- বইয়ের নামঃ কপোট্রনিক সুখদুঃখ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. কপোট্রনিক ভালবাসা
আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি রিসার্চ সেন্টারের করিডোরে আমাকে গুলি করেছিল। স্পষ্টতই সে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু যে-কারণেই হোক, আমি মরি নিী এবং কে আমাকে গুলি করেছিল সেটা এখন পর্যন্ত বাইরের কেউই জানে না। আমার বাম ফুসফুসেটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল এবং এজন্যে আমাকে পুরো তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এই সুদীর্ঘ তিন মাস আমি যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছি, আমার গবেষণার সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি মানুষের ইচ্ছা, আকাঙক্ষা, বেঁচে থাকার প্রেরণা, আনন্দল ও যন্ত্রণার যৌক্তিকতা নিয়ে ভেবেছি। হাসপাতালের নিঃসঙ্গ পরিবেশ বা আমার অসুস্থ অবস্থার জন্যই হোক, আমি পরিপূর্ণভাৰে হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি আঁত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করছিলাম। ঠিক এই সময়ে আমাের সেই বন্ধুটি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে ভীষণ শীর্ণ হয়ে পড়েছিল, তার চোখের কোণে কালি, মুখে অপরাধবোধের ছাপ।
তুমি পুলিশকে আমার নাম বলতে পারতে—সে ঠিক এই কথাটি দিয়ে শুরু করেছিল—বল নি দেখে। ধন্যবাদ। তবে যদি ভেবে থাক এটা তোমার মহত্ত্ব এবং মহত্ত্ব দিয়ে তুমি আমার উপর প্রভুত্ব করবে, তা হলে খুব ভুল করছি।
আমি তার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, তুমি কী জন্যে আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে সেটা না জানলে হয়তো তোমাকে আমি ঘৃণা করতাম না। কিন্তু এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি।
সে আমার এই কথাটায় বিচলিত হয়ে পড়েছিল। আমার কাছ থেকে বিদায় নেবার পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, হয় সে, নাহয় আমি বেঁচে থাকব। একজন অন্যজনকে ঘৃণা করতে করতে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে পারে না। পরের দিনই আমি খবর পেয়েছিলাম আমার বন্ধুটি গুলি করে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছে। আমি জানতাম তার অনুভূতি চড়া সুরে বাঁধা, কিন্তু এতটা ধারণা করি নি।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকের চাকরিটি ছেড়ে দিলাম। আমার বয়স তখন মাত্র চরিশ বছর, আর সে-বছর থেকেই পায়োনের সাব-স্ট্রাকচারের মডেলটি আমার নামে পরিচিত হতে লাগল। এই মডেলটি আমার চিন্তাপ্রসূত এবং আমার মৃত বন্ধুটির এটির প্রতি মোহ জন্মেছিল।
সবরকম আকর্ষণ থেকে ছাড়া পাওয়া আমার পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হয়েছিল। এর জন্য আমাকে যথেষ্ট নির্মম ও বিরূপ সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই বাইরের জগতের জন্য আকর্ষণ জাগাতে পারছিলাম না। আমি নিজের ভিতরে একটি আর ভাবনার জগৎ গড়ে তুলেছিলাম, আমার সেখানে ড়ুবে থাকতেই ভালো লাগছিল।
যে-মেয়েটি আমাকে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত, ক্ৰমে ক্রমে সেও আমার অসহ্য হয়ে উঠল। তাকে বিদায় করার পর আমার দৈনন্দিন কাজে নানারকম বিঘ্ন ঘটতে লাগল। আমার সারা দিনের রুটিন ছিল খুব সাদাসিধে। আমি অনেক বোলা পর্যন্ত ঘুমোতাম। ঘুম থেকে উঠে। সারা দিন ছবি আঁকতাম। রাত্ৰিবেলা আমি দর্শন ও মধ্যযুগীয় চিরায়ত সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতাম। আমি কারো সাথে দেখা করতাম না। সপ্তাহে এক দিন লেটার-বক্স থেকে চিঠিগুলি এনে ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। ফোনটার তার কেটে দিয়েছিলাম বহু আগেই। আমার এই সহজ জীবনযাত্রায় শুধু দুবেলার খাবার ও একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ঝামেলাটুকুও অসহনীয় হয়ে উঠল। এজন্যে একজন সাহায্যকারী রাখতেই হয়। আমি গৃহকৰ্মে পারদর্শী একটা রবোট কিনব কি না ভাবছিলাম। কিন্তু আমার ঘরে ভাবলেশহীন একটা যন্ত্ৰদানব ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভোরে আমার কফি তৈরি করে দিচ্ছে, কাপড় ইন্ত্রি করছে—এটা ভাবতেই আমার মন বিরূপ হয়ে উঠল। আমার ইচ্ছে করছিল একটা সংবেদনশীল রবোটের সাহচর্য পেতে। কিন্তু পৃথিবীতে অনুভূতিসম্পন্ন রবোট এখনো তৈরি হয় নি। আমি প্রায় হঠাৎ করে ঠিক করলাম, একটা অনুভূতিসম্পন্ন রবোট আমি নিজেই তৈরি করব–সম্পূৰ্ণ আমার মনোমতো করে।
এই সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করার পর আমার জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে গেল। আমার বেশিরভাগ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকত রবোটের নক্সা ও খুঁটিনাটি বিষয়ে। পরিশ্রম করতে শুরু করার পর একটা মেয়েকে কাজে সাহায্য করতে রাখার বিরক্তিটাও তত বেশি মনে হল না।
সাধারণ রবোট তৈরি এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। রবোটের মস্তিষ্ক-যেটাকে সাধারণভাবে কপোট্রন বলা হয়ে থাকে, সেটা যে-কোনো ফার্ম থেকেই অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু আমার রবোটটির জন্যে ঠিক কী ধরনের কপোট্রন প্রয়োজন বুঝতে পারছিলাম না। বি-এফ-২ ধরনের কপোট্রন গৃহস্থালি কাজের জন্যে ব্যবহার করা হয়। কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে যেসব রবোট ব্যবহার করা হয়, তাদের কপোট্রন এল. ২. বি.টাইপের। আমাদের বিদ্যালয়ের বিভাটনটির ভার দেয়া ছিল এল. এ, এফ, টাইপের কপোট্রনযুক্ত রবোটকে।
আমি যে রবোটটি তৈরি করতে যাচ্ছি, সেটাতে এগুলোর কোনোটিই খাটবে না, কারণ এ সবগুলিই বিভিন্ন যান্ত্রিক বিষয়ে অভিজ্ঞ। সংবেদনশীলতা বা যেটাকে আমরা অনুভূতি বলে থাকি, সেটা এগুলোর কোনোটিতেই নেই। সংগীতে অবশ্যি গাণিতিক রবোটের বি. কে. ২১ কিপেটিন ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু সেসব রবোট গাণিতিক বিশ্লেষণ করে সুর সৃষ্টি করলেও সুরকে অনুভব করতে পারে না। কারণ অনুভূতি বলে যে-মানবিক প্রক্রিয়াটি আছে, সেটা এখন পর্যন্ত মানুষের একচেটিয়া। আমি এমন একটি রবোট সৃষ্টি করতে চাইছি, যেটা গান শুনতে ভালবাসবে, কবিতা পড়বে, হাসবে, এমন কি দুঃখ পেলে কাঁদবে। আনন্দ, বেদনা, ঈৰ্ষা বা রাগ-এ সব কয়টি মানবিক অনুভূতি যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি করা যায় কি না। আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই।