির দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্রই আবার চতুষ্কোণ দরজাটি খুলে গেল। প্রথমে আমি এবং আমার পিছু পিছু বাকি নয় জন ভিতরে এসে ঢুকল। আজকে দরজার পাশে চার হাতের সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে নেই, যে দাঁড়িয়ে আছে সে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক এবং নিরস্ত্র। মানুষটি উঁচু গলায় বলল, তোমাদের জন্য মহামান্য গ্রুটাস অপেক্ষা করছেন।
আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। মানুষটি হাঁটতে শুরু করল এবং আমরা দশ জন তার পিছু পিছু যেতে শুরু করলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে একবার নয় জন অতিমানবীর মুখের দিকে তাকালাম, তাদের চেহারায় আতঙ্ক বা অস্থিরতার কোনো চিহ্ন নেই, বরং এক বিস্ময়কর প্রশান্তি। এদের মাঝে কোনজন লাইনা কে জানে, কিংবা কে জানে এই প্রশ্নটিই কি এখন করা সম্ভব?
হ্যাঁ সম্ভব। আমার মাথার মাঝে লাইনা বলল, শুধু আমাকে একটি নাম দিয়েছ তুমি, এখানে আর কারো নাম নেই।
আমি আবার ঘুরে তাকালাম এবং লাইনা এবারে হাত তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সে নিজে থেকে পরিচয় না দিলে এই নয় জনের ভিতর কোনজন লাইনা আমার পক্ষে বোঝা সেটি একেবারেই অসম্ভব। আমি লাইনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কীভাবে এটি কর? ব্যাপারটি প্রায় ভৌতিক।
লাইনা এবারে শব্দ করে হেসে বলল, মানুষ যেটা বুঝতে পারে না সেটাকেই বলে ভৌতিক। এটি অত্যন্ত সহজ একটি ব্যাপার। দুটি মস্তিষ্কের স্টেট পুরোপুরি এক হলে তার স্বাভাবিক কম্পন এক হয়ে যায় তখন খুব সহজে সুষম উপস্থাপন করা যায়। আমরা নিজেরা সেটা করি অনায়াসে, তোমারটাতে একটু অসুবিধে হয়
কিন্তু যেহেতু এটা তথ্যের এক ধরনের আদান-প্রদান, এর বিনিময় হয় কিসে?
সবই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়। মানুষের শরীরে নার্ভাস সিস্টেমের সমস্ত তথ্যের আদান প্রদান হয় ইলেকট্রো কেমিক্যাল সিগনাল দিয়ে।
ব্যাপারটি বোঝার জন্য আমি আরো একটা প্রশ্ন করতে চাইছিলাম কিন্তু তার আগেই যে মানুষটি পথ দেখিয়ে আনছে সে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে মহামান্য গ্রুটাস তোমাদের সাথে দেখা করবেন।
আমি একটু অবাক হয়ে ঘরটিতে প্রবেশ করলাম। আমার পিছু পিছু লাইনারা নয় জন এবং সবার শেষে মানুষটি নিজেও ভিতরে ঢুকে গেল। ঘরটি ছোট এবং সেখানে গ্রুটাস নেই, আমি যেভাবে গ্রুটাসকে দেখেছি সে এখানে কীভাবে আসবে বুঝতে পারলাম না। আমি ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ ঘরের ভিতরে একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করল। কোনো একটা জিনিস ফেটে যাবার মতো শব্দ করে আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বাতাস বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো শব্দ করে চুপসে যেতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি সত্যিকার মানুষ নয়। আমার সামনে মানুষটি দুমড়েমুচড়ে ভেঙেচুরে যেতে শুরু করল এবং হঠাৎ করে আমার নাকে তীব্র একটি ঝাজালো গন্ধ এসে লাগল। গন্ধটি অপরিচিত, এটি বিষাক্ত কোনো গ্যাস, মানুষের মতো দেখতে এই যন্ত্রটির ভিতরে করে পাঠানো হয়েছে। আমার চেতনা হঠাৎ করে লুপ্ত হয়ে যেতে শুরু করে, জ্ঞান হারানোর আগে আমি ঘুরে তাকালাম—অতিমানবীরাও বুক চেপে ধরে দেয়াল আঁকড়ে ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। এটি শুধু মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়, অতিমানবীদের জন্যও বিষাক্ত। আমরা একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছি।
জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে শুনতে পেলাম আমার মস্তিষ্কে কেউ একজন বলল, ভার্ন গ্যাস!
.
জ্ঞান ফিরে পাবার পর চোখ খুলে দেখলাম আমার মুখের উপরে একটি যন্ত্র ঝুঁকে আছে। আমাকে জেগে উঠতে দেখে যন্ত্রটি সরে দাঁড়াল–এটি একটি প্রাচীন রোবট। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সেটি সম্ভব নয়, আমাকে ধবধবে সাদা একটা বিছানায় শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি রোবটটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোথায়?
রোবটটি এগিয়ে এসে বলল, তুমি প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির রেট্রো ভাইরাস অংশে।
এখানে কেন?
এই ল্যাবরেটরি যেসব রেট্রো ভাইরাস তৈরি করেছে সেগুলো পরীক্ষা করার উপযোগী মানুষের খুব অভাব। তোমাকে পাওয়ায় কিছু পরীক্ষা করা যাবে।
আমি বৃথাই আবার ওঠার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, আমার ওপরে পরীক্ষা চালানো হবে?
হ্যাঁ।
কিসের পরীক্ষা!
সেটা তুমি সম্ভবত বুঝবে না। মহামান্য গ্রুটান বলে থাকেন মানুষমাত্রই নির্বোধ।
তুমি বলে দেখ। হয়তো বুঝতে পারব।
তুমি নিশ্চয়ই জান রেট্রো ভাইরাস তার ডি, এন. এ. মানুষের ক্রোমোজমে পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দেয়।
আমি জানতাম না কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। রোবটটি তার একঘেয়ে গলায় বলল, মহামান্য গ্রুটাস কিছু চমৎকার রেট্রো ভাইরাস তৈরি করেছেন, তাদের ডি. এন. এ. তে কিছু মজার জিনিস ঢোকানো আছে।
সেই মজার জিনিসগুলো কী?
একটি মানুষের নিউরনের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
কীভাবে?
মস্তিষ্কের আয়তন বাড়িয়ে দিয়ে।
আমি পুরো পদ্ধতিটি ভালো করে বুঝতে পারলাম না, রোবটটি ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা করল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের নিউরনের সংখ্যা বেড়ে গেলে মানুষেরা কি বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যায়?
সেটি এখনো প্রমাণিত হয় নি। কারণ খুলির আকার বাড়ানো হয় নি বলে মস্তিষ্কের চাপে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় শেষ মানুষটির মৃত্যু হয়েছে।
আমি শিউরে উঠে রোবটটির দিকে তাকালাম, রোবটটি যান্ত্রিক গলায় বলল, নতুন রেট্রো ভাইরাসে খুলিটাকেও বড় করার ব্যবস্থা হয়েছে। এখনো পরীক্ষা করে দেখা হয় নি।
তার অর্থ আমাকে দিয়ে যে পরীক্ষা হবে সেটি সফল হলে আমার মস্তিষ্ক অনেক বড় হবে, সফল না হলে আমি মারা যাব?
যদি দেখা যায় তুমি মারা যাচ্ছ তা হলে তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে নেওয়া হবে। তোমার কিছু ক্লোন তৈরি হবে। ক্লোন তৈরি হতে সময় নেয় সেটাই হচ্ছে সমস্যা।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি রাজি নই।
কিসের রাজি নও?
আমাকে নিয়ে পরীক্ষা করায়। আমি কোনো রেট্রো ভাইরাসে আক্রান্ত হব না।
রোবটটি এক পা এগিয়ে বলল, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। এখানে তোমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই। মহামান্য গ্রুটাস যেভাবে চান সেভাবেই হবে।
কোথাও কিছু গোলমাল হয়েছে। আমি বললাম, আমাকে তোমরা এভাবে হত্যা করতে পারবে না। আমি সারা পৃথিবীতে অতিমানবীর টিস্যু ছড়িয়ে রেখেছি। আমাকে
মিথ্যাবাদী! রোবটটি শান্ত গলায় বলল, তোমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগানো ছিল, আমরা জানতাম না। তুমি যখন অচেতন ছিলে আমরা সেটা বের করে এনেছি।
বের করে এনেছ? তার মানে আমার মাথায় এখন ট্রাকিওশান নেই?
না। আমরা সেই ট্রাকিওশানটিকে বিশ্লেষণ করেছি। সেটি সব কথা স্বীকার করেছে। সে বলেছে তুমি সারা পৃথিবীতে অতিমানবীদের টিস্যু ছড়িয়ে দাও নি। তুমি অতিমানবীদের জীবকোষ বাঁচিয়ে রাখ নি। তুমি প্রতিরক্ষা দপ্তরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছ, নানা কেন্দ্রে জীবকোষ সংরক্ষণের ভান করেছ।
আমি হতচকিত হয়ে রোবটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রতিরক্ষা দপ্তরের বিরুদ্ধে আমার এবং অতিমানবীদের নিরাপত্তার পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করেছিল এই ছলনাটির ওপর। সেটি ধরা পড়ে গেলে আমাদের রক্ষা করবে কে?
