- বইয়ের নামঃ এনিম্যান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. লিডিয়া কাফেটেরিয়ার এক কোনায়
এনিম্যান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
উৎসর্গ
গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ তরুণীদের। যারা মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা শ্লোগানটি আবার নূতন করে আমাদের উপহার দিয়েছে।
০১.
লিডিয়া কাফেটেরিয়ার এক কোনায় বসে তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে চারপাশের মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে। বাইশ বছরের একটা মেয়েকে সুন্দরী বলার জন্যে তার ভেতরে যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হয় লিডিয়ার মাঝে তার সবগুলোই আছে কিন্তু তবুও কেউ কখনো তাকে সুন্দরী হিসেবে বিবেচনা করেনি। অন্য কেউ সেই কারণটা না জানলেও লিডিয়া জানে। কারণটা একটু বিচিত্র, একজন মানুষের ভেতরটুকু সুন্দর না হলে তার বাইরের সৌন্দর্যটুকু ঠিক করে প্রকাশ পায় না। লিডিয়ার ভেতরটুকু অসুন্দর, এবং কদর্য। সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে কিন্তু তার ভেতরে বিবেক বলে কিছু নেই। মনোবিজ্ঞানীরা লিডিয়াকে নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেলে তাকে নিশ্চিতভাবেই সাইকোপ্যাথ বলে চিহ্নিত করতো। লিডিয়া কখনো কোনো মনোবিজ্ঞানীর কাছে যায়নি, যাবার প্রয়োজন হয়নি। সে খুবই সাধারণ একটা পরিবারে জন্ম নিয়ে স্বাভাবিক একটা পরিবেশে বড় হয়েছে। খুব অল্প বয়সেই তার মা প্রথমে লিডিয়ার ভেতরকার অস্বাভাবিকতাটুকু ধরতে পেরেছিলেন। তিনি কাউকে সেটি বলেন নি। একটু বড় হয়েই লিডিয়া তার পরিবারকে পরিত্যাগ করে নিজে একা একা বড় হয়েছে। একজন মানুষের মাঝে যখন কোনো ভালোবাসা, মায়া মমতা নীতি কিংবা বিবেক থাকে না তখন তার বেঁচে থাকা খুব সোজা। লিডিয়া তার অস্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খুব সফলভাবে বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে তার ভেতরে কোনো ভাবালুতা নেই। এই মূহুর্তে সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার এক কোনার একটি টেবিলে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চারপাশের ছাত্র-ছাত্রীদের এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্ছাস আগ্রহ, উৎসাহকে তার কাছে শিশুসুলভ ছেলেমানুষী মনে হয়।
লিডিয়া তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে খাবারের ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখল। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সাথে সাথে লিডিয়া বুঝে যায় মানুষটি তার কাছে আসছে। লিডিয়া ইচ্ছে করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় এবং সরাসরি না তাকিয়েই বুঝতে পারে মানুষটি এগিয়ে এসে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছে। পর মুহূর্তে সে মানুষটির গলা শুনতে পেল, “আমি কী তোমার টেবিলে বসতে পারি?”
লিডিয়া এবারে ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল, বড় কোম্পানীর ম্যানেজারের মতো চেহারা, দামী স্যুট, সুন্দর টাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্যাফেটেরিয়াতে এরকম পোষাক পরা মানুষেরা খেতে আসে না। লিডিয়া মানুষটির দিকে তাকাল, বলল, “অনেক খালি টেবিল আছে। তোমার এখানেই বসার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও যখন এই টেবিলে বসতে চাইছ তার মানে তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে এসেছ?”
“লিডিয়া?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমি তোমার কাছেই এসেছি। ছবি দেখে মানুষের চেহারা বোঝা যায় না। তোমার ছবিতে তুমি অন্য রকম।”
এই কথাটি লিডিয়া অনেকবার শুনেছে। কথাটির প্রকৃত অর্থটিও সে জানে, প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ছবিতে তোমাকে সুন্দরী একটি মেয়ে বলে মনে হয়। বাস্তবে তুমি মোটেও সুন্দরী নও।
মানুষটি টেবিলে খাবারের ট্রে টা রেখে লিডিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম রিকার্ডো।”
লিডিয়া খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে রিকার্ডো নামের মানুষটির হাত স্পর্শ করল, সে যে রকম অনুমান করেছিল ঠিক সেরকম তার হাত ভেজা এবং নরম। ভেজা হাতের মানুষের করমর্দন করতে লিডিয়ার এক ধরণের ঘৃণা হয়।
“তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?”
মানুষটি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, “থিসিস জমা দিয়েছ?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল। রিকার্ডো তার পেটের রোস্ট বীফের টুকরোটির ওপর মরিচের গুড়ো ছিটাতে ছিটাতে বলল, “থিসিসটি তুমি নিজে লিখলে কেন? তুমি নিজে লিখলে আরো অনেক ভালো থিসিস লিখতে পারতে।”
লিডিয়া ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মাথায় অনেকগুলো চিন্তা খেলে গেলো। একটি মেধাবী ছেলের সাথে অন্তরঙ্গতায় ভান করে সে তাকে দিয়ে থিসিস লিখিয়ে নিয়েছে। এ কথাটি সত্যি সে নিজে আরো ভালো লিখতে পারত কিন্তু এই ধরণের আনুষ্ঠানিক কাজে সে কোনো আগ্রহ পায় না। কাজ শেষ হবার পর মেধাবী ছেলেটিকে সে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পরিত্যাগ করেছে। তার প্রয়োজন ছিল, ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই বিষয়টি কেউ জানে না বলে লিডিয়ার ধারণা ছিল, দেখা যাচ্ছে ধারণাটি সত্যি নয়। এই মানুষটি সেই ছেলেটির কেউ নয়, লিডিয়া জানে ছেলেটির কেউ নেই। মানুষটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে আসে নি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে এই বিষয়টি নিয়ে কিছু করার ক্ষমতাও নেই। মানুষটি পুলিশ বা ডিটেকটিভ এজেন্সী থেকে হতে পারে, সেটি ঘটবে যদি মানসিক ভারসাম্যহীন মেধাবী ছেলেটি নির্বুদ্ধিতা করে আত্মহত্যা করে থাকে এবং মৃত্যুর কারণ হিসেবে এই ঘটনাটির কথা লিখে গিয়ে থাকে। ছেলেটি ভীতু প্রকৃতির ছিল তার পক্ষে আত্মহত্যার মতো সাহসের কাজ করা সম্ভব বলে মনে হয়নি। যেটাই ঘটে থাকুক লিডিয়াকে সতর্ক থাকতে হবে। সে তার জীবনে এই প্রথম নিজের ভেতর এক ধরণের ভীতি অনুভব করল।
রোস্ট বীফের একটা টুকরো মুখে ঢুকিয়ে মানুষটা হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে লিডিয়াকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি পুলিশ থেকে আসিনি।”
লিডিয়া বলল, “আমি ভয় পাইনি।” কথাটি বলতে গিয়ে লিডিয়া এক ধরণের অপমান অনুভব করে। তার জীবনে সে সবসময় অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, অন্য মানুষেরা কখনো তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। লিডিয়া তার জীবনকে একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। সে কখনো ভাবেনি কেউ সেই দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেদ করে তার জীবনের ভেতরে উঁকি দিতে পারবে। দেখা যাচ্ছে তার জীবনের ভেতর কেউ না কেউ উঁকি দিয়েছে। মানুষটি যদি তার থিসিস লিখিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি জানে তাহলে সম্ভবত আরো অনেক কিছু জানে। লিডিয়ার জীবনে অনেক ঘটনা আছে যেগুলো জানাজানি হলে তাকে দীর্ঘ দিন জেলখানায় জীবন কাটাতে হবে।
রিকার্ডো নামের মানুষটি লিডিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা দীর্ঘদিন থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। তুমি তোমার থিসিস জমা দিয়েছ এখন কাজ শুরু করতে পারবে। আমি তোমাকে একটা চাকরী দিতে এসেছি।”
লিডিয়া একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা বেশ তৃপ্তি নিয়ে রোস্ট বীফের টুকরোটা চিবুতে চিবুতে বলল, “আমরা তোমার লেখাপড়ার ক্ষতি করতে চাইনি, তাই আগে আসিনি। এখন এসেছি।”
লিডিয়া তার কফির মগটি টেবিলে রেখে বলল, “তোমরা কারা?”
“বলছি। আগে বলি কেন তোমার কাছে এসেছি।”
লিডিয়া শান্ত মুখে রিকার্ডো নামের মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।
রিকার্ডো বলল, “বছর তিনেক আগে আফ্রিকার একটা দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল জনসংখ্যা। তখন তুমি একটা প্রবন্ধ লিখে সমস্যাটার সমাধান দিয়েছিলে, মনে আছে?”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না। কথাটি সত্যি যে জনসংখ্যা এবং দুর্ভিক্ষের সে একটি অত্যন্ত সহজ সমাধান দিয়েছিল। প্রবন্ধটি যে সে লিখেছে সেটি কারো জানার কথা নয়। মানুষকে যে গবাদি পশুর মতো খাবারের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে পৃথিবীর মানুষ সেই সত্যটি গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুত নয়। জনসংখ্যাই হচ্ছে সমস্যা, খাবার হিসেবে ব্যাবহার করে সেই জনসংখ্যাই কমিয়ে দেয়া যায় সেটি কেন কারো চোখে পড়েনি সেটি লিডিয়া কখনো বুঝতে পারেনি। পৃথিবীর মানুষ লিডিয়ার সমাধানটি গ্রহণ করেনি কিন্তু সেটি নিয়ে সারা পৃথিবীতে প্রচণ্ড আলোড়ন হয়েছিল। প্রবন্ধটি কে লিখেছিল সেটি কেউ জানতে পারেনি অন্ত ত লিডিয়া তাই ভেবেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে আর কেউ না জানলেও এই মানুষটি জানে।
রিকার্ডো বলল, “তুমি যে পদ্ধতিতে তোমার পরিচয়টি গোপন রেখেছিলে সেটি অসাধারণ। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ আমরা জানি। কীভাবে জানি সেটাও তোমাকে বলতে পারি–আমাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করতে হয়েছে। আমাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী একটা সুপার কম্পিউটার আছে, সেটা ব্যবহার করে তোমার লেখার স্টাইল শব্দচয়ন বাক্যগঠন এই সবকে প্যারামেট্রাইজ করেছি। তারপর পৃথিবীর সকল প্রকাশিত লেখার সাথে মিলিয়ে দেখেছি। সেখান থেকে শর্ট লিস্ট করে তাদের খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তোমাকে আলাদা করেছি। তুমি জান না, আমরা দুইবার তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছি। একটু অসাবধান থাকার কারণে দুইবারই তুমি আইনী ঝামেলায় পড়ে যেতে পারতে।”
লিডিয়া প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কারা?”
মানুষটি পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের কার্ড বের করে টেবিলে রাখে। তারপর একটা টোকা দিয়ে সেটাকে টেবিলের অন্যপাশে লিডিয়ার দিকে পাঠিয়ে দিল। কার্ডের ওপর ছোট করে লেখা এপসিলন। লিডিয়া কখনো এই প্রতিষ্ঠানের নাম শুনেনি।
রিকার্ডো বলল, “এপসিলনের নাম সারা পৃথিবীর খুব বেশী মানুষ জানে না। এপসিলন যেসব কোম্পানীর মালিক, কিংবা পরিচালনা করে তার নাম কিন্তু সবাই জানে। যুদ্ধ জাহাজ থেকে ভাইরাসের প্রতিষেধক সবকিছু আমরা তৈরি করি। সারা পৃথিবীতে আমাদের ব্যবসা। সত্যি কথা বলতে কী রাষ্ট্র নাম দিয়ে আমরা পৃথিবীর মাঝে যে বিভাজন করেছি সেটি আমাদের কাছে হাস্যকর একটি বিভাজন! আমরা রাষ্ট্রের ওপরের স্তর। পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ছোটখাটো রাষ্ট্রের পরিবর্তন করতে চাইলে আমরা এক সপ্তাহে করতে পারি। খুব বড় রাষ্ট্র হলে বছরখানেক লাগতে পারে।”
“তুমি আমাকে এসব কেন বলছ?”
“তোমাকে দলে টানার জন্যে!”
“তাতে তোমাদের লাভ?”
“আমরা আমাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছি তোমাদের মত কিছু মানুষ দিয়ে।”
লিড়িয়া ভুরু কুঁচকালো, “আমাদের মত?”
রিকার্ডো মুখে আরেকটা বড় রোস্ট বীফের টুকরো ঢুকিয়ে খুব তৃপ্তির সাথে চিবুতে চিবুতে গলা নামিয়ে বলল, “হ্যাঁ। তোমাদের মত মানুষ। যাদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, যারা অসম্ভব সৃজনশীল, যাদের উচ্চাকাংখার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। কিন্তু যাদের ভেতর কোনো মানবতা নেই তাদেরকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না। কারণ তাদের ভেতর বিবেক বলে কিছু নেই। তারা বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ ছাড়া যে কোনো ধরণের অন্যায় করতে পারে! তুমি হচ্ছ সেরকম একজন মানুষ।”
লিডিয়া স্থির চোখে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে রইল, এর আগে কেউ তাকে এতো সোজাসুজি এই কথাগুলো বলেনি। রিকার্ডো হাসার মত ভঙ্গী করে বলল, “তুমি যদি এপসিলনের কোর টিমে যোগ দাও তাহলে হয়তো তুমি বেঁচে যাবে, কারণ আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দেব। যদি যোগ না দাও আজ হোক কাল হোক তুমি কোনো একটা ভুল করবে, ধরা পড়বে তারপর বাকী জীবনটা জেলখানায় কাটিয়ে দেবে।”
লিডিয়া এবারেও কোনো কথা বলল না। রিকার্ডো ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে নিচু গলায় বলল, “সাধারণ একজন মানুষ তার জীবনে কী চায়? একটা ভালো চাকরী, ভালো বেতন, একটা পরিবার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, একটা বাড়ী, গাড়ী এইসব। আবার কিছু মানুষ কী চায়? খ্যাতি। বড় অভিনেতা, গায়ক, ফুটবল প্লেয়ার, লেখক, শিল্পী। আবার কিছু মানুষ কী চায়? নেতৃত্ব। যাদের কথায় অন্য মানুষেরা উঠবে বসবে।”
রিকার্ডো এক মুহূর্ত চুপ করে সোজাসুজি লিডিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তুমি কিংবা তোমার মত মানুষ কী চায়?”
লিডিয়া শীতল চোখে রিকার্ডোর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “তুমিই বল। আমি তোমার মুখ থেকেই শুনি।”
“তোমরা চাও চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তোমরা যে চ্যালেঞ্জ চাও সেই চ্যালেঞ্জ কেউ দিতে পারে না।”
রিকার্ডো বুকে হাত দিয়ে বলল, “আমরা পারি।”
লিডিয়া তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “আমি যদি এপিসিলনে যোগ দিই আমাকে কী করতে হবে?”
“সেটা নির্ভর করবে তোমার ওপরে। তুমি যদি রাজনীতিতে আনন্দ পাও তাহলে আফ্রিকা এশিয়ার দেশগুলোর সরকার পতন করাতে পার। যদি ব্যবসাতে আনন্দ পাও তাহলে পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানীকে কেনা বেচা করতে পার। যদি বিজ্ঞানে আনন্দ পাও নূতন কিছু তৈরী করে বাজারজাত করতে পার। এটা পুরোপুরি তোমার ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। আমি শুধু বলতে পারি যে বিষয়েই তোমার আগ্রহ থাকুক তুমি সেটা এখানে খুঁজে পাবে।”
“আমি কার সাথে কাজ করব?”
রিকার্ডো হাত নেড়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দিল, বলল, “ডিটেলস। তুমি নিশ্চিত থাক এগুলো কোনো সমস্যা নয়। যে যেভাবে কাজ করতে চায় সে সেভাবে কাজ করবে। তোমাকে আমাদের সাথে তাল মিলাতে হবে না। আমরা তোমাদের সাথে তাল মিলাব।”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না, তার ভেতরে যে শেষ প্রশ্নটি ছিল রিকার্ডো নামের মানুষটা নিজেই তার উত্তর দিল, বলল, “আমরা কখনো কারো সাথে বেতন নিয়ে কোনো কথা বলিনি কারণ সেটা ইস্যু না। তোমাকে যে প্লাস্টিকের কার্ডটা দিয়েছি সেটা একটা ক্রেডিট কার্ড। তুমি যত ইচ্ছা টাকা খরচ করতে পার।”
“যত ইচ্ছা?”
“হ্যাঁ। যত ইচ্ছা। আমার কথা বিশ্বাস না করলে এখান থেকে বের হয়ে বি.এম. ডব্লিউয়ের শো রুমে গিয়ে একটা গাড়ী কিনে দেখতে পার।”
লিডিয়ার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল, সে হাসতে অভ্যস্ত নয় তাই তার হাসিটিতে কোনো আনন্দের চিহ্ন নেই। লিডিয়া প্লাস্টিকের কার্ডটা হাতে নিয়ে সেটাকে উল্টে পাল্টে দেখে আবার টেবিলে রেখে দিল।
রিকার্ডো বলল, “আমি চাই তুমি একটা গাড়ী কিনো। তাহলে বুঝব তুমি এপসিলনে যোগ দেবে বলে ঠিক করেছ।”
লিডিয়া বলল, “তুমি যা যা বলতে এসেছ তার সবকিছু কী বলে ফেলেছ?”
“না। দুটি জিনিষ এখনো বলা হয়নি।”
“কোন দুটি জিনিষ?”
“যিনি এপসিলনকে গড়ে তুলেছেন তার কথা বলা হয়নি। খুব বেশী মানুষ তাকে দেখেনি। তিনি কিন্তু সবাইকে দেখেন। এপসিলনে তুমি যদি যোগ দাও আর তুমি যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পার তিনি হয়তো সরাসরি তোমার সাথে দেখা করবেন। তার সাথে হয়তো তোমার দেখা হবে।”
লিডিয়াটা জিজ্ঞেস করল, “আর দ্বিতীয়টি।”
“দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এপসিলন কিন্তু একমুখী রাস্তা। তুমি এখানে যোগ দিতে পারবে কিন্তু কখনো এপসিলন ছেড়ে যেতে পারবে না।”
“ছেড়ে যেতে পারব না?”
“না।” এই প্রথম রিকার্ডোর মুখটা কঠিন হয়ে যায়, প্রায় শোনা যায় এরকম গলায় বলল, “কেউ যে কখনো ছেড়ে যায়নি তা নয়। ছেড়ে গিয়েছে। তারা এপসিলন আর পৃথিবী এক সাথে ছেড়ে গিয়েছে।”
লিডিয়া কয়েক মুহূর্ত রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর তার হাতের প্লাস্টিকের কার্ডটি রিকার্ডোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এপসিলনে যোগ দিতে চাই না।”
রিকার্ডো হা হা করে হেসে উঠল, বলল, “যোগ দিতে না চাইলে দিও। কিন্তু কার্ডটা রেখে দাও। কাজে লাগবে। তা ছাড়া–”
“তাছাড়া কী?”
“আমরা যখন কাউকে আমাদের কার্ড দিই আমরা সেটা আর ফিরিয়ে নিই না।”
“তার মানে—”
রিকার্ডো হাত তুলে লিডিয়াকে থামাল। বলল, “তোমাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। সাধারণ মানুষেরা মুখ ফুটে কথা বলে। তোমার আমার মত মানুষের মুখ ফুটে কথা বলতে হয় না। কথা না বলেই আমার তথ্য আদান প্রদান করতে পারি।” রিকার্ডো লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কথা না বলে তথ্য আদান প্রদান বলতে কী বোঝানো হয় বিষয়টা হঠাৎ করে লিডিয়া বুঝতে শুরু করে।
০২. স্কুল বাস থেকে নেমে তিষা
স্কুল বাস থেকে নেমে তিষা আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে ধূসর এক ধরণের মেঘ, এটা মেঘ না কুয়াশা ভালো করে বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে যখন ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয় তখন বোঝা যায় যে এটা কুয়াশা না, এটা মেঘ। তিষার হঠাৎ করে দেশের কথা মনে পড়ল। আকাশ কালো করে কুচকুচে মেঘে হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতো, বিজলীর ঝলকে সবকিছু কেমন যেন ঝলসে ঝলসে উঠতো, সাথে সাথে কী গম্ভীর গুড় গুড় করে মেঘের ডাক। তারপর বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মনে হতো সারা পৃথিবী বুঝি ভাসিয়ে নেবে। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে কী মজা–সবাই মিলে তারা বাইরে নেমে যেতো! আর এখানে সবকিছু অন্যরকম। ধোয়ার মত এক ধরনের বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, প্যাঁচপ্যাঁচে মন খারাপ করা বৃষ্টি।
তিষা স্কুল বাসের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হল। এখানে সব কিছু কেমন ছিমছাম, সবকিছু কী চমৎকার নিয়ম দিয়ে বাধা। এই যে সে রাস্তা পার হচ্ছে তার জন্যে রাস্তার দুই পাশে সব গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল বাসটা যতোক্ষণ তার বাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণ কোনো গাড়ী চলতে পারবে না, স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেন ঠিকমত রাস্তা পার হতে পারে। তিষার ছোট চাচা দেশে গাড়ী একসিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন। ছোট চাচা রাস্তা পার পর্যন্ত হচ্ছিলেন না, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন একটা গাড়ী আরেকটা গাড়ীকে ওভারটেক করে যাবার সময় তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই গাড়ীটাকে কোনোদিন ধরা পর্যন্ত যায়নি।
তিষা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে তাদের এলাকায় ঢুকে গেল। কী সুন্দর ছিমছাম শান্ত পরিবেশ। সামনে সবুজ লন, ছবির মতো একেকটি বাসা, পিছন থেকে ঝাউগাছ উঁকি দিচ্ছে। যেদিন রোদ ঝলমল সুন্দর একটি দিন হয় সেদিন সবকিছুকে রঙিন মনে হয়। মনটা ভালো থাকে তাই মনে হয়, সবকিছুকে মনে হয় আরো বেশী রঙিন দেখায়। আজ আকাশে মন খারাপ করা মেঘ, তাই চারপাশে একটা বিষণভাব।
তিষা হেঁটে হেঁটে তাদের বাসার দিকে যেতে থাকে, কোথাও কোনো মানুষ নেই। প্রথম যখন এদেশে এসেছিল তার মনে হতো মানুষজন সব গেল কোথায়? তার অনেকদিন লেগেছে বুঝতে যে এদেশে মানুষজনই কম। যে এলাকা যত বড়লোকদের সেখানে মানুষ তত কম। তিষার বন্ধুরা বলেছে। নিউইয়র্ক শহরে নাকী অনেক মানুষ। তিষার আব্বু বলেছেন এর পরের বার। ছুটিতে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাবেন। নিউইয়র্ক শহর নাকি খুব মজার। একটা শহর কীভাবে মজার হয় তিষা অবশ্যি বুঝতে পারে না। একটা মানুষ মজার হতে পারে, তাই বলে আস্ত একটা শহর?
বাসার সামনে এসে তিষা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। সামনে কোনো গাড়ী নেই, যার অর্থ তার আব্বু কিংবা আম্মু কেউ আসেননি। আব্বু অবশ্যি কখনোই আগে চলে আসেন না। আম্মু মাঝে মাঝে চলে আসেন। তখন তাকে আর খালি বাসায় ঢুকতে হয় না। খালি বাসায় ঢোকার মাঝে কেমন জানি খুব একটা মন খারাপের বিষয় আছে। দুই বছর আগে তারা যখন প্রথম এই দেশে এসেছিল তখন দেশের অনেক কিছুর জন্যে মন খা খা করতো। আস্তে আস্তে সবকিছুতে অভ্যাস হয়ে গেছে, শুধু এই একটা বিষয় তার অভ্যাস হয়নি। এখনো তার খালি একটা বাসায় ঢুকতে মন খারাপ হয়ে যায়। দেশে তার চাচা ফুপুরা সবাই মিলে একটা বিল্ডিংয়ে থাকতো তাদের সবার বাচ্চা কাচ্চারা মিলে তাদের একটা বিশাল পরিবার ছিল, বাসায় ঢোকার আগেই অনেক দূর থেকে সব বাচ্চা কাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেতোকী মজার একটা সময় ছিল! তিষা ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ব্যাগ থেকে বাসার চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ছিমছাম সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স, তার ঘরটা, দোতলায়। তিষা তার স্কুল ব্যাগটা কার্পেটে রেখে নিচে সোফায় বসে পড়ল। রাস্তার জুতো পরে বাসার কার্পেটের উপর চলে এসেছে, মা দেখলে নিশ্চয়ই রাগ করবেন, কিন্তু মা বাসায় নেই রাগ করবেন কীভাবে?
তিষা কফি টেবিলে পা তুলে চুপচাপ বসে থাকে। তার বয়স তেরো, এখন সে আনুষ্ঠানকিভাবে টিন এজার হয়েছে। দেশে থাকতে সে যখন আমেরিকায় গল্প শুনেছে তার বেশীর ভাগ ছিল টিন এজারদের গল্প। সে এখন এই আমেরিকার টিন এজার, এখন তার অনেক আনন্দ হওয়ার কথা। তার কী আনন্দ হচ্ছে? স্কুলে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অনেক মজা হয় সেটি সত্যি। রাত্রি বেলা যখন আব্বু আম্মু থাকে তখনও সময়টা কেটে যায়, তারপরেও বিশাল একটা সময় সে একা থাকে। কম্পিউটারের সামনে বসে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায় কিন্তু সেটা কেমন জানি কৃত্রিম। একজন মানুষকে সামনাসামনি না দেখলে তার সাথে কী কথা বলা যায়? অনেকেই পারে। তিষা পারে না।
তিষার খিদে পেয়েছে। ফ্রীজ খুললেই দেখবে আম্মু তার জন্যে খাবার রেডি করে রেখেছেন। মাইক্রোওয়েভে গরম করে সে খেতে পারবে। টিভিটা চালিয়ে দিলেই কোথাও না কোথাও একটা সিটকম খুঁজে পাওয়া যাবে, দর্শকদের কৃত্রিম হাসি শুনতে শুনতে এক সময় সে নিজেও একজন কৃত্রিম দর্শক হয়ে টেলিভিশনের চরিত্রগুলোকে দেখে হাসতে থাকবে। কিন্তু তিষার সোফা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সে কফি টেবিলে পা তুলে দিয়ে জানালার ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ধূসর মন খারাপ করা একটি আকাশ। একটু পর মনে হয় টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হবে, তখন মনে হয় আরো বেশী মন খারাপ হয়ে যাবে।
.
সোফায় বসে থাকতে থাকতে তিষা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধেবেলা আম্মু কাজ থেকে ফিরে এসে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন তিষা সোফায় ঘুমিয়ে আছে, পা থেকে জুতো পর্যন্ত খুলেনি। আম্মু একটু ভয় পেয়ে তিষাকে ধরে একটা ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন,”তিষা মা, এখানে ঘুমাচ্ছিস?”
তিশা ধড়মড় করে উঠে বসল, একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “হায় খোদা! আমি ঘুমিয়ে পড়েছি!”
“জুতো পর্যন্ত খুলিস নি? শরীর ভালো থাছে তো?”
“হ্যাঁ আম্মু শরীর ভালো আছে। যা খিদে পেয়েছে–”
“স্কুল থেকে এসে কিছু খাসনি।”
“আলসেমি লাগছিল।” বলে তিষা অপরাধীর মত হাসল।
“যা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আয়। কী খাবি বল।”
তিশা তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “যা দিবে তাই খাব আম্মু। একা একা খেতে ইচ্ছা করে না।”
আম্মু তিষার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটি এই কথাটি একটুও ভুল বলেনি। একা বসে বসে খাওয়ার চাইতে বড় বিড়ম্বনা আর কিছু হতে পারে না।
.
রাত্রে তিনজন খেতে বসেছে, তিষা তার স্প্যাগোটির উপর ঘন লাল রংয়ের একটা সস ঢালতে ঢালতে বলল, “আম্মু তোমাদের এই কাজটা ঠিক হয়নি।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কোন কাজটা?”
“এই যে আমি একা। আমার কোনো ভাইবোন নেই।”
আলু খেতে খেতে বললেন, “তাতে তোর সমস্যা কী? তুই একা তোর আদর যত্নে কেউ ভাগ বসাচ্ছে না।”
তিষা বলল, “আমার আদর যত্নে ভাগ বসালেও একটুও কম পড়বে আব্বু। তোমার এটা ঠিক যুক্তি না।”
“তাহলে কোনটা ঠিক যুক্তি।”
“একটা ছেলে কিংবা মেয়ে যদি একা বড় হয় তাহলে সে স্বার্থপর হয়ে বড় হয়। আমি নিশ্চয়ই স্বার্থপর হয়ে বড় হচ্ছি।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “হচ্ছিস নাকী?”
তিষা বলল “সেটা তো আর আমি বুঝতে পারব না, তোমরা বুঝবে।”
আব্বু বললেন, “আমরা যখন বুড়ো হব তখন যদি ওল্ড হোমে আমাদের দেখতে না আসিস তাহলে বুঝব স্বার্থপর হয়েছিস।”
“তোমাদের আরো ছেলেমেয়ে হওয়া উচিৎ ছিল আম্মু।”
“একটা নিয়েই পারি না আরো ছেলে মেয়ে!”
তিষা বলল, “কী বলছ আম্মু? আমি তোমাকে কখনো জ্বালাতন করেছি?”
“এখন করিস না। কিন্তু তুই যখন ছোট ছিলি” আব্বু বললেন, “বাপরে বাপ! এমন কোনো অসুখ নাই যে তোর হয় নাই। তোর মেজাজ ছিল গরম, সারা রাত চিৎকার করতি, বাসার কারো ঘুম নাই খাওয়া নাই–”
“আমি বিশ্বাস করি না।”
“তুই বিশ্বাস করিস কী না করিস তাতে কিছু আসে যায় না। সত্য হচ্ছে সত্য।”
তিষা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, আমার বয়স তেরো। তোমার বয়স যখন পঁচিশ তখন আমার জন্ম হয়েছে। তার অর্থ তোমার বয়স এখন আটত্রিশ। আটত্রিশ বছরে আমেরিকার মহিলাদের ধুমাধুম বাচ্চা হচ্ছে।”
আম্মু চোখ ছোট করে বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস?”
“আমি বলতে চাচ্ছি যে তোমার এখনো বাচ্চা নেয়ার বয়স আছে। একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। মেয়ে হলে খুবই ভালো ছেলে হলেও চলবে।”
আম্মু খপ করে তিষার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বেশী মাতবর হয়েছিস, মাকে পরামর্শ দিস কীভাবে বাচ্চা নিতে হবে?”
তিষা “আউ আউ” করে প্রয়োজন থেকে অনেক জোরে চিৎকার করে মাথাটা সরিয়ে নিতে নিতে বলল, “আমার ভালো মন্দ নিয়ে আমি পরামর্শ দিতে পারব না? আমার একা একা বাসায় ঢুকতে কতো খারাপ লাগে তুমি
জানো? ছোট একটা বোন না হয়ে ভাই হলে কতো মজা হতো!”
আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “নো। ভাই বোনের জন্যে দেরী হয়ে গেছে। খুব বেশী হলে তোকে একটা কুকুরের বাচ্চা কিনে দিতে পারি।”
আম্মু চোখ কপালে তুললেন, “কুকুর? ঘরের মাঝে একটা দামড়া কুকুর ঘুরে বেড়াবে? ছিঃ!”
তিষা বলল, “কেন মা? কুকুর তো থাকেই। আমার স্কুলের সব বন্ধুর কুকুর আছে!”
“থাকুক। তাই বলে আমার বাসার ভিতরে একটা কুকুর ঘুরে বেড়াতে পারবে না।”
“কেন মা? দেশে আমাদের বাসায় একটা বিড়াল ছিল মনে নাই? যদি বাসায় বিড়াল থাকতে পারে তাহলে কুকুর থাকলে দোষ কী?”
“বিড়াল কত ছোট, কুকুর কতো বড়”
আব্বু বললেন, “ছোট ব্রীডের কুকুরও আছে। বিড়ালের সাইজ!”
আম্মু বললেন, “বাসায় পোষাপাখী রাখা খুব সোজা ব্যাপার না। এটাকে খাওয়াতে হয় বাথরুম করাতে হয় সব দায়িত্ব নিতে হয়।”
তিষা সোজা হয়ে বসে মুখ শক্ত করে বলল, “আম্মু, তুমি যদি বিশ্বাস করে আমাকে একটা ছোট ভাই কিংবা বোন দিতে আমি তাকে পর্যন্ত দেখে শুনে রাখতাম। আর ছোট একটা কুকুরের বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখতে পারব না?”
কাজেই পরের উইক এন্ডেই তিষা তার আব্বুকে নিয়ে একটা পেট স্টোর থেকে ছোট একটা কুকুরের বাচ্চা আর কুকুর পালার উপর একটা বই কিনে আনল। দোকানে অনেক ধরণের কুকুর, তাদের দামও অনেক, তিষা তার মাঝে বেছে বেছে ছোট একটা বাদামীর মাঝে সাদা আর কালো রংয়ের কুকুর বেছে নিল। এটাকে এখানে বলে বিগল, বড় বড় চোখ, ঝোলা কান। দেখলেই আদর করার ইচ্ছে করে।
কুকুরটার এমন মায়া কড়া চেহারা যে বাসায় আনার পর তাকে দেখে আম্মুর মুখে পর্যন্ত হাসি ফুটে উঠল। রান্না ঘরের মেঝেতে ছেড়ে দেবার পর। সেটা কুঁই কুঁই শব্দ করে মেঝে শুকতে শুকতে এদিকে সেদিক ঘুরতে থাকে। নূতন জায়গায় এসে তার মাঝে এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভাব, কোথায় যাবে কার কাছে একটুখানি আদর পাবে সেটা নিয়ে এক ধরনের দুর্ভাবনা। কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ্যি বুঝে গেল তিষা হচ্ছে তার আসল মালিক তাই সে গুটিশুটি মেরে তার কোলে এসে বসে পড়ল। তিষা আদর করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সোনামনি আমার। টুই টুই টুই।”
আব্বু হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম দিবি তোর কুকুরের?”
তিষা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “টুইটি।”
“টুইটি একটা পাখীর বাচ্চার নাম।”
“হোক। আমার এই টুনটুনির নাম টুইটি।”
আম্মা বললেন, “টুনটুনি একটা পাখী। কুকুরের বাচ্চা কবে থেকে পাখী হল।”
তিষা বলল, “আমি এতো কিছু বুঝি না।” তারপর কুকুরের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি টুনটুনি? আজ থেকে তোর নাম টুইটি। টু-ই টি।”
কুকুরের বাচ্চাটা কী বুঝল কে জানে, মাথা তুলে ভৌ ভৌ করে একবার ডাকল। তিষা তার আলু আর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ, টুইটি তার নামটাকে পছন্দ করেছে!”
.
এক সপ্তাহ পর তিষা তার স্কুল বাস থেকে নামল, তারপর রাস্তা পার হয়ে সে হেঁটে হেঁটে তাদের এলাকায় ঢুকে পড়ে। অন্যান্য দিনের মত আকাশে মেঘ, পথে কোনো মানুষজন নেই। ছবির মত একটি একটি বাসা পার হয়ে সে তার বাসায় এল, সামনে কোনো গাড়ী নেই। তার অর্থ আম্মু এখনো আসেননি। আজকে কিন্তু তার মন খারাপ হল না, তিষা জানে সে একা নয়। বাসায় তার জন্যে টুইটি অপেক্ষা করছে। দরজার তালায় চাবিটা স্পর্শ করা মাত্রই ভেতরে সে টুইটির উত্তেজনা টের পেল, সে ঘরের ভেতর ছোটাচ্চুটি শুরু করেছে। দরজা খুলতেই টুইটি তার ছেলেমানুষী গলায় ভেউ ভেউ করে ডাকতে ডাকতে তিষাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর আবার ছুটে ঘরের আরেক মাথায় চলে যায় আবার ছুটে আসে। দেখে বোঝা যায় আনন্দে সে কী করবে বুঝতে পারছে না।
তিষা স্কুলের ব্যাগটা নিচে রেখে বলল, “আস্তে টুইটি, আস্তে! তোর তো উত্তেজনায় স্ট্রোক হয়ে যাবে!”
টুইটি তিষার কথা কিছু বুঝল কীনা কে জানে কিন্তু তার উত্তেজনা বিন্দুমাত্র কমল না। সে ছোটাচ্চুটি করতে লাগল, তিষাকে ঘিরে ঘূরতে লাগল, তার উপর লাফিয়ে পড়তে লাগল এবং চিকন গলায় ভেউ ভেউ করে ডাকতে লাগল। তিষা টুইটিকে জাপটে ধরে আদর করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার উত্তেজনা কমে আসে। তিষা তখন তার ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রাখে, স্কুলের পোষাক পাল্টে নেয় এবং সারাক্ষণ টুইটি তাকে ঘিরে লাফ ঝাঁপ দিতে থাকে। তারপর নিচে নেমে তিষা ফ্রীজ থেকে একটা পিৎজার টুকরো বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেয়। একটা প্লেটে পিজার টুকরোটা নিয়ে সে পিছনের দরজা খুলে বের হয়ে আসে। তিষা বের হবার আগেই টুইটি লাফিয়ে বের হয়ে যায়। ঘরের ভেতর সবকিছু সে এতোদিনে চিনে গেছে বাইরে সবকিছু তার কাছে রহস্যময়। সে সতর্কভাবে এদিকে সেদিকে তাকায়। গাছে একটা রবিন পাখীকে দেখে গরগর করে একটা গর্জনের মত ভঙ্গী করে। একটা কাঠবেড়ালীকে দেখে তাকে ধাওয়া করে এবং হঠাৎ করে থেমে গিয়ে মাটি শুকতে শুকতে এগিয়ে যায়।
তিষা এক ধরণের স্নেহ নিয়ে এই অবুঝ পশুটির দিকে তাকিয়ে থেকে তার পিৎজাটি খেতে থাকে। একটা ছোট অবুঝ পশু একজন মানুষের জীবন এভাবে পাল্টে দিতে পারে তিষা আগে কখনো কল্পনা করেনি।
. ঠিক এরকম সময় তিষার বাসা থেকে দুই হাজার তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটা ছয়তলা দালানে লিডিয়া এপসিলোন কোম্পানীতে যোগ দিতে গিয়েছি।
০৩. রিকার্ডো লিডিয়ার দিকে চোখ
রিকার্ডো লিডিয়ার দিকে চোখ মটকে বলল, “তুমি বলেছিলে তুমি এপসিলোনে যোগ দেবে না।”
লিডিয়া কোনো উত্তর দিল না। রিকার্ডো সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, “আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করে এখানে যোগ দেয়াটা তোমার জন্যে খুব চমৎকার একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
লিডিয়া হিংস্র মুখে বলল, “তুমি যখন আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে তখন যদি পরিষ্কার করে সত্যি কথাটা বলে আসতে তাহলে
আমার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আরো সহজ হতো।”
রিকার্ডো অবাক হবার ভান করে বলল, “কোন সত্যি কথাটা তোমাকে বলা হয়নি?”
“তোমার সাথে দেখা হওয়ার দুই সপ্তাহের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় আমার থিসিস নিয়ে তদন্ত কমিটি বসিয়েছে, তিন সপ্তাহের মাঝে ইনকাম ট্যাক্স অফিস থেকে চিঠি এসেছে, চার সপ্তাহের মাঝে এফ বি আই কথা বলতে এসেছে–এগুলো কী এমনি এমনি হয়েছে?”
“তুমি যখন একটা বি.এমডব্লিউ গাড়ী কিনে আমাদের সিগন্যাল দিয়েছ যে তুমি আমাদের সাথে যোগ দেবে তখন কী ম্যাজিকের মতো সব যন্ত্রণা মিটে যায়নি?”
“গিয়েছে।”
“তাহলে আমরা তোমার ভালো চাই লিডিয়া। তুমি একা একা থাকলে আগে হোক পরে হোক বিপদে পড়বে। আমাদের সাথে থাকো তুমি জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো পাবে, কিন্তু কখনো বিপদে পড়বে না। আমরা তোমাকে রক্ষা করব। আর যদি না থাকো–”
“আর যদি না থাকি?”
রিকার্ডো হা হা করে হাসল, “আর যদি না থাকো তাহলে কী হতে পারে সেটা তো দেখেছই। সেটা এখন অতীত। এখন তুমি আমাদের এসসিলনের একজন সম্মানীত গবেষক। এপসিলনে তোমাকে স্বাগত জানাই।”
লিডিয়া জিজ্ঞেস করল, “এখন আমাকে কী করতে হবে?”
“তোমাকে আলাদা করে কিছুই করতে হবে না। আমাদের কাজকর্মের সাথে পরিচিত হও, দেখো কী ধরণের কাজ তোমার ভালো লাগে। সেটা করো।”
“ঠিক আছে।”
রিকার্ডো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল, তোমাকে আমাদের অফিসটা ঘুরিয়ে দেখাই। তোমার ভালো লাগবে।”
রিকার্ডো তখন লিডিয়াকে সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। বড় লাইব্রেরী, বড় ডাটা সেন্টার, নানা ধরনের ল্যাবরেটরি। সবচেয়ে দর্শনীয় বিষয়টি হচ্ছে ক্র্যাগনন নামে একটা বিশাল সুপার কম্পিউটার। সারা পৃথিবীতেই মনে হয় এই মডেলের কম্পিউটার খুব বেশী নেই। ছোট ছোট অফিস ঘরে টেবিলে ঝুঁকে মানুষজন কাজ করছে। মানুষগুলোর চেহারার মাঝে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ আছে কিন্তু কোনো কমনীয়তা নেই। চেহারার মাঝে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা রয়েছে সেটা কেন বোঝা যায় না শুধু অনুভব করা যায়।
সবকিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে যখন অফিসের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে তখন লিডিয়ার চোখ পড়ল একটা নোটিস বোর্ড–সেখানে আলাদা আলাদাভাবে বেশ কিছু মানুষের ছবি। মানুষগুলোর সবাই কম বয়সী। লিডিয়া জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কাঁদের ছবি?”
রিকার্ডো বলল, “সেটা তোমার এখনই জানতে হবে না।”
“আমি জানতে চাই।”
“বেশ। তাহলে শোনো–এরা আমাদের প্রাক্তন গবেষক।”
“প্রাক্তন?”
“হ্যাঁ।”
লিডিয়া ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কোথায়?”
“নেই।”
“নেই মানে?”
“মারা গেছে।”
“কীভাবে?”
রিকার্ডো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কেউ একসিডেন্টে, কেউ সুইসাইড, কেউ ড্রাগ ওভারডোজ।”
লিডিয়া ধীরে ধীরে রিকার্ডোর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“এরা সবাই এপসিলন ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এপসিলনের কাজ করার পদ্ধতি তাদের পছন্দ হয়নি। চাকরী ছেড়ে দেবার পর হতাশায় ডুবে গিয়ে এভাবে মারা গেছে।”
লিডিয়া ফিস ফিস করে বলল, “আসলে, তোমরা এদের সবাইকে মেরে ফেলেছ, তাই না?”
রিকার্ডো কোনো উত্তর দিল না। হাসার মত ভঙ্গী করল। লিডিয়া গলা আরেকটু নামিয়ে বলল, “তারপর এই ছবিগুলো এখানে টানিয়ে রেখেছ, সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছ, কেউ যদি এপসিলনের সাথে বেইমানী করে তাহলে তার অবস্থাও হবে এরকম। তাই না?”
রিকার্ডোর মুখে হাসিটুকু আরো বিস্তৃত হল, বলল “কফি খাবে? আমাদের কাফেটারিয়াতে অসাধারণ কফি পাওয়া যায়।”
.
এক সপ্তাহ পর লিডিয়া রিকার্ডোর হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে নাও। এর ভিতরে একটা সিডি আছে। সিডির ভেতরে আমি একটা প্রজেক্ট সম্পর্কে লিখেছি।”
রিকার্ডো খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “চমৎকার। সাধারণত এতো তাড়াতাড়ি কেউ কোনো আইডিয়া দিতে পারে না।”
লিডিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে লাইব্রেরীর দিকে হেঁটে গেল। ঘণ্টাখানেক পর রিকার্ডো তাকে খুঁজে বের করে বলল, “তোমার প্রজেক্টটা পড়েছি।”
লিডিয়া তার মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইল রিকার্ডোর কথায় কোনো উৎসাহ দেখাল না। রিকার্ডো বলল, “আমি বসের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ধারণা–”
লিডিয়া এবারেও রিকার্ডোর কথায় কোনো উৎসাহ দেখাল না। তার মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইল। রিকার্ডো হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমার ধারণা তোমার বক্তব্য পুরোটা এক ধরনের পাগলামো। অবাস্তব পাগলামো।”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না।
পরদিন ভোরবেলা রিকার্ডো উত্তেজিত ভাবে লিডিয়াকে খুঁজে বের করল। গলা নামিয়ে বলল, “ তোমাকে এখনই নিউইয়র্ক যেতে হবে।”
“এখনই?”
“হ্যাঁ। বস তোমার সাথে কথা বলতে চাইছেন।”
লিডিয়া বলল, “পরের ফ্লাইট কখন?”
“ফ্লাইটে যেতে হবে না। আমাদের কোম্পানীর নিজের জেট আছে। তুমি রেডি হও।”
“আমি রেডি।”
রিকার্ডো উত্তেজিত গলায় বলল, “আগে কখনো এরকম ঘটেনি। বস কখনো এতো জুনিয়র মানুষের সাথে দেখা করতে চাননি।”
লিডিয়া কিছু বলল না। রিকার্ডো বলল, “তোমার প্রজেক্ট! নিশ্চয়ই তোমার প্রজেক্টটা নিয়ে বস কিছু বলবেন। আমার কাছে মনে হয়েছে পাগলামো, কিন্তু বসের কাছে পাগলামো মনে হয়নি। বস নিশ্চয়ই এর মাঝে কিছু একটা দেখেছেন যেটা আমি দেখিনি।
লিডিয়া বলল, “বসের সাথে কথা বলার জন্যে আমার কী আলাদা কিছু জানা থাকতে হবে?”
“তাকে নাম ধরে ডাকবে না। স্যার বলবে। তোমাকে নাম ধরে ডাকার অনুমতি দিলেও নাম ধরে ডাকবে না। তোমাকে বসার অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত বসবে না।”
“আর কিছু?”
“তোমাকে কিছু খেতে দিলে না করবে না। খাবে, অপছন্দ হলেও খাবে।”
“আর কিছু?”
“সোজাসুজি চোখের দিকে তাকাবে না।”
লিডিয়া বলল, “ঠিক আছে।”
.
ঠিক ছয় ঘন্টা পর একটা কালো গাড়ী লাগার্ডিয়া এয়ারপোর্ট থেকে লিডিয়াকে তুলে নিয়ে গেল। ম্যানহাটনের মাঝামাঝি একটা বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ীটা দাঁড়াতেই একজন দরজা খুলে বলল, “লিডিয়া?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল। মানুষটি বলল, “আমার সাথে এসো। বস তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
ছিয়াশি তালায় লিফট থেমে গেল, লিডিয়া তখন মানুষটির পিছনে পিছনে লিফট থেকে বের হয়ে আসে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভারী দরজাটা খুলে যায়। দুজনে ভেতরে ঢুকে গেল। সামনে আরেকটা ভারী দরজা। সেটাও খুলে গেল। মানুষটা একটা লম্বা করিডর ধরে হেঁটে হেঁটে একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছে একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “লিডিয়া, বস এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
লিডিয়া দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। বিশাল একটা আলোকোজ্জ্বল ঘর। ঘরের শেষ মাথায় একটা বড় টেবিলের পিছনে একজন মানুষ তার দিকে পিছন দিয়ে একটা কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে। লিডিয়ার পায়ের শব্দ শুনে মানুষটি ঘুরে তাকাল। মানুষটির চুল ধবধবে সাদা, চোখ দুটো আশ্চর্য রকম নীল। মুখে বয়সের বলি চিহ্ন। তার বয়স কতো অনুমান করা কঠিন। সাদা রংয়ের শার্ট সাদা টাই সাদা স্যুট। জুতো দেখা যাচ্ছে না কিন্তু লিডিয়া অনুমান করতে পারল সেগুলোও নিশ্চয়ই ধবধবে সাদা। লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, “এসো লিডিয়া।”
লিডিয়া এগিয়ে যায়। কাছে না গিয়েও বুঝতে পারে এই মানুষটি ভয়ংকর। একদিন সে কী এই মানুষটির মতো হতে পারবে?
লিডিয়া কাছাকাছি পৌঁছানোর পর মানুষটি বলল, “বস।”
লিডিয়া একটা চেয়ার টেনে বসে। চেয়ারটি সুন্দর কিন্তু আরামদায়ক নয়। ইচ্ছে করে এরকম রাখা হয়েছে, এই ঘরে নিশ্চয়ই কাউকে আমন্ত্রিত অনুভব করতে দেয়া হয় না।
মানুষটি বলল, “চা, কফি কিছু খাবে।” লিডিয়া চোখের কোনা দিয়ে আগেই দেখেছে ঘরের কোনায় একটা কফি মেশিনে কফি রাখা আছে। পাশে বেশ কয়টা মগ। তাই সে বলল, “একটু কফি খেতে পারি। ব্ল্যাক।”
মানুষটি নিজেই উঠে গেল কফি আনতে। মানুষটি লম্বা, হাঁটে সোজা হয়ে। পায়ের জুতো সাদা, ঠিক যে রকম অনুমান করেছিল। মানুষটি দুটি মগে কফি ঢেলে তার দিকে এগিয়ে আসে। লিডিয়ার সামনে একটা কফির মগ রেখে সে আবার তার চেয়ারে গিয়ে বসল। লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
“না। কোনো অসুবিধে হয়নি।” লিডিয়া কফির মগে চুমুক দিয়ে বুঝতে পারল পৃথিবীতে এর চাইতে ভালো কফি হওয়া সম্ভব নয়।
“আমার নাম উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী। আমাকে বিল বলে ডাকতে পার।”
রিকার্ডো বলেছিল তাকে নাম ধরে না ডাকতে, কিন্তু লিডিয়া নাম ধরে ডাকল, বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ বিল।”
রিকার্ডো বলেছিল সরাসরি তার চোখের দিকে না তাকাতে, কিন্তু লিডিয়া সরাসরি উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জীর চোখের দিকে তাকাল, এতো নীল। চোখ সে আগে কখনো দেখেনি।
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি তোমার রিপোর্টটা দেখেছি। তোমার চিন্তার স্টাইলটা আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি কী আমাকে তোমার মত করে বোঝাতে পারবে মানুষ কেন পোষা কুকুরের বদল পোষা মানুষের বাচ্চা রাখবে?”
লিডিয়া একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “মানুষ পোষা পশুপাখী রাখে সঙ্গ পাবার জন্যে। যে প্রাণী যত বুদ্ধিমান সে তত ভালো সঙ্গ দিতে পারে। মানুষ থেকে বুদ্ধিমান আর কোন প্রাণী আছে? তাই মানুষের বাচ্চা সবচেয়ে ভালো সঙ্গ দিতে পারবে। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ আমার রিপোর্টে আমি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি এই মানুষের বাচ্চাগুলো আইন মাফিক বাজার থেকে কেনা যাবে কারণ এরা পুরোপুরি স্বাভাবিক বাচ্চা হবে না। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে এই বাচ্চা গুলোর মাঝে কিছু পরিবর্তন করে কংগ্রেস থেকে পাস করিয়ে নিতে হবে যে দেখতে মানুষের মতো হলেও এরা আসলে মানুষ প্রজাতি নয়। এরা মানুষ এবং পশুর কাছাকাছি একটা প্রাণী। এরা হাসিখুশি হবে কিন্তু কোনো কথা বলবে না। এদের বুদ্ধিমত্তা হবে সীমিত, স্মৃতিশক্তি হবে দুর্বল। এদের আয়ু হবে সর্বোচ্চ দশ বছর। যারা এতোদিন বাসায় কুকুর পুষছে তারা এখন মানুষের বাচ্চা পুষবে।”
“তুমি কেন মনে কর কংগ্রেস থেকে এই প্রজাতিকে মানুষ নয় সেটা পাশ করিয়ে নেয়া যাবে?”
“আমি জানি তোমার অনেক ক্ষমতা। তাছাড়া কংগ্রেসম্যান আর সিনেটরদের টাকা দিয়ে কেনা যায়। আমরা কাজটা সহজ করে দেব বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিয়ে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তীক্ষ্ণ চোখে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি কীভাবে বিজ্ঞানীদের সাহায্য নেবে?”
“আমরা বলব এই মানুষের বাচ্চাগুলো আসলে কোনো মায়ের গর্ভে জন্ম নেয় না। এরা জন্ম নেয় ল্যাবরেটরির কৃত্রিম পরিবেশে?”
“এটা কী সত্যি?”
“না। কিন্তু আমরা পৃথিবীর একাধিক ল্যাবরেটরিতে এটা করে দেখাব। যখন দেখানো হবে একটা স্তন্যপায়ী প্রাণী ল্যাবরেটরির কৃত্রিম পরিবেশে জন্ম নেয়ানো সম্ভব হয়েছে তখন সবাই মেনে নেবে এই প্রযুক্তি আছে। জার্নালে প্রকাশিত তথ্য কে অবিশ্বাস করবে?”
“একটা মিথ্যা গবেষণার ফল কীভাবে জার্নালে ছাপাবে?”
লিডিয়া শব্দ করে হাসল, বলল “আমার যে দুটি গবেষণা দিয়ে আমি বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত হয়েছি দুটিই ভূয়া। রাজনীতিবিদদের যেভাবে কেনা যায় বিজ্ঞানীদেরও সেভাবে কেনা যায়। সবারই একটা মুল্য থাকে–সেই মূল্য দিতে রাজী থাকলে এগুলো খুব সহজ।”
“মানুষের যে বাচ্চাটকে পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করতে চাও সেটা দেখতে কেমন হবে তুমি ভেবেছ?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “ভেবেছি। তবে আমার ভাবনটাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা এটার জন্যে অনেকগুলো জরীপ নিতে পারি।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “তবু তোমার ভাবনাটা শুনি।”
“বড় বড় চোখ। চাপা নাক। মুখে হাসি। মানুষ থেকে আলাদা করার জন্যে দুই পায়ে দাঁড়া করানোর প্রয়োজন নেই। গায়ে পশম। নিউট্রাল জেন্ডার অর্থাৎ ছেলেও না মেয়েও না। এরা মানুষের প্রজাতির না সেটা প্রমাণ করার জন্যে বাড়তি কিছু ক্রমোজম দেয়া যেতে পারে।”
“আর কিছু?”
“কখনো চেহারার মাঝে দুঃখ বেদনায় ছাপ পড়বে না। যখন কষ্ট পাবে তখনও হাসবে। যন্ত্রণা পেলেও হাসবে। মানুষ কখনোই জানবে না তার ভেতরে কষ্ট আছে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এই মানুষের বাচ্চার ব্যবসা করে কতো বিলিওন ডলার আসতে পারে তার যে হিসেবটি দিয়েছ সেটা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। সঠিক হিসেব। ভালো কাজ হয়েছে।”
“ধন্যবাদ।”
“আমি যদি তোমার এই প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করতে চাই কতোদিন লাগবে?”
“তুমি কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে চাও তার উপর নির্ভর করবে। যদি টাকা পয়সা কোনো সমস্যা না হয় তাহলে দুই বছর।”
“ঠিক আছে মেয়ে, আমি তোমাকে দুই বছর সময় দিচ্ছি।”
“ধন্যবাদ।”
“তুমি এখন যেতে পার।”
লিডিয়া উঠে দাঁড়ল, বলল, “শুভ রাত্রি।”
“শুভ রাত্রি।”
লিডিয়া যখন ঠিক ঘর থেকে বের হয়ে যাবে তখন উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তাকে থামাল, বলল, “তুমি কী এই পোষা মানুষের বাচ্চার কোনো নাম ঠিক করেছ?
“করেছিলাম।”
“কী?”
লিডিয়া একটু ইতস্তত করে বলল, “এটাকে এনিম্যান বলা যায়। এনিম্যালের এনি এবং হিউমানের ম্যান। এনিম্যান।”
“ঠিক আছে লিডিয়া, তোমার এনিম্যান প্রজেক্ট সফল হোক।”
০৪. তিষা বাসায় ঢুকে তার মাকে বলল
তিষা বাসায় ঢুকে তার মাকে বলল, “আম্মু, বল দেখি এটার মানে কী?”
তারপর সে প্রথমে তার ডান হাতটা নিজের বুকের উপর রাখে, তারপর দ্বিতীয় হাতটাও বুকের উপর নিয়ে আসে তারপর দুই হাত দিয়ে তার আম্মুকে দেখায়। আম্মু বললেন, “জানি না বাপু।”
তিষা বলল, “এর মানে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আম্মু বললেন, “তুই কাউকে ভালোবাসলে সোজাসজি মুখ ফুটে বলে ফেল। হাত পা নেড়ে এতো কায়দা করে বলতে হবে কেন?”
তিষা বলল, “এটা হচ্ছে সাইন ল্যাংগুয়েজ। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে এসেছে সে কানে শুনতে পায় না, ঠিক করে কথাও বলতে পারে না। সবকিছু সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলে। আমাদেরকে সে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাচ্ছে।”
আম্মু বললেন, “ব্যাপারটা খারাপ হয় না। তুই যতক্ষণ বাসায় আছিস সারাক্ষণ সাইন ল্যাংগুয়েজ কথা বললে বাসাটা একটু নিরিবিলি থাকবে!”
তিষা তার মাকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও আম্মু। তোমার সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা।”
টুইটি তিষাকে সমর্থন করে ভারী গলায় ডাকল। তাকে যখন প্রথম আনা হয়েছিল তারপর দুই বছর পার হয়ে গেছে এখন সে আর ছোট কুকুরটি নেই, রীতিমত বড় হয়ে গেছে। তেজী শরীর, মসৃণ অবয়ব, কৌতূহলী চোখ। যতক্ষণ তিষা স্কুলে কিংবা বাইরে থাকে টুইটি ততক্ষণ খুবই দায়িত্বশীল একটা কুকর। সে বাসায় আসা মাত্র তার দুষ্টুমি শুরু হয়ে যায়। সে লাফ ঝাঁপ দিতে থাকে, তিষাকে ঘিরে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। তার প্রিয় খেলা হচ্ছে তিষার একপাটি জুতো মুখে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যাওয়া। ঘরের ভেতরে না থেকে বাইরে ছোটাচ্চুটি করা টুইটির অনেক বেশী পছন্দ। যতদিন শীত না পড়েছে ততদিন সমস্যা ছিল না কিন্তু বরফ পড়তে শুরু করার পর তিষা বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে–টুইটি সেটা বুঝতে পারে না। সে যেরকম বরফে ছোটাচ্চুটি করতে পারে তার ধারণা সবাই বুঝি সে রকম পারে!
এই দুই বছরে তিষাও অনেক বড় হয়েছে। তার ক্লাশের আমেরিকান বান্ধবীরা অবশ্যি আর কিশোরী নেই সবাই তরুণী হয়ে গেছে। তিষা এখনো হালকা পাতলা, চোখে মুখে একটু বাড়তি বুদ্ধির ছাপ, চাল চলনে একটু বেশী আত্মবিশ্বাস তা না হলে হয়তো বোঝাই যেতো না তার বয়স এখন। পনেরো।
রাতে খাবার টেবিলে তিষা আবার তার ক্লাশের কানে না শোনা ছেলেটির কথা তুলল, বলল, “আব্বু, তুমি জান আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে এসেছে, ছেলেটা কানে শুনতে পায় না কিন্তু কম্পিউটারের জিনিয়াস।”
আব্বু বলল, “হতেই পারে। কানে না শুনলে একজন কী জিনিয়াস হতে পারে না? বিটোভেন কানে শুনতেন না–তাতেই কতো বড় শিল্পী কানে শুনলে না জানি কী হতো!”
তিষা বলল, “ছেলেটার নাম জন। জন উইটক্যাম্প। খুবই সুইট। একদিন বাসায় নিয়ে আসব দেখো।”
“নিয়ে আসিস।”
“আমাদেরকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাচ্ছে।”
“ইন্টারেস্টিং।” আব্বু বললেন, “আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন সাইন ল্যাংগুয়েজের কথা জানতাম না। যদি জানতাম তাহলে কী করতাম বল দেখি?”
“কী করতে?”
“পরীক্ষার হলে নকল করা খুব সোজা হতো। আমাদের ফার্স্ট বয় এক কোনায় বসে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলতো আর পুরো হলের আমরা সবাই লিখে ফেলতাম। একেবারে নিঃশব্দে।”
“আব্বু, আজকাল পরীক্ষায় নকল করার জন্যে সাইন ল্যাংগুয়েজ লাগে না। কতো রকম ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বের হয়েছে তুমি জান?”
“তা ঠিক।”
আম্মু বললেন, “এই যে ছেলেটা কানে শুনতে পায় না তার ক্লাশ করতে সমস্যা হয় না?
“মোটেও না। লিপ রিডিং করতে পারে। ঠোঁট নাড়া দেখে সব কথা বুঝতে পারে। একটু একটু বলতেও পারে, কষ্ট করে বুঝতে হয়।”
“ইন্টাররেস্টিং।” আব্বু বললেন, “আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না এরকম একজন আমাদের সাথে লেখাপড়া করবে।”
তিষা বলল, “জন তো মোটামুটি স্বাভাবিক। আমাদের স্কুলে একজন আছে অন্ধ। আরো দুইজন হুইল চেয়ারে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, যে মেয়েটি অন্ধ সে তার ক্লাশের মনিটর।”
“বাহ!”
“আমরা কেউ অবশ্যি অন্ধ বলি না, সবসময়েই বলি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।”
“তাইতো বলা উচিত।”
.
পরের কয়েকদিন প্রচুর তুষারপাত হল, চারদিক বরফে ঢেকে গেল। এর মাঝে তিষা একদিন খবর আনল কাছাকাছি সাসকুয়ান হ্রদটা বরফে ঢেকে গেছে, সবাই তার ওপরে স্কেটিং করছে।
আম্মু বললেন, “জানি না বাপু।হ্রদের উপর বরফ জমে গেছে সেখানে স্কেটিং করার সময় বরফ ভেঙ্গে যদি নিচে পড়ে যায়?”
তিষা বলল, “কী বল আম্মু? বরফ কতো শক্ত হয় জান? লেকের ওপর রীতিমত গাড়ী যেতে পারে!”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। চল একবার দেখে আসি।”
“তোর আব্বুকে বল, গিয়ে দেখে আসব। খোদার দুনিয়ায় কতো বিচিত্র জিনিষই না আছে!”
“আমি আমার স্কেট নিয়ে যাব।”
“ঠিক আছে।”
এই বয়সী মেয়েরা যা করে তিষাও সেগুলো করে। রোলার স্কেটিং করে আইস স্কেটিং করে, উইক এন্ডে দলবেধে মলে বেড়াতে যায়। সবাই মিলে সিনেমা দেখে। দেশের অনেক মানুষ এখানে এসে তাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করে, তিষার আব্বু আম্মু কখনো সেটা করেন নি।
.
দুই সপ্তাহ পর এক উইক এন্ডে তিষাকে নিয়ে তার আবু আম্মু জমে যাওয়া সাসকুয়ান লেক দেখতে গেল। আব্বু গাড়ী চালাচ্ছেন সামনে আম্মু। পিছনে তিষা আর টুইটি। টুইটির উত্তেজনা চোখে পড়ার মত, অনেকদিন পর ঘর থেকে বের হতে পেরে তার আনন্দের শেষ নেই।
প্রায় দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করে তারা সেই জমে যাওয়া হদে উপস্থিত হলো। এমনিতে দেখে বোঝার উপায় নেই কোথায় শক্ত মাটি কোথায় হ্রদ সবকিছু ধবধবে সাদা বরফে ঢাকা। একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়, যেখানে হ্রদ ছিল সেখানে গাছ নেই, আশে পাশে পাতা ঝড়ে যাওয়া অনেক গাছ।
উইক এন্ড বলে আজকে অবশ্যি অনেক মানুষ। দূরে গাড়ী পার্ক করে সবাই হ্রদের উপর স্কেটিং করতে চলে এসেছে। উজ্জল রঙ্গীন কাপড় পরে নানা বয়সী মানুষ ছোটাচ্চুটি করছে, দেখতে ভারি ভালো লাগে। তিষা গাড়ী থেকে নেমে তার স্কেটগুলো হাতে নিয়ে সামনে ছুটে যেতে থাকে, তার ভাব দেখে মনে হয় সামনে যে বিশাল আনন্দোৎসব চলছে একটু দেরী করলেই সেটা বুঝি শেষ হয়ে যাবে। টুইটিরও উৎসাহের শেষ নেই, সে তিষার পিছনে পিছনে ডাকতে ডাকতে ছুটতে থাকে।
আব্বু আর আম্মু গাড়ী থেকে বের হয়ে আসেন। দুই হাত ঘষে একটু উষ্ণতা তৈরী করতে করতে তারা বরফে ঢেকে যাওয়া হ্রদের একটু কাছে এগিয়ে যান।
তিষা কতোক্ষণ স্কেটিং করছিল মনে নেই, এই শীতের মাঝেও তার শরীর প্রায় ঘেমে গিয়েছে। তাদের ক্লাসের কয়েকজন এতো চমৎকার আইস স্কেটিং করতে পারে যে দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। বরফের ওপর এতো সুন্দর করে ঘুরপাক খায় যে দেখে মনে হয় কাজটা বুঝি খুবই সহজ। তিষা চেষ্টা করে দেখেছে, কাজটা মোটেও সহজ নয়, চেষ্টা করতে গিয়ে একটু পরপর বরফের ওপর আছাড় খেয়ে পড়েছে!
তিষা ঘুরপাক খেতে খেতে হ্রদের একপাশে চলে এসেছিল ঠিক তখন সে প্রথমে একজনের তারপর হঠাৎ করে সম্মিলিত মানুষের একটা ভয় পাওয়া আতংকের চিৎকার শুনতে পায়। তিষা দাঁড়িয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হয়েছে, তখন সে মানুষের চিৎকারের পাশাপাশি বরফ ভাঙ্গার একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পেল এবং পরমুহূর্তে তার পায়ের নিচ থেকে কিছু একটা সরে যাওয়ার অনুভূতি হল। কী ঘটছে সেটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় নেয়। হ্রদের উপর যে বিশাল বরফের স্তর রয়েছে সেটা হঠাৎ করে ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে–এটা সত্যিই ঘটা সম্ভব কী না সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবার সময় নেই, এখন এখান থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে। তিষা দেখল আতংকে চিৎকার করতে করতে সবাই হ্রদের তীরে ছুটে যেতে শুরু করেছে। তিষা মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কোন দিকে গেলে সে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি তীরে পৌঁছাতে পারবে, তারপর ঘুরে সে সেদিকে ছুটতে থাকে ঠিক তখন তার সামনে হঠাৎ করে বরফের এটা ফাটল বের হয়ে নিচ থেকে কুচকুচে কালো হিমশীতল পানি বের হয়ে আসে। তিষা প্রাণপণে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে থামতে পারল না। তিষা বরফের উপর শুয়ে পড়ে বরফকে খামচে ধরে নিজেকে থামাতে চেষ্টা করল কিন্তু তবু নিজেকে থামাতে পারল না। তিষা বরফের ফাটল দিয়ে হিমশীতল পানিতে পড়ে মুহূর্তের মাঝে তলিয়ে গেল। টুইটি ঠিক তখন ছুটতে ছুটতে সেখানে এসেছে, বরফের ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে সেটি একবার হাহাকার করে ডাকল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে কালো হিমশীতল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তিষার আলু আর আম্মু এক ধরনের আতংক নিয়ে হ্রদের দিকে তাকিয়েছিলেন, কী ঘটছে বুঝতে তাদের একটু সময় লাগল। এতো মানুষের ভীড়ে তিষাকে খুঁজেও পাচ্ছিলেন না, যখন সব মানুষ নিরাপদে সরে এসেছে। এবং তাদের ভেতরে কোথাও তিষা কিংবা টুইটিকে খুঁজে পেলেন না। তখন হঠাৎ করে একটা অচিন্ত্যনীয় ভয়াবহ আতংকে তারা পাথর হয়ে গেলেন। যারা ছুটে এসেছে তাদের মুখে আব্বু আম্মু শুনতে পেলেন বরফের ফাটল দিয়ে লাল পার্কা পরা একটি মেয়ে পড়ে গেছে আর তার পিছু পিছু একটা কুকুর সেখানে ঝাঁপ দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে তিষার আব্বু আম্মুর পুরো জগৎটি মুহূর্তে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। আম্মু চিৎকার করে সেখানে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে কেউ যেতে দিল না, সবাই মিলে তাকে ধরে রাখল।
বেশ কয়েকজন সতর্ক ভাবে তিষার খোঁজে এগিয়ে গেল, বরফের ফাটল দিয়ে উঁকি দেয়া কুচকুচে কালো পানিতে তিষার কোনো চিহ্ন নেই। তিষা সাঁতার জানে কিন্তু এই হিমশীতল পানিতে ডুবে বরফের নিচে চলে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। নিঃশ্বাস নিতে না পারলে মানুষ কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। এর মাঝে বেশ কয়েক মিনিট সময় পার হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে এই বরফের নিচ থেকে তিষাকে জীবিত উদ্ধার করার সব আশা খুব দ্রুত শেষ। হয়ে যেতে শুরু করল।
উদ্ধারকারীদের খবর দেওয়া হয়েছে, তারা কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে, কিন্তু যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান তখন এই উদ্ধারকারী দলের এখানে পৌঁছে কিছু করার থাকবে না। তারা এসে হয়তো তিষার মৃতদেহটা শুধু উদ্ধার করবে।
ঠিক এরকম সময়ে মানুষজনের চিৎকার শোনা গেল, বরফের ফাটলের এক জায়গায় লাল পার্কার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে তার পাশে কিছু একটা নড়ছে, নিশ্চয়ই টুইটি। বেশ কয়েকজন মানুষ ছুটে যায়, তারা তিষার হিমশীতল শরীরটি টেনে তোলে। ক্লান্ত শ্রান্ত টুইটি বরফের ফাটলে পা রেখে ওঠার চেষ্টা করে, উঠতে পারে না। একজন তাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু তার হাত পিছলে টুইটি আবার পানিতে পড়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে টুইটিকে দেখা যায় না, একটু পর সে আবার ভেসে উঠে, আবার সে ওঠার চেষ্টা করে। উঠতে পারে না, একজন তাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল, পারল না, টুইটি আবার তলিয়ে গেল, আর তাকে দেখা গেল না।
তিষা বেঁচে আছে না নেই কেউ সেটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করল না, তাকে নিয়ে ছুটে যেতে থাকে, ততক্ষণে একটা এম্বুলেন্স চলে এসেছে। এম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে শুইয়ে দিতেই এম্বুলেন্সটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে যেতে থাকে।
আম্মু আব্বুর বুকের কাপড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “আমার তিষা এনিম্যান বেঁচে যাবে? বেঁচে যাবে?”
আব্বু কিছু বললেন না। এতো দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকলে কেউ বেঁচে থাকে না কথাটি কেমন করে বলবেন? যদি বেঁচে থাকে সেই বেঁচে থাকার অর্থ কী? মস্তিষ্কে অক্সিজেন না গেলে সেই মস্তিষ্কের যে ক্ষতি হয় সেই ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক নিয়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষের জীবন কতো ভয়ংকর সেটি কী কেউ কল্পনা করতে পারবে?
০৫. লিডিয়া জিজ্ঞেস করল
লিডিয়া জিজ্ঞেস করল, “বিল, আমি কী শুরু করব?”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “হ্যাঁ শুরু কর।” যখনই কারো সাথে তার পরিচয় হয় সে তাকে তার নাম ধরে ডাকার অনুমতি দেয়। এই মেয়েটির আগে কেউ তাকে নাম ধরে ডাকার সাহস পায়নি।
লিডিয়া বলল, “আমরা প্রায় এক ডজন এনিম্যান প্রটোটাইপ তৈরি করেছি। আমাদের ল্যাবরেটেরিতে সেগুলো বড় হচ্ছে। তুমি চাইলে আমি একটি দুটি নিয়ে আসতে পারতাম কিন্ত আমার মনে হয় এই ছবি ভিডিও আর ত্রিমাত্রিক প্রেজেন্টেশান থেকে তুমি একটা ধারণা পেয়ে যাবে।
“তোমার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, টাকা পয়সা নিয়ে আমার কখনো চিন্তা করতে হয়নি তাই গবেষণার কোথাও আমাকে বিন্দুমাত্র সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমার মনে হয় টাকা পয়সার থেকেও বড় সহযোগিতা ছিল আইনী সহযোগিতা। এই গবেষণায় অনেক কিছুই ছিল যেটি দেশের প্রচলিত আইনে বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি নির্দ্বিধায় সেগুলো করে গেছি কারণ আমি জানি তুমি আমাকে সেই জায়গাগুলো থেকে রক্ষা করবে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মহিলাদের গর্ভে আমরা নানা ধরনের মডেল পরীক্ষা করেছি। এক দুইবার স্থানীয় কোনো সাংবাদিক তার আঁচ পেয়ে যে প্রতিবাদের চেষ্টা করেনি তা নয় কিন্তু তোমার সহযোগিতার কারণে কখনোই সেটা সমস্যা হতে পারেনি। সমস্যাটা শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদেরই হয়েছে।
“লিডিয়া তখন স্ক্রীনে একটি মানবশিশুর ছবি দেখিয়ে বলল, এটি হচ্ছে আমাদের এনিম্যানের মডেল। তুমি দেখতেই পাচ্ছ এটি যে মানব শিশু তাতে কোনো ভুল নেই কিন্তু একই সাথে সাধারণ মানুষকে যদি বলা হয় এটি আসলে মানব শিশু নয় এটি একধরণের পশু সেটাও সবাই মেনে নেবে! তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছ শিশুটির চোখ সাধারণ মানুষের চোখ থেকে বড়, চোখের রং আমরা ডিজাইন করতে পারি। চাপা নাক সে কারণে যখন এটি পূর্ণ বয়স্ক হবে তখনও তাকে দেখে শিশুর মতো মনে হবে। কানগুলো একটু লম্বা করা হয়েছে, উপরের ভাগ সূঁচালো মানুষ থেকে ভিন্ন। মুখ দাঁত জিবে আমরা কোনো পরিবর্তন করিনি, তাহলে মানুষের কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে না।
“যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে তার গায়ের লোম। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা তার সারা শরীর লোম দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। তার কয়েকটা কারণ, শরীরে কুকুর বা বেড়ালের মত লম্বা লোম থাকলে এটাকে মানুষ না ভেবে পশু হিসেবে কল্পনা করা সহজ। দ্বিতীয়ত শরীরে এক ধরনের নিরাপত্তা থাকে, মানুষের যেরকম কাপড় পরে থাকতে হয়, এদের তার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া শরীরের লোমের নানা ধরণের রং দিয়ে বৈচিত্র আনতে পারব।
“যদিও এরা মানুষ কিন্তু আমরা এটাকে সাধারণত মানুষের মতো দুই পায়ে দাঁড়াতে দিই না। হাতগুলো তুলনামূলকভাবে লম্বা করে ডিজাইন করা হয়েছে যেন চার হাত পায়ে যখন হেঁটে বেড়াবে তখন বিসদৃশ্য মনে না হয়। ইচ্ছে করলে কোনো কিছু ধরে এই এনিম্যান দুই পায়ে দাঁড়াতে পারবে, কিন্তু সেটি আমরা ক্রেতাদের ইচ্ছের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।”
লিডিয়া দ্রুত কয়েকটা ছবি এবং ভিডিও দেখিয়ে বলল, “এখন আমি এনিম্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুতে আসি। এদের ব্যবহার এবং আচার আচরণ। এর বুদ্ধিমত্তা হবে পাঁচ বছরের শিশুর মতো। এর কোনো ভাষা নেই, মুখে কথা বলতে পারবে না। চেষ্টা করলে বড় জোর এক বছরের শিশুর মতো দুর্বোধ্য শব্দ করতে পারবে। এর চেহারায় সব সময়েই হাসিখুশি এবং আনন্দের ভাব থাকবে। এর মুখের দিকে তাকালেই মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে।
“পৃথিবীর সকল প্রাণীরই ভয় আতংক এমন কী কোনো কোনো প্রাণীর মাঝে দুঃখের অনুভূতি থাকে, কাজেই এনিম্যানের ভেতর থেকে এই অনুভূতিগুলো কোনোভাবেই পুরোপুরি সরানো সম্ভব হয়নি। তার ভেতরেও আনন্দের পাশাপাশি দুঃখ কষ্টের অনুভূতি আছে। কিন্তু তার মুখে কখনো তার প্রতিফলন ঘটবে না। এটি সবসময়েই হাসি হাসি মুখ করে থাকবে। এটি হাসবে।”
ঠিক এই সময়ে উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী হাত তুলে লিডিয়াকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি ইচ্ছে করে এটাকে যন্ত্রণা দিই, ধরা যাক একটা লোহার শিক গরম করে ছ্যাকা দিই তাহলে কী করবে?”
লিডিয়া মুখে হাসি টেনে বলল, “তাহলেও এটা খিলখিল করে হাসবে। তার সমস্ত অনুভূতির মাত্র একধরণের প্রতিফলন, সেটি হচ্ছে হাসি! সাধারণ মানুষ কখনোই তার চেহারায় অন্য কোনো অনুভূতি খুঁজে পাবে না। যারা এটাকে পোষা প্রাণী হিসেবে পালবে তারা কখনোই এই প্রাণীটাকে কষ্ট দিচ্ছে তার অনুভূতি পাবে না। তাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললেও সবাই ভাববে প্রাণীটার বুঝি অনেক সুখ, অনেক আনন্দ।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জর মুখে হাসি ফুঠে উঠল, বলল, “অসাধারণ!”
“তুমি ঠিকই বলেছ বিল, এটি অসাধারণ। গবেষণার এই অংশটুকু ছিল সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু আমরা সেটা করতে পেরেছি, আমরা সঠিকভাবে জিনেটিক কোডিং করতে পেরেছি। এটা করার জন্যে তার নার্ভাস সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে, তার ব্যথার অনুভূতি তুলনামূলকভাবে কম।
“এর জন্মপদ্ধতি মোটামুটি জটিল, তবে যারা এটা কিনবে তাদের সেটা জানার প্রয়োজন নেই। আমরা একেবারে নবজাতক শিশু কখনোই ক্রেতাদের দেব না। এটাকে একটু বড় করিয়ে, একটু ট্রেনিং দিয়ে তারপর সাপ্লাই দেব। মানুষ যখন একটা কুকুর কিনে আনে তখন প্রথম প্রথম তাকে নানারকম ট্রেনিং দিতে হয়, এনিম্যানের বেলায় তার কোনো প্রয়োজন হবে না।
“এনিম্যানের আয়ু সর্বোচ্চ দশ বছর। তবে এর চেহারায় কখনো বার্ধক্যের ছাপ পড়বে না। এটি অসুস্থ হয়ে ধুকে ধুকে মারা যাবে না। মৃত্যুটি সবসময়েই হবে স্বাভাবিক। এর আকার হবে ছোট কুকুরের মতো, মানুষ ইচ্ছে করলেই তাকে কোলে নিতে পারবে। আদর করতে পারবে। এর কোনো জেন্ডার নেই এটি ছেলেও না মেয়েও না। যেহেতু আমরা এই প্রজাতিকে জন্ম দিতে যাব না তাই এর ছেলে মেয়ে নেই। এটি একই ধরণের, নিউট্রাল।”
লিডিয়া তখন ত্রিমাত্রিক প্রেজেন্টেশান শুরু করে বলল, “তুমি ইচ্ছে করলে এই প্রাণীটিকে আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারবে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “তার প্রয়োজন হবে না। তোমাকে অভিনন্দন লিডিয়া একটি অসাধারণ আবিষ্কারের জন্যে।”
“তোমাকেও ধন্যবাদ, আমাকে অসাধারণ সহযোগিতা করার জন্য।”
“এখন তোমার পরিকল্পনা কী?”
“আমার সকল দায়িত্ব শেষ। এখন পুরো দায়িত্ব মার্কেটিংয়ের। তুমি কংগ্রেস থেকে এটাকে পাশ করিয়ে দাও, আমরা প্রোডাকশান শুরু করে দেব।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জীর মুখে ধীরে ধীরে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, “তুমি ধরে নাও এটা কংগ্রেস থেকে পাশ হয়ে গেছে। একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে পৃথিবীর মানুষকে এনিম্যান সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রস্তুত হও!”
লিডিয়া বলল, “আমি প্রস্তুত।”
০৬. তিষার আম্মু কেবিন থেকে বের হয়ে
তিষার আম্মু কেবিন থেকে বের হয়ে ক্লান্ত পায়ে হাসপাতালের করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে ওয়াটিং রুমের দিকে যেতে থাকেন। একটু পর বাইরে আলো হয়ে সূর্য উঠবে, কিন্তু তার ভেতরটুকু আর কখনোই আলোতে ঝলমল করে উঠবে না। প্রতি রাত তিনি তিষার পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গভীর কোমায় ঘুমন্ত তিষা কখন চোখ খুলে তার দিকে তাকাবে তিনি সেই আশায় গত তিন মাস বসে আছেন কিন্তু তিষা চোখ খুলে তাকায়নি। সম্ভবত কখনোই চোখ খুলে তাকাবে না, এইভাবে একটা বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে।
ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে তিষার আম্মু ভেতরে ঢুকলেন। বড় একটা সোফায় একজন মহিলা কাত হয়ে বসে আছে। তার ছেলেটি গতকাল গাড়ী। একসিডেন্টে আহত হয়ে এখানে এসেছে। একটা ছোট শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেকজন কমবয়সী মা পিঠ সোজা করে বসে আছে। তার স্বামী সম্ভবত আজ মারা যাবে।
আম্মু ঘরের এক কোনায় সোফায় বসলেন। দুই হাতের উপর মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করলেন। কতো অল্প ঘুম, কতো অল্প খাওয়া দিয়ে একজন মানুষ কতো দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারে সেটা তিনি গত তিনমাস ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছেন।
.
আই সি ইউয়ের এগারো নম্বর কেবিনে খুব ধীরে ধীরে তিষা চোখ খুলে তাকাল, “আমি এখন কোথায়?” এই ধরনের একটা ভাবনা তার মাথায় একবার উঁকি দিয়ে যায়। “আমার ঘরে আমার পায়ের দিকে বইয়ের শেলফ, এখানে শেলফ নেই, তাহলে কী আমি অন্য কোথাও?” তিষা আবার চোখ বন্ধ করল, “রাত্রি বেলা আমি লাইট নিভিয়ে ঘুমাই। এখানে আলো জ্বলছে। মাথার কাছে একটা টেলিভিশন! আমার ঘরে টেলিভিশন কেন? আমি এখন কোথায়?” তিষা আবার চোখ খুলে তাকাল, সে একটু নড়ার চেষ্টা করতেই শরীরে এক ধরনের আড়ষ্ট অনুভূতি কাজ করে, কোথায় জানি টান পড়ে আর সাথে সাথে দূরে কোথায় জানি এক ধরণের এলার্ম বেজে ওঠে। তিষা একটু অবাক হল, “এলার্ম কেন বাজে?”
প্রায় সাথে সাথে একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল, মহিলাটির মাথায় নার্সদের মত ক্যাপ, তিষার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মহিলটি বলল, “হানি, তুমি কী জেগেছ?”
তিষা মহিলাটির মুখের দিকে তাকায়, তাদের স্কুলের নার্স মিসেস স্মিথের মতো চেহারা কিন্তু সে মিসেস স্মিথ নয়। তিষা জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”
“তুমি খুব ভালো জায়গায় আছ, হানি।”
“আমার কী কিছু হয়েছে?”
“তোমার অনেক কিছু হয়েছিল।”
“এখন?”
“হানি, এখন তুমি আমাদের সবার সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছ।”
তিষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে একটি দুটি কথা বলতেই তার উপর বিচিত্র এক ধরনের ক্লান্তি এসে ভর করছে। সে এতো দুর্বল কেন? সে ফিসফিস করে বলল, “আমার আব্বু আর আম্মু কই?”
“তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর আমি তোমার আম্মুকে ডেকে আনি। তুমি আবার ঘুমিয়ে যেয়ো না যেন!”
তিষা বলল, “না। আমি ঘুমাব না।”
ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে নার্স ভিতরে উঁকি দেয়। কোনার একটা সোফায় দুই হাতের ওপর মাথা রেখে তিষার আম্মু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। ঘুমিয়ে আছেন না জেগে আছেন বোঝা যায় না। নার্স কাছে গিয়ে নিচু গলায় ডাকল, “মিসেস আহমেদ।”
সাথে সাথে আম্মু চোখ খুলে তাকালেন। নার্স তার ঘাড়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “তোমার মেয়ে জেগে উঠে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
আম্মুর মুখ দেখে মনে হল আম্মু বুঝি কথাটা বুঝতে পারেন নি, কিন্তু তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে আম্মু উঠে দাঁড়ালেন, হঠাৎ করে তাঁকে দেখে মনে হল তার শরীরে বুঝি কোনো শক্তি নেই। নার্সের হাত ধরে আম্মু যখন ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন তখন শিশুকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকা মহিলাটি বলল, “এই যে, তুমি শুনো।”
আম্মু ঘুরে তার দিকে তাকালেন, মহিলাটি তার ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এভাবে তোমার মেয়ের কাছে যেতে পারবে না। তিন মাস কোমায় থেকে জেগে উঠে তোমাকে এভাবে দেখলে তোমার মেয়ে আবার কোমায় চলে যাবে।”
আম্মু অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকালেন, মহিলাটি বলল, “তোমাকে দেখে বোঝা যায় তুমি তিন মাস আয়নার সামনে যাও নাই। তুমি একজন সুন্দরী মহিলা, তোমার চেহারার কী অবস্থা করেছ তুমি জান না! দাঁড়াও, তুমি চুল আঁচড়াও, ঠোঁটে লিপস্টিক দাও। তোমার দরকার ডার্ক শ্যাডো–আমারটা দিয়ে কাজ চলে যাবে! নাও লিপস্টিক দাও, তোমার ভয় নাই, আমার কোনো সংক্রামক রোগ নাই।”
মহিলাটি আম্মুর চুল খুলে আঁচড়ে দিল, ঠোঁটে লিপস্টিক দিল, গালে পাউডার দিল তারপর বুকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
.
তিষা তার আম্মুকে দেখে বলল, “আম্মু তোমার কী হয়েছে? তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?”
আম্মু বললেন, “আমার কিছু হয়নি মা। আমি খুব ভালো আছি। সারা পৃথিবীতে আমার থেকে ভালো কেউ নেই।”
“আমার কী হয়েছে আম্মু? আমি হাসপাতালে কেন?” “সেটা অনেক বড় একটা কাহিনী মা। তোকে বলব।”
“আজকে কী বার আম্মু? বৃহস্পতিবার আমার মায়া সভ্যতার উপর একটা রিপোর্ট জমা দেবার কথা ছিল।”
আম্মু হেসে ফেললেন, বললেন “তুই রিপোর্ট লেখার অনেক সময় পাবি মা। আজকে কী বার সেটা তো আমিও জানি না!”
.
সন্ধেবেলা তিষা তার ঘরে টেলিভিশনে স্থানীয় খবরে নিজেকে দেখতে পেল। স্থানীয় সংবাদদাতা বলল, “গত ২৪ জানুয়ারী সাসকুয়ান হদে বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে টিশা আমেদ (আমেরিকান সংবাদদাতা তিষা আহমেদ নামটা এর চাইতে ভালো করে উচ্চারণ করতে পারে না!) নামে কাউন্টি জুনিয়র স্কুলের ছাত্রী হিম শীতল পানিতে ডুবে যায়। বরফের নিচ থেকে তার পোষা কুকুর টুইটি টিশা আমেদের দেহ উদ্ধার করে আনে। ততক্ষণে তার দেহ হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালিত না হওয়ায় সে কোমাতে চলে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্ত আশংকাকে অমূলক প্রমাণ করে আজ সে জেগে উঠেছে। চিকিৎসকেরা অনুমান করছেন তার শরীর হাইপোথারমিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালিত না হওয়ার পরও তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
টিশা আমেদের জ্ঞান ফিরে আসার খবরে তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিপুল আনন্দোচ্ছাস দেখা যায়।”
।তিষা তখন তার স্কুলের ছেলে মেয়েদের দেখল। সবাই দুই হাত তুলে আনন্দে চিৎকার করছে। তিশা জনকেও দেখতে পেল। সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল “আমরা তোমাকে ভালোবাসি তিশা।”
খবর শেষ হবার পর তিশা আম্মুর হাত ধরে বলল, “টুইটি কেমন আছে আম্মু?”
আম্মু কোন উত্তর দিলেন না। তখন তিষার গলার স্বর কেঁপে গেল, “কেমন আছে টুইটি?”
আম্মা তিষার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, “নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে মা। যেখানে গেলে সবাই খুব ভালো থাকে তোক বাঁচিয়ে দিয়ে টুইটি সেখানে চলে গেছে।”
তিষা দুই হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে বসে রইল।
.
একজন মানুষ পুরো তিন মাস এক ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকলে তার শরীরের অনেক কিছুই সাময়িকভাবে অচল হয়ে যায়, হঠাৎ করে সেটাকে সচল করা যায় না। তাই তিষাকে চট করে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হল না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু আধটু বই পড়তে দিলেও বেশীর ভাগ সময় তাকে টেলিভিশন দেখে সময় কাটাতে হল। টেলিভিশনে সে পৃথিবীর অনেক খবর জানতে পারলেও যে খবরটি তাকে সবচেয়ে চমকৃত করল সেটি হচ্ছে পোষা প্রাণী হিসেবে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা নূতন একটা প্রাণী যার নাম এনিম্যান। সে যখন আচেতন হয়েছিল তখন এই ছোট প্রাণীটির আবিষ্কার নিয়ে প্রথম একটা সাংবাদিক সম্মেলন হয়। সারা পৃথিবীতেই এটা নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়েছিল, মানুষের বাচ্চাকে কুকুর বেড়ালের মতো পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করা যাবে না এই রকম একটা দাবী নিয়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হল, টেলিভিশনে আলোচনা হল, ইনটারনেটে তুমুল বাকবিতণ্ডা হল। যে কোম্পানী এটা তৈরি করেছে তারা দাবী করল এটা মোটেও মানুষের বাচ্চা নয়, এটা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরী করা একটা কৃত্রিম প্রাণী। এটি কেনো মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়নি, এটি তৈরী হয়েছে ল্যাবরেটরির বায়োসেলে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে তাতে সায় দিলেন। মনোবিজ্ঞানীরা প্রাণীটাকে নিয়ে গবেষণা করে বললেন এর বুদ্ধিমত্তা কুকুর বিড়াল জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সমান। তাই কেউ যদি কুকুর বিড়াল পোষা প্রাণী হিসেবে বেচাকেনা করতে পারে তাহলে এটা বেচাকেনা করতে দোষ কী?
শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে আলোচনা হল এবং দীর্ঘ শুনানীর পর এনিম্যান নামের প্রাণীটাকে বিক্রি করার অনুমতি দেয়া হল। এটি রাতারাতি অসম্ভব জনপ্রিয় একটা পোষা প্রাণী হয়ে গেল। আমেরিকার প্রত্যেকটা পরিবার এখন একটা এনিম্যান চায়।
তিষা অবশ্যি কারণটা বুঝতে পারে। এতো মিষ্টি চেহারার একটা প্রাণী, অনেকটা মানবশিশুর মতো আবার মানব শিশু নয়, বড় বড় মায়া কাড়া চোখ, শরীরে কোমল পশম, মুখের মাঝে একটা ছেলেমানুষী প্রায় দুষ্টুমীর হাসি–এই প্রাণীটাকে একজন ভালো না বেসে পারে কীভাবে?
যারা যারা এনিম্যানকে কিনে এনেছে তারা সবাই এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটি খুবই মিষ্টি স্বভাবের। এটি শান্ত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এর প্রয়োজন খুবই কম, বাথরুম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। প্রাণীটি খুবই হাসিখুশী, যার বাসায় একটি এনিম্যান আছে সেই বাসাটিতেই হতাশা বা দুঃখ রাতারাতি কমে গেছে।
সেই রাতে যখন তিষার আব্বু তিষাকে দেখতে এলেন তিষা বলল, “আব্বু আমাকে একটা এনিম্যান কিনে দেবে?”
আব্বু তিষাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “শুধু এনিম্যান কেন, তুই চাইলে তোকে আমি রয়াল বেঙ্গল টাইগার কিনে দেব।”
তিষা হি হি করে হেসে বলল, “না আব্বু, আমার রয়েল বেঙ্গল টাইগার দরকার নেই। একটা এনিম্যান হলেই হবে।”
আব্বু বললেন, “এনিম্যানের তো এখন খুব ডিমান্ড তাই চাইলেই পাওয়া যায় না, বুকিং দিতে হয়। বুকিং দেওয়ার পর কম পক্ষে ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। আমি আজকেই বুকিং দিয়ে দেব, ছয় সপ্তাহের মাঝে চলে আসবে।”
আম্মু বললেন, “তুই যখন প্রথম কুকুর পুষতে চেয়েছিলি তখন আমি কতো আপত্তি করেছিলাম মনে আছে?”
তিষা মাথা নাড়ল, “মনে আছে।”
“ভাগ্যিস তোকে পুষতে দিয়েছিলাম, সেজন্যে তুই বেঁচে আছিস।”
তিষা নিচু গলায় বলল, “আমি টুইটির কথা ভুলতে পারি না আম্মু!”
আম্মু বললেন, “আমরাও পারি না।”
আব্বু বললেন, “যখন এনিম্যান চলে আসবে তখন হয়তো একটু ভুলে থাকতে পারবি।”
তিষা বলল, “কিন্তু সে জন্য তো ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।”
আম্মু বললেন, “দেখতে দেখতে ছয় সপ্তাহ কেটে যাবে।”
.
তিষার অবশ্য ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হল না তার আগেই একটা এনিম্যান পেয়ে গেল।
জ্ঞান ফিরে পাবার তিন সপ্তাহ পর তিষাকে তার বাসায় যাবার অনুমতি দেয়া হল। যদিও সে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে কারো সাহায্য না নিয়েই হাঁটতে পারছে তারপরও তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হল একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে। ঠিক যখন তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হচ্ছে তখন তার স্কুলের বেশ কয়জন ছেলে মেয়ে এসে হাজির। বাসায় যাবার আগে তাকে তাদের স্কুল হয়ে যেতে হবে, সেখানে সবাই মিলে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে বিশাল একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রেখেছে।
স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে তিষার আব্বু আম্মু দেখলেন সত্যিই বিশাল আয়োজন। স্কুলের ঢোকার রাস্তায় বেলুন দিয়ে একটা গেট তৈরী করা। হয়েছে। গেটের ওপর বিশাল ব্যানার সেখানে হাস্যোজ্জল তিষার ছবি, বড় বড় করে লেখা, তিষার জন্য ভালোবাসা।
তিষাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে কে তাকে ঠেলে নেবে সেটা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে একটা ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যাকে সে সুযোগটা দেয়া হল তার নাম জন। ছেলেটি কানে শুনতে পায় না এবং সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলে, আলু আর আম্মু আগেই তিষার মুখে বেশ কয়েকবার জনের কথা শুনেছিল, তিষার ভাষায় জন হচ্ছে কম্পিউটারের জিনিয়াস। তিষাকে স্কুলের করিডোরে আনা মাত্রই ড্রামের শব্দ হতে থাকে। ড্রামের সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের চিৎকার শোনা যায়। তিষাকে হুইল চেয়ারে করে স্কুলের অডিটরিয়ামে নেয়া হয়। স্টেজে কয়েকটা চেয়ার রাখা হয়েছে সেখানে এখনো কেউ বসে নেই। অডিটরিয়ামে সব ছেলে মেয়েরা বসে চেঁচামেচি করছে। হুইল চেয়ার ঠেলে যখন তিষাকে স্টেজে তোলা হল। তখন ছেলে মেয়েদের চেঁচামেচিতে অডিটরিয়ামের ছাদ ধ্বসে পড়ার মতো অবস্থা হল।
স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস সাস্টিক আর তিষার ক্লাশ টিচার মিসেস রামজি স্টেজে উঠলেন, হাত নেড়ে বাচ্চাদের থামানোর চেষ্টা করলেন। বাচ্চারা চিৎকার করতেই থাকল, মিসেস সাস্টিক তখন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, “বাচ্চারা তোমরা শান্ত হও! টিশা এই মাত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে, তোমরা চিৎকার করে তাকে আবার অসুস্থ করে দিও
বাচ্চারা তখন একটু শান্ত হল, মিসেস সাস্টিক তখন বললেন, “তোমরা সবাই জান আমাদের টিশা সাসকুয়ান লেকে বরফের ফাটলে পড়ে গিয়েছিল। লেকের উপর সেই ফাটল কেন তৈরী হয়েছিল সেটি এখনো একটি রহস্য। জিওলজিস্টরা বের করার চেষ্টা করছেন, অনুমান করা হয় একটা ভূকম্পনের কারণে এটা ঘটেছিল। যাই হোক সেই হিমশীতল পানিতে টিশা ডুবে গিয়েছিল, মানুষ নিঃশ্বাস না নিয়ে এক দুই মিনিটের বেশী বেঁচে থাকতে পারে না, টিশা সেই পানিতে প্রায় সাতাইশ মিনিট ডুবেছিল, তার বেঁচে থাকার কোনো কথা ছিল না কিন্তু তোমরা সবাই দেখছ টিশা শুধু যে বেঁচে আছে তা নয় সে আমাদের সামনে বসে আছে।”
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মিসেস সাস্টিক বললেন, “এই দীর্ঘ সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ না হলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু আমরা সবাই জানি, হাসপাতালের ডাক্তারদের টিম রিপোর্ট দিয়েছেন টিশার মস্তিষ্ক পুরোপুরি ঠিক আছে।”
বাচ্চারা আবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মোটাসোটা একটা ছেলে চিৎকার করে বলল, “আমরা টিশার বেন ফাংশান টেস্ট করতে চাই। টিশা বল পাঁচ আর পাঁচে কত হয়?”