রোবটটি একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি মিথ্যাবাদী। আমরা মিথ্যাবাদীদের কঠোর শাস্তি দিই। মহামান্য গ্রুটাস তোমাকে কঠোর শাস্তি দেবেন। শাস্তি দেওয়ার আগে তোমার ওপর এই পরীক্ষাটি করতে চান। আমরা আশা করছি এই পরীক্ষায় তোমার যেন মৃত্যু না হয়।
না। আমি অক্ষম আক্রোশে চিৎকার করে বললাম, না! তোমরা সেটা করতে পার না।
মহামান্য গ্রুটাস ঠিকই বলেছেন। মানুষমাত্রই নির্বোধ।
আমি চিৎকার করে বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও।
তুমি বুঝতে পারছ না। এই পরীক্ষাগারে সত্যিকার মানুষ খুব দুষ্প্রাপ্য জিনিস। তোমাকে কিছুতেই ছাড়া যাবে না। রিগা কম্পিউটারের সাথে ষড়যন্ত্র না করেই তোমাকে ব্যবহার করা যাবে। তুমি একই সাথে বড় অপরাধী।
আমি ছটফট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম, ছেড়ে দাও আমাকে, ছাড়।
রোবটটি আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি মিছেমিছি ছটফট করছ। আমি তোমার দেহে প্রবেশ করানোর জন্য রেট্রো ভাইরাসটি নিয়ে এসেছি। তুমি স্থির হয়ে শুয়ে থাকলে আমি ভাইরাসটি তোমার রক্তে মিশিয়ে দেব।
সরে যাও। আমি চিৎকার করে বললাম, সরে যাও।
নির্বোধ মানুষ
আর এক পা এগিয়ে এলে আমি তোমাকে শেষ করে দেব। ধ্বংস করে দেব।
তুমি শুধু মিথ্যাবাদী নও। তুমি বাকসর্বস্ব একজন নিষ্ফল মানুষ। তুমি নির্বোধ এবং দুর্বল। মানুষ জাতির বড় দুর্ভাগ্য যে গ্রুটাসের মতো মানুষের সংখ্যা এত কম।
রোবটটি আরেকটু এগিয়ে আসতেই আমি তার হাতে লাল রঙের সিরিজটি দেখতে পেলাম। আমি চিৎকার করে বললাম, আর আমার কাছে আসবে না। ধ্বংস করে দেব।
রোবটটি আমার কথা না শুনে আরেকটু এগিয়ে আসতেই আমি মুখের ভিতরে রাখা বিস্ফোরকটি ছুঁড়ে দিলাম। মুখ থেকে প্রচণ্ড বেগে ছোট ক্ষেপণাস্ত্রটি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে সমস্ত ঘর কেঁপে উঠল, অন্ধকার হয়ে এল চারদিক, ধোঁয়া সরে যেতেই দেখতে পেলাম ঘরের দেয়ালে কয়েক মিটার ব্যাসের একটি ফুটো। রোবটটিকে কোথাও দেখতে পেলাম না। সম্ভবত প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভস্মীভূত হয়ে গেছে, শুধু তার একজোড়া পা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিস্ফোরণের কারণেই কি না জানি না আমি নিজেও ঘরের একমাথায় ছিটকে সরে এসেছি, শরীরের বাঁধনও খুলে গেছে হঠাৎ। আমি শরীরের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারদিকে প্রচণ্ড হইচই হচ্ছে, লোকজন–রোবট ছোটাছুটি করছে। আমার দিকে চার হাতের কয়েকজন মানুষ ছুটে এল। আমি হাত তুলে ডাকলাম একজনকে, বললাম, আমাকে গ্রুটাসের কাছে নিয়ে যাও। যদি না নাও তা হলে তোমাদের ল্যাবরেটরির বাকি যেটুকু আছে সেটুকুও আমি উড়িয়ে দেব।
কেন উড়িয়ে দেব, কীভাবে উড়িয়ে দেব মানুষটি সেই যুক্তিতর্কে না গিয়ে মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন করে বলল, চলুন, এই পথে।
আমি মানুষটির পিছু পিছু হেঁটে যেতে থাকি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত ল্যাবরেটরি তছনছ হয়ে গেছে, স্থানে স্থানে ভাঙা দেয়াল আসবাবপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। বিচিত্র ধরনের নানারকম আধা–মানুষ আধা–প্রাণী ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করছে, আবার ধ্বংসস্তূপের মাঝে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হয়ে কেউ কেউ বসে আছে। বড় একটা করিডোর ঘুরে আমি গ্রুটাসের হলঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। চার হাতের মানুষটি দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিল।
আমি ভিতরে ঢুকতেই গ্রুটাস সরসর করে ঘরের মাঝামাঝি সরে গিয়ে বলল, তুমি কী চাও আমার কাছে?
তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে অতিমানবীদের সাধারণ মানুষে পাল্টে দেবে। আমি জানতে এসেছি তার কত দূর।
গ্রুটাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, আমি তোমার একটি রোবটের সাথে রেট্রো ভাইরাস ল্যাবরেটরির বড় অংশ ধ্বংস করে এসেছি। আমার শরীরের ভিতরে এখনো যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটা দিয়ে তোমার এই পুরো হলঘর উড়িয়ে দিতে পারি।
আমি জানি।
তা হলে আমার কথার উত্তর দাও। তুমি কি তোমার কথা রাখবে? নাকি আমি তোমার ঐ বিদঘুঁটে মাথাসহ পুরো ঘরটি উড়িয়ে দেব?
গ্রুটাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দুঃখিত কিরি। তুমি একটু দেরি করে ফেলেছ।
কী হয়েছে? আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, আমি কিসের জন্য দেরি করে ফেলেছি?
নয় জন অতিমানবীকে আমি একটা বিশেষ পরীক্ষায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। তারা রাজি হয় নি। তারা স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছে।
স্বেচ্ছামৃত্যু?
হ্যাঁ। আমি তাদেরকে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে দিতে পারি না। আমি তাই আমার টেকনিশিয়ানদের নির্দেশ দিয়েছি তাদের শরীরকে বিকল করে দিতে। ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নিয়ে সমস্ত শারীরিক কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হবে।
কেন? কেন তুমি তাদের কষ্ট দিচ্ছ?
আমি, আমি—
তুমি কী?
আমি তাদের মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। তাদের ভিতরে বিচিত্র সব অনুভূতি খেলা করে, সেগুলোকে লিপিবদ্ধ করার আগে তাদেরকে কিছুতেই স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।
আমি ঘুরে পিছনে তাকালাম। চার হাতের মানুষটি তখনো দাঁড়িয়ে ছিল, আমি তার একটি হাত ধরে ঘুরিয়ে চাপ দিতেই সে ভয়ংকর যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। আমি দাঁত দাঁত ঘষে বললাম, আমি ইচ্ছে করলে তোমার হাত মুচড়ে খুলে আনতে পারব–সেটা করতে চাই না। এক্ষুনি আমাকে অতিমানবীদের কাছে নিয়ে চল। এক্ষুনি।
নিচ্ছি। মানুষটি কাতর গলায় বলল, এক্ষুনি নিচ্ছি।
আমি মানুষটিকে ঠেলে ঘর থেকে বের করার আগে ঘুরে গ্রুটাসের দিকে তাকিয়ে। বললাম, গ্রুটাস তুমি শুনে রাখ। আমাকে কথা দিয়ে সেই কথা না রাখার জন্য আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। কখনো না।
আমি চার হাতের মানুষটির হাত মুচড়ে পিছন দিকে ধরে রেখে তার পিছু পিছু ছুটে যেতে থাকি, আমার মনে হতে থাকে আমি পৌঁছানোর আগেই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে এবং আমার সাথে আর কখনো লাইনার দেখা হবেনা!
চার হাতের মানুষটি আমাকে একটা ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, এখানে আছে সবাই।
আমি মানুষটিকে ছেড়ে দিয়ে লাথি মেরে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঘরের ভিতর সারি সারি কালো ক্যাপসুল সাজানো, উপরে ক্রায়োজেনিক পাম্প মৃদু গুঞ্জন করছে। ক্যাপসুলগুলোর পাশে কিছু রোবট, কিছু সাদা পোশাক পরা রোবটের মতো মানুষ। দরজা খোলার শব্দ শুনে সবাই ঘুরে তাকাল। আমি দুই পা ছড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, যে যেখানে আছ সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।
কাছাকাছি পঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট একটু এগিয়ে এসে যান্ত্রিক গলায় বলল, এই ঘরে মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। তুমি প্রবেশ করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের বড় একটি নিয়ম ভঙ্গ করেছ। তোমাকে
আমি রোবটটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চিৎকার করে বললাম, আমার হাতের মাঝে যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটা ব্যবহার করে আমি ইচ্ছা করলে এ রকম দুই চারটে ল্যাবরেটরি উড়িয়ে দিতে পারি। একটু আগে আমি রেট্রো ভাইরাস ল্যাবরেটরিটা উড়িয়ে দিয়ে এসেছি, তোমরা হয়তো সেটা এখানে বসে টের পেয়ে থাকবে।
রোবটটি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, পেয়েছি।
আমার কথা না শুনলে আমি এই মুহূর্তে তোমাদের ধ্বংস করে দেব।
রোবটের মতো দেখতে একজন মানুষ এগিয়ে এসে শুষ্ক গলায় বলল, তুমি কী চাও?
এই ক্রায়োজেনিক পাম্প বন্ধ করে অতিমানবীদের দেহ উষ্ণ করে তোল। আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।
সেটি সম্ভব নয়।
সেটি সম্ভব করতে হবে।
রোবটের মতো দেখতে মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটি কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমি আমার হাতটি ক্রায়োজেনিক পাম্পের দিকে লক্ষ্য করে মাংসপেশি ব্যবহার করে একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটালাম। হাতের যে অংশটি দিয়ে ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী বিস্ফোরকটি বের হয়ে এসেছে সেখান থেকে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছিল, আমি সাবধানে সেটা চেপে ধরে রেখে উপরের দিকে তাকালাম, একটু আগে যেখানে একটি বিশাল ক্রায়োজেনিক পাম্প ছিল এখন সেখানে একটি বিশাল গর্ত। সারা ঘরে বিস্ফোরণের ধ্বংসপ্প ছড়িয়ে পড়ছে। আমি রোবটের মতো মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললাম, এখন কি সম্ভব হয়েছে?