টিশা হাসল, বলল, “দুইশ বারো!”
সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে! মিসেস সাস্টিকও হাসলেন, হেসে বললেন, “আমরা এই মাত্র টিশার মস্তিষ্ক টেস্ট করলাম, তোমরা সবাই দেখেছ সেটা শুধু যে ঠিক আছে তা নয় এটা এখন ওভার ড্রাইভ মোডে কাজ করছে। যাই হোক, আমরা আজকে টিশাকে কিছুক্ষণের জন্যে আমাদের স্কুলে এনেছি কারণ আমরা সবাই তাকে বলতে চাই, আমরা তোমাকে ভালোবাসি টিশা!”
সবাই চিৎকার করে বলল, “আমরা তোমাকে ভালোবাসি, টিশা।”
দর্শকের সারিতে বসে থাকা তিষার আম্মু শাড়ীর আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছলেন।
এবারে তিষার ক্লাশ টিচার মিসেস রামজী হাতে মাইক্রোফোন নিলেন, মোটাসোটা হাসিখুশী মহিলা, চশমা ঠিক করে বললেন, “আমরা টিশাকে এখানে এনেছি, তার দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণটা সবাই জান। সে হচ্ছে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মেয়ে। এরকম নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা মানুষ সারা পৃথিবীতে বলতে গেলে নেই। তাই আমরা টিশাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের স্কুল থেকে একবার ঘুরিয়ে নিতে চাই, যেন আমাদের স্কুলে টিশার সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটা ছড়িয়ে পড়ে এবং তোমাদেরও সেই সৌভাগ্য স্পর্শ করে আর তোমারাও লেখাপড়া না করেই ভালো গ্রেড পাও!”
সবাই মিসেস রামজির কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে। মিসেস রামজি হাসির শব্দ থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তারপর গলার স্বর পরিবর্তন করে বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জান টিশার একটা পোষা কুকুর ছিল, সেই কুকুরটি নিজের জীবন দিয়ে টিশাকে বাঁচিয়েছে। আমরা সবাই সেই অসম্ভব ভালো পোষা কুকুরটাকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে স্মরণ করব। আমরা জানি টিশা নিশ্চয়ই সেই কুকুরটাকে অনেক ভালোবাসত এবং তার অভাবটা নিশ্চয়ই আর কখনো পূরণ হবে না।”
বাচ্চারা সারাক্ষণই আনন্দে চেঁচামেচি করছিল, তিষার পোষা কুকুরের প্রসঙ্গটি আসতেই সবার মন ভারী হয়ে যায়। তারা নিঃশব্দে মিসেস রামজির কথা শোনে। মিসেস রামজী নরম গলায় বললেন, “আমরা কখনো টিশার প্রিয় কুকুরটার অভাব পূরণ করতে পারব না। তারপরও সে যেন একটু হলেও তার দুঃখটা ভুলে থাকতে পারে সে জন্যে তাকে একটা পোষা প্রাণী উপহার দিতে চাই। এখানে টিশার বাবা মা আছেন, তারা যদি অনুমতি দেন। তাহলে আমরা টিশাকে একটা এনিম্যান দিতে চাই!”
সবাই এবার শুধু আনন্দে চিৎকার করে উঠল না, উত্তেজনায় নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল! তিষার আব্বু আম্মু মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন তখন স্টেজের পাশ থেকে একটা বড় বাক্স আনা হল। সেটি সুন্দর রিবন দিয়ে বাঁধা। তিষা হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রিবনের এক মাথা ধরে টান দিতেই বাক্সটা খুলে যায় এবং সবাই অবাক হয়ে দেখে বাক্সের মাঝামাঝি ছোট একটা এনিম্যান গুটি গুটি মেরে বসে আছে। সেটি সাবধানে তার দুই পা আর দুই হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল, তারপর তার বড় বড় চোখে চারদিকে তাকাল। তিষা হাত বাড়িয়ে দিতেই এনিম্যানটি তার নিজের দুই হাত বাড়িয়ে তিষাকে ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তিষা সাবধানে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতেই সেটি তার ফোকলা দাঁত বের করে ফিক করে হেসে দিল
তিষা এনিম্যানটি কোলে নিয়ে আবার তার হুইল চেয়ারে বসে পড়ে।
মিসেস রামজি তিষাকে বললেন, “টিশা তুমি কী কিছু বলতে চাও?”
তিষা মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিছু বলার চেষ্টা করলেই কেঁদে ফেলব।”
“একটু না হয় কেঁদেই ফেল।”
তিষা মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। তার কাঁদার কারণটা তবু বোঝা যায় কিন্তু ছটফট দুরন্ত বাচ্চাদের অনেকেই কেন তার সাথে সাথে কেঁদে ফেলল তার কারণটা ঠিক বোঝা গেল না!
০৭. লিডিয়া টেবিলে পা তুলে
লিডিয়া টেবিলে পা তুলে দিয়ে তার অফিসের বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। রাস্তা থেকে ডাউনটাউনকে খুব ব্যস্ত একটা শহর মনে হয়, তেতাল্লিশ তালা থেকে সেই ব্যস্ততাটুকু বোঝা যায় না। মনে হয় নিচে বুঝি এক ধরণের শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ। লিডিয়া রাস্তার একটি মোড় থেকে একটা বড় দোতলা বাসকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করছিল ঠিক তখন ঘরের মাঝে পায়ের শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। রিকার্ডো দরজা খুলে অফিসে ঢুকেছে, লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, “কেমন আছ। লিডিয়া?”
“ভাল।”
রিকার্ডো একটা চেয়ারে বসে চারদিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এতো বড় মাল্টি বিলিওন ডলার প্রজেক্টের ম্যানেজার সেই হিসেবে তোমার অফিসটা একেবারে ফাঁকা। এখানে কিছু নেই, দেয়ালে অন্ততপক্ষে একটা এন্ড্রু ওয়াইথ বা জন স্টুয়ার্ট থাকা উচিৎ ছিল”
“আমি পেইনটিং দুই চোখে দেখতে পারি না।”
“তোমার অফিসে কাগজপত্র, ফাইল, কম্পিউটার কিছু নেই!”
“না। কখনো থাকে না। আমার সবকিছু মাথার মাঝে থাকে।”
রিকার্ডো মুখে জোর করে একটা হাসি ধরে রেখে বলল, “বছর তিনেক আগে তোমাকে যখন আমি রিক্রুট করেছিলাম তখন আমি চিন্তাও করিনি এতো দ্রুত তুমি এই কোম্পানীর এতো বড় একটা এসেট হয়ে উঠবে।”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না। রিকার্ডো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি যখন এনিম্যানের ওপর প্রজেক্টটা দিয়েছিলে তখন আমি ভেবেছিলাম এটা স্রেফ পাগলামো। বস কিন্তু ঠিকই এর গুরুত্ব ধরতে পেরেছিলেন। এখন সারা পৃথিবী এনিম্যান নিয়ে পাগল।”
লিডিয়া এবারেও কোনো কথা বলল না। রিকার্ডো অন্যমনষ্কভাবে আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিতে দিতে বলল, “বুঝেছ লিডিয়া আমি যখন চিন্তা করি যে আমি তোমাকে রিক্রুট করেছিলাম তখন আমার এক ধরণের অহংকার হয়। বলতে পার তুমি হচ্ছ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান।”
লিডিয়া বলল, “তুমি আমার কাছে কেন এসেছ বল।”
“আমি এনিম্যানের পরের প্রডাকশান নিয়ে কথা বলতে এসেছি। তুমি তো জান আমাদের প্রথম প্রডাকশন”
লিডিয়া হাত তুলে তাকে থামাল। বলল, “দাঁড়াও।”
রিকার্ডো কথা থামিয়ে লিডিয়ার দিকে তাকাল। লিডিয়া বলল, “আমি যখন প্রথমবার বসের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখন তুমি আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলে, মনে আছে?”
রিকার্ডো একটু অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ। কেন?”
“তুমি বলেছিলে বস অনুমতি না দিলে বসবে না, নাম ধরে ডাকার অনুমতি দিলেও নাম ধরে ডাকবে না, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকাবে না, কিছু খেতে দিলে জোর করে হলেও খাবে। মনে আছে?”
“হ্যাঁ মনে আছে।”
“তুমি কেন সেই উপদেশ দিয়েছিলে বলতে পারবে?”
“তার কারণ তুমি তখন ছিলে একেবারে নূতন একজন গবেষক আর বস কতো ওপরে!”
“এখন?”
“এখন তুমিও অনেক উপরে উঠেছ। অনেক উপরে—”
“আর তুমি?”
“আমি?” রিকার্ডো কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
লিডিয়া বলল, “আর তুমি এখনও অনেক নিচে আছ। অনেক নিচে যারা থাকে তাদের অনেক উপরে যারা থাকে তাদের সাথে যেরকম ব্যবহার করার কথা, আমি চাই তুমি সেভাবে আমার সাথে ব্যবহার কর।”
রিকার্ডো বিস্ফারিত চোখে বলল, “কী বলছ তুমি লিডিয়া?”
“যদি নিয়মটা পছন্দ না হয় তুমি এপসিলন ছেড়ে চলে যেতে পার। যারা এপসিলন ছেড়ে চলে গেছে তাদের ছবি করিডোরের শেষে টানানো আছে। তোমারটাও টানিয়ে দেব।”
রিকার্ডোর মুখ কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে ওঠে। লিডিয়া বলল, “যাও। তুমি আবার শুরু কর। অফিসের বাইরে যাও। ঢোকার আগে দরজায় শব্দ করে অনুমতি নিও।”
“লিডিয়া–”
“শুধুমাত্র আমি অনুমতি দিলে–”
রিকার্ডো উঠে দাঁড়াল। সে কিছুক্ষণ লিডিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। খুব ধীরে ধীরে তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। হাসিটা মুখে ধরে রেখে সে অফিস থেকে বের হয়ে যায়।
প্রায় সাথে সাথেই দরজায় শব্দ করে রিকার্ডো তারপর মাথাটা ঢুকিয়ে বলল, “আসতে পারি?”
লিডিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, মাথা ঘুরিয়ে রিকার্ডোর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “এসো।”
রিকার্ডো অফিসের ভেতরে ঢুকে লিডিয়ার টেবিলের সামনে দাঁড়াল, লিডিয়া তার মুখের দিকে তাকাল কিন্তু রিকার্ডো লিডিয়ার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। লিডিয়া তার ড্রয়ার খুলে একটা ললিপপ বের করে, তার ওপরের প্লাস্টিকটা সময় নিয়ে খুলে ফেলে তারপর ছোট বাচ্চাদের মত সেটা চেটে চেটে খেতে শুরু করে। রিকার্ডো কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
লিডিয়া বলল, “তুমি কিছু বলবে?”
“জী ম্যাডাম।”
“বল।”
“এনিম্যানের প্রথম শিপমেন্ট শেষ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় শিপমেন্ট পথে আছে। তৃতীয় শিপমেন্ট তৈরী হচ্ছে। আমরা যেরকম অনুমান করেছিলাম এনিম্যানের চাহিদা তার থেকে অনেক বেশী।”
“আমি জানি।”
রিকার্ডো বলল, “জী ম্যাডাম। আপনি সেটা অনেকবার বলেছেন। আমাদের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট খুব সতর্কভাবে পরিকল্পনা করায় আমরা এই ক্রাইসিসে পড়েছি।”
লিডিয়া তার ললিপপটা আরেকবার চেটে বলল, “এটা মোটেও ক্রাইসিস না। আমাদের হাতে যদি এক শিপমেন্ট এনিম্যান থাকত যেটা মার্কেটিং করা যাচ্ছে না সেটা হতো ক্রাইসিস।”
রিকার্ডো বলল, “জি ম্যাডাম।”
“এখন মার্কেটিং ডিপাটমেন্ট প্রডাকশান কতো বাড়াতে চাচ্ছে?”
“কম পক্ষে দশ গুণ। এনিম্যানের দামও বাড়িয়ে দেবে।”
“চমৎকার।”
“কিন্তু–“
“কিন্তু কী?”
রিকার্ডো বলল, “কীভাবে প্রোডাকশন এতো বাড়াব আমি বুঝতে পারছি না।”
লিডিয়ার মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল, সে হিংস্র গলায় বলল, “রিকার্ডো, তোমার সম্ভবত বয়স হয়ে গেছে। তোমার মস্তিষ্ক সম্ভবত আগের মতো ধারালো নেই। তুমি খুব সহজ বিষয় বুঝতে পার না।”
রিকার্ডো ফ্যাকাসে মুখে বলল, “আমি দুঃখিত।”
লিডিয়া মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে বলল, “আমরা কীভাবে এনিম্যান প্রডাকশান করি রিকার্ডো?”
“ক্লোন করে।”
“গুড। এই প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় ফান্ড ব্যয় করা হয়েছে এই অসাধারণ ক্লোনটি তৈরি করতে। এনিম্যান ক্লোন করার জন্যে আমাদের কোল্ড স্টোরেজে তিন মিলিওন জাইগট জমা করে রাখা আছে। যখন খুশী আমরা এই জাইগট থেকে এনিম্যান তৈরি করি।”
“জী ম্যাডাম।”
“কীভাবে তৈরি করি?”
“সেটি গোপনীয় ম্যাডাম। আমরা মিডিয়াকে একভাবে জানিয়েছি। তাদেরকে বলেছি আমাদের বিশাল জাইগট ফার্ম আছে সেখানে হাজার হাজার বায়োসেল, সেই বায়োসেলে জাইগট বড় হচ্ছে। এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। মায়ের গর্ভ ব্যবহার না করে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্ম দেওয়া।
“আর আসলে আমরা কী করি?”
“আফ্রিকা এশিয়ার গরীব দেশের মহিলাদের গর্ভটাকে এনিম্যান জন্ম দেয়ার জন্য ব্যবহার করি। আমাদের দেশের এন জিও সেই সব দেশে স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার নামে তাদের গর্ভে এনিম্যান জাইগট ইমপ্লান্ট করে। বড় হলে বের করে নেয়।”
“তাহলে প্রডাকশান বাড়াতে হলে কী করতে হবে?”
“এরকম মহিলার সংখ্যা বাড়াতে হবে।”
“চমৎকার। নূতন নূতন দেশ খুঁজে বের করতে হবে। দেশের সরকার যদি সহযোগিতা না করে সেই দেশে বিপ্লব করে সরকার ফেলে দিতে হবে।”
“জী ম্যাডাম।”
“তাছাড়া আমাদের গবেষণা চলছে।”
রিকার্ডো দ্বিধান্বিত গলায় বলল, “মায়ের গর্ভ ব্যবহার না করে সত্যিকারের বায়োসেল তৈরি করার গবেষণা?”
লিডিয়া শব্দ করে হেসে উঠল, সারা জীবনে সে এতো কম হেসেছে যে সে ঠিক করে হাসতে শিখেনি এবং তার হাসি দেখে রিকার্ডো এক ধরনের আতংক অনুভব করে। লিডিয়া হাসি থামিয়ে বলল, “তোমার কথা শুনে আমার খুব আশা ভঙ্গ হয়েছে রিকার্ডো। তুমি আমাকে খুব নিরাশ করেছ।”
“আমি খুব দুঃখিত ম্যাডাম।”
“তুমি আমাকে বল রিকার্ডো, একটা সত্যিকারের বায়োসেলের দাম বেশী নাকী এশিয়া কিংবা আফ্রিকার একটা গরীব দেশের একটা দরিদ্র মেয়ের জীবনের দাম বেশী।”
“অবশ্যি বায়োসেলের দাম বেশী।”
“এতো সস্তা দরিদ্র মহিলারা থাকতে আমরা কেন মূল্যবান বায়োসেল তৈরি করতে যাব?”
রিকার্ডো ইতস্তত করে বলল, “তাহলে গবেষণাটা কীসের উপর হচ্ছে ম্যাডাম?”
“গবেষণাটা হচ্ছে একটা মহিলার গর্ভে মাত্র একটা এনিম্যান জাইগট ইমপ্লান্ট না করে এক সাথে পাঁচটা ইমপ্লান্ট করা যায় কী না তার ওপর। মায়ের শরীরের ওপর চাপ পড়তে তার জীবনী শক্তি কমে যাবে কিন্তু সেটা হয়তো খারাপ না।”
রিকার্ডো মাথা নাড়ল, বলল, “জী ম্যাডাম। এই হতভাগ্য মহিলাদের কষ্টের জীবন যত কমানো যায় ততই মঙ্গল।”
লিডিয়া জিব বের করে তার হাতে ধরে রাখা ললিপপটা আরো একবার চেটে নিল তারপর বলল, “তিনটি পর্যন্ত জাইগট ইমপ্লান্ট করার গবেষণা শেষ হয়েছে। আমি পাঁচটি করার জন্য চাপ দিচ্ছি।”
“জী ম্যাডাম।”
“ঠিক আছে রিকার্ডো, তুমি তাহলে ফাইলগুলো আপলোড কর। আমি দেখি।”
“জী ম্যাডাম।”
লিডিয়া হঠাৎ সুর পাল্টে বলল, “রিকার্ডো, তুমি কী ললিপপ খেতে পছন্দ কর?”
“জী ম্যাডাম।”
লিডিয়া তার হাতের ললিপপটা রিকার্ডোর দিকে এগিয়ে দেয়, নাও। এটা তোমার জন্যে।”
রিকার্ডো হাত বাড়িয়ে ললিপপটা হাতে নেয়। লিডিয়া মুখে হাসি টেনে বলল, “খাও রিকার্ডো।”
রিকার্ডো লিডিয়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চেটে চেটে ললিপটা খেতে থাকে।
০৮. তিষা তার বিছানায় পা তুলে বসে
তিষা তার বিছানায় পা তুলে বসে এনিম্যানের ম্যানুয়েলটি দেখছে। স্কুল থেকে তাকে যে ছোট এনিম্যান শিশুটি দিয়েছে সেটি তার ঘরের মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাণীটি কৌতূহলী, যেটাই দেখছে সেটাই হাত দিয়ে স্পর্শ করছে, যদি হাতে নেয়া সম্ভব হয় তাহলে হাতে তুলছে, দেখছে আবার রেখে দিচ্ছে। কোনো কিছু একটু মসৃণ হলে সে হাত দিয়ে সেটা বারবার অনুভব করছে। ম্যানুয়েলে লেখা আছে এনিম্যানের স্মৃতি খুব দুর্বল। কোনো একটা কিছু দেখলে সেটা মনে রাখতে পারে না, কিন্তু তিষা বুঝতে পারল কথাটা পুরোপুরি সত্যি না, যে জিনিষটা সে একবার দেখেছে সেটি সে দ্বিতীয়বার তুলে দেখে না।
এনিম্যানটার কিছু বিচিত্র ব্যবহার আছে। এটি পিছনের দুই পা আর দুই হাতে ভর দিয়ে হাঁটে। ছেলে মেয়েরা যখন চারপায়ে হাঁটার ভঙ্গী করে তখন তারা দুই হাত আর হাঁটুতে ভর দেয়, এটি হাঁটু ব্যবহার করে না, পায়ের পাতা ব্যবহার করে। তিষা লক্ষ্য করেছে এনিম্যানটি ইচ্ছে করলে দুই পায়ে দাঁড়াতে পারে কিন্তু কখনোই দাঁড়ানোর চেষ্টা করে না। কেউ যদি আশে পাশে না থাকে তাহলে খুব সাবধানে দুই পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মত দাঁড়ায় কিন্তু খুব কম সময়ের জন্যে। কাউকে দেখলেই আবার হাত পায়ের উপর ভর দিয়ে ফেলে।
যে কারণে এনিম্যান নামের এই পোষা প্রাণীটি এতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেটি হচ্ছে তার মুখের হাসি। সবসময়েই এর হাসি মুখ, মাঝে মাঝে সত্যি সত্যি শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসিটি খুবই সুন্দর, এনিম্যানটি ছোট বাচ্চাদের মত খিল খিল করে হেসে ওঠে। এনিম্যানটি যখন হাসে তখন তাকে দেখে অন্যরাও না হেসে পারে না। ম্যানুয়েলটিতে এই হাসি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে অনেক গবেষণা করে এই
এনিম্যান প্রাণীটিকে খুব সুখী এবং আনন্দময় প্রাণীতে তৈরি করা হয়েছে। এই হাসিটি আন্তরিক কারণ এর মাঝে কোনো দুঃখ নেই। শুধু যে দুঃখ নেই তা নয় এর মাঝে ভয় আতংক বা হিংসা বলেও কিছু নেই। ম্যানুয়েলটিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে এটি হাসতে পারলেও আর কিছু পারে না, কেউ যেন এর মাঝে অন্যান্য মানবিক গুণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা না করে। এনিম্যানের হাসিটি এই প্রাণীটির একটি অতি সাধারণ অভিব্যক্তি তার ভাষা। প্রাণীটির কথা বলার ক্ষমতা নেই তাই এই হাসিটি দিয়েই সে আশে পাশে অন্যান্যদের সাথে ভাব বিনিময় করে।
তিষা বেশ কিছুক্ষণ এনিম্যানটিকে লক্ষ্য করে শেষে তাকে ডাকল, “এই যে! এদিকে তাকাও–”
এনিম্যানটি মাথা ঘুরে তিষার দিকে তাকাল তারপর ফিক করে হেসে ফেলল হুবহু একটা মানুষের বাচ্চার মত। তিষা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “এসো আমার কাছে।”
এনিম্যানটি তার কথা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হয় না, মেঝেতে বসে ঘাড় নাড়িয়ে তাকিয়ে রইল। তিষা হাত দিয়ে ডাকল, “এসো। কাছে এসো।”
এবারে এনিম্যানটি তার কাছে এগিয়ে আসে, কাছে এসে তার হাতকে স্পর্শ করে। ছোট ছোট আঙ্গুল, হাতটা শীতল। তিষা এনিম্যানটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সেটি আবার ফিক করে হেসে ফেলল তারপর আরামে চোখ বুজে ফেলল। মাথায় লম্বা চুল, শরীরে কোমল এক ধরণের পশম, তিষা আদর করে সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়।
আম্মু ঠিক তখন এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসেছেন, সেটা দেখেই তিষা মুখ ভার করে বলল, “আম্মু তুমি আবার দুধ নিয়ে এসেছ!”
“খেয়ে নে বাবা, তোর ডাক্তার বলে দিয়েছে খুব ভালো করে খেতে হবে।”
“কখনো বলেনি আম্মু। এই দেশের ডাক্তাররা কখনো খেতে বলে না, বরং উল্টোটা বলে। কম করে খেতে বলে।”
“এই এক গ্লাস দুধ।”
তিষা নাক কুঁচকে বলল, “খাওয়া উচিৎ তোমার আম্মু! তুমি কতো শুকিয়েছ সেটা দেখেছ?”
তিষার কথা বলার ভঙ্গীর কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক এনিম্যানটি মনে হয় খুব মজা পেল, সেটা হঠাৎ খিলখিল করে শব্দ করে হাসতে থাকে। তিষা তার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, “কী হল? তুমি এভাবে হাসছ কেন?”
এনিম্যানটি মনে হয় এই কথায় আরো বেশী মজা পেয়ে গেল। সেটা আরো জোরে হাসতে থাকে। আম্মু বললেন, “কী মজার একটা জিনিষ! শুধু হাসে।”
“হ্যাঁ আম্মু, অসম্ভব হাসিখুশী। পৃথিবীর সব মানুষ যদি এদের মত হতো তাহলে কতো মজা হতো!”
“দেখে মনে হয় খুব লক্ষ্মী।”
“হ্যাঁ আম্মু খুব লক্ষ্মী।”
“কী নাম দিবি ঠিক করেছিস?”
“এতো লক্ষ্মী তাই ভেবেছিলাম লক্ষ্মী বলেই ডাকব। কিন্তু তাহলে আমার এদেশের বন্ধুরা নাম উচ্চারণই করতে পারবে না। দাঁত টাত ভেঙ্গে যাবে। তাই ঠিক করেছি মিশকা নাম দিয়ে ডাকব।”
“মিশকা?”
“হ্যাঁ। মিশ-কা।” তিষা তখন এনিম্যানটার দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলে? এখন থেকে তোমার নাম মিশকা মিশ-কা।”
এনিম্যানটি কী বুঝল কে জানে, কিন্তু ঠিক মানুষের মত মাথা নাড়ল।
তিষা দুধ শেষ না করা পর্যন্ত আম্মু দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর খালি গ্লাসটা নিয়ে নিচে চলে গেলেন। ঠিক এরকম সময় বাসার সামনে একটা গাড়ী থামার শব্দ হল। প্রায় সাথে সাথেই গাড়ীর দরজা খুলে কয়েকজনের গাড়ী থেকে হৈ হুল্লোড় করে নামার শব্দ হল। তিষা জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল এবং সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার ক্লাশের বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসেছে। গাড়ীর ড্রাইভিং সিট থেকে জন নেমে আসছে–এতো বড় একটা গাড়ী জন কোথায় পেয়েছে কে জানে?
তিষা এনিম্যানটাকে কোল থেকে নিচে নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। ততক্ষণে সবাই বাসার ভেতরে ঢুকে গেছে। তিষার, আম্মু দরজা খুলে তাদেরকে বাসার ভিতরে নিয়ে এসেছেন। তিষাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসতে গিয়ে এদের অনেককেই তিষার আম্মু চিনেন। একজন একজন করে সবাই তিষার আম্মুকে আলিঙ্গন করল। মেয়েরা আম্মুকে চুমু খেল।
তিষাকে দেখে সবাই চিৎকার করে হাসল, বলল, “টিশা! তোমাকে অসাধারণ দেখাচ্ছে!”
তিশা বলল, “আমি তোমাদের কতোবার বলব আমার নাম টিশা না, আমার নাম তিষা!”
লিজা নামের একজন মেয়ে বলল, “ তোমার কথাবার্তা খুবই আজব। আমরা তো টিশাই বলছি!”
জন তার হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “শুধু আমি ঠিক করে উচ্চারণ করি। তাই না?”
জনের কথা শুনে কিংবা দেখে সবাই হেসে উঠল এবং তিষা সাথে সাথে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ!”
তিষা জনকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই গাড়ী কোথায় পেয়েছ জন?”
“কিনেছি! মনে নেই গত সামারে ক্রীতদাসের মতো খাটলাম? সেই ক্রীতদাসের বেতন দিয়ে কিনেছি।”
তিষা চোখ কপালে তুলে বলল, “সত্যি?”
লিজা বলল, “সে জন্যেই তো তোমাকে নিতে এসেছি! জন তার নূতন গাড়ীতে চড়িয়ে আমাদের আইসক্রিম পার্লার নিয়ে যাবে!”
তিষা আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু আমি যাই?”
“যাবি? যা।”
এই স্টেটে মাত্র পনেরো বছর বয়সেই গাড়ী চালানোর নিয়ম আছে ষোল বছরে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে দেয়। এতো অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা গাড়ী চালাবে আম্মু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। বললেন, “সাবধানে গাড়ী চালিও।”
তিষা বলল, “তুমি কোনো চিন্তা করো না আম্মু, জন হচ্ছে সুপার ড্রাইভার!”
বসার ঘরে হইচই শুনে এনিম্যানটি সতর্ক পায়ে নিচে নেমে এসেছে। তাকে দেখে সবাই আবার আনন্দে চিৎকার করতে থাকে! জন কাছে গিয়ে সেটাকে কোলে তুলে নেয় আর সাথে সাথে সেটা ফিক করে হেসে ফেলে। একজন একজন করে সবাই এনিম্যানটিকে আদর করল, তারপর তিষাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। আম্মু জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন সবাই জনের বিশাল গাড়ীটিতে গিয়ে উঠেছে, এতো কম বয়সী ছেলে এতো বড় একটা গাড়ী কেমন করে কিনে ফেলল কে জানে! হয়তো এই দেশে বড় গাড়ীই সস্তা, কে বলতে পারবে?
তিষা যখন ফিরে এসেছে তখন আকাশে কালো করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। আম্মু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা! ঠিক ঠিক চলে এসেছিস। যা দুশ্চিন্তা লাগছিল!”
তিষা অবাক হয়ে বলল, “সে কী! তোমার দুশ্চিন্তা কী নিয়ে?”
“বাচ্চা একটা ছেলে সবাইকে নিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে, দুশ্চিন্তা করব না?”
“আম্মু, তুমি আমেরিকানদের চিনো না! এরা গাড়ী ছাড়া আর কিছু বুঝে না। জন গাড়ীর পুরো ইঞ্জিন খুলে আবার লাগিয়ে দিতে পারে। সে হচ্ছে গাড়ীর পোকা!”
“আমি ভেবেছিলাম সে কম্পিউটারের পোকা।”
“কম্পিউটারের জিনিয়াস আর গাড়ীর পোকা।”
“দুটোর মাঝে পার্থক্য কী?”
“একটা হয় মাথা দিয়ে অন্যটা অভ্যাস দিয়ে!”
আম্মু হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গী করে মাথা নাড়লেন আর ঠিক তখন বাইরে বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠল। আম্মু বললেন, দেখেছিস! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে!”
তিষা জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল, বলল, “এই দেশে আমি কখনো আকাশে মেঘ জমতে দেখি নি! বিদ্যুৎ তো অনেক দূরের ব্যাপার।”
আম্মু বললেন, “আজকে খবরে বলেছে রাতে বজ্রপাতসহ ঝড় হবে!”
তিষা হাত তালি দিয়ে বলল, “সত্যি হবে তো? কতোদিন বিজলী মেঘ এসব দেখি না! মনে আছে বাংলাদেশে কালবৈশাখীর সময় কী চমৎকার ঝড় হতো? কুচকুচে কালো মেঘ আর তার মাঝে ঝিলিক করে বিজলী তারপরে মেঘের ডাক! মনে আছে?”
আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মনে নেই আবার! দেশের মেঘ বৃষ্টি খুবই মিস করি।”
.
রাত্রে তিষা তার বিছানায় বসে কোলের মাঝে ল্যাপটপ রেখে কাজ করছে। ঘরের এক কোনায় একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে একটা কম্বল ভাঁজ করে তার মাঝে মিশকার শোওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক ছোট শিশুর মত পা গুটিয়ে সে ঘুমিয়ে আছে।
তিষা তার প্রিয় একটা গান ডাউনলোড করে যখন সেটা শুনতে যাচ্ছে ঠিক তখন আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল, ঠিক যেভাবে দেশে মেঘ ডাকতো। তিষা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, আকাশ চিরে একবার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল তারপর হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দে আশেপাশে কোথাও বাজ পড়ল।
তিষা চমকে উঠল আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। মিশকা চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল, আতংকে চিৎকার করার ফলে সেটি খুব জোরে শব্দ করে হেসে উঠল তারপর অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মত হাসতে হাসতে সেটি তার বাক্স থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে প্রায় ছুটে এসে তিষার বিছানায় উঠে তিষাকে জড়িয়ে ধরে খিল খিল করে হাসতে থাকে। তিষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল সেটি থরথর করে কাঁপছে।
তিষা এনিম্যানটাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বজ্রপাতের বিকট শব্দে এটি ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়ে এটি আতংকে চিৎকার না করে শব্দ করে হেসে উঠছে। যখন কাদার কথা তখন হাসছে!