মানুষটি তার উপর থেকে ধুলোবালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, হ্যাঁ। সম্ভব হয়েছে। অতিমানবীদের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করবে এক্ষুনি।
আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।
তারা স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছে। তোমার কথা শুনবে না।
আমি তবু কথা বলতে চাই।
সেটি সম্ভব নয়।
আমি আমার হাত উদ্যত করে বললাম, আমার হাতে এখনো আরো একটি বিস্ফোরক রয়েছে।
মানুষটি হঠাৎ দ্রুত কাছাকাছি একটা ক্যাপসুলের পাশে রাখা একটি মাইক্রোফোন। আমার হাতে তুলে দিল। বলল, তুমিই চেষ্টা কর।
আমি মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোনজন?
সারি সারি রাখা নয়টি ক্যাপসুলে নয়টি অতিমানবীর শীতল দেহ, তার মাঝে কোনোটি সাড়া দিল না। আমি আবার বললাম, আমি জানি তুমি আমার কথা শুনছ। তুমি সাড়া দাও লাইনা।
কেউ সাড়া দিল না। আমি কাতর গলায় বললাম, লাইনা, আমি ক্রায়োজেনিক পাম্পটি ধ্বংস করে দিয়েছি। আমি জানি তোমাদের দেহ ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে। তোমাদের জেগে উঠতে হবে লাইনা। তোমাদের বেঁচে উঠতে হবে। তোমাদের ওপর যে ভয়ঙ্কর অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার না করে তোমরা চলে যেতে পারবে না। কিছুতেই চলে যেতে পারবে না।
নয়টি ক্যাপসুলে নয় জন অতিমানবী নিথর হয়ে শুয়ে রইল। আমি একটি একটি করে সব কয়টি ক্যাপসুলের সামনে দাঁড়ালাম, কোনোটির মাঝে এতটুকু প্রাণের চিহ্ন নেই। মাইক্রোফোন হাতে আমি চিৎকার করে উঠলাম, লাইনা, সোনা আমার। জেগে ওঠ। দোহাই তোমার–জেগে ওঠ।
কেউ জেগে উঠল না। আমি ভাঙা গলায় বললাম, তোমরা নয় জন অতিমানবী, তোমাদের মস্তিষ্ক হবহু এক পর্যায়ে, তোমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি নিউরন একরকম, তার মাঝে তথ্য একরকম। প্রতিটি সিনান্স একইভাবে জুড়ে আছে–সারা পৃথিবীতে এর থেকে বড় সুষম উপস্থাপন কি আর কোথাও আছে? নেই! একটিও নেই! তোমরা ইচ্ছে করলে অসাধ্য সাধন করতে পার। নয় জন একসাথে যদি তোমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক তরঙ্গকে উজ্জীবিত কর, কী ভয়ঙ্কর রেজোনেন্স হবে তোমরা জান? একটিবার চেষ্টা করে দেখ–মাত্র একটিবার! ইচ্ছে করলে তোমরা সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে পার। তা হলে কেন এত বড় একটা অবিচার সহ্য করে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছ? কেন?
আমি ক্যাপসুলগুলোর মাঝে খ্যাপার মতো ঘুরে বেড়ালাম। তাদের ঢাকনা টেনে খোলার চেষ্টা করলাম। ক্যাপসুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে কথা বলার চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ হল না। আমি বুকের ভিতরে এক ভয়াবহ শূন্যতা অনুভব করতে থাকি, ইচ্ছে হতে থাকে ক্যাপসুলে মাথা কুটে আকুল হয়ে কঁদি, কিন্তু আমি তার কিছুই করলাম না। ঘরে অসংখ্য রোবট এবং রোবটের মতো মানুষ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তাদের সামনে ব্যথাটুকু প্রকাশ করতে আমার সংকোচ হল।
আমি একসময় চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। এই ভয়ঙ্কর অবিচারের প্রতিশোধ আমার একাই নিতে হবে। আমার হাতে এখনো দ্বিতীয় বিস্ফোরকটি রয়ে গেছে, সেটি দিয়েই আমি গ্রুটাসকে হত্যা করব। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চিৎকার করে বলব, তুমি একজন দানব। পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে তাকে তুমি কলুষিত করতে পারবে না। তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব। তার কুৎসিত দেহ, বীভৎস মস্তিষ্ক আমি চূর্ণ করে দেব।
আমি শেষবার একবার কালো স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুলে হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ল্যাবরেটরিতে এখনো আধা–মানুষ আধা–যন্ত্র বিচিত্র প্রাণীরা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে, আমাকে দেখে সেগুলো ভয়ে ছিটকে সরে গেল। আমি পাথরের মতো মুখ করে সোজা হেঁটে গেলাম গ্রুটাসের সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে।
.
গ্রুটাসকে দেখে মনে হল সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘরের মাঝামাঝি সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেও সে একটি কথাও বলল না। আমি কঠোর গলায় বললাম, গ্রুটাস।
বল।
তুমি কি নিজেকে মানুষ বলে দাবি কর?
দুর্ভাগ্যক্রমে করি। আমার ক্রমোজম ৪৬টি।
মানুষের একটি সংজ্ঞা আছে গ্রুটাস। সেটি হচ্ছে পরস্পর পরস্পরের জন্য ভালবাসা। তোমার মাঝে তার এতটুকুও নেই।
অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি কোনো কাজে আসে না।
তুমি মানুষ নও গ্রুটাস। তুমি পশুও নও। তুমি একটি তুচ্ছ কলকব্জা। তুচ্ছ যুক্তিতর্ক। তুচ্ছ নিয়মকানুন। এই পৃথিবীতে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।
সেটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস–অবিশ্বাসের ব্যাপার।
তোমার এই তুচ্ছ জীবনকে আমি শেষ করে দেব গ্রুটাস। আমি তোমাকে হত্যা করতে এসেছি।
আমারও তাই ধারণা। গ্রুটাস ভেসে ভেসে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার।
আমি আমার হাতটি উদ্যত করতে গিয়ে থেমে গেলাম, গ্রুটাস হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। এই প্রথম আমি এ প্রাণীটিকে হাসতে দেখলাম। গ্রুটাস হাসতে হাসতে বলল, তুমি প্রথমবার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছ, আমরা সেটা থামাতে পারি নি। দ্বিতীয়বারও পারি নি তার অর্থ এই নয় যে, আমি তোমাকে তৃতীয়বার এখানে বিস্ফোরণ ঘটাতে দেব।
গ্রুটাস হঠাৎ সরসর করে আমার একেবারে কাছে এসে হাজির হল, আমি তার হলুদ চোখ, চোখের ফুলে ওঠা রক্তনালী পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সে ষড়যন্ত্রীদের মতো নিচু গলায় বলল, এই মুহূর্তে ঘরের চারপাশে চারটি প্রতিরক্ষা ডিভাইস তোমার হাতের মাঝে লুকানো বিস্ফোরকটিকে লক ইন করে আছে। তোমার হাত যদি এক সেন্টিমিটার উপরে ওঠাও চারটি এক শ মেগাওয়াটের আই. আর. লেজার তোমাকে ভস্মীভূত করে দেবে।
গ্রুটাস ভেসে ভেসে আমার আরো কাছে চলে এল, আমি তার কুঞ্চিত চামড়া, চুলহীন বীভৎস মাথা, মাথার ভিতরে নড়তে থাকা যন্ত্রাংশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কটু গন্ধে হঠাৎ আমার সারা শরীর গুলিয়ে এল। গ্রুটাস প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার। আমি তোমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছি কিরি। আমি শুনেছি তুমি নাকি চিতাবাঘের চাইতেও ক্ষিপ্র।
আমি এতটুকু না নড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিকৃত দেহের এই মানুষটার প্রতি একটা অচিন্তনীয় ঘৃণা আমার ভিতরে পাক খেতে থাকে, ভয়ঙ্কর বিজাতীয় একটা ক্রোধ এবং আক্রোশ আমার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। ইচ্ছে করতে থাকে সত্যি সত্যি আমি চিতাবাঘের মতো এই কুৎসিত প্রাণীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। টুটি চেপে ধরে তার বীভৎস মস্তিষ্ক মেঝেতে ঠুকে ঠুকে ভিতর থেকে থলথলে ঘিলুটাকে বের করে আনি।
কিরি তুমি শান্ত হও। আমি চমকে উঠলাম, কে আমার মস্তিষ্কের মাঝে কথা বলছে?
তুমি নিজেকে সংবরণ কর কিরি।
কে কথা বলছে? আমার মাথা থেকে তো ট্র্যালিওশান সরিয়ে নিয়েছে। এখন তো আর কিছুই সরাসরি আমার মস্তিষ্কে কথা বলতে পারবে না। কে কথা বলছে? তা হলে কি অতিমানবীরা নিজেদের মুক্ত করে চলে এসেছে?
দরজায় একটা মৃদু শব্দ হল এবং আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, দেখতে পেলাম ধীর পদক্ষেপে এক জন এক জন করে নয় জন অতিমানবী ঘরে এসে ঢুকছে। তাদের মুখমণ্ডল শান্ত, সেখানে এক ধরনের স্নিগ্ধ কোমলতা।
কিরি, নিজেকে শান্ত কর। আমি আবার শুনতে পেলাম কেউ একজন বলল, আমি লাইনা।
লাইনা! আমি আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেলাম, এই ঘরে চারটি এক শ মেগাওয়াট আই. আর. লেজার আমার দিকে তাক করা আছে, ইচ্ছে করলেই আমাদের ভস্মীভূত করে দেবে।
নয় জন অতিমানবী খুব শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। আমি কাঁপা গলায় বললাম, খুব সাবধান। চারটি আই. আর. লেজার–
কোনো ভয় নেই। ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অতিমানবীটি বলল, গ্রুটাসের মস্তিষ্ক এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তুমি সত্যি কথাই বলেছিলে কিরি। আমরা নয় জন যখন আমাদের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন করি ভয়ঙ্কর রেজোনেন্স হয় তখন যা ইচ্ছে করতে পারি আমরা।
তোমরা সত্যিই গ্রুটাসকে নিয়ন্ত্রণ করছ? সত্যি?