হঠাৎ করে তিষার একটা বিচিত্র কথা মনে হল, হয়তো এই এনিম্যানটি আসলে ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কিন্তু যারা তাকে তৈরী করেছে তারা এনিম্যানের কাদার ক্ষমতা দেয়নি তাই যখন কাঁদার কথা তখন সেটি হাসছে। আসলে হয়তো এটি হাসি নয় আসলে এটি কান্না। এই এনিম্যানটি হয়তো আসলে হাসিখুশী একটা প্রাণী নয়, এনিম্যানটি হয়তো আসলে খুব দুঃখী একটা প্রাণী। এটা তার দুঃখটাকে প্রকাশ করে হাসি দিয়ে! তিষা নিজের অজান্তেই কেমন জানি শিউরে উঠল।
এনিম্যানটি কিছুক্ষণেই শান্ত হয়ে যায়। তার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিষা আবার তাকে তার কার্ডবোর্ডের বাক্সে শুইয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা কোলে তুলে নেয়। বাহিরে যখন ঝড় শুরু হয়েছে বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে তখন সে তার ব্লগে লিখল।
“এনিম্যান কী সত্যি খুব হাসি খুশী প্রাণী? এমনকী হতে পারে না যে আসলে এটি খুব দুঃখী একটা প্রাণী? তার ভেতর অনেক কষ্ট কিন্তু সে তার কষ্টটা প্রকাশ করে হাসির মতো একটা ভঙ্গী করে। তাই আমরা ভাবি এটি খুব হাসিখুশী। আসলে এটি হাসিখুশী নয়। আসলে এটি ভীত আতংকিত একটা প্রাণী?
আমি শুধু শুধু এটি বলছি না। একটু আগে বিকট শব্দে একটা বজ্রপাত হল। ভয়ে চমকে জেগে উঠে আমার এনিম্যানটি আতংকে চিৎকার না করে জোরে হেসে উঠল। ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে এটা ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। কিন্তু তার মুখে ভয় নেই, তার মুখে হাসি।
কি বিচিত্র!”
তিষা জানতেও পারল না ব্লগে তার এই সহজ কয়েক লাইনের লেখাটি কী ভয়ংকর একটি প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।
০৯. উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার টেবিলে
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার টেবিলে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিতে দিতে বলল, “ব্লগের লেখাটা পড়েছ?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “পড়েছি। এনিম্যানকে নিয়ে যত লেখা বের হয় তার সব কিছু সিস্টেম পাঠানো হয়। আমাদের সুপার কম্পিউটার ক্র্যাগনন সেটা বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পাঠায়।”
“আমি জানি।” উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় সেটা আমাকেও জানানো হয়। এটা আমাকে জানানো হয়েছে, আমি ব্লগটা পড়েছি। ব্লগটা লিখেছে পনেরো বছরের একটা মেয়ে। নাম তিষা আহমেদ।”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, “মেয়েটার সব খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে।”
“এখন কী করবে?”
“সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে মেয়েটাকে মেরে ফেলা। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“এই মেয়েটা সাধারণ একটা মেয়ে না। তার এলাকায় সে ছোটখাটো সেলিব্রেটি। সাসকুয়ান হ্রদের উপরে বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে নিচে পড়ে গিয়ে অক্সিজেন ছাড়া সাতাইশ মিনিট ছিল। মেয়েটা বেঁচে গেছে, ব্রেনের কোনো ক্ষতি হয়নি। লোকাল নিউজে তাকে অনেকবার দেখিয়েছে। ন্যাশনাল নিউজেও এসেছে। স্কুলে সে অসম্ভব পপুলার।”
“তার মানে কী দাঁড়াল?”
লিডিয়া বলল, “এখন তাকে হুট করে মেরে ফেলা যাবে না। খুব সাবধানে মারতে হবে যেন কেউ কোনো রকম সন্দেহ করতে না পারে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী কোনো কথা না বলে লিডিয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে লিডিয়া এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে শুকনো গলায় বলল, “এরকম কিছু হতে পারে আমরা কখনো ভাবিনি।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এবারেও কোনো কথা বলল না, লিডিয়া বলল, “আমরা ব্যাপারটা সামলে নেব। এই মেয়েটা যে কথা লিখেছে তার বিপরীতে অসংখ্য ব্লগ লেখা হচ্ছে। আমরা মোটামুটিভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দেব লেখাটি সত্যি নয়।
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এবারেও কোনো কথা বলল না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো কথা বলছে না ততক্ষণ লিডিয়া স্বস্তি পাচ্ছে না। সে এক ধরনের। অনুনয়ের স্বরে বলল, “আমার উপর বিশ্বাস রাখো বিল। আমি ব্যাপারটা সামলে নেব।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ লিডিয়া, এই মেয়েটি যে কথা লিখেছে যদি পৃথিবীর মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করে তাহলে আমাদের এই পুরো প্রজেক্ট চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে? কতো বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট তুমি সেটা জান?”
লিডিয়া দুর্বল গলায় বলল, “জানি।”
“যে কোনো অবস্থায় আমি সবার আগে দুটো বিষয় দেখি। সবচেয়ে ভালো কী হতে পারে আর সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে। এই টিনএজ মেয়েটির ব্লগ পড়ে আমি দুটো বিষয়ই ভেবে দেখেছি। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে মেয়েটিকে কোনো ঝামেলা ছাড়া মেরে ফেলা। আর সবচেয়ে খারাপ কী জান?”
লিডিয়া নিচু গলায় বলল, “জানি।”
“না, জান না। তুমিও জান না আমিও জানি না। আমাদের সেই ক্ষমতা নেই। কারণ আমরা হচ্ছি সাইকোপ্যাথ। সাধারণ মানুষের মাঝে যে পুরোপুরি অর্থহীন একটা ব্যাপার আছে যেটাকে তারা মায়া-মমতা বলে, স্নেহ বলে, ভালোবাসা বলে আমাদের মাঝে সেটা নেই। তাই এই বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করে, আমরা সেটা বুঝতে পারি না। আমরা সেটা অনুমান করার চেষ্টা করি কিন্তু আমাদের অনুমান ভুল হতে পারে।”
লিডিয়া আস্তে আস্তে বলল, “আমাদের সুপার কম্পিউটার ক্র্যাগননে সব তথ্য দিয়ে আমরা নিখুঁতভাবে মানুষের মন বিশ্লেষণ করতে পারি।”
“করে কী দেখেছ?”
লিডিয়া মাথা নিচু করে বলল, “খুব ভালো ফল দেখিনি। পৃথিবীর মানুষ বেশির ভাগই নির্বোধ। যুক্তি থেকে তারা আবেগের উপর নির্ভর করে বেশী। তাই যত সুন্দর যুক্তিই দেখানো যোক মানুষ এই নির্বোধ মেয়েটির
“তুমি কেমন করে জান মেয়েটি নির্বোধ?”
লিডিয়া বলল, “নির্বোধ না হলে শুধুমাত্র একটা ঘটনা দেখে কেউ এরকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “কিন্তু তার সিদ্ধান্তটিতে সত্যতা আছে। এনিম্যানের হাসিটি সত্যিকারের হাসি নয়।”
“ঘটনাক্রমে সঠিক। যাই হোক এখন সেটা আমাদের দেখাতে হবে। আমি যেটা বলছিলাম-সাধারণ মানুষ এই মেয়েটির কথা কোনো যুক্তি ছাড়াই বিশ্বাস করতে চাইবে। সামাজিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেটা যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটা আমাদের জন্যে বড় বিপদ হয়ে যাবে। কাজেই আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছি কতো মানুষ এই মেয়েটার ব্লগ পড়ছে। যদি দেখি সংখ্যাটা হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে আমরা কিছু একটা করব।”
“মেয়েটিকে কী করবে?”
“ওকে মেরে ফেলতে হবে। আগে হোক পরে হোক, ওকে মরতে হবে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এতো সহজে একজন মানুষকে মেরে ফেলার কথা কী আর কেউ বলতে পারবে?
লিডিয়া বলল, “আমাদের একটা বড় সুবিধা আছে।”
“কী?”
“এনিম্যান নিজে কোনো তথ্য দিতে পারবে না। তার কোনো ভাষা নেই। হাসি ছাড়া আর কোনো শব্দ করতে পারে না। কেউ তাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে পারবে না।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী মাথা নাড়ল, সেটা সত্যি। যখন পোষা প্রাণী হিসেবে কেউ এনিম্যানকে নিয়ে যায় তখন তার বয়স কতো থাকে?”
“জৈবিক বয়স খুবই কম, মাত্র এক বছর। কিন্তু মানসিক বয়স বেশি। ছয় থেকে সাত।”
“এতো বেশী কেন?”
“এনিম্যান নিজে যদি তার দৈনন্দিন কাজ করতে না পারে তাহলে সাধারণ মানুষ এটাকে পুষতে চাইবে না। সেজন্যে তার মানসিক বয়স একটু বাড়িয়ে দিতে হয়েছে।”
“যদি এটা মানুষ হতো তাহলে তার সাথে এই বয়সে কথা বলা। যেতো?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ তাহলে কথা বলা যেতো। কারণ এনিম্যান আসলে মানুষ। আমরা কেউই জানতে দেই না কিন্তু আসলে এটি মানব শিশু।”
“তাহলে তাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো, তোমার মনে কি দুঃখ আছে? সে কী উত্তর দিতো?”
“ছয় সাত বছরের বাচ্চার মতো কিছু একটা উত্তর দিতো। কিন্তু এখন দেবে না। কারণ এখন তার কোনো ভাষা নেই। কিছু জিজ্ঞেস করলে খিল। খিল করে হাসবে। একেবারে খাঁটি অকৃত্রিম হাসি।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী কিছুক্ষণ লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “ঠিক আছে, আমি তোমাকে এক মাস সময় দিচ্ছি। এক মাস পরে তুমি এখানে এসে আমাকে বলবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে চলে এসেছে।”
“বলব।”
“যদি সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে চলে না আসে তাহলে তোমার আসার প্রয়োজন নেই। তুমি নিশ্চয়ই জান তখন আমাকে কী করতে হবে।”
লিডিয়া ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল কিন্তু বাইরে প্রকাশ করল না। মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি।”
“যাও।”
লিডিয়া উঠে দাঁড়াল, বলল, “আমি বিশেষ কাজের জন্যে কোম্পানীর সাহায্য পাব তো?”
“পাবে। যতজন মার্ডারার দরকার পাবে। পুলিশ বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আমি কিনে রেখেছি। যেটা আমার নিয়ন্ত্রণে নাই সেটা হচ্ছে অপদার্থ পাবলিক আর তাদের মাতলামো করার জায়গা–যেটাকে তোমারা বল সাইবার ওয়ার্ল্ড ইন্টারনেট। সারা পৃথিবীর ইন্টারনেট আমি বন্ধ করে দিতে পারব না।”
“আমার তার প্রয়োজন নেই।”
“ঠিক আছে। শুভ রাত্রি।”
“শুভ রাত্রি।”
লিডিয়া ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভাবল, কী অর্থহীন একটা কথা–শুভ রাত্রি। একজনের শুভ রাত্রির জন্যে কাউকে না কাউকে কোথাও। না কোথাও অশুভ রাত্রি পেতে হয়! ভয়ঙ্কর নিরানন্দ রাত্রি পেতে হয়।
» ১০. কম্পিউটার মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে
কম্পিউটার মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে জন তিষার দিকে তাকাল, হাত দিয়ে, সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে বলল, “আমাদের কেন মিশরীয় সভ্যতার উপর রিপোর্ট লিখতে হবে?”
জনের সাথে সাথে থেকে তাদের ক্লাশের অনেকেই এখন সাইন। ল্যাংগুয়েজ অনেকখানি বুঝতে পারে, যখন বুঝতে পারে না তখন জন ফিস ফিস করে তার আধা যান্ত্রিক আধা মানবিক গলায় বুঝিয়ে দেয়। এবারে অবশ্যি তার বুঝিয়ে দিতে হল না, জন কী বলতে চেয়েছে তিষা সাইন ল্যাংগুয়েজ থেকে সেটা বুঝে গেল। হেসে বলল, “কোর্সটা ইতিহাসের তাই মিশরীয় সভ্যতার উপর লিখতে হবে। কম্পিউটারের কোর্স হলে কম্পিউটারের উপর লিখতে হত। গাড়ীর কোর্স হলে গাড়ীর উপর লিখতে হত।”
জন হাত দিয়ে বলল, “সরাসরি কেটে এনে রিপোর্টে বসিয়ে দিলে সমস্যা কী? নিজের মতো করে লিখতে হবে কেন? আমি কী গুগল থেকে বেশী জানি?”
তিষা হাসল, বলল, “সেটা ভুল বলনি! কিন্তু গ্রেডটা তো গুগলকে দেয়া হয় না, গ্রেড দেয় তোমাকে!”
জন হতাশার ভঙ্গী করে আবার মনিটরে চোখ দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মিশরের ফেরাউন রামেসিসের কাহিনী পড়তে থাকে।
এরকম সময় মিশকা ঘরে এসে ঢুকে, সে কাছে এসে তিষাকে ধরে দুই পায়ে দাঁড়াল। তিষা মিশকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “কী খবর মিশকা? জীবনটা কী রকম মনে হচ্ছে?”
মিশকা ফিক করে হেসে তিষার হাতে হাত বুলিয়ে দেয়। তার ভঙ্গী দেখে মনে হয় সে বুঝি তিষার কথাটা বুঝতে পেরেছে। তিষা বলল, “মিশকা। তুমিই ভালো আছ তোমার মিশরীয় সভ্যতার উপর রিপোর্ট এনিম্যান লিখতে হচ্ছে না!”
মিশকা আবার ফিক করে হেসে উঠল। জন মিশকার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “কী সুন্দর হাসে দেখেছ?”
মিশকা জনের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় সেও বুঝি সাইন ল্যাংগুয়েজ বোঝার চেষ্টা করছে, তারপর জনের কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত বুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। জন আদর করে মিশকার চুল এলোমেলো করে দিয়ে তিষাকে বলল, “আমি কখনো জানতাম না মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী হাসতে পারে।”
তিষা বলল, “হয়তো এটা মানুষ।”
জন মাথা নাড়ল, বলল, “না। এটা মানুষ না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেছে। এর জিনেটিক কোডিং মানুষের থেকে ভিন্ন।”
“কতোটুকু ভিন্ন? তার চেয়ে বড় কথা কতোটুকু ভিন্ন হলে তুমি বলবে এটা মানুষ না?”
জন হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, “আমি জানি না। আমি এনিম্যান ডিজাইন করি নাই।”
তিষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশকার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তা ছাড়া এই যে এর মুখের হাসি, তুমি কী মনে কর এটা সত্যি? হয়তো এটা সত্যি না।”
জন হাত তুলে তিষাকে থামাল, বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, মনে আছে তুমি তোমার ব্লগে এটা লিখেছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর অন্যেরা কী লিখেছে দেখ নাই।”
“দেখেছি। অন্যেরা বলেছে এটা ঠিক না, তাদের এনিম্যান কখনো ভয় পায় না, দুঃখ পায় না। বলেছে এনিম্যানের ভয় পাবার, দুঃখ পাবার, মনে কষ্ট পাবার ক্ষমতা নেই।”
“কাজেই কেস ক্লোজড। তুমি এটা নিয়ে মাথা ঘামিও না।”
তিষা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”
“কী মনে হয়?”
“আমার মনে হয় এই যে অন্যেরা যা লিখেছে সেগুলো আসলে সত্যি না। যারা এনিম্যান তৈরী করেছে তারা চায় না আসল কথাটা বের হয়ে আসুক। তারা সবকিছু গোপন রাখতে চায়।”
জন হা হা করে হাসল, বলল, “তুমি আজকাল মনে হয় খুব বেশী ডিটেকটিভ বই পড়ছ!”
তিষা হাসল না। বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“আমার মনে হয় আমি যদি কোনোভাবে মিশকার সাথে কথা বলতে পারতাম তাহলে জিজ্ঞেস করতাম, বল দেখি মিশকা তোমার মনে কোনো গোপন দুঃখ আছে কী না!”
জনের মনে হল কথাটা খুব পছন্দ হল, সে আরো জোরে হা হা করে। হাসতে লাগল। মিশকা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর সেও, খিল খিল করে হাসতে লাগল।
.
দুইদিন পর বিকেল বেলা তিষা স্কুলে তার আম্মুর জন্যে অপেক্ষা করছে তখন তার টেলিফোন বেজে উঠল, তার আম্মুই ফোন করেছেন। তিষা ফোন ধরল, “হ্যালো আম্মু। তুমি কোথায়?”
“আর বলিস না। সেফওয়ে থেকে বাজার করে গাড়ীতে উঠেছি, দেখি গাড়ী কেমন যেন ঘসটে ঘসটে যাচ্ছে আর থপ থপ শব্দ!”
তিষা অবাক হয়ে বলল, “থপ থপ শব্দ?”
“হ্যাঁ, গাড়ী থামিয়ে দেখি সামনের ডান দিকের চাকায় কোনো বাতাস নাই। চাকা পাংচার।”
“এখন?”
“গাড়ী পার্কিং লটে রেখে তোর আব্বুকে ফোন করেছি!”
তিষা হতাশ ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “এই দেশের ক্লাশ ফাইভের বাচ্চাও গাড়ীর চাকা পালটাতে পারে, আর তুমি এখনো মনে হয় জান না। তোমার গাড়ীর চাকা কয়টা!”
আম্মু বললেন, “ঢং করবি না। আমি মরি নিজের যন্ত্রণায় আর ইনি এসেছেন জ্ঞান দিতে।”
“তুমি যদি চাকা বদলানো শিখে নিতে তাহলে আর নিজের যন্ত্রণায় মরতে হত না। যাই হোক আমি কী করব? তোমার জন্যে অপেক্ষা করব নাকী বাসায় চলে যাব?”
“আমার মনে হয় দেরী হবে। তোর আব্বু সেই বেসমন্ট থেকে আসবে, এসে আমার উপর একটু মেজাজ করবে তারপর চাকা বদলাবে তারপর আবার মেজাজ করবে তারপর পাংচার চাকা ঠিক করতে দিবে মনে হয় কয়েকঘন্টার ধাক্কা। তুই কোনোভাবে চলে যা–”
“ঠিক আছে আম্মু।”
“তুই কীভাবে যাবি?”
“বাসে চলে যাব না হলে কেউ নামিয়ে দেবে। জনের কতো বড় গাড়ী দেখ নাই?”
“ঠিক আছে।”
তিষা জনকে খুঁজে বের করে বলল, “জন। তুমি যদি আমাকে দশ ডলার দাও তাহলে তোমাকে আমি একটা খুবই স্পেশাল কাজ করার সুযোগ দিব।”
“কী স্পেশাল কাজ?”
“আমার আম্মু তার গাড়ী নিয়ে আটকা পড়েছে, আমি তোমাকে আমায় বাসায় নামিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ দেব।”
জন হা হা করে হেসে কুর্নিস করার ভঙ্গী করে মাথা নিচু করে বলল, “প্রিন্সেস তিষা! আপনাকে বাসায় নামিয়ে দেবার জন্যে আমি দশ ডলার কেন দশ হাজার ডলার দিতে প্রস্তুত।”
তিশা বলল, “আজকে স্পেশাল সেল, তাই তোমার জন্যে ফ্রী! চল।”
একটু পরেই দেখা গেল জনের বিশাল গাড়ীতে জনের পাশে বসে তিষা তার বাসায় রওনা দিয়েছে। জন কয়েক মিনিট গাড়ী চালিয়েই তার ভ্রূ কুঁচকে একটা গালি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল। তিষা বলল, “কী হয়েছে?”
জন কানে শুনতে পায় না, মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ভঙ্গী দেখে কথা বুঝতে পারে তাই সে তিষার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। জন গাড়ীর গতি হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিয়ে আবার হঠাৎ করে কমিয়ে এনে কিছু একটা পরীক্ষা করল। তিষা জনের কাঁধ স্পর্শ করতেই সে ঘুরে তিষার দিকে তাকাল। তিষা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
জন স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে বলে সাইন ল্যাংগুয়েজে না বলে তার নিজস্ব অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, “কিছু একটা গোলমাল লাগছে। গাড়ীটা ঠিক ব্যবহার করছে না।”
তিষা হেসে ফেলল, বলল, “গাড়ী কী মানুষ নাকী! গাড়ী আবার ঠিক আর ভুল ব্যবহার করবে কেমন করে?”
জন বলল, “মানুষকে কেউ বিশ্বাস করে না। গাড়ীকে করতে হয়।”
জন দক্ষ হাতে গাড়ীটা চালিয়ে নিতে থাকে। তাদের স্কুলটা ছোটখাটো একটা উপত্যকার মাঝে, শহরে যেতে হলে আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে পাহাড়ী একটা এলাকায় উঠতে হয়। সেখান থেকে ঢালু বেয়ে নিচে নেমে একটা খাড়া পাথরের ঢালের পাশে দিয়ে যেতে হয়। জায়গাটা একটু বিপদজনক তবে জনের জন্যে এটি কোনো সমস্যা নয়। এই পথে সে
এতোবার গাড়ী চালিয়েছে যে সে আক্ষরিক অর্থেই চোখ বন্ধ করে এখানে গাড়ী চালিয়ে যেতে পারে।
পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নামার সময় হঠাৎ জন চিৎকার করে একটা গালি দিল, গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, তিষা চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে?”
“ব্রেক ফেল করেছে।”
তিষা আতংকিত হয়ে দেখে জন বারবার ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে আর প্রতিবার প্যাডেল একেবারে নিচে নেমে যাচ্ছে কিন্তু গাড়ী থামছে না, ব্রেক একেবারেই কাজ করছে না।
পাহাড়ী ঢালু বেয়ে নামতে নামতে গাড়ীর বেগ বেড়ে যাচ্ছে জন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার মাঝে হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ বেড়ে গেল–শুধু যে ব্রেক কাজ করছে না, গাড়ীর ইঞ্জিন দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করছে। গাড়ী সোজা ছুটে যাচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে খাড়া ঢালটায় এসে রাস্তার পাশের হালকা রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে কয়েকশ ফুট নিচে পাথরের উপর ছিটকে পড়বে। পৃথিবীর কোনো শক্তি এখন তাদের থামাতে পারবে না।
জন হঠাৎ আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল। স্টিয়ারিং হুইলটা শক্ত করে তার বিচিত্র যান্ত্রিক উচ্চারণে বলল, “তিষা।”
“হ্যাঁ।”
“হ্যান্ডব্রেকটা দুই হাত দিয়ে ধর।”
তিষা কাঁপা হাতে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা দুই হাতে ধরল।
জন শান্ত গলায় বলল, “যখন আমি বলব তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেকটা টানবে।”
“ঠিক আছে।”
“যদি গাড়ী থামাতে না পারি দুজনেই মরে যাব।”
তিষা কোনো কথা বলল না। জন বলল, “আমি দুঃখিত তিষা। আমি খুব দুঃখিত। এটা হওয়ার কথা ছিল না।”
তিষা কোনো কথা না বলে সমস্ত শক্তি দিয়ে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা ধরে রাখল, জন যখন বলবে সে টেনে ধরবে।
খাড়া ঢালটাতে নেমে রেলিংটাতে প্রচণ্ড বেগে আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তে জন সমস্ত শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে স্টিয়ারিং হুইল পুরোটা ঘুরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “এখন।”
গাড়ীটা ঘুরছে, কোন দিকে ঘুরছে সে জানে না, বিকট ঘর্ষণের শব্দ হচ্ছে তার সাথে টায়ার পোড়া গন্ধ, ধোঁয়ায় গাড়ী ভরে গেল। সিট বেল্ট তার বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসেছে, তার মনে হল তবু বুঝি সে ছিটকে বের হয়ে যাবে, সে সবকিছু ভুলে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে ধরল।
তারপর কী হল সে জানে না। গাড়ীটা কয় পাক ঘুরেছে সেটাও জানে।, কোথায় ধাক্কা খেয়েছে তাও জানে না, কিন্তু হঠাৎ করে টের পেল গাড়ীটা থেমে গেছে। জন তার বিচিত্র উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছ?”
তিশা বলল, “মনে হয়।”
“তাহলে নেমে যাও।”
তিষা পোড়া একটা গন্ধ টের পেলো কোথা থেকে জানি ধুয়া বের হচ্ছে। হাত দিয়ে দরজার হ্যাঁন্ডেলটা টান দিয়ে সে দরজা খুলে বের হয়ে এল। কপালের কাছে হাত দিতেই ভিজে চটচটে একটা অনুভূতি হল। হাত চোখের সামনে এনে দেখে রক্ত, কপালের কাছে কোথাও কেটে গেছে।
গাড়ীর অন্য পাশ থেকে জন নেমে আসে, তার নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিষার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “আমরা বেঁচে গেছি।”
তিষা ফিস ফিস করে বলল, “থ্যাংকু জন। শুধু মাত্র তোমার জন্যে বেঁচে গেছি।” রাস্তার পাশে তখন বেশ কয়েকটা গাড়ী এসে থেমেছে, সেখান থেকে লোকজন নেমে তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। এতক্ষণ তারা দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের ক্লান্তি এসে তাদের উপর ভর করে। প্রথমে তিষা তারপর জন রাস্তার পাশে এসে বসে পড়ল। তিষা জনের ঘাড়ে মাথা রেখে ফিস ফিস করে বলল, “কী হয়েছিল জন?”
জন বিড় বিড় করে বলল, “কেউ একজন আমাদেরকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল!”
তিষা কথাটা শুনতে পেল না, তাই জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ?”
জন তিষার মুখের দিকে তাকাল, মুখের মাঝে বয়সের তুলনায় বেমানান একটা নির্দোষ সারল্য, তার হঠাৎ করে তার জন্যে এক ধরণের বিচিত্র মায়া হল। বলল, “ব্রেক ফেল করেছিল।”
“কেন?”
“জানি না তিষা। আমি জানি না।”
১১. লিডিয়া স্থির দৃষ্টিতে তার সামনে
লিডিয়া স্থির দৃষ্টিতে তার সামনে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি এই সহজ কাজটা করতে পারলে না?”
“আমি আমার কাজ একেবারে নিখুঁত ভাবে করেছি। মেয়ের মায়ের গাড়ীর চাকা পাংচার করিয়ে গ্রোসারী স্টোরের পার্কিং লটে আটকে দিয়েছি। জন নামের শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছেলের গাড়ীতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস লাগিয়েছি, মেয়েটা ঠিক ঠিক জনের গাড়ীতে উঠেছে। জন যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছে তখন তার ব্রেক ওয়েল ফেলে দিয়ে ব্রেক অকেজো করেছি, কাজটা নিশ্চিত করার জন্যে ফুয়েল ইনজেকশানে বাড়তি ফুয়েল দিয়ে গাড়ীর স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছি এর চাইতে নিখুঁত পরিকল্পনা করা আর সেই পরিকল্পনা কাজে লাগানো এই পৃথিবীর কারো পক্ষে সম্ভব না। এই গাড়ীটার প্যাসেঞ্জারদের কোনো ভাবে বেঁচে আসা সম্ভব না।”
লিডিয়া বলল, “কিন্তু গাড়ীটা খাদে পড়ে যায়নি। গাড়ীটা একেবারে ভালো আছে। ছেলে মেয়েগুলোকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করেনি, ছেড়ে দিয়েছে।”
“আমি কেমন করে জানব ষোল বছরের একটা ছেলে এরকম স্টান্টম্যানের মতো গাড়ী চালায়? যে ভাবে সে গাড়ীটাকে ঘুরিয়ে থামিয়ে দিয়েছে সেই পদ্ধতিটা সিক্রেট এজেন্টের লোকেরা তাদের কমান্ডোদের শেখায়। গাড়ীর মোমেন্টাম আর এংগুলার মোমেন্টাম ব্যবহার করে গাড়ীকে থামানো, উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিলে যে মোমেন্টাম পরিবর্তন হয় সেটা দিয়ে”
“আমি তোমার থেকে পদার্থ বিজ্ঞান শিখতে আসিনি।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, “আমার কাছে পুরোটার ভিডিও আছে। আমি পিছনে পিছনে ছিলাম, তুমি ভিডিওটা একবার দেখো তাহলে বুঝবে এই ছেলে কীভাবে গাড়ী চালায়। মাত্র ষোল বছর বয়স, কানে শুনতে পায়। কিন্তু গাড়ী চালানো দেখলে মনে হয় ইন্ডি ফাইভ হান্ড্রেডের ড্রাইভার।”
লিডিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার ভিডিও দেখে মুগ্ধ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন কাজ উদ্ধার করা। পনেরা ষোল বছরের একটা মেয়েকে শেষ করতে পার না।”
“একটা মানুষকে খরচা করতে আমার তিরিশ সেকেন্ড সময়ও লাগে না। কিন্তু তুমি বলেছ কাজটা ক্লিন হতে হবে। কেউ যেন বুঝতে না পারে এটা মার্ডার, যেন মনে হয় এটা একসিডেন্ট। সেজন্যেই তো এতো যন্ত্রণা।”
“কিন্তু এখন কী লাভ হল? সবাই জেনে গেল তাদেরকে তুমি মার্ডার করার চেষ্টা করেছ।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “না। কেউ জানে নাই। একসিডেন্টের পর অনেক মানুষের ভীড় ছিল আমি তার মাঝে গাড়ীর হুড খুলে ফুয়েল ইনজেকশান থেকে আমার ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস খুলে নিয়েছি। ছেলেটা বা মেয়েটা কিছু জানে না। পুলিশকে বলেছে গাড়ীর ব্রেক ওয়েল পড়ে ব্রেক ফেল করেছে। পুলিশ উল্টো ছেলেটাকে দোষ দিচ্ছে, তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করে দিতে পারে। কাজেই তুমি নিশ্চিন্ত থাক এই সুপার ড্রাইভার আমার প্রজেক্ট ফেল করিয়ে দিয়েছে কিন্তু এখনো কেউ কিছু জানে না।”
লিডিয়া মাথা নেড়ে বলল, “আমি যদি ঐ ছেলেটা কিংবা মেয়েটা হতাম তাহলে বুঝে যেতাম।”
“কিন্তু ঐ ছেলে আর মেয়ে তুমি না। তুমি হচ্ছ একটা রাক্ষুসি ওরা রাক্ষুসি না। ওরা সাধারণ ছেলে মেয়ে। ওরা তোমার মতো চিন্তা করে না। যদি করতো তাহলে পুলিশকে বলত। ওরা বলে নাই, আমি জানি। পুলিশকে আমরা কন্ট্রোল করি।”
লিডিয়া তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। প্রথম বার তোমার প্রজেক্ট ফেল করেছে, দ্বিতীয়বার ফেল করতে পারবে না।”
“করবে না। তুমি নিশ্চিত থাক।”
“কখন করবে?”
“একটু সময় দিতে হবে। যদি এই মুহূর্তে আবার চেষ্টা করি তাহলে সবার সন্দেহ হবে।”
“কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। এর মাঝে এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে।”
“কম পক্ষে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে চেষ্টা করতে হবে, তা না হলে সন্দেহ করবে।”
“এক সপ্তাহ।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ঢাকা তার গালটা চুলকে বলল, “ঠিক আছে এক সপ্তাহ। তার মানে পরিকল্পনাটা আরো নিখুঁত করতে হবে। কোনো ফাঁক থাকতে পারবে না। সবচেয়ে ভাল হয় বুলেট দিয়ে একেবারে মাথায় গুলী করলে, কোনো ঝুঁকি থাকে না। স্কুলের একটা বাচ্চা মেয়ের মাথায় বুলেট দিয়ে গুলী করতে পারে শুধু মাথা খারাপ মানুষ। এই দেশে সেই রকম মানুষের অভাব নাই। দুইদিন পর পর কোনো না কোনো স্কুলে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে মাথা খারাপ মানুষ এসে অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে গুলী করে বাচ্চাদের মারছে। এরকম একজন নিয়ে আসতে হবে। তবে মাথা খারাপদের কন্ট্রোল করা একটু কঠিন–”
লিডিয়া হাত তুলে মানুষটাকে থামাল, বলল, “আমার ডিটেলস জানার দরকার নেই। কাজ হলেই আমি খুশী।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমি সেটা জানি। মেয়েটা মার্ডার হলেই যে তুমি খুশী হবে রাক্ষুসী লিডিয়া আমি সেটা জানি।”
লিডিয়া হিস হিস করে বলল, “তুমি মনে করো না আমাকে রাক্ষুসী ডেকে তুমি আমাকে অপমান করতে পারবে।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটি হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল, “আমি তোমাকে অপমান করার চেষ্টা করছি না, আমি সত্যি কথাটাই বলছি।” লিডিয়া শীতল দৃষ্টিতে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো উত্তর দিল না।
১২. জিমনাসিয়ামে স্কুলের বাস্কেটবল টিম
জিমনাসিয়ামে স্কুলের বাস্কেটবল টিম এ্যাকটিস করছে। দুই পাশের গ্যালারীতে কোনো দর্শক নেই, শুধু ডান দিকের গ্যালারীতে ঠিক মাঝখানে তিষা আর জন বসে আছে। দুদিন আগে একটা ভয়ংকর একসিডেন্টে মারা যেতে যেতে কোনোভাবে তারা বেঁচে গেছে, বিষয়টা সেভাবে কেউ জানে না। জন কিংবা তিষা দুজনের কেউই সেটা তাদের বাসাতে সেভাবে বলেনি।
জন এখন নিশ্চিতভাবে জানে যে তার গাড়ীটিতে কিছু একটা করা হয়েছিল। সে যেহেতু কানে শুনতে পায় না তাই গাড়ী চালানোর সময় প্রতি সেকেন্ডে কয়েকবার রিয়ারভিউ মিররে তাকায়। দুর্ঘটনার ঠিক আগে আগে সে রিয়ারভিউ মিররে একটা সিলভার রংয়ের ফোর্ড এস.ইউ.ভি দেখেছে, তাকে ওভারটেক করার সুযোগ পেয়েও সেটা ওভারটেক করেনি তার পিছনে রয়ে গেছে। ঠিক যখন তার ব্রেক ফেল করেছে তার আগে সে একটা ঝাঁকুনী অনুভব করেছে। এখন তার মনে হচ্ছে রিমোট কন্ট্রোলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার ব্রেক ফেল করিয়েছে। শুধু তাই না, সে দেখেছে তার পিছনের গাড়ীর ড্রাইভার হাতে কিছু একটা ধরে সেখানে চাপ দিচ্ছে আর তার গাড়ীর গতি বেড়ে গেছে। যখন সে গাড়ী থামিয়েছে তখন সে দেখেছে এই এস. ইউ. টি তার গাড়ীর পাশে থামিয়েছে। তখন অনেক মানুষের ভীড়, সেই ভীড়ের মাঝে মানুষটি জনের গাড়ীর হুড খুলে কিছু একটা খুলে নিয়েছে। গাড়ীর ফুয়েল ইনজেকশানে কিছু একটা লাগিয়েছিল, তার একটা ছেঁড়া তার পরেও সেখানে লাগানো ছিল, জন পরে দেখেছে। সে কাউকে কিছু বলেনি। বলেও লাভ নেই, পুলিশ তার এই আজগুবি কথা বিশ্বাস করবে না। তিষাকেও বলেনি, বললে মেয়েটি শুধু শুধু ভয় পাবে।
গ্যালারীতে বসে জন হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে তিষাকে বলল,
“তিষা। তুমি খুব সাবধানে থেকো।”
তিষা একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। কেন?”
“বিপদ যখন আসে একা আসে না। তিনবার আসে। তোমার দুইবার হয়েছে, একবার সাসকুয়ান লেক, দুইদিন আগে আমার গাড়ীতে। এখন তিন নাম্বারটা বাকী আছে। খুব সাবধান।”
তিষা কোনো কথা বলল না। জন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “আর আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“তুমি যে ভেবেছিলে এনিম্যানের হাসিটা তার সত্যিকারের হাসি নয়, এটা কৃত্রিম, সেটা হয়তো সত্যি। এনিম্যান আসলে হাসি খুশী প্রাণী না, খুব দুঃখী একটা প্রাণী সেটাও হয়তো সত্যি।”
তিষা অবাক হয়ে বলল, “কেন? হঠাৎ করে তোমার এই কথা মনে হল কেন?”
“হঠাৎ করে না, আমি কয়েকদিন থেকেই এটা ভাবছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা সত্যি।”
জনের খুব ইচ্ছে করল সে তিষাকে তার আসল সন্দেহের কথাটা বলে দেয়। সেদিন তার গাড়ীর ব্রেকটি ফেল করিয়ে আসলে তিষাকেই মারতে চেয়েছিল। তার গাড়ীটি শুধু ব্যবহার করেছে। জন সেটা বলতে পারল না, এই সহজ সরল মেয়েটাকে সে ভয় দেখাতে চায় না, শুধু সাবধান করতে চায়।
জন বলল, “তিষা।”
“বল।”
“এনিম্যান নিয়ে তুমি যদি নতুন কিছু পাও সেটা কিন্তু ব্লগে লিখ না।”
“ব্লগে লিখব না?”
“না।”
“কেন?”
“এনিম্যান কোম্পানী খুব বড় কোম্পানী, যদি তাদের ব্যবসার ক্ষতি হয় তখন রেগে মেগে তোমার ক্ষতি করতে পারে।”
“আমার ক্ষতি? আমার আবার কী ক্ষতি করবে?”
জনের একবার ইচ্ছে হল বলে, তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। দুইদিন আগে যেরকম আমাকে সহ মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বলল না। শুধু হাসার ভঙ্গি করে বলল, “কী ক্ষতি করতে পারে আমি সেটা জানি না, কিন্তু বড় কর্পোরেশানকে কোনো বিশ্বাস নেই। দরকার কী ওদের চটিয়ে।”
“ঠিক আছে।”
“আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“ব্লগে তোমার যে লেখাটা আছে আপাতত তুমি সেটাও সরিয়ে ফেল।”
“সরিয়ে ফেলব?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে।”
.
তিষা সেই রাতে ব্লগ থেকে তার লেখাটি সরিয়ে ফেলল।
তবে তিষা যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ সে তার এনিম্যান মিশকাকে লক্ষ্য করে। তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মিশকাকে বোঝার চেষ্টা করে। আশে পাশে যখন কেউ নেই তখন একবার সে মিশকাকে তার কোলে নিয়ে বসল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বল তো মিশকা, তুমি কী আমার কথা বুঝতে পারছ?”
মিশকা মাথা নাড়ল, তারপর ফিক করে হেসে ফেলল। তিষা বলল, “তুমি যদি আমার কথা বুঝে থাকো তাহলে বল দেখি আমার নাম কী?” মিশকা আবার একটু হেসে ফেলল। তিষা বলল, “ বল দেখি তোমার নাম কী?”
মিশকা একটু মাথা নাড়ল তারপর আবার হাসল। তিষা বলল, “বল মিশকা। মি-শ-কা। মি-শ-কা।”
মিশকা কিছু না বলে খিলখিল করে হাসল। ঠিক তখন বাইরে একটা গাড়ীর শব্দ শুনে তিষা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল জন তাদের বাসার সামনে তার গাড়ী পার্ক করছে। তিষা নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, জন তাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছ?”
তিষা বলল, “এখন পর্যন্ত।”
“কী করছিলে?”
“মিশকার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম।”
“কথা বলতে পেরেছ?”
“শুধু এক দিক দিয়ে, আমি বলি আর সে শুনে। শুনে আর হাসে।”
“তোমার কথা কী বুঝতে পারে?”
“জানি না।”
তিষা দরজা বন্ধ করে বলল, “চল তুমি নিজেই দেখ।”
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে তিষার রুমে ঢুকল, মিশকা জনকে দেখে তার কাছে ছুটে এসে তার হাত ধরল। জন মিশকাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিল। মিশকা মনে হয় এই ব্যাপারটাতে খুব মজা পায়, সে খিলখিল করে হাসতে থাকে। জন আবার তাকে নিচে নামিয়ে দেয়, তিষা তখন মিশকাকে তার নিজের কোলে বসিয়ে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে থাকে, “মিশকা, তুমি খুবই সুইট একটা এনিম্যান। তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি, তোমার একটাই সমস্যা তুমি শুধু হাসো, কথা বলার চেষ্টা কর না। এখন আমি তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করব। তুমি খুব মন দিয়ে শোনো আমি কী বলছি। মিশকা, তুমি বল তুমি কী আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”
মিশকা মাথা নাড়ল, তারপর খিলখিল করে হাসতে থাকল। তিষা হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না, না হাসলে হবে না। হাসি বন্ধ কর। কথা বলার চেষ্টা কর। বল, তোমার নাম কী? বল।”
মিশকা আবার খিল খিল করে হাসল। তিষা জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা হচ্ছে সমস্যা। কোনো কথার উত্তর দেয় না। শুধু হাসে।”
জন তার হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে বলল, “এনিম্যানদের কথা বলার ক্ষমতা নেই। মিশকা কী করবে? কেমন করে কথা বলবে?”
“আমি ভাবছিলাম যদি চেষ্টা করে তাহলে হয়তো একটু পারবে।”
জন বলল, “আমার কথা চিন্তা কর। আমি কী চেষ্টা করলে তোমার মত মুখ দিয়ে কথা বলতে পারব? পারব না। আমাকে হাত দিয়েই কথা বলতে হবে। সাইন ল্যাংগুয়েজে!”
মিশকা খুব মনোযোগ দিয়ে একবার তিষার মুখের দিকে আরেকবার জনের দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার কী মনে হল কে জানে, সে হাত দিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজের মত একটা ভঙ্গী করল। জন চমকে উঠে মিশকার দিকে তাকাল তারপর তিষার দিকে তাকাল, উত্তেজিত ভঙ্গীতে বলল, “তুমি দেখলে তিষা, মিশকা কী করল?”
“কী করল?”
“সাইন ল্যাংগুয়েজে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। তার মানে বুঝতে পারছ?”
তিষা উত্তেজিত গলায় বলল, “তার মানে মিশকা যদি মুখ দিয়ে কথা। নাও বলতে পারে সে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতে পারবে?”
“হ্যাঁ। আমি স্পষ্ট দেখলাম সে এই মাত্র চেষ্টা করল।”
মিশকা তাদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল এবারে অকারণেই খিল খিল করে হেসে উঠল। জন মিশকাকে নিজের কাছে টেনে এনে হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “আমি জন।”
মিশকা মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখল তারপর সেও সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “আমি জন।”
তিষা চিৎকার করে উঠে, “দেখেছ? দেখেছ জন? মিশকা কথা বলছে। মিশকা কথা বলছে!”
জন মাথা নাড়ল, “এখনো নিজে কথা বলছে না। আমি যেটা বলেছি সেটা অনুকরণ করছে।”
“কিন্তু শিখিয়ে দিলে নিশ্চয়ই নিজে কথা বলবে। নিশ্চয়ই বলবে।” জন মাথা নাড়ল, বলল, “চেষ্টা করে দেখি।”
তারপর বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে সে মিশকাকে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে তাদের তিনজনের নাম বুঝিয়ে দিল। তার নিজের নাম হচ্ছে মিশকা। আর তারা দুজনের একজন জন অন্যজন তিষা। যতবার তাকে শেখানো হল প্রত্যেকবারই মিশকা খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখল তারপর মাথা নাড়ল। যখন জন আর তিষার মনে হল মিশকাকে বেশ ভালোভাবে শেখানো গেছে তখন জন সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি কে?”
মিশকা এক মুহূর্ত জনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হাত দিয়ে বলল, “জন।”
জন তিষাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটি কে?”
মিশকা জানাল, “তিষা।”
জন মিশকার দিকে আঙ্গুল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
মিশকা জানাল, “আমি মিশকা।”
তিষা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। জনও জোরে জোরে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আমার মনে হয় মিশকাকে আমরা সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাতে পারব।”
তিষা উত্তেজিত গলায় বলল, “তার মানে বুঝতে পেরেছ? তার মানে আমরা মিশকার কাছ থেকে তার ভেতরের সব কথা জেনে যাব।”
জন বলল, “কিন্তু মনে আছে তো, এই কথাটা কাউকে বলতে পারবে না?”
“মনে আছে।”
“তোমার বাবা মাকেও না।”
তিষা মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে, বলব না।”
“ব্লগে লিখতে পারবে না”
“ঠিক আছে, লিখব না।”
“সারা পৃথিবীতে এটা এখন শুধু তিনজন এটা জানবে। তুমি আমি আর মিশকা।”
তিষা গম্ভীর মুখে বলল, “ঠিক আছে। সারা পৃথিবীতে শুধু আমরা তিনজন এটা জানব।”
. জনের সাথে থাকতে থাকতে তিষাদের ক্লাশের সব ছেলে মেয়েই কম বেশী সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখে গেছে। জনের সাথে একটু বেশী সময় কাটিয়েছে বলে তিষা অন্যদের থেকে সেটা অনেক ভালো জানে। তিষা তাই পরের কয়েকদিন মিশকাকে তার নিজের মতো করে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাতে লাগল। যখনই সময় পেতো তখনই জনও চলে আসতো। খাতা কলম টেলিভিশন চেয়ার টেবিল এগুলো শেখানো গেল খুব সহজেই। ব্যথা, দুঃখ ভয় কষ্ট আনন্দ এগুলো শেখানো হল সবচেয়ে কঠিন। তারপরও মিশকা। দ্রুত শিখতে লাগল, কতো তাড়াতাড়ি মিশকা কতো সুন্দর করে কথা বলতে শিখে গেল দেখে তিষা নিজেই আবাক হয়ে যায়।
১৩. রালফ তোমার চাকরী নেই
“রালফ, তোমার চাকরী নেই?”
“না।”
“কতোদিন থেকে চাকরী নেই?”
“জানি না। অনেক দিন।”
“কেন তোমার চাকরী নেই রালফ?”
“জানি না।”
“কেন তুমি জান না রালফ? তোমার জানতে হবে।”
“আচ্ছা।”
“তোমার চাকরী নেই তার কারণ অন্যায়ভাবে তোমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, রালফ।”
“আচ্ছা।”
“রালফ, তোমাকে শুধু আচ্ছা বললে হবে না। তোমাকে কিছু একটা করতে হবে।”
“করব।”
“হ্যাঁ রালফ। আমাদের দেশের নাম কী বল দেখি রালফ।”
“ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা।”
“এই দেশটা কার জন্যে রালফ?”
“কার জন্য?”
“আমাদের জন্য রালফ। আমাদের যাদের গায়ের রং সাদা তাদের জন্যে। আমরা যারা জিসাসকে বিশ্বাস করি তাদের জন্য।”
“হ্যাঁ। আমাদের জন্যে।”
“বল দেখি এই দেশটা কার জন্য?”
“আমাদের যাদের গায়ের রং সাদা তাদের জন্য।”
“অন্যেরা আমাদের দেশে এসে আমাদের চাকরী নিয়ে নিচ্ছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ রালফ। তুমি দেখছ না তোমার চাকরী নিয়ে নিচ্ছে। তোমাকে বরখাস্ত কর দিচ্ছে। এখন তুমি খেতে পাও না। তোমার একটা ভালো গাড়ী নাই। তোমার গার্লফ্রেন্ড নাই।
“নাই। কিছু নাই।”
“বুঝেছ রালফ। তোমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে। বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
“তোমার বন্দুক আছে রালফ?”
“নাই। বন্দুক নাই।”
“তুমি বন্দুক দিয়ে গুলী করতে পার রালফ?”
“পারি। রাইফেল দিয়ে গুলী করতে পারি। গুলী করতে আমার খুব ভালো লাগে। গুলীর শব্দ আমার খুব ভালো লাগে। রাইফেল দিয়ে গুলী। করলে যে বারুদের গন্ধ বের হয় সেটাও ভালো লাগে। গুলী খুব ভালো লাগে।”
“চমৎকার রালফ। আমাদের সবার রাইফেল ভালো লাগে।”
“রাইফেল দিয়ে গুলী করব।”
“অবশ্যই করবে রালফ। অবশ্যই তুমি গুলী করবে। তোমাকে রাইফেল দিব। গুলী ভরা ম্যাগাজিন দিব। তুমি গুলী করবে আর গুলী করবে
“গুলী করব।”
“কাকে গুলী করবে রালফ?”
“কাকে করব?”
“এই যে এই মেয়েটাকে করতে পার।”
“এই মেয়েটা তো ছোট।”
“কিন্তু তার গায়ের রং দেখেছ রালফ?”
“দেখেছি।”
“কী মনে হয় রালফ? গায়ের রং কী তোমার আমার মত সাদা?”
“না। সাদা না।”
“তার মানে বুঝেছ? এই মেয়েটা আর তার ভাই আর তার বোন আর তার মা আর তার বাবা সবাই আমাদের দেশে এসেছে। এখন তারা আমাদের চাকরী নিয়ে আমাদের বরখাস্ত করে দেয় রালফ। কাজটা কী ঠিক হচ্ছে রালফ?”
“না।”
“তুমি ঠিক বলেছ রালফ। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এখন কী করতে হবে বল।”
“গুলী।”
“কাকে গুলী করবে?”
“জানি না। মনে হয় এই মেয়েটাকে।”
“হ্যাঁ তোমাকে আমি আরো বলব। কিন্তু বলার আগে তুমি এটা খাও।”
“এটা কী?”
“একটা ড্রিংক”
“এটা খেলে কী হয়?”
“তুমি নিজেই দেখবে রালফ। এটা খেলে সবকিছু ভালোভাবে বোঝা যায়।”
রালফ ড্রিংকটা খেলো, খেয়ে বলল, “ড্রিংকটাতে খুব ঝঝ মনে হচ্ছে, মাথা থেকে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে রালফ, আগে আবার এই মেয়েটার ছবিটা দেখ। চেহারাটা মনে রাখ।”
“মনে রাখছি।”
“মেয়েটাকে কী করতে হবে?”
“গুলী করতে হবে।”
“কোথায় গুলী করবে রালফ?”
“তুমি বল।”
“মাথায়। মাথায় আর বুকে।”
“ঠিক আছে।”
“কী রকম রাইফেল তুমি চাও রালফ?”
“সেমি অটোমেটিক।”
“ঠিক আছে, তুমি তাই পাবে। আসো এই ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকো। মেয়েটার ছবি। চেহারাটা মনে রাখো। রালফ।”
“মনে রাখছি।”
“মেয়েটাকে কী করতে হবে রালফ।”
“গুলী করতে হবে।”
“চমৎকার।”
“মেয়েটাকে কী করতে হবে রালফ?”
“বললাম তো।”
“আবার বল।”
“গুলী করতে হবে।”
“চমৎকার। মেয়েটার ছবিগুলোর দিকে তাকাও রালফ। চেহারাটা মনে রাখো।”
“ঠিক আছে।”
“তোমার এখন কেমন লাগছে রালফ?”
“খুব ভালো লাগছে।”
১৪. জন আর তিষা তাদের ল্যাপটপের সামনে
জন আর তিষা তাদের ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। গত কয়েকদিন মিশকার সাথে কথা বলে তারা অনেক কিছু ভিডিও করেছে। সেখান থেকে কেটে কেটে বিভিন্ন অংশ জুড়ে দিয়ে তারা দুই মিনিটের একটা ক্লিপ তৈরী করেছে। দুজনে বসে এখন তারা সেটা দেখছে। তিষার কোলে মিশকা বসে আছে যখনই ল্যাপটপে তার ছবি ভেসে ওঠে মিশকা আনন্দে আটখানা হয়ে যায়। সে হাততালি দেয় এবং হাত নেড়ে নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলতে থাকে, “এটা আমি। এটা আমি।” তারপর খিলখিল করে হাসতে থাকে।
জন তিষাকে বলল, “এটা আমাদের ফাইনাল ভিডিও। আমরা এটা আপলোড করব।”
তিশা বলল, “আরো একবার দেখে নিই। শেষবার। দেখি সবকিছু ঠিক আছে কী না।”
জন বলল, “ঠিক আছে।” তারপর ল্যাপটপের মাউসে একবার ক্লিক করল, সাথে সাথে ভিডিওটা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে সেখানে একটা লেখা ভেসে আসে।
“সবার ধারণা এনিমেন কথা বলতে পারে না। এনিমেনের বুদ্ধিমত্তা খুব নিচু পর্যায়ের। কিন্তু এটি কী সত্যি? “সত্যি নয় কারণ এ্যানিম্যানকে আসলে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানো সম্ভব। সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানোর পর আমরা তার চিন্তা ভাবনার কথা তাদের কাছ থেকেই জানতে পারি।”
লেখাটি শেষ হবার সাথে সাথে মিশকাকে দেখা গেল। সে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলছে। সবাই সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বুঝতে পারে না তাই প্রত্যেকবার মিশকা সাইন ল্যাংগুয়েজে কিছু বলার পর নিচে তার কথাগুলো লিখে দেয়া হয়েছে। মিশকার কথা গুলো এরকম:
“আমি মিশকা। আমি ভালো। তুমি ভালো। আইসক্রিম ভালো। আইসক্রিম ঠাণ্ডা কিন্তু ভালো। কলা ভালো। (হাসি) টেলিভিশন ভালো না। টেলিভিশন খুব বেশী কথা। খুব বেশী রাগ। টেলিভিশন গুলি। টেলিভিশন শব্দ। টেলিভিশন ভালো না। (হাসি) আমি আগে খুব ছোট। এখন বড়। আমি এখন আনন্দ। আমি আগে ছোট। আগে কষ্ট। আমি আগে খুব কষ্ট। আমি ব্যথা। চাবুক। ইলেকট্রিক চাবুক। আমি কাঁদি। আগুন ব্যথা। (হাসি) অনেক ছোট ছোট আমি। অনেক অনেক আমি। আমরা খুব ব্যথা। আমরা খুব কষ্ট। আমরা পালাই। আমরা দৌড়াই। আমরা চাবুক। ব্যথা। কষ্ট। রক্ত। আমরা হাত রক্ত। পিঠ রক্ত। খুব রক্ত। আমরা দুঃখ। (হাসি) আমরা ঘরে বন্ধ। ঘর গরম। ঘর অনেক গরম। আমরা মারামারি। আমরা ধাক্কা ধাক্কি। আমরা চাবুক। ইলেট্রিক চাবুক। অনেক কষ্ট। (হাসি) আমরা ভয়। অনেক ভয়। আমরা। খুব বেশী ভয়। আমরা দৌড়াই। আমরা চোখ বন্ধ। আমরা ভয় পাই। আমরা খুব বেশী ভয় পাই। আমরা চিৎকার। আমরা অনেক চিৎকার। আমি আগে ছোট। আমি ভয়, আমি কষ্ট। আমি ব্যথা। আমি এখন বড়। আমি এখন আনন্দ আমি এখন ভালো। খুব ভালো। আমি ভালো। তুমি ভালো। সব ভাল। (হাসি) আইসক্রিম ভালো।”
মিশকার ভিডিও এখানে শেষ। তারপর দেখা গেল তার হাতে একটা আইসক্রিম কোন এবং মিশকা খুব তৃপ্তি করে সেই আইসক্রিমটা খাচ্ছে। তখন স্ক্রীনে আবার লেখা ফুটে উঠল।
“এই এনিম্যানের কথায় কী এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেনি যে তারা যখন ছোট ছিল তখন তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে? তারা ভয় পেয়েছ? তারা আতংকিত হয়েছে, প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে? এনিম্যানের মনের কথা শুনলে এরকম আরো অনেক অজানা কথা বের হয়ে আসবে। আপনি কী আপনার এনিম্যানের মনের ভেতরের অজানা কথা জানতে চান? তাহলে তাকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখিয়ে দিন। তার সাথে কথা বলুন। আপনি নিজেই দেখুন এনিম্যানের ভেতরে কী আনন্দ, নাকী তার মনের গভীরে এখনো লুকিয়ে আছে দুঃখ বেদনা আর আতংক। তার সুখের হাসিটি কী
সত্যিকারের হাসি নাকী এর পিছনে আছে গভীর যন্ত্রণা। আপনাকে এই ভিডিওটি বিশ্বাস করতে হবে না, আপনি নিজেই আপনার এনিম্যানকে জিজ্ঞেস করুন।” ভিডিওটা এখানেই শেষ। জন আর তিষা দুজনেই ভিডিওটা দেখে মাথা নাড়ল। তারা যেটা বলতে চেয়েছে সেটা বেশ ভালো ভাবেই এর মাঝে প্রকাশ পেয়েছে।
তিশা বলল, “এখন আমরা কী করব?”
“আমরা এটাকে আপলোড করব।”
“কখন?”
জন মাথা চুলকে বলল, “এক দুইদিন দেখি। একটু চিন্তা করি। আগেই তুমি কিছু করো না। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
কিন্তু তিষা অনেকটা না বুঝেই সেই রাতে ভিডিওটা আপলোড করে দিল। জন যখন সেটা জানতে পেরেছে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
১৫. মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ একটা সেমি অটোমেটিক রাইফেল হাতে নিয়ে তার ম্যাগাজিনটা পরীক্ষা করল। তারপর সেটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে হাতে তুলে দিল, বলল, “রালফ, এই যে তোমার রাইফেল।”
রালফ নামের মানুষটার মাথায় নোংরা হলুদ চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তার চোখ লাল, চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতস্থ। মানুষটা তার হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “অনেক ধন্যবাদ বস।”
“এখন কী করতে হবে জান?”
“জানি।”
“আবার বলি। তুমি স্কুলের পার্কিং লটে আপেক্ষা করবে। দেখবে নীল রঙের একটা ভলবো গাড়ী করে একটা মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে আসবে। মেয়েকে নামিয়ে মহিলা চলে যাবে। তখন তুমি এগিয়ে যাবে। মেয়েটাকে গুলী করবে।”
“ঠিক আছে।”
“মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
“যাও রালফ। তোমার উপরে যে অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিশোধ নিয়ে এস।”
“ঠিক আছে বস।”
রালফ ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং একটু পরেই গাড়ীর শব্দ শোনা গেল রালফ তার প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নিতে গেছে।
ঠিক তখন মধ্য বয়স্ক মানুষটির টেলিফোন বেজে উঠল। মানুষটি ফোনটি কানে লাগালো, “হ্যালো।”
সে শুনতে পেলো অন্য দিক থেকে লিডিয়া জিজ্ঞেস করছে, “তোমার হিটম্যান কী রওনা দিয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাকে থামাও। এই মুহূর্তে থামাও।”
“কেন?”
“এখন আমাকে প্রশ্ন করো না, যে কোনো মূল্যে তাকে থামাও।”
“কিন্তু–”
“এই মেয়ে একটা ভিডিও আপলোড করেছে। সারা পৃথিবীর সবাইকে সে আমাদের এনিম্যানের গোপন কথা বলে দিয়েছে। এখন যদি তুমি এই মেয়েকে খুন করো তাহলে তুমি আমি কেউ রক্ষা পাব না। এই মেয়েকে এখন খুন করা যাবে না। কিছুতেই না।”
“তুমি এতো দেরী করে আমাকে বললে?”
লিডিয়া অধৈর্য হয়ে বলল, “আমি এই মুহূর্তে জানতে পেরেছি। তোমার হিট ম্যানকে থামাও।”
“মনে হয় থামানো যাবে না।”
“থামাতে হবে।”
“দেখি কী করা যায়।”
ফোন রেখে মধ্যবয়স্ক মানুষটা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর ফোনটা আবার হাতে তুলে নিল।
দশ মিনিট পর মানুষটি লিডিয়াকে ফোন করল, “হ্যালো।”
“বল।”
“হিটম্যানকে থামিয়েছি।”
“কীভাবে থামালে?”
“টেলিভিশনে দেখ। ডাউন টাউন দিয়ে যাবার সময় পুলিশের সাথে ক্রস ফায়ার হলো। আমার হিটম্যান শেষ।”
“চমৎকার।”
“এখন তুমি কী করবে।”
লিডিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের সোজা সমাধান আর নেই। এখন একটা মাত্র সমাধান, সেটা অনেক কঠিন, অনেক জটিল। কিন্তু আমাদের আর কিছু করার নেই।”
“সমাধানটা কী?”
“তোমাকে টেলিফোনে বলা যাবে না। তবে তোমার একটা কাজ করে দিতে হবে।”
“কী কাজ?”
“তিষা নামের মেয়েটি, তার শ্রবণ প্রতিবন্ধী বন্ধু জন আর তার এনিম্যান মিশকাকে ধরে নিয়ে আসতে হবে।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটা অবাক হয়ে বলল, “ধরে নিয়ে আসতে হবে?”
“হ্যাঁ। শুধু লক্ষ্য রাখবে যেন এটাকে কিডন্যাপের মতো মনে না হয়।”
“দুইজন মানুষকে তুলে নিয়ে যাব আর সেটাকে কিডন্যাপের মতো মনে হতে পারবে না? কী বলছ তুমি?”
“না মনে হতে পারবে না।”
“তাহলে কী মনে হবে?”
“মনে হতে হবে যে এই মেয়েটা আর ছেলেটা পালিয়ে গেছে?”
“আর তাদের এনিম্যান?”
“সেটাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।”
মধ্যবয়স্ক মানুষ কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “লিডিয়া তুমি একটু পর পর অত্যন্ত বিচিত্র বিচিত্র আদেশ দাও! তোমার এই সব আদেশের কোনো মাথা মুণ্ডু নেই।”
“না থাকলে নেই। কিন্তু আমি যেটা বলি তোমাকে সেটা করতে হবে।”
“করা এতা সহজ নয়।”
“না হলে নেই, কিন্তু তোমাকে করতে হবে। খামোকা তোমাকে এতো বেতন দিয়ে আমাদের পে-রোলে রাখা হয়নি।”
“ঠি আছে। ঠিক আছে।” মধ্যবয়স্ক মানুষটি শুনল অন্যপাশে লিডিয়া ফোন রেখে দিল।
বিকেলে তিষা তার স্কুল বাস থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বাসায় এসেছে, অন্যান্য দিন দরজা খোলা মাত্র মিশকা ছুটে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আজকে কেউ ছুটে এল না। তিষা অবাক হয়ে ডাকল, “মিশকা।”
কোনো সাড়া নেই। তিষা দরজা খুলে ভিতরে পা দিয়েই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। ঘরের সোফায় মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বসে আছে, মানুষটিকে সে আগে কখনো দেখেনি। মানুষটির সামনে মিশকা শুয়ে আছে, তার হাত পা বাঁধা। মুখে একটা টেপ লাগানো, তাই কোনো শব্দ করতে পারছে না।
মানুষটি তিষার দিকে তাকল, তিষা দেখল তার কোলে একটা বেঢপ রিভলবার। মানুষটি রিভলবারটা হাতে নিয়ে বলল, “তোমার ভয় পাবার কিছু নেই, আমি তোমাকে এখন গুলী করব না। কিন্তু এই রিভলভারের বাট দিয়ে তোমার ঘাড়ে মারতে পারি, তখন তুমি অচেতন হয়ে যাবে। আমি তখন তোমাকে ঘাড়ে করে আমার গাড়ীতে তুলে নেব। কিংবা তুমি নিজেই হেঁটে হেঁটে ঐ বাইরে পার্ক করে রাখা ফোর্ড এস. ইউ. ভি.-টাতে উঠতে পার তাহলে আমার রিভলভারের বাট দিয়ে তোমার ঘাড়ে মারতে হবে না।”
তিষা হতবুদ্ধি হয়ে মধ্যবয়সী মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “অন্যকিছু করার চেষ্টা করো না মেয়ে। আমি কিন্তু প্রফেশনাল।”
তিষা অন্যকিছু করার চেষ্টা করল না। হেঁটে হেঁটে বাসার বাইরে পার্ক করে রাখা সিলভার কালারের ফোর্ডের এস. ইউ. ভি-টাতে গিয়ে উঠল। তিষা অবাক হয়ে দেখল পিছনের সিটে জন বসে আছে। তার হাত পা বাঁধা। মুখে টেপ লাগানো। তিষার মুখেও টেপ লাগানো হল, হাত পা গুলো বেঁধে নেয়া হল। তারপর এস. ইউ. ভি-টা চলতে শুরু করল।
জন কিংবা তিষা নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করল না, তারা জানে চেষ্টা করে লাভ নেই। মিশকা জানে না, তাই সে মুক্ত হবার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
১৬. লিডিয়া তিষার কাছে এসে
লিডিয়া তিষার কাছে এসে তার মুখে লাগানো ধূসর রঙের ডাক্ট টেপটা এক টান দিয়ে খুলে ফেলল, তারপর কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি তাহলে সেই মেয়ে।”
তিষা কোনো উত্তর দিল না। সেই মেয়ে বলতে কোন মেয়ে বোঝানো হচ্ছে সে জানে না। লিডিয়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, “তোমার জন্যে আমাদের খুব যন্ত্রণা হল। তুমি নির্বোধ একটা মেয়ে আর তোমার ছোট একটা নির্বুদ্ধিতার জন্যে আমাদের কতো ঝামেলা। তুমি একা হলে তবু একটা কথা ছিল, তোমার সাথে এখন যোগ দিয়েছে এই প্রতিবন্ধী।”
লিডিয়া তখন জনের কাছে গিয়ে তার মুখে লাগানো ডাক্ট টেপটাও টান দিয়ে খুলে ফেলল। জন সাথে সাথে তার বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নেয়। তাকে দেখে মনে হয় সে অনেকক্ষণ থেকে এই সময়টার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। লিডিয়া কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর টেবিলের কোথায় জানি চাপ দিয়ে নিচু গলায় ইন্টারকমে কাউকে বলল, “এদের সরিয়ে নিয়ে যাও।”
তিষা জিজ্ঞেস করল, “আমাদেরকে এখানে কেন এনেছ?”