হ্যাঁ। শুধু গ্রুটাস নয়, এই ল্যাবরেটরির সকল জীবিত প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করছি। ইচ্ছে করলে তোমাকেও করতে পারি, কিন্তু তার তো কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি হেসে বললাম, না, আমি যেটুকু জানি তাতে মনে হয় প্রয়োজন নেই।
তোমার ধারণা সত্যি কিরি। আমরা সবাই মিলে একটা অস্তিত্ব সেটি আমরা জানতাম কিন্তু আমাদের সবার মস্তিষ্ক যে একসাথে সুষম উপস্থাপন করতে পারে আমরা সেটা জানতাম না। এখন আমরা সেটা করছি। আমাদের এখন কী ভয়ঙ্কর শক্তি তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
আমি জানি। আমি অনুভব করতে পারছি।
আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীর যে কোনো জীবিত প্রাণীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটাকে পরিবর্তন করতে পারি। মস্তিষ্কের নিউরন থেকে তথ্য মুছে দিতে পারি, সিনান্সের জোড় খুলে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থামিয়ে দিতে পারি, ফুসফুসকে নিথর করে দিতে পারি। আমরা যদি চাই এই মুহূর্তে গ্রুটাসকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি।
আমি জানি।
আমরা অতিমানবী। কিন্তু এই পৃথিবী, পৃথিবীর সভ্যতা অতিমানবীর জন্য তৈরি হয় নি। আমরা এখানে অনাহুত। মা–বাবার ভালবাসায় আমরা জন্ম নিই নি, মা–বাবার ভালবাসায় বড় হই নি। কিন্তু মা–বাবার ভালবাসায় সিক্ত হওয়া সেই জিন আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। আমরা ভালবাসার জন্য, স্নেহের জন্য কাঙাল–একটি কোমল কথার জন্য তৃষ্ণার্ত, কিন্তু সমস্ত পৃথিবীতে আমরা বড় নিঃসঙ্গ। আমাদেরকে এতটুকু স্নেহ দেবার জন্য কেউ নেই।
আছে। নিশ্চয়ই আছে। আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম, আমি আছি।
আমরা জানি তুমি আছ। তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ কিরি। অতিমানবীদের ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জগতে তুমি আমাদের একমাত্র বন্ধু
যে মেয়েটি কথা বলছিল সে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, মানুষের শরীরের সীমাবদ্ধতা আমাদের নেই। আমাদের দেহে অচিন্তনীয় শক্তি, পরিচিত রোগ–শোক আমাদের স্পর্শ করতে পারে না, অল্প একটু খাবারে আমরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারি, একটু অক্সিজেনেই আমাদের চলে যায়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থেকে বেঁচে থাকতে পারি, আমরা চিতাবাঘের চাইতেও ক্ষিপ্র, মত্ত হাতি থেকেও শক্তিশালী। তুমি একটু আগে আমাদের নতুন শক্তির সন্ধান দিয়েছ, মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন করে এখন আমরা অন্যের মনকেও নিয়ন্ত্রণ। করতে পারি। এই পৃথিবীতে আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই। আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে অতিমানব জাতি সৃষ্টি করতে পারি।
আমি হতবাক হয়ে নয় জন অতিমানবীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আবার বলল, পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য এর চেয়ে বড় আশঙ্কার ব্যাপার কিছু ঘটে নি।
কিন্তু
হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের প্রকৃত জিন মানুষ থেকে এসেছে। মানুষের জন্য আমাদের প্রকৃত ভালবাসা। মানুষকে রক্ষাও করব আমরা।
কী করবে তুমি? তোমরা?
আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলব। শুধু নিজেদের নয়, এই ল্যাবরেটরিকে, এর প্রতিটি তথ্যকে।
না। আমি চিৎকার করে বললাম, না লাইনা।
আমাদের কোনো উপায় নেই কিরি।
তা হলে তোমরা কেন জেগে উঠে এসেছ?