“তোমরা দুই নির্বোধ যে নির্বুদ্ধিতা করেছিলে সেগুলো শুদ্ধ করার জন্যে।”
“তুমি বার বার বলছ আমরা নির্বুদ্ধিতা করেছি, কিন্তু সেটি কী বলছ না।”
“যদি নির্বোধ না হতে তাহলে বুঝে যেতে। নির্বোধ বলে বুঝতে পারছ না।”
তিষা বলল, “কিন্তু তুমি একজনকে জোর করে ধরে আনতে পার না। এটা বেআইনী।”
লিডিয়া কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তিষার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে তিষার বুক কেঁপে উঠল। এটি মানুষের নয় এটি যেন একটি অশরীরি প্রেতাত্মার দৃষ্টি।
তিষা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “আমাদেরকে এখন কী করবে?”
“সময় হলেই দেখবে।”
ঠিক তখন দরজা খুলে দুজন মানুষ এসে ঢুকল, তাদের পাহাড়ের মতো শরীর, তারা তিষা আর জনকে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে ফেলল। তিষা সেই অবস্থায় জিজ্ঞেস করল, “মিশকা কোথায়? আমার মিশকা?”
কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া প্রয়োজন মনে করল না।
.
তিষা আর জনকে যে ঘরটাতে আটকে রেখেছে সেই ঘরটা খুব সুন্দর, পাশে একটা ছোট ছিমছাম বাথরুম। বাথরুমে পরিষ্কার তোয়ালে, সাবান, টুথ ব্রাশ। ঘরের কোণায় ছোট একটা ফ্রীজ সেখানে কোল্ড ড্রিংকস, স্যান্ডউইচ এবং কিছু ফলমূল। ঘরের দুই পাশে দুটো সোফা, সোফার উপর ভাঁজ করে রাখা কম্বল। সোফায় বসে থাকা যায় ইচ্ছে করলে শুয়ে থাকা যায়।
এই ঘরে এনে তাদের হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে। মধ্যবয়স্ক যে মানুষটি তাদের ধরে এনেছে সে নিজেকে প্রফেশনাল বলে দাবী করেছিল, কথাটি নিশ্চয়ই সত্যি। তাদেরকে ধরে রীতিমত প্লেনে উড়িয়ে অন্য স্টেটে নিয়ে এসেছে কোথাও বিন্দুমাত্র ঝামেলা হয়নি। যাদের আকাশে ওড়ার জন্যে নিজেদের প্লেন থাকে নিজেদের রানওয়ে থাকে তাদেরকে মনে হয় গুরুত্ব দিয়েই নেয়া উচিৎ। তিষা আর জন এখন তাদেরকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছে।
ভয়ে এবং আতংকে তিষার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সেই তুলনায় জন মনে হল বেশ শান্ত। সে ফ্রীজ খুলে একটা স্যান্ডউইচ বের করে খেয়ে ফেলল। শুধু যে খেল তা নয়, বেশ তৃপ্তি করে খেল এবং খাওয়া শেষ করে তিষাকে বলল, “খেয়ে দেখতে পার। বেশ ভালো স্যান্ডউইচ।”
তিষা স্যান্ডউইচের ধারে কাছে গেল না, ভয় পাওয়া গলায় বলল, “আমাদের কী হবে?”
জন বলল, “এখন কী করবে জানি না কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে।”
তিষা আতংকিত হয়ে বলল, “মেরে ফেলবে? মেরে ফেলবে কেন? আমরা কী করেছি।”
“আমরা মনে হয় ওদের বিলিওন বিলিওন ডলারের ব্যবসার অনেক ক্ষতি করেছি।”
“কখন ব্যবসার ক্ষতি করেছি?”
“ঐ যে তুমি ভিডিওটা আপলোড করে দিলে তখন। ওটা আপলোড করা ঠিক হয়নি।”
“আমি বুঝতে পারিনি–আমি ভেবেছিলাম–”
“এখন চিন্তা করে লাভ নেই।”
তিষা অবুঝের মতো বলল, “সেইজন্যে আমাদের মেরে ফেলবে?”
তার কথা শেষ হবার আগেই ঘরের দরজাটা খুলে যায়। দরজায় প্রায় যমদূতের মতো দুজন মানুষ তাদের হাতে দুটো স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, তারা রাইফেলটি তাদের দিকে তাক করে গুলী করতে শুরু করে। বাঁচার আদিম প্রবৃত্তির কারণে দুজনেই চিৎকার করে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে পড়ল এবং তাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেটগুলো ছুটে যেতে থাকে, সেগুলো পিছনের দেওয়ালে আঘাত করতে থাকে। তারা দুজন মাথা নিচু করে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল এবং বেশ কিছুক্ষণ তাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেটগুলো ছুটে গেল। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের প্রচণ্ড আওয়াজ তাদের কানে তালা লেগে যায়। ঘর ধূলো বালিতে অন্ধকার হয়ে যায়।
যমদূতের মতো মানুষগুলো যে-ভাবে হঠাৎ করে গুলী শুরু করেছিল, ঠিক সেরকম হঠাৎ করে গুলী থামিয়ে, দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
প্রথমে জন তারপর তিষা উঠে দাঁড়ায়। তিষা ভয়ে থর থর করে কাপঁছে, ফিস ফিস করে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে এখানে?”
জন বলল, “আমাদেরকে মারতে চায়নি। শুধু ভয় দেখিয়েছে।”
“কেন? ভয় দেখাবে কেন?”
“জানি না। মারতে চাইলে আমাদের গুলী করতে পারত। গুলী করেনি।”
দুইজন ঘরটার দিকে তাকায়। রাইফেলের গুলীতে ঘরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে এনিম্যান গেছে। ঘরের ভেতর ধূলো, ধোঁয়া এবং বারুদের গন্ধ।
.
ঠিক তখন এই বিল্ডিংয়ের অন্য মাথায় লিডিয়া একটা কনফারেন্স রুমে বসেছে। টেবিলে বেশ কয়েকজন নানা বয়সী মানুষ নিঃশব্দে বসে আছে। তাদের মুখ পুরোপুরি ভাবলেশহীন, দেখে মনে হয় তাদের মুখে কখনো আনন্দ দুঃখ বেদনা বা কোনো কিছুরই ছাপ পড়ে না।
লিডিয়া তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, “আমি কোনোরকম ভূমিকা না করে সরাসরি শুরু করে দিই। আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই।”
সবাই নিজ নিজ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে লিডিয়ার দিকে তাকাল। লিডিয়া বলল, “বারো ঘন্টা আগে তিষা আহমেদ নামে পনেরো বছরের একটা মেয়ে আর জন উইটক্যাম্প নামে ষোল বছরের একটা ছেলে ইন্টারনেটে একটা ভিডিও আপলোড করেছে। ভিডিওর বিষয়বস্তু হচ্ছে এনিম্যানকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখিয়ে দিলে সেটি সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে কথা বার্তা বলতে পারে। তারা তার উদাহরণ হিসেবে তাদের এনিম্যানকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখিয়ে তার কাছ থেকে অনেক তথ্য বের করে এনেছে, যেগুলো আমাদের কর্পোরেশনের জন্যে ভয়ংকর বিপদজনক।
“ভিডিওটা আমরা খুব সাবধানে পর্যবেক্ষণ করছি। এখনো খুব বেশী মানুষ দেখেনি। কিন্তু যারাই দেখছে তারাই এটা অন্যকে দেখার জন্য উৎসাহিত করছে। কাজেই আমাদের হিসেবে আগামী ছত্রিশঘন্টার মাঝে এটা ভাইরাল হয়ে যাবে, বিয়াল্লিশ ঘন্টার মাঝে এটা জাতীয় পত্রিকায় আর আটচল্লিশ ঘন্টার মাঝে আন্তর্জাতিক খবরে চলে আসবে। এক কথায় আমরা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাব।”
লিডিয়া চুপ করে সবার দিকে তাকাল। সবাই ভাবলেশহীনভাবে যন্ত্রের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইল। লিডিয়া বলল, “আমরা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাব কথাটার অর্থ বুঝতে পারছ? তার অর্থ এই প্রতিষ্ঠানের সবাই আইনী ঝামেলায় পড়ে যাবে। আমাদের বাকী জীবন জেলে কাটাতে হবে।
“আমাদের বেঁচে থাকার একটা উপায়। কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীর মানুষকে বোঝাতে হবে যে এই টিনএজ ছেলেমেয়ের তৈরি ভিডিওটা ভূয়া এবং এই ছেলেমেয়ে দুটো আসলে গ্রহণযোগ্য চরিত্রের নয়। তারা অসৎ, অসামাজিক এবং ড্রাগ এডিক্ট।
“আমরা সেই কাজ শুরু করেছি। তোমরা সবাই জান আমরা পৃথিবীর চলচ্চিত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রাফিক্স সফটওয়ার কিনেছি। একটা সময় ছিল যখন কোনো চলচ্চিত্র তৈরী করার জন্যে অভিনেতা অভিনেত্রীদের পুরা সময় অভিনয় করতে হতো। এখন তার প্রয়োজন হয় না, তোমরা নিশ্চয়ই ব্লক বাস্টার ছবি দি থার্ড আই দেখেছ সেখানে অভিনয় করেছে ক্যারেন মাহিলা আর রিচি কর্ডোনা। তোমরা সবাই জান ছবি তৈরী করার আগে ক্যারেন আর রিচির শরীরের সম্ভাব্য সকল অঙ্গভঙ্গীর ভিডিও করা হয়েছিল। তারপর গ্রাফিক্স সফটওয়ার সেই সম্ভাব্য সকল অঙ্গভঙ্গীকে ব্যবহার করে মূল ছবিটা তৈরী করেছে। ছবিটি দেখে কেউ বুঝতে পারে না যে আসলে এখানে ক্যারেন বা রিচি অভিনয় করেনি।
“আমরা এই সফটওয়ার ব্যবহার করে তিষা আর জনের একটা ভিডিও তৈরি করব। যেখানে দেখানো হবে তিষা আর জন তাদের এনিম্যানকে দিয়ে জোর করে একটিং করিয়ে এই ভিডিওটা তৈরী করেছে। শুধু তাই না আরো একটা ভিডিওতে দেখানো হবে যে তারা আসলে ড্রাগ এডিক্ট, তারা দুইজন ড্রাগ নেয়, নানা ধরনের অপকর্ম করে।”
কনফারেন্স টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা স্কুল মাস্টারের মতো দেখতে শুকনো খিটখিটে একজন মানুষ বলল, “আমরা স্ক্রিপটা তৈরী করেছি। এখন গ্রাফিক্সের কাজ শুরু করব। সে জন্যে আমার এই ছেলে মেয়ের ভিডিও গুলো দরকার।
লিডিয়া বলল, “ভিডিও নেয়া শুরু হয়েছে। তাদেরকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে নানা ধরনের পরিস্থিতি তৈরী করে তাদের ভিডিও নেয়া হচ্ছে। তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে, অপমান করা হবে, যন্ত্রণা দেয়া হবে, আনন্দ দেয়া হবে–”
“আনন্দ? আনন্দ কেমন করে দেবে?”
“দুইভাবে। ড্রাগস দিয়ে এবং তাদের পোষা এনিম্যান দিয়ে। পোষা এনিম্যানটা তাদের কাছে রাখব, সেটাকে দেখলে তারা নিশ্চয়ই এক ধরনের আনন্দ পাবে।”
শুকনো খিটখিটে মানুষটা বলল, “ যাই হোক আমি ডিটেলসে যাচ্ছি না। আমার টিম রেডি। তুমি যত তাড়াতাড়ি আমাকে ভিডিও ফুটেজটা দেবে আমি তত তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করব।”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “আজ রাতের মাঝে তুমি পেয়ে যাবে।”
“আমি অন্য একটা শরীর ব্যবহার করে কাজ শুরু করে দিয়েছি। তোমার ভিডিও ফুটেজ পেলে আসল শরীর বসিয়ে দেব।”
“চমৎকার।” লিডিয়া বলল, “মনে রেখো তোমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই শুধু আমরা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারি। এটা হচ্ছে। আমাদের অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন।”
কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই পাথরের মুখ করে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
ঘন্টা খানেক পর লিডিয়া সিস্টেম ম্যানেজারকে তার অফিসে ডেকে পাঠালো। সিস্টেম ম্যানেজার কমবয়সী একজন মেয়ে, লিডিয়ার ঘরে ঢুকে শংকিতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। লিডিয়া জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে যে দায়িত্বটি দিয়েছিলাম তার কী খবর?”
“কাজ চলছে। যতই ডাটা আসছে ততই ভবিষ্যৎবাণী ভালো হচ্ছে।”
“আমাকে দেখাতে পারবে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই পারব।”
মেয়েটি লিডিয়ার টেবিলে বড় মনিটরটিতে লগ ইন করল কিছু গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে সে সরে দাঁড়াল, বলল, “বাম দিকে আসল মানুষ দুজন। ডানদিকে তাদের ভবিষ্যৎবাণী।”
লিডিয়া তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দুটো ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। বামদিকের ছবিতে তিষা সোফায় বসে আছে, কাছাকাছি আরেকটি সোফায় হেলান দিয়ে জন মেঝেতে বসে আছে। ডান দিকের ছবিটিও প্রায় একই রকম শুধু জন সোফায় হেলান না দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। সুপার কম্পিউটারের সবচেয়ে চমকপ্রদ যে প্রোগ্রামটি ব্যবহার করা হচ্ছে এটি সেই সফটওয়ারের আউটপুট। একজন মানুষ সম্পর্কে তার সব তথ্য দিয়ে দেয়ার পর সেই মানুষটি কখন কী করবে সেটি এই সফটওয়ার প্রায় নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারে।
বাম দিকের ছবিতে দেখা গেল জন উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে পায়চারী শুরু করেছে। ডানদিকেও দেখা গেল জন উঠে ঘরে পায়চারী করছে। সফটওয়ারটি নিখুঁতভাবে সেটি বলে দিতে পেরেছে।
লিডিয়া সম্ভষ্টির ভঙ্গী করে বলল, “তুমি কতোক্ষণ পর্যন্ত ভবিষ্যত্বাণী করতে পারবে?”
“এক ঘন্টা প্রায় নিখুঁত হয়। তারপর ধীরে ধীরে ছোটখাটো বিচ্যুতি দেখা দিতে পারে।”
“আমরা কী বিষয়টা পরীক্ষা করতে পারি।”
“কীভাবে পরীক্ষা করতে চাও?”
লিডিয়া বলল, “যদি আমরা এই দুজনের ঘরের দরজা খুলে তাদেরকে ছেড়ে দিই তাহলে তারা কখন কোথায় থাকবে সেটা কী ভবিষ্যৎবাণী করতে পারবে?”
“পারার কথা।”
“কখন কোথায় যাবে, কী করবে সেটা বলতে পারবে?”
“পরের এক ঘন্টা নিখুঁতভাবে পারব। যদি এই ছেলে মেয়ের আরো কিছু ডাটা থাকে তাহলে আরো নিখুঁতভাবে পারার কথা।”
“চমৎকার।” লিডিয়া বলল, “তুমি এখন যেতে পার।”
মেয়েটি চলে যাবার পর লিডিয়া কিছুক্ষণ মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর কী বোর্ডটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে সেখানে নিজের নামটি টাইপ করে। লিডিয়া তার নিজের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীটি দেখতে চায়।
লিডিয়া দেখল আটচল্লিশ ঘন্টার মাথায় একজন মানুষ তার মাথায়। গুলী করছে। মানুষটির চেহারা এখনো স্পষ্ট নয়। ধীরে ধীরে হয়তো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
লিডিয়া হিংস্র মুখে কী বোর্ডটি ছুঁড়ে দিয়ে হিস হিস করে বলল, “না! এটা হতে পারে না। এটা হতে পারবে না।”
১৭. দরজাটা খুট করে খুলে
দরজাটা খুট করে খুলে ভেতরে একজন মানুষ ঢুকল। সে এক হাতে মিশকাকে ধরে রেখেছে। গত কয়েক ঘন্টায় দরজাটা অনেকবার খুট করে খুলেছে এবং অনেক রকম মানুষ এসেছে। অনেক কিছু করে গেছে। তাই প্রত্যেকবার যখন খুট করে দরজাটা খুলে যায় তিষা আর জন ভয় পেয়ে চমকে ওঠে।
এই প্রথম বার তারা ভয় পেয়ে চমকে উঠল না। মিশকাকে দেখে তাদের দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিষা হাত বাড়িয়ে বলল, “মিশকা! তুমি।”
মিশকা মানুষটির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে তিষার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিষা মিশকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে বলল “কোথায় ছিলে তুমি দুষ্ট ছেলে? কোথায় ছিলে?”
এরকম সময় সব সময় মিশকা যা করে তাই করল, খিল খিল করে হাসল। তারপর সেও তার ছোট ছোট শীতল হাত দিয়ে তিষার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিল, তারপর তার গালে চুমু খেল।
তিষা ভেবেছিল মানুষটি বুঝি সারাক্ষণই দাঁড়িয়ে থাকবে, কিন্তু মানুষটি মিশকাকে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। খুট করে আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
মিশকা তার হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “তুমি বন্ধ। তুমি ঘরে বন্ধ। তুমি কেন ঘরে বন্ধ?”
তিষা বলল, “আমরা তো জানি না কেন আমাদের ঘরে বন্ধ করে রেখেছে।”
মিশকা বলল, “খারাপ। মানুষ খারাপ।”
তিষা বলল, “হ্যাঁ। মানুষগুলো খুব খারাপ।“
মিশকা বলল, “এখানে না। বাসা যাব।”
তিষা ম্লান মুখে হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমরা কি এখানে থাকতে চাই? চাই না। আমরাও তো বাসায় যেতে চাই। বাসায় আব্বু আম্মু না জানি কতো চিন্তা করছে।” কথা বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলল, মিশকা কী করবে বুঝতে পারে না, একটু হাসে তারপর তিষার চোখ মুছে দেয়।
জন বলল, “যদি কোনোভাবে এই ঘর থেকে বের হতে পারতাম। তাহলে চেষ্টা করে দেখতাম।”
তিষা বলল, “কেমন করে ঘর থেকে বের হবে?”
“সেটাই তো জানি না।” মি
শকা সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “দুই চার দুই পাঁচ।”
জন জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী?”
“দরজা।”
“দরজার কী?”
মিশকার ভাষা জ্ঞান যথেষ্ট না তাই সে ঠিক বোঝাতে পারল না, কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।
আধা ঘন্টা পর আবার খুট করে দরজা খুলে গেল। আগের মানুষটি এসে মিশকাকে তিষার কোল থেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মিশকা যেতে চাচ্ছিল না। দুই হাত দিয়ে তিষাকে ধরে রাখল কিন্তু লাভ হল না। মানুষটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে সরিয়ে নিল।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তিষা দরজায় একটু খুট খুট শব্দ শুনতে পেল, মনে হল কেউ দরজা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু খুলতে পারছে না। তিষা দরজায় কান লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কী হচ্ছে, কেন জানি তার মনে হল এখানকার কোনো মানুষ নয় মিশকা দরজা খোলার চেষ্টা করছে!
সত্যি সত্যি হঠাৎ দরজা খুলে গেল এবং দেখা গেল দরজার সামনে মিশকা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিজয়ীর মতো হাসি। সে বলল, “দুই চার দুই পাঁচ।”
তিষা আর জন এবারে দুই চার দুই পাঁচের রহস্যটা বুঝতে পারে। দরজার বাইরে যে ইলেকট্রনিক নাম্বার লক লাগানো সেটা খুলতে নাম্বার প্যাডে দুই চার দুই পাঁচ নম্বর বোতামে চাপ দিতে হয়। মিশকাকে নিয়ে যখন মানুষটি এসে দরজা খুলেছে তখন মিশকা সেটা লক্ষ্য করেছে। এখন সে নিজে এসে দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু সে কোথা থেকে এসেছে? কেমন করে একা একা চলে এসেছে? [ মিশকা নিজেই বলল যে তাকে একটা ঘরে তালা মেরে রেখেছিল। সেই ঘরের ছাদে বাতাস প্রবাহের যে সরু ডাক্ট আছে তার ভেতর দিয়ে সে বের হয়ে এসেছে। মানুষগুলো বুঝতে পারেনি সে এভাবে পালিয়ে যেতে পারবে। তিষা তার পিঠ চাপড়ে বলল, “চমৎকার কাজ মিশকা!
মিশকা বিজয়ীর মতো মুখ ভঙ্গি করে হাসল। তিষা বলল, “চল, এখন পালাই।”
জন বলল, “চেষ্টা করি। কিন্তু খুব বেশী দূর পালিয়ে যেতে পারব বলে মনে হয় না। আবার আমাদের ধরে ফেলবে।“
“তবু চেষ্টা করি।”
মিশকাকে কোলে নিয়ে তিষা আর জন খুব সাবধানে ঘর থেকে বরে হল। এদিক সেদিক তাকিয়ে যখন দেখল কেউ নেই তখন সাবধানে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। আশে পাশে যে এই মূহুর্তে কোনো মানুষ নেই। সেটা অনেক ভাগ্যের কথা।
ঠিক সেই মুহূর্তে সুপার কম্পিউটারের সিস্টেম ম্যানেজার, এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়েছিল। একটা এনিম্যান যে দরজার কোডটা মনে রেখে সেই কোড ব্যবহার করে দরজাটা খুলে ফেলতে পারবে সেটা সে কখনো কল্পনা করেনি। কী ভাবে এনিম্যানটা মুক্ত হয়ে এসেছে সেটা সে এখনো জানে না। খোঁজ নিতে হবে। কিন্তু একদিক ভালোই হল, তার সফটওয়ারটির একটা ফিল্ড টেস্ট হবে! এই ছেলে আর মেয়ে জানে না তাদের সম্পর্কে সব তথ্য এমন ভাবে লোড করা আছে যে আগামী এক ঘন্টা তারা কী করবে সে এখানে বসে নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারবে। ইচ্ছে করলেই সে এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিতে পারে কিন্তু সেটা করল না। আজ রাতে সবাই পাগলের মতো কাজ করছে। এর মাঝে হঠাৎ একটা এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে আলাদাভাবে দুশ্চিন্তিত করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। সে জানে ঠিক কোথায় তাদেরকে পাওয়া যাবে, সিকিউরিটির মানুষ দিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে আসলেই হবে।
তাই সিস্টেম ম্যানেজার সিকিউরিটির মানুষটিকে জানিয়ে দিল ঠিক দশ মিনিট পর করিডোরের শেষ মাথায় সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে থাকা তিষা আর জনকে ধরে নিয়ে আসার জন্যে। এর আগে সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দশ মিনিট পর তিষা আর জন সেখানে লুকিয়ে থাকবে।
.
ঘর থেকে বের হয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিষা জনকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন কোনদিকে যাব?”
জন মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। কোনোভাবে ধরা না পড়ে একটু হেঁটে হেঁটে আগে জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করি।”
“লুকিয়ে থাকতে হবে।”
তিষা বলল, “ঐ যে সিঁড়ির নিচে মনে হয় কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকা যাবে।”
জন বলল, “হ্যাঁ চল ওদিকে এগিয়ে যাই।”
মিশকা হঠাৎ করে তিষার হাত ধরে অন্যদিকে টেনে নিতে থাকে। তিশা একটু অবাক হয়ে মিশকাকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মিশকা জানাল, “আস। আমার সাথে আস।”
“কোথায়?”
“আমাদের ঘরে?”
“তোমাদের ঘরে?”
“হ্যাঁ।”
“কী আছে তোমাদের ঘরে।”
“আমরা আছি।”
“তোমরা?” “
হ্যাঁ।”
কোথায় যাবে সেটা যেহেতু তারা কেউই জানে না তাই মিশকা যেখানে নিয়ে যেতে চাইছে তারা সেদিকেই রওনা দিল। মিশকা মনে হয় এলাকাটা বেশ ভালো ভাবে চিনে, নানা ধরনের ছোট বড় করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে তারা বড় একটা গুদাম ঘরের মতো জায়গায় পৌঁছাল। একটা বড় লোহার গেট। গেটে ইলেকট্রনিক তালা।
মিশকা বলল, “তিন তিন সাত চার।”
সংখ্যটা কী এবারে তারা চট করে বুঝে গেল। তিষা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে জান?
“আমি দেখেছি। একটু আগে আমাকে নিয়ে তিন তিন সাত চার করে ভিতরে ঢুকেছে।”
তিষা ইলেকট্রনিক তালায় তিন তিন সাত চার সংখ্যা ঢুকাতেই তালাটা খুট করে খুলে গেল। ভারী লোহার গেটটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে তিষা আর জন হতবাক হয়ে গেল। ফুটবল মাঠের মতো বিশাল একটা হল ঘর সেখানে যতদূর তাকানো যায় ততদূর শুধু এনিম্যান আর এনিম্যান। হাজার হাজার নয়, মনে হয় লক্ষ লক্ষ এনিম্যান! গেট খোলার শব্দ শুনে সবগুলো এনিম্যান তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, বড় বড় চোখে এক ধরনের কৌতূহল আর বিস্ময়। তিষা আর জন হতবাক হয়ে এই অসংখ্য এনিম্যানগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
তিষা এক পা এগিয়ে যেতেই সবগুলো এনিম্যান তার থেকে সরে যায়। সে একটা চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেল। তিষা জানে এই হাসির শব্দ আসলে প্রকৃত হাসি নয়। এটা তাদের ভয় পাওয়ার প্রতিক্রিয়া। হাসি কান্না দুঃখ ভয় সবকিছুর জন্যেই তাদের একটা মাত্র প্রতিক্রিয়া সেটা হচ্ছে হাসি। এনিম্যানগুলো তাদেরকে দেখে ভয় পেয়েছে।
তিষা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে একটা এনিম্যানকে ডাকল। এনিম্যানটা একটু সরে গিয়ে কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তিষা সাবধানে তার হাতটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে এনিম্যানটাকে আস্তে আস্তে স্পর্শ করে। এনিম্যানটাও তখন খুব সাবধানে তিষার হাতটা স্পর্শ করল। তিষা হাসি হাসি মুখে এনিম্যানটাকে নিজের কাছে ডাকল, তখন এনিম্যানটা খুব সতর্ক ভাবে তিষার কাছে এগিয়ে আসে।
তিষা তাকে সাবধানে কোলে তুলে নেয়, তারপর আদর করে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এনিম্যান শিশুটি এই আদরটুকু বুঝতে পারল এবং হঠাৎ করে তার ভেতরে তিষাকে নিয়ে যে দ্বিধা বা সংকোচ ছিল তার সবটুকু দূর হয়ে গেল। এনিম্যান শিশুটি তখন তিষার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে। তিষা হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার সামনে এই বিশাল হলঘরের হাজার হাজার এনিম্যান শিশুর সবাই আসলে ভালোবাসার কাঙ্গাল। তাদের জন্যে কেউ কখনো ভালোবাসা দেখায়নি। তাদেরকে কেউ কখনো আদর করেনি। এগুলো মানবশিশু কিন্তু তারা কখনো মানুষের সম্মান, মানুষের মায়া মমতা পায়নি।
একটি একটি করে এনিম্যান শিশুগুলো তখন তিষা আর জনের দিকে হেঁটে আসতে থাকে। তারা সেগুলোকে কোলে নেয় আদর করে। এরা সবাই একটি করে মানব শিশু। একটি মানব শিশুর আসলে বিশাল হলঘরে এভাবে গাদাগাদি করে থাকার কথা নয়। তাদের মায়ের ভালোবাসা নিয়ে বড় হবার কথা। তিষা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই শিশুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর মানুষ কেমন করে এতো বড় একটা অবিচারকে মেনে নিল?
তিষা মেঝেতে বসে এনিম্যান শিশুগুলোকে আদর করতে থাকে। তারা ভয়ংকর একটা বিপদে আছে, তাদের কী হবে তারা জানে না, কিন্তু এই মুহূর্তে তিষার আর কিছুই মনে রইল না, সে শুধু মাত্র ভালোবাসার কাঙ্গাল এই মানব শিশুগুলোর দিকে গভীর মমতা নিয়ে তাকিয়ে রইল।
.
লিডিয়া হিংস্র গলায় বলল, “কী বলছ হারিয়ে গেছে?”
কম বয়সী সিস্টেম ম্যানেজার শুকনো মুখে বলল, “ছেলেটা আর মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্র্যাগনন সুপার কম্পিউটার যেখানে থাকবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছে সেখানে নেই। আমাদের সিকিউরিটি তন্ন
তন্ন করে খুঁজছে, ওদের পাওয়া যাচ্ছে না।”
“তোমার সুপার কম্পিউটার ভুল ভবিষ্যত্বাণী করছে?”
“তাইতো দেখছি।” লিডিয়া টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “এটা কীভাবে সম্ভব?”
“বুঝতে পারছি না।” সিস্টেম ম্যানেজার শুকনো গলায় বলল, “আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।”
“কী সন্দেহ?”
“ক্র্যাগনন সুপার কম্পিউটার এই ছেলেটা আর মেয়েটার সব তথ্য লোড করেছে তাই তারা কখন কী করবে বের করে ফেলতে পারে। কিন্তু তার কাছে এনিম্যানটার কোনো তথ্য নাই। যদি এনিম্যানটা কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সুপার কম্পিউটার সেটা সম্পর্কে জানবে না। তাই ভুল ভবিষ্যত্বাণী করবে।”
“তুমি বলতে চাইছ এই ছেলেটা আর মেয়েটা নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে চলছে না? একটা এনিম্যানের বুদ্ধি দিয়ে চলছে?”
“আমি সেটাই সন্দেহ করছি।”
লিডিয়া দাঁতে দাঁত চেপে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “এখন তোমরা কী করছ?”