তোমার জন্য। গ্রুটাসের নৃশংস থাবা থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নিরাপদে এখান থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। প্রতিরক্ষা দপ্তর যেন আর কখনো তোমাকে স্পর্শ না কতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য।
না। আমি কাতর গলায় বললাম, আমি যাব না। লাইনাকে না নিয়ে আমি যাব না।
নয় জন অতিমানবী কোমল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জানি না এর মাঝে কোনজন লাইনা। কিংবা কে জানে যখন নয় জন অবিকল ক্লোন তাদের মস্তিষ্কে অবিকল একই তথ্য নিয়ে থাকে তখন এই প্রশ্নটির আদৌ কোনো অর্থ আছে কি না। আমি তাদের মুখের দিকে তাকালাম, একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তোমরা ইচ্ছে করলে আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন খুলে দেখতে পার। দেখ, তোমরা দেখ। আমার নিজের চেয়ে তোমরা বেশি জান আমি লাইনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
নয় জন অতিমানবী থেকে এক জন হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, কোমল গলায় বলল, কিরি। আমি লাইনা।
লাইনা! আমি তাকে জাপটে ধরে বুকের মাঝে টেনে নিলাম। তার রেশমের মতো চুলে মুখ গুঁজে বললাম, লাইনা, সোনা আমার।
আমি আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার কিছুই বলতে পারলাম না, হঠাৎ এক ভয়াবহ শূন্যতায় আমার হৃদয়–মন হাহাকার করে ওঠে।
লাইনা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে চিকচিক করছে পানি। দুই হাতে আমার মাথাকে ধরে নিজের মুখের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, কিরি, এই নয় জন অতিমানবীর মাঝে থেকেও আমি আলাদা। আমি একজন অতিমানবী যে তোমার আসল ভালবাসাটুকু পেয়েছি। সেই ভালবাসা আমি অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত করেছি। আমাদের এই ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জীবনে তোমার ভালবাসাটুকু একমাত্র সুখের স্মৃতি।
আমি লাইনার অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কাতর গলায় বললাম, লাইনা, তুমি যেও না। তুমি আমার সাথে চল।।
না কিরি। লাইনা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তুমি আমাকে এ কথা বোলো না, আমার শেষ সময়টুকু তুমি আরো কঠিন করে দিও না।
আমি ভাঙা গলায় বললাম, লাইনা, সোনা আমার! তুমি চল আমার সাথে। দূর নির্জন এক দ্বীপে শুধু তুমি আর আমি থাকব। পৃথিবীর মানুষ জানবে না। শুধু তুমি আর আমি। তুমি আর আমি।
লাইনা হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, আমাকে এভাবে বোলো না। এভাবে লোভ দেখিও না কিরি। আমাকে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিও না।
তা হলে আমি কী নিয়ে থাকব?
লাইনা আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও কিরি।
আমি লাইনার চোখের দিকে তাকালাম। লাইনা ফিসফিস করে বলল, তোমার সব দুঃখ আমি ভুলিয়ে দেব কিরি। আমাকে নিয়ে তোমার সব স্মৃতি আমি মুছে দেব।
না। আমি ভুলতে চাই না। আমি চিৎকার করে বললাম, আমি ভুলতে চাই না।
তোমাকে ভুলতে হবে কিরি। আমি একজন অতিমানবী–অতিমানবীর স্মৃতি তুমি নিজের মাঝে রেখো না।
না। লাইনা। না—
আমার চোখের দিকে তাকাও কিরি।
আমি লাইনার চোখের দিকে তাকালাম। কী অপূর্ব আয়ত কালো দুটি চোখ–সেই চোখে চিকচিক করছে পানি। চোখের মাঝে কী বিস্ময়কর গভীরতা! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটি গভীর বেদনায় আমার বুক দুমড়ে–মুচড়ে যেতে থাকে। সেই অপূর্ব কালো গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে আমি বুঝি সেই চোখের গভীরে প্রবেশ করে যাচ্ছি। মনে হতে থাকে সেই গভীরে এক বিশাল শূন্যতা। মনে হয় আদি নেই, অন্ত নেই এক বিশাল বেলাভূমিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সমুদ্রের কল–কল্লোল ভেসে আসছে দূর থেকে। নীল মহাসমুদ্রের ঢেউ ভেসে এসে একের পর এক আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে, সিক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার পা। আমি মাথা তুলে তাকালাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাইনা, বাতাসে উড়ছে তার দেহের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়। আমি ম বালুতে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম লাইনার দিকে, লাইনা তখন সরে গেল আরো দূরে। আমি আবার এগিয়ে গেলাম–লাইনা তখন আরো দূরে সরে গেল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম, লাইনা তখন আরো দূরে সরে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম লাইনা চলে যাচ্ছে দূরে…..বহুদূরে, আমি তাকে ধরতে পারছি না। দূরদিগন্তে সে মিশে যাচ্ছে মিলিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। বালুবেলায় আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছি। সমুদ্রের পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। এক গভীর শূন্যতায় আমি হারিয়ে যাচ্ছি, এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় আমি ডুবে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি এক অন্ধকারে–এক নির্জনতায়–এক নিসঙ্গতায়…
শেষ কথা
উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ের পাদদেশে গভীর অরণ্যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটি গোপন ল্যাবরেটরি ভয়ঙ্কর একটি অগ্নিকাণ্ডে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ল্যাবরেটরির কাছাকাছি অরণ্যে একজন অপ্রকৃতিস্থ স্মৃতিশক্তিহীন যুবককে পাওয়া যায়, তার হাতে একটি অস্ত্রোপচারের চিহ্ন। যুবকটির নাম কিরি, সে কেন এখানে এসেছে জানে না। কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে দেখছে।