“পুরানো কায়দায় ছেলেটা আর মেয়েটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সিসি টিভির ফুটেজ দেখা হচ্ছে। সিকিউরিটির মানুষেরা ঘরে ঘরে গিয়ে খুঁজছে।”
“আমার হাতে সময় নেই। এই ছেলে আর মেয়েটাকে আমার দরকার। এই মুহূর্তে দরকার।”
সিস্টেম ম্যানেজার বলল, “আমরা পেয়ে যাব। নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। আমাদের এখানে মানুষ খুব কম। এত বিশাল একটা কম্পাউন্ড এতো অল্প কয়েকজন মানুষ দিয়ে চালানো হয় সেটাই হচ্ছে সমস্যা।”
লিডিয়া কঠিন মুখে বলল, “আমি কোনো কৈফিয়ত শুনতে চাই না। দশ মিনিটের মাঝে আমি এই ছেলে আর মেয়েটাকে চাই।”
সিস্টেম ম্যানেজার নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
জন আর তিষাকে খুঁজে বের করতে সিকিউরিটির মানুষগুলোর অবিশ্যি দশ মিনিট থেকে বেশী সময় লাগল না। সিসি ক্যামেরাতে দেখা গেছে তারা দুজন একটা এনিম্যানকে নিয়ে বড় হলঘরের দিকে এগিয়ে গেছে। সিকিউরিটির মানুষেরা হলঘরে গিয়েই তাদের পেয়ে গেল। হাজার হাজার এনিম্যান শিশু ছোটাচ্চুটি করছে, তার মাঝে তিষা আর জন খুব সাবধানে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এনিম্যান শিশুগুলো প্রথমে তাদের থেকে দূরে দূরে ছিল, কীভাবে বুঝে গেছে তাদেরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তখন তাদের কাছে এসে ভীড় করেছে। জন আর তিষা হলঘরের শেষ মাথায় যেতে চাইছিল, সেখানে কয়েকটা উঁচু জানালা রয়েছে। এই জানালা দিয়ে বের হওয়া যায় কী না তারা একবার চেষ্টা করে দেখতে চাইছিল কিন্তু তার আর সুযোগ হল না। বড় লোহার গেট খুলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে পাহাড়ের মতো দুইজন সিকিউরিটি গার্ড হলঘরে ঢুকে গেল।
সাথে সাথে এনিম্যান শিশুগুলো ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। আনন্দ বেদনা দুঃখ বা আতংক সবকিছুতেই তাদের প্রতিক্রিয়া এক রকম, তাই তারা খিল খিল করে হাসতেও শুরু করে। ভয়ংকর আতংকে যখন কেউ হাসতে থাকে সেটি অত্যন্ত বিচিত্র একটি দৃশ্য। তিষা আর জন বিশাল হলঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে এনিম্যান শিশুদের এই বিচিত্র প্রতিক্রিয়াটির দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সিকিউরিটি গার্ডের একজন চিৎকার করে বলল, “তোমাদের পালানোর কোনো জায়গা নেই। আমাদের সাথে এসো।” কথা বলেই সে শেষ করল না তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তিষা আর জনের দিকে এগুতে থাকে। এনিম্যান শিশুগুলো সরে গিয়ে গার্ডকে জায়গা করে দেয়। তিষা আর জনের কাছাকাছি গিয়ে সিকিউরিটি গার্ড তার হাতের অস্ত্রটা ঝাকুনী দিয়ে বলল, “এসো।”
তিষা আর জন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। তাদের আর, কিছু করার নেই। সিকিউরিটি গার্ড আবার তার হাতের অস্ত্র ঝাঁকুনি দিয়ে। বলল, “চল আমাদের সাথে।”
তিষা আর জন এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু সাথে সাথে এনিম্যান শিশুরা তাদেরকে জাপটে ধরে, তারা তিষা আর জনকে যেতে দেবে না। একটি শিশুর গায়ে তেমন জোর না থাকতে পারে কিন্তু যখন একসাথে অনেকে জাপটে ধরে তখন সেটা একজনকে আটকে ফেলার জন্যে যথেষ্ঠ। তারা জোর করে এগুতে চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হলো না। এনিম্যান শিশুরা কথা বলতে পারে না, তাদের একমাত্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে হাসি তাই তারা তিষা আর জনকে জাপটে ধরে খিল খিল করে হাসতে থাকে।
সিকিউরিটি গার্ড তখন এগিয়ে এসে এনিম্যান শিশুদের প্রথমে হাত দিয়ে ধরে টেনে সরিয়ে দেয়, তাতে খুব একটা লাভ হয় না একজনকে সরাতেই অন্য একজন ছুটে এসে ধরে ফেলে। সিকিউরিটি গার্ড তখন শক্ত বুট দিয়ে লাথি মেরে তাদেরকে সরিয়ে দিতে থাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় এনিম্যান শিশুদের আর্তনাদ করার কথা-তারা আর্তনাদ করতে পারে না তাই তারা এবারে অট্টহাসির মতো শব্দ করতে থাকে।
এনিম্যান সিকিউরিটি গার্ড দুজন শেষ পর্যন্ত তাদেরকে শক্ত করে তাদের কাপড় ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে টেনে নিতে থাকে। হলঘরের হাজার হাজার এনিম্যান শিশু নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে, তাদের মুখে হাসি কিন্তু সেই হাসিতে কোনো আনন্দ নেই।
.
তিষা আর জনকে যখন লিডিয়ার ঘরে আনা হল। তখন লিডিয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে তার মনিটরে একটা ভিডিও দেখছে, পায়ের শব্দ শুনে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। সেই মুহূর্তে মনিটরে তিষা আর জনের একটি দৃশ্য, তারা খুবই অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে একজন অন্যজনকে ধরে রেখেছে, জনের হাতে একটা সিরিঞ্জ। ভিডিওতে দেখা গেল তিষা তার বাম হাতটি এগিয়ে দিয়েছে তখন জন সেখানে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিষা তীব্র আনন্দের একটা শব্দ করল, দেখতে দেখতে তার শরীর কাঁপতে থাকে।
তিষা হতবাক হয়ে ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এই ভিডিওটি কীভাবে তৈরী করেছে? লিডিয়া সিকিউরিটি গার্ড দুজনের দিকে তাকিয়ে। বলল, “এক্সিকিউশান টিমকে খবর দাও।”
“খবর দেওয়া হয়েছে।”
“আমাদের হাতে সময় নেই। খুব দ্রুত শেষ করতে হবে।”
“ঠিক আছে।” গার্ডটি সাথে সাথে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
তিষা মনিটরটির দিকে দেখিয়ে বলল, “এই ভিডিও কী ভাবে তৈরী করেছ?”
লিডিয়া বলল, “পছন্দ হয়েছে?”
“কীভাবে তৈরী করেছ?”
“পুরোটা দেখলে তোমরা মুগ্ধ হতে। দেখতে চাও?”
তিষা মাথা নাড়ল, বলল, “না। দেখতে চাই না।”
লিডিয়া হাসার ভঙ্গী করল, তার মুখের মাংশপেশি হাসিতে অনভ্যস্ত তাই তার হাসিটি কেমন যেন ভয়ংকর দেখায়। মুখে ভয়ংকর সেই হাসিটি ফুটিয়ে রেখে বলল, “আর কয়েক মিনিটের মাঝে আমরা তোমাদের দুইজনকে মেরে ফেলব তাই তোমাদের বলতে এখন কোনো সমস্যা নেই।”
তিষা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, আতংকের একটা শীতল স্রোত তার মাথা থেকে মেরুদণ্ড দিয়ে নিচের দিকে বয়ে যেতে থাকে। সে জনের দিকে তাকাল, জন মানুষের ঠোঁটের ভঙ্গী দেখে কথা বুঝে নেয়, সবসময় যে সমান ভাবে বুঝতে পারে তা নয়। এতো সহজে কাউকে মেরে ফেলার কথা বলা যেতে পারে জন সেটা জানে না তাই সে লিডিয়ার কথাটা বুঝতে পেরেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তিষার আতংকিত মুখ দেখে বুঝতে পারল কথাটা সত্যি, লিডিয়া সত্যিই তাদের মেরে ফেলার কথা বলছে।
লিডিয়া বলল, “আমাদের ভিডিওটাতে দেখানো হয়েছে তোমরা কীভাবে পরিকল্পনা করেছ যে আমাদের ব্ল্যাকমেল করার জন্যে তোমরা তোমাদের এনিম্যানকে নিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানোর একটা ভূয়া ভিডিও তৈরী করবে। তারপর দেখানো হবে তোমরা এনিম্যানের হাত ধরে সেই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাকে দিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজের ভান করে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলাচ্ছ–দেখতে চাও?”
তিষা মাথা নাড়ল, সে দেখতে চায় না। সত্যি কথা বলতে কী কোনো। কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না। ভয়ংকর একটা আতংকে তার মাঝে এখন ক্রোধ হতাশা দুঃখ বা অন্য কোনো অনুভূতি নেই। লিডিয়া টেবিলে টোকা দিতে দিতে বলল, “ভিডিওটার শেষ দৃশ্যে দেখানো হবে তোমরা ড্রাগ নিতেই থাকবে, নিতেই থাকবে। ড্রাগের ওভারডোজ হয়ে তোমরা মারা যাবে। উদ্ধৃঙ্খল লোভী অনৈতিক দুশ্চরিত্র দুইজন টিন এজারের অকাল মৃত্যু। সেই মৃত্যু দেখে কারো মনে বিন্দুমাত্র সমবেদনা হবে না। আমরা পুরোটা একটু একটু করে তৈরী করেছি–পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সফটওয়ার ব্যবহার করে সেটা একটু একটু করে তৈরী হয়েছে। শেষ দৃশ্যটা আমরা তৈরী করব না। শেষ দৃশ্যটি হবে অরিজিনাল, সেইজন্যে আমরা তোমাদের এখানে ধরে এনেছি। খাঁটি ড্রাগস ওভারডোজ করে আমরা তার ভিডিও নিব! সেটা ব্যবহার করব। কী মনে হয় তোমাদের, আমাদের পরিকল্পনায় কোনো খুঁত আছে?”
তিষা আর জন কেউ কোনো কথা বলল না। তিষা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল, পৃথিবীতে সত্যিই এরকম মানুষের জন্ম হতে পারে? একজন মানুষ সত্যিই এরকম রাক্ষুসী হতে পারে?
লিডিয়া তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, হেঁটে হেঁটে তিষার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নিজের একটা দেশ ছিল, গরীব মানুষের দেশ, সেই দেশ ছেড়ে বড়লোকের দেশে এসেছ। কাজটা ভালো হয় নাই। নিজের দেশে থাকলে ড্রাগ ওভারডোজে মারা যেতে না। এখন তোমাকে ড্রাগ ওভারডোজে মারা যেতে হবে! কেমন লাগছে চিন্তা করে?”
লিডিয়া তার মুখটা তিষার একেবারে কাছাকাছি নিয়ে আসে, তিষার কী মনে হল কে জানে হঠাৎ প্রচণ্ড ঘৃণায় থু করে লিডিয়ার মুখে থুতু ফেলল। ঘরে যারা ছিল তারা এতো চমকে উঠল যে সবাই কয়েকমুহূর্ত স্থির হয়ে রইল। তিষাকে যে সিকিউরিটি গার্ড ধরে রেখেছিল, সে খপ করে তার হাত ধরে মোচড় দিতেই তিষা ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ড তাকে মারার জন্যে হাত উপরে তুলল, লিডিয়া তাকে থামাল, বলল, “না গায়ে হাত দেবে না। শরীরে মারের বা আঘাতের চিহ্ন থাকতে পারবে না।”
লিডিয়ার চোখ এবং গালে তিষার থুতু ল্যাপটে আছে, সে টেবিল থেকে একটা টিস্যু তুলে তার মুখটা মুছে নেয়। টিসুটার দিকে তাকিয়ে তার মুখটা ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে যায়। সে মাথা ঘুরিয়ে তিষার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করে বলল, “মেয়ে তোমার খুব সৌভাগ্য যে তোমার ড্রাগ ওভারডোজ হয়ে খুব আনন্দের একটা মৃত্যু ঠিক করে রাখা আছে সেটা আর পাল্টানো যাবে না। কিন্তু জেনে রাখ আমি তোমার বাবা মা থেকে শুরু করে তোমার চৌদ্দগুষ্টির সবাইকে টিপে টিপে পোকার মতো মারব!”
ঠিক তখন দরজা খুলে কয়েকজন ঘরে ঢুকল। সবার সামনে সাদা গাউন পরা একজন বয়স্ক মানুষ। হাতে একটা ব্যাগ। ভেতরে ঢুকেই টেবিলে ব্যাগটা রেখে সেখান থেকে একটা সিরিঞ্জ, কয়েকটা এমপুল বের করে সে কাজ শুরু করে দেয়। তাকে দেখে মনে হল এই ঘরে যে অন্য মানুষেরা আছে সেটা সে লক্ষ্য পর্যন্ত করে নি।
বয়স্ক মানুষটির পেছন পেছনে বেশ কয়েকজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের কারো হাতে টেলিভিশন ক্যামেরা কারো হাতে স্ট্যান্ডের উপর লাগানো লাইট, কারো হাতে রিফ্লেক্টর। সবার শেষে দুজন মানুষের হাতে বড় একটা সবুজ রংয়ের পর্দা।
চশমা পরা স্কুল মাস্টারের মতো দেখতে শুকনো একজন লিডিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় শুট করব?”
লিডিয়া বলল, “সেটা তোমাদের ব্যাপার। তোমরা ঠিক কর।”
স্কুল মাস্টারের মতো মানুষটি চারিদিকে তাকিয়ে জানালার কাছাকাছি একটা জায়গা দেখিয়ে তার লোকদের বলল, “ক্রমা কীয়ের জন্যে সবুজ স্ক্রিনটা এখানে টানাও।”
মানুষগুলো তখন তখনই কাজে লেগে গেল। স্কুল মাস্টারের মতো মানুষটি তখন অন্য মানুষগুলোকে বলল, “তোমরা লাইটিং শুরু কর। ন্যাচারল লাইটিং হবে, বিকাল বেলা, গাছের ছায়ার কাছাকাছি।”
মানুষগুলো মাথা নেড়ে তাদের ঘাড়ে করে আনা স্টুডিও লাইটগুলো বসাতে শুরু করে।
লিডিয়া জিজ্ঞেস কলল, “কতোক্ষণ লাগবে?”
স্কুলমাস্টার বলল, “খুব বেশী হলে দশ মিনিট।”
লিডিয়া তখন ডাক্তারের মতো মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার?”
মানুষটি বলল, “আমি রেডি।“
লিডিয়া তখন তিষা আর জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের আয়ু আর দশ মিনিট। যা কিছু দেখার আছে দেখে নাও।” কথা শেষ করে লিডিয়া আবার হাসার চেষ্টা করল, হাসতে অনভ্যস্ত তার মুখের মাংশপেশী আবার বিকৃত একটা ভঙ্গীতে কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
ভিডিও ক্যামেরা হাতে মানুষগুলো খুবই দক্ষ, তারা দশ মিনিটের আগেই সবকিছু রেডি করে ফেলল। স্কুল মাস্টার লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা রেডি।”
লিডিয়া তখন তিষা আর জনের দিকে তাকিয়ে জিব দিয়ে সমবেদনার ভঙ্গীতে চুক চুক শব্দ করে বলল, “আমি খুবই দুঃখিত, বেঁচে থাকার জন্যে তোমাদের দশ মিনিট সময়ও দেওয়া গেল না। বুঝতেই পারছ আমাদের তাড়াহুড়ো আছে।” তারপর সিকিউরিটি গার্ডদের বলল, “এদের স্টেজে নিয়ে এস।”
সিকিউরিটি গার্ড ওদেরকে টেনে নিয়ে আসতে থাকে। লিডিয়া স্কুল মাস্টারকে বলল, “মনে রেখো, তোমাদের কিন্তু দ্বিতীয়বার শুট করার সুযোগ নেই।”
স্কুল মাস্টার বলল, “আমি জানি। দ্বিতীয়বারের প্রয়োজন হবে না। মৃত্যু দৃশ্যে অভিনয় সব সময় খুবই খাঁটি হয়।”
কথাটাকে একটা উঁচু দরের রসিকতা বিবেচনা করে ঘরের সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।
তিষা আর জনকে যখন স্টুডিও লাইটগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে তখন হঠাৎ ঝটকা মেরে নিজেকে মুক্ত করে জন তাকে ধরে রাখা সিকিউরিটি গার্ডের দুই পায়ের মাঝখানে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে সে একটা হিংস্র স্বাপদের মতো লিডিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লিডিয়া কিংবা ঘরের কেউ এর জন্যে প্রস্তুত ছিল
–লিডিয়া প্রচণ্ড ধাক্কায় হুড়মুড় করে পিছনে পড়ে গেল। টেবিলটা ধরে সে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করতে চাইল কিন্তু পারল না, তার মাথা শব্দ করে মেঝেতে আঘাত করে এবং মুহূর্তের জন্যে তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। জন তার বুকের উপর বসে দুই হাতে লিডিয়ার মুখে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে মুহূর্তের মাঝে লিডিয়ার নাক মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়।
সবাই ছুটে এসে জনকে পিছন থেকে ধরে টেনে সোজা করে-লিডিয়া কোনোমতে উঠে বসে বিড় বিড় করে বলল, “খবরদার ওর গায়ে হাত দিও না। ওর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকতে পারবে না।”
সবাই মিলে জনকে ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়, তার সিকিউরিটি গার্ডটি তখনো দুই পায়ের মাঝখানে ধরে বাঁকা হয়ে শুয়ে কোকাচ্ছিল, চোখে আগুন ঝরিয়ে সে জনের দিকে তাকিয়ে একটা কুৎসিত গালি দিল।
লিডিয়া হাত দিয়ে তার নাক মুখ থেকে রক্ত মুছে তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হতে থাকে সে বুঝি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
লিডিয়া টেবিলটা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “কাজ শেষ করো। এই দুই নর্দমার কীটকে তাদের সত্যিকার জায়গায় পাঠাও। এই মুহূর্তে।”
বেশ কয়েকজন তখন শক্ত করে দুইজনকে ধরে রাখে, ডাক্তারের মতো দেখতে বয়স্ক মানুষটা সিরিঞ্জটা নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। যারা জন আর তিষাকে ধরে রেখেছে তাদেরকে বলল, “ইঞ্জেকশান পুশ করার সময় ধরে রেখ। যখন আমি বলব তখন ছেড়ে দিও।”
তিষা জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “গুড বাই জন। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
জন ফিসফিস করে বলল, “আমিও তোমাকে ভালোবাসি তিষা। সবসময়।”
ডাক্তারের মতো মানুষটা সিরিঞ্জ হাতে প্রথমে জনের দিকে এগিয়ে গেল।
হঠাৎ করে ঘরের সবাই এক সাথে স্থির হয়ে গেল। তারা বহুদূর থেকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। ঘরের মেঝেতে মৃদু এক ধরনের কাঁপন অনুভব করে। সবাই বিস্মিত হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাল, ঢেউয়ের মতো শব্দটা ধীরে ধীরে ছোট শিশুদের সম্মিলিত হাসির মতো শোনাতে থাকে আর মৃদু কম্পনটা অসংখ্য ছোটছোট পায়ের শব্দের মতো শোনাতে থাকে। সবাই বুঝতে না পারলেও তিষা সাথে সাথে বুঝে গেল কী ঘটেছে। তার মিশকা এনিম্যান শিশুদের বুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসছে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য।
সবাই এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে দরজার দিকে তাকালো এবং হঠাৎ করে দরজাটা ধড়াম করে খুলে যায় এবং বন্যার পানির মতো অসংখ্য এনিম্যান ঘরের ভেতরে এসে ঢুকে আর মুহূর্তে সারা ঘরে তারা ছড়িয়ে পরে। সংখ্যায় তারা একজন দু’জন নয়, অসংখ্য। তারা একে অনের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। দেখতে দেখতে হাজার হাজার এনিম্যান শিশু আর তাদের হাসির শব্দে পুরো ঘরটা ভরে যায়। এনিম্যান শিশুগুলো খালি হাতে আসেনি। তাদের হাতে ছোট পাথর, কাঠি, কাঁচের টুকরো, কাঁটা, চামুচ বা কিছু একটা আছে। তারা শুধু আসিনি তাদের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। যতোগুলো মানুষ ছিল তাদের প্রত্যেকের শরীর বেয়ে তারা উপরে উঠতে থাকে। তারা খিল খিল করে হাসির শব্দ করতে করতে মানুষগুলোকে আঘাত করতে থাকে। জন আর তিষা অবাক হয়ে দেখল ঘর বোঝাই হবার পরও তাদের আসা বন্ধ হল না। তারা আসতেই থাকল, একে অন্যের উপর দিয়ে ছুটতে লাগল।
অন্যদের আঘাত করলেও জন আর তিষাকে কিছু করল না। মাঝে মাঝে তাদের শরীর বেয়ে উপরে উঠে তারা তাদের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে আবার নিচে নেমে অন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে।
জন আর তিষাকে যারা ধরে রেখেছিল তারা ততক্ষণে তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে-একটি এনিম্যান শিশু একেবারেই দুর্বল, তাদের হাতের আঘাতে কারো ব্যথা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখন একসাথে হাজার হাজার এনিম্যান শিশু এসে একজনকে জাপটে ধরে তাকে টেনে নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে তখন তারা অসহায়! এনিম্যান শিশুরা যখন তাদের ছোট ছোট হাত দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে তখন সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়।
জন লক্ষ্য করল সিকিউরিটি গার্ডগুলো তাদের হাতের অস্ত্রগুলো দিয়ে এনিম্যান শিশুগুলোকে গুলি করার চেষ্টা করছে, হাজার হাজার এনিম্যান তাদের ধরে রেখেছে বলে তারা অস্ত্রগুলো ঠিক করে ধরতে পারছে না। জন তখন এগিয়ে গিয়ে একজন সিকিউরিটি গার্ডের হাত থেকে তার অস্ত্রটি কেড়ে নিল। তিষার হাতে সেটি দিয়ে সে তখন দ্বিতীয় গার্ডের অস্ত্রটিও কেড়ে নেয়। এনিম্যান শিশুগুলো মানুষগুলোকে টেনে নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তাদের পা ধরে টানতে থাকে, কামড় দিতে থাকে, ধাক্কা দিতে থাকে, লাথি দিতে থাকে।
দেখতে দেখতে মানুষগুলো ঘরের মেঝেতে পড়ে যেতে থাকে তখন এনিম্যানগুলো তাদের হাত পা ধরে রাখে যেন তারা নড়তে না পারে, অন্য অনেকগুলো এনিম্যান তাদের উপর লাফাতে থাকে। লাথি মারতে থাকে, তাদের হাতে কাঁটা চামুচ কাঠি যা কিছু আছে সেটা দিয়ে খোঁচাতে থাকে। তিষা আর জন বিস্ফারিত চোখে দেখল লিডিয়া মেঝেতে পড়ে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, পারছে না। অসংখ্য এনিম্যান শিশু তাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করছে, তার মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করছে কিন্তু এনিম্যান শিশুর হাসির শব্দে সব কিছু চাপা পড়ে গেছে।
তিষা জনকে আঁকড়ে ধরে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “এরা সবাই মেরে ফেলবে।”
জন বলল, “হ্যাঁ।”
তিষা বলল, “আমি সহ্য করতে পারছি না জন। কিছু একটা কর।“
“কী করব? এদেরকে কেমন করে থামাই?”
“মিশকা! মিশকাকে বলে দেখি।”
জন বলল, “এর মাঝে খুঁজে পাবে?”
“দেখি চেষ্টা করে।”
তখন তিষা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকল, “মিশকা! মি-শ-কা! তুমি কোথায়?”
হাজার হাজার এনিম্যানের ভয়ঙ্কর হাসিয় শব্দ আর মানুষগুলোর আর্তনাদের মাঝে তিষার গলা চাপা পড়ে গেল। তিষা আবার গলা ফাটিয়ে ডাকল, “মি-শ-কা! মি-শ-কা!”
এবারে হঠাৎ করে মিশকাকে দেখা গেল। স্কুল মাস্টারের মতো দেখতে মানুষটির উপর অসংখ্য এনিম্যান শিশুদের একটা ঢিবি। তার উপর মিশকা দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে তিষার ডাকের সাড়া দিল। তিষা সাইন ল্যাংগুয়েজে তাকে বলল, “এদেরকে মেরে ফেলো না।”
মিশকা মেরে ফেলা শব্দটির সাথে পরিচিত না। তাকে সাইন ল্যাংগুয়েজে অনেক কিছু শেখানো হয়েছে কিন্তু মেরে ফেলা শব্দটি কখনো শেখানো হয়নি। মিশকা হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে জিজ্ঞেস করল, “তার মানে কী?”
“এখন থামাও।”
“কেন? এরা খারাপ। এরা দুষ্ট। এদেরকে কষ্ট দিতে হবে।”
“কষ্ট দেওয়া হয়েছে। এখন থামাও।”
মিশকাকে এই প্রস্তাবে রাজী হতে দেখা গেল না, হাত নেড়ে বলল, “থামালে এরা আমাদের কষ্ট দিবে।”
“কষ্ট দিতে পারবে না। আমরা এদেরকে বেঁধে রাখব।”
“বেঁধে রাখবে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে?”
“তোমরা থাম, তখন আমি তোমাকে দেখাব।”
মিশকাকে আরো খানিকক্ষণ বোঝাতে হল তখন তারা থামতে রাজী। হল। তিষা আর জন তাদেরকে বোঝাল যে তারা ইচ্ছে করলে শক্ত করে মেঝেতে চেপে ধরে রাখতে পারে কিন্তু তাদেরকে আর কিছু করার প্রয়োজন। নেই।
মানুষগুলোকে বাঁধার জন্যে দড়ি পাওয়া সহজ হল না, তাই প্যান্টের বেল্ট, কম্পিউটারের পাওয়ার কর্ড, স্টুডিও লাইটের তার এরকম জিনিস দিয়ে তাদের একজন একজন করে বেধে রাখা হল। কয়েকজন মানুষের সার্ট খুলে সেটাকে পাকিয়ে দড়ির মতো করে সেগুলোও বাঁধার জন্যে ব্যবহার করা হল। এনিম্যান শিশুগুলো পুরো প্রক্রিয়াটা খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল তারপর সম্ভষ্টির মতো মাথা নাড়ল।
লিডিয়াকে ঠেলে সোজা করে বসিয়ে দেয়া হল। তার মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে, এখন পুরো মাথায় কোনো চুল নেই, তাকে দেখে চেনা যায়। না। মুখ ক্ষতবিক্ষত উপরের ঠোঁটটা দুইভাগ হয়ে রক্ত পড়ছে। শরীরের কাপড়ও ছিন্ন ভিন্ন, তিষা ভেবেছিল তার জ্ঞান নেই, কিন্তু দেখা গেল জ্ঞান আছে।
তিষা ফিস ফিস করে বলল, “আমার আয়ু তাহলে মাত্র দশ মিনিট ছিল না! মনে হয় ভালোই আছে। তোমার আয়ু নিয়েই মনে হচ্ছে সমস্যা।”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না। তিষা বলল, “আরেকটা জিনিস জেনে রাখো, আমার গরীব দেশটা কিন্তু খুব সুন্দর সেই দেশে কিন্তু তোমার মতো
একটাও অসুন্দর মানুষ নেই! তোমার দেশটাও খুব সুন্দর কেন জানো? কারণ এখানে জনের মতো ছেলেরা আছে!”
লিডিয়া এবারেও কোনো কথা বলল না। তিষা বলল, “একটু আগে। আমি তোমার মুখে থুতু দিয়েছিলাম, তুমি খুব রাগ করেছিলে। এখন যত ইচ্ছে তত থুতু দিতে পারব, কিন্তু আমি দেব না। কেন দেব না জান?”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না, তিষা বলল, “তার কারণ একজন মানুষের মুখে থুতু দিয়ে তার যেটুকু সম্মান নষ্ট করা যায় তোমার সেই সম্মানটুকুও আর নেই। তুমি এখন আর নর্দমার কীটও নও।”
লিডিয়া কোনো কথা না বলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
.
তিষা আর জন পুরো বিল্ডিংয়ের সবগুলো মানুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলার পর বাইরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে আবিষ্কার করল এই পুরো এলাকাটুকু বাইরের পুরো জগতের সাথে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। টেলিফোন কাজ করে না, নেটওয়ার্ক কাজ করে
, আশে পাশে কোনো জনমানব নেই। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় না পেয়ে তারা শেষ পর্যন্ত একটা বিল্ডিংয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের শিখাটা এনিম্যান শিশুরা খুবই উপভোগ করল বলে মনে হল।
আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথমে ফায়ার ব্রিগেড তারপর পুলিশের গাড়ি এসে এলাকাটা ঘিরে ফেলল। পুলিশের একটা দল ভিতরে ঢুকে তিষা আর জনকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলল, “ তোমরা কারা? এখানে কী হচ্ছে?”
তিষা বলল, “সেটি বোঝাতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু তার আগে আমি কী আমার মায়ের সাথে একটু কথা বলতে পারি? মা’কে শুধু জানাব আমি ভালো আছি?”
.
ঘণ্টাখানেক পর পুরো এলাকার দৃশ্যটি পাল্টে গেল। শত শত পুলিশের গাড়ি, অসংখ্য এম্বুলেন্স, টেলিভিশনের গাড়ি, সাংবাদিক, আকাশে হেলিকপ্টার। এনিম্যান শিশুদের দায়িত্ব নেবার জন্য ডাক্তার নার্স। সামাজিক কর্মী তাদের কীভাবে শান্ত রাখা যায় জিজ্ঞেস করার পর তিষা বলেছে আইসক্রিম খেতে দিতে, সে জন্যে বেশ কয়েকটা আইসক্রীমের ।ট্রেইলার ট্রাক। দেখা গেছে তিষার কথা সত্যি। এনিম্যান শিশুগুলো আইসক্রিম পেয়ে মহাখুশী।
অনেক রাতে যখন পুরো এলাকাটা নিয়ন্ত্রণের মাঝে এসেছে তখন একটা সিঁড়িতে নক্ষত্রের আলোতে জন আর তিষা বসে আছে। তিষা তখন জনকে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “ঠিক যখন আমাদের ড্রাগ ওভারভেজ করতে যাচ্ছিল তখন আমি তোমাকে কী বলেছিলাম, তুমি খেয়াল করেছিলে?”
জন মাথা নাড়ল। তিষা বলল, “আমি বলেছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওটা কিন্তু খুবই মানবিক একটা ভালোবাসা। ওর মাঝে কিন্তু কোনো রোমান্স ছিল না।
জন হাসল, বলল, “হ্যাঁ। আমি বুঝতে পেরেছিলাম।“ তারপর দুজনই হি হি করে হাসতে লাগল।
তাদের গায়ে হেলান দিয়ে মিশকা বসেছিল, সেও তাদের হাসিতে যোগ দিল সে কী বুঝেছে কে জানে!
.
শেষ কথা
লিডিয়াকে জীবন্ত এরেস্ট করা যায়নি। কীভাবে কীভাবে জানি সে তার হাতের বাঁধন খুলে তার ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা রিভলবার বের করে নিজের মাথায় গুলি করেছে। ক্র্যাগনন সুপার কম্পিউটারের ভবিষ্যত্বাণী সঠিক ছিল, যে মানুষটি লিডিয়ার মাথায় গুলি করেছে তার পরিচয়টি জানা ছিল না, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মানুষটি সে নিজে।
এনিম্যান তৈরী বন্ধ হয়ে গেল। যে এনিম্যান শিশুগুলি পাওয়া গিয়েছিল তাদেরকে বিভিন্ন পরিবারের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া হয়েছিল। সবাই তাদেরকে আদর যত্ন করে রেখেছে। এরা আসলে মানব শিশু, তাই চেষ্টা করা হয়েছে মানব শিশু হিসেবে বড় করার।
এনিম্যান নিয়ে যেরকম আলোড়ন হওয়ার কথা ছিল সেরকম আলোড়ন হল না, পুরো বিষয়টি কেমন যেন চাপা দিয়ে দেওয়া হল। কারা এটি করেছে কীভাবে করেছে পুরো বিষয়টিই সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত থেকে গেল। সঠিকভাবে জানাজানি হলে এশিয়া আফ্রিকার অসংখ্য দরিদ্র মহিলাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হতো, সম্ভব সে জন্যেই বিষয়টা নিয়ে কোনো হই চই হল না। উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী হই চই হতে দেয়নি। সরকারের উচ্চ মহলে তার অনেক বন্ধু।
মিশকা এর পর আট বছর বেঁচেছিল। এই আট বছরে মিশকা একটু একটু লিখতে পড়তে শিখেছিল। আম্মুর রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে সে খুব পছন্দ করত। তিষার হেভি মেটাল একেবারে সহ্য করতে পারত না।
মিশকা মৃত্যুর ঠিক আগে আগে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একরাতে তিষা মিশকাকে কোলে নিয়ে বাসার ছাদে বসে আছে। মিশকা দুর্বল হাতে সাইন ল্যাংগুয়েজে তিষাকে জিজ্ঞেস করল, “কেউ যখন মারা যায় তখন কী হয়?”
তিষা বলল, “তখন সে আকাশের তারা হয়ে যায়।
“আমি যখন মারা যাব আমিও কি আকাশের একটা তারা হব?”
“হ্যাঁ সোনা। তুমিও নিশ্চয়ই একটা তারা হবে।”
“আমি কোথায় তারা হব তিষা?”
“সেটা তুমি ঠিক কর।”
মিশকা খুব মনোযোগ দিয়ে আকাশের নক্ষত্রগুলো পরীক্ষা করে কালপুরুষকে দেখিয়ে বলল, “আমি ওখানে একটা তারা হতে চাই।”
“ঠিক আছে মিশকা।”
এর দুদিন পর তিষা ঘুম থেকে উঠে দেখে মিশকা তার ছোট বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে তার শরীর শীতল, জীবনের স্পন্দন নেই।
রাত্রি বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন বাসায় ছাদে উঠে তিষা কালপুরুষের কাছে তাকিয়ে থাকল। অনেক তারা জ্বল জ্বল করছে, তার মাঝে একটা নিশ্চয়ই মিশকা। তিষা ফিস ফিস করে বলল, “ভালো থেকো মিশকা।